উপ-সম্পাদকীয়- 'ধনির দায় গরিবের হক জাকাত' -কালের কন্ঠ- ১০ আগস্ট ২০১২

উপ-সম্পাদকীয়- 'ধনির দায় গরিবের হক জাকাত' -কালের কন্ঠ- ১০ আগস্ট ২০১২
ধনীর দায় গরিবের হক জাকাতকালের কন্ঠ, ১০ আগস্ট ২০১২

ধনীর দায় গরিবের হক জাকাত

মো. রহমত উল্লাহ্‌

আল্লাহ তায়ালা যাকে সম্পদ দিয়েছেন, তার ওপর জাকাত ফরজ করেছেন। যে ব্যক্তি মালদার হওয়া সত্ত্বেও জাকাত পরিশোধ করে না, পরকালে তাকে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে। হাদিস অনুযায়ী- যার কাছে রুপা বা স্বর্ণ আছে, অথচ সে জাকাত দেয়নি, কিয়ামতের দিন ওই রুপা বা স্বর্ণকে তামার পাতে পরিণত করে দোজখের আগুনে দগ্ধ করে বুকে-পিঠে, পাঁজরে-কপালে ছ্যাঁকা দেওয়া হবে। অন্য হাদিসে আছে- যে ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা ধনসম্পদ দিয়েছেন কিন্তু সে জাকাত দেয়নি, কিয়ামতের দিন ওই ধনসম্পদ বিষাক্ত সাপ হয়ে তাকে গলায় পেঁচিয়ে ধরবে এবং দুই গালে দংশন করবে। ইসলাম ধর্মের এই বিধানটি সমাজের দরিদ্র শ্রেণীকে ধনীর সম্পদের অংশীদার করেছে। ধনী ও দরিদ্রের আর্থিক ব্যবধান কমাতে সহায়তা করে এই জাকাত ব্যবস্থা। আমরা অনেকেই জাকাতের মাসয়ালা সঠিকভাবে জানি না কিংবা জানতে চাই না। জাকাত না দেওয়ার বা কম দেওয়ার জন্য ফাঁকফোকর খুঁজতে গেলেই বিষয়টি জটিল। নিয়ত সহিহ থাকলে বুঝতে এবং মানতে কোনো জটিলতা নেই। বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে, মাসয়ালা-মাসায়েলের ফাঁকফোকর খুঁজে-বেছে জাকাত পরিশোধ করতে গিয়ে বিন্দুমাত্র কম পরিশোধিত হলে অসীম পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। তাই সহজ-সরল হিসাবে কিছু বেশি অর্থ পরিশোধ করাই সর্বোত্তম। এতে শতভাগ জাকাত প্রদান নিশ্চিত হবে এবং অতিরিক্ত অর্থ প্রদানের জন্য আল্লাহ তায়ালা অতিরিক্ত নেকি দান করবেন। অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা মানুষের অন্তর বোঝেন।
ইসলাম ধর্মের অনুসারী ধনী ব্যক্তির জন্য শতকরা আড়াই টাকা হারে জাকাত প্রদানের বিধান করা হয়েছে। অর্থাৎ মালদারের প্রতি ১০০ টাকার মধ্যে আড়াই টাকা গরিবের। এটি ধনীর দায় এবং গরিবের হক। প্রশ্ন হচ্ছে, কী পরিমাণ ধনসম্পদের অধিকারী হলে জাকাত ফরজ হবে? যে ব্যক্তি সাড়ে ৫২ তোলা রুপা বা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণের কিংবা তৎমূল্যের টাকা বা ধনসম্পদের মালিক হয় এবং তার কাছে ওই পরিমাণ টাকা বা ধনসম্পদ পূর্ণ এক বছরকাল স্থায়ী থাকে, সেই ব্যক্তির ওপর জাকাত ফরজ হয়। এর চেয়ে কম হলে জাকাত ফরজ হয় না। তবে বেশি হলে অবশ্যই ফরজ হবে। জাকাতযোগ্য এই ধনসম্পদের পরিমাণকে নিসাব বলা হয় এবং যে ব্যক্তি (প্রাপ্তবয়স্ক-অপ্রাপ্ত বয়স্ক, নারী-পুরুষ) জাকাতযোগ্য ধনসম্পদের মালিক হয়, তাকে মালিকে নিসাব বা সাহেবে নিসাব বলা হয়। আমাদের সমাজের অনেকেই মনে করেন, যেহেতু আমার কাছে সাড়ে ৫২ তোলা রুপা বা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ নেই, সেহেতু (অন্য ধনসম্পদ যতই থাকুক) আমাকে জাকাত দিতে হবে না। আসলে এটা সঠিক নয়। এ ক্ষেত্রে রুপা বা স্বর্ণ থাকা বা না থাকা কোনো বিষয় নয়। রুপা বা স্বর্ণের পরিবর্তে জাকাতযোগ্য অন্য ধনসম্পদ থাকলেও জাকাত প্রদান ফরজ হবে। রুপা বা স্বর্ণ হচ্ছে নিসাবের পরিমাণ নির্ধারণের একটি মাধ্যম মাত্র। এক বিন্দু রুপা বা স্বর্ণ না থাকলেও ওই ব্যক্তির জন্য জাকাত প্রদান ফরজ হবে, যার মালিকানায় নিসাব পরিমাণ কিংবা তার চেয়ে বেশি পরিমাণ জাকাতযোগ্য সম্পদ জাকাতবর্ষ-এর শুরুতে ও শেষে থাকে। এ ক্ষেত্রে সঠিকভাবে মালিকে নিসাব এবং জাকাত প্রদেয় সময় চিহ্নিত করার জন্য তিনটি প্রধান বিষয় বিশেষভাবে বিবেচ্য। প্রথমত, নিসাবের পরিমাণ নির্ধারণের মাধ্যম হিসেবে রুপার মূল্য ধরা হবে, নাকি স্বর্ণের মূল্য ধরা হবে? দ্বিতীয়ত, নিসাবের পরিমাণ হিসাব করার সময় কোন কোন সম্পত্তি যোগ-বিয়োগ করতে হবে? তৃতীয়ত, কিভাবে জাকাতবর্ষ গণনা করা হবে?
১. নিসাবের পরিমাণ নির্ধারণের মাধ্যম হিসেবে রুপার মূল্য ধরাই অধিক যুক্তিযুক্ত। কারণ সাড়ে ৫২ তোলা রুপার বর্তমান মূল্য সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণের চেয়ে অনেক বেশি। তাই মাধ্যম হিসেবে রুপার মূল্য ধরা হলে জাকাত প্রদানকারীর সংখ্যা ও জাকাতের পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি পায় এবং গরিব মানুষ অধিক লাভবান হয়। ফলে আল্লাহ পাক যে উদ্দেশ্যে জাকাত ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছেন, তা অধিক কার্যকর হয়। আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের ওপর অধিক খুশি হন। লক্ষণীয়, এই হাদিসে বারবারই আগে রুপা শব্দটি এবং পরে স্বর্ণ শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে। তথাপি কেউ যদি সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণের মূল্যকেই নিসাবের পরিমাপ নির্ধারণের মানদণ্ড ধরে জাকাত দেওয়া বা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে জোর আপত্তির সুযোগ নেই। যেকোনো একটিকে মানদণ্ড ধরে জাকাত প্রদান করা যাবে।
২. নিসাব পরিমাণ সম্পত্তি (জাকাতযোগ্য সম্পত্তি) হিসাব করার সময় যা কিছুর মূল্য যোগ এবং বিয়োগ হবে, তা হচ্ছে-
(ক) যোগ করতে হবে : নিজের মালিকানায় থাকা সব নগদ টাকা-পয়সা, লগি্নকৃত/বিনিয়োগকৃত টাকা-পয়সা এবং এর ওপর প্রাপ্ত লাভ, রুপা ও স্বর্ণের (ব্যবহৃত/অব্যবহৃত) বাজারমূল্য, ব্যবসায়িক পণ্য (অর্থাৎ বিক্রি করে লাভ করার নিয়তে ক্রয়কৃত সব ধরনের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি), ভাড়ায় খাটানো স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত ভাড়ার টাকা, আদায় হওয়ার সম্ভাবনা আছে এমন পাওনাদি ইত্যাদি।
(খ) যোগ করতে হবে না : নিজেদের ব্যবহৃত বা ব্যবহারের নিয়তে ক্রয়কৃত সব ধরনের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি (রুপা ও সোনা ব্যতীত), ভাড়ায় খাটানো সব ধরনের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি, বাবা-মা ও স্বামী-সন্তানের মালিকানায় থাকা সম্পত্তি (কারণ প্রত্যেকের হিসাব পৃথক হবে), আদায় হওয়ার সম্ভাবনা নেই এমন পাওনাদি ইত্যাদি।
(গ) বিয়োগ করতে হবে : সব ধরনের দায়দেনা।
৩. জাকাতবর্ষ হিসাব করার সময় বছরের শুরু এবং শেষ দেখতে হবে। ধরা যাক, কাদির মোল্লার মালিকানায় জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন নিসাব পরিমাণ ধনসম্পদ ছিল এবং তিনি ওই ধনসম্পদের জাকাত দিয়েছিলেন। তারপর যেকোনো কারণেই হোক, কয়েক মাস তার ধনসম্পদ নিসাব পরিমাণের চেয়ে অনেক কমে গিয়েছিল। কিন্তু আল্লাহর রহমতে ডিসেম্বর মাসের শেষ দিনে আবার নিসাব পরিমাণ ধনসম্পদ তাঁর মালিকানায় এসেছে। এমতাবস্থায় ওই মালের ওপর শতকরা আড়াই টাকা হারে জাকাত পরিশোধ করতে হবে। ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর- এই ১২ মাসই হবে তাঁর জাকাতবর্ষ। জাকাত শুধু গরিব ব্যক্তির হক। আল্লাহ তায়ালা আমাদের তাওফিক দিন, আমরা যেন যথাযথভাবে জাকাত পরিশোধ করতে পারি, আমাদের নিয়ত যেন সহিহ্ থাকে, হৃদয় যেন গরিবদের পক্ষে থাকে।
মো. রহমত উল্লাহ
লেখক: অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ

জাকাত: ধনির দায়, গরিবের হক

জাকাত: ধনির দায়, গরিবের হক
জাকাত: ধনীর দায়, গরিবের হক
মো. রহমত উল্লাহ
আল্লাহ তায়ালা যাকে সম্পদ দিয়েছেন, তার ওপর জাকাত ফরজ করেছেন। যে ব্যক্তি মালদার হওয়া সত্ত্বেও জাকাত পরিশোধ করে না, পরকালে তাকে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে। হাদিস অনুযায়ী- যার কাছে রুপা বা স্বর্ণ আছে, অথচ সে জাকাত দেয়নি, কিয়ামতের দিন ওই রুপা বা স্বর্ণকে তামার পাতে পরিণত করে দোজখের আগুনে দগ্ধ করে বুকে-পিঠে, পাঁজরে-কপালে ছ্যাঁকা দেওয়া হবে। অন্য হাদিসে আছে- যে ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা ধনসম্পদ দিয়েছেন কিন্তু সে জাকাত দেয়নি, কিয়ামতের দিন ওই ধনসম্পদ বিষাক্ত সাপ হয়ে তাকে গলায় পেঁচিয়ে ধরবে এবং দুই গালে দংশন করবে।

ইসলাম ধর্মের এই বিধানটি সমাজের দরিদ্র শ্রেণীকে ধনীর সম্পদের অংশীদার করেছে। ধনী ও দরিদ্রের আর্থিক ব্যবধান কমাতে সহায়তা করে এই জাকাত ব্যবস্থা। আমরা অনেকেই জাকাতের মাসয়ালা সঠিকভাবে জানি না কিংবা জানতে চাই না। জাকাত না দেওয়ার বা কম দেওয়ার জন্য ফাঁকফোকর খুঁজতে গেলেই বিষয়টি জটিল। নিয়ত সহিহ থাকলে বুঝতে এবং মানতে কোনো জটিলতা নেই। বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে, মাসয়ালা-মাসায়েলের ফাঁকফোকর খুঁজে-বেছে জাকাত পরিশোধ করতে গিয়ে বিন্দুমাত্র কম পরিশোধিত হলে অসীম পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। তাই সহজ-সরল ভাবে হিসাব করে (নিজের প্রদেয় জাকাতের পরিমান সঠিক ভাবে হিসাব করা ওয়াজিব) কিছু বেশি অর্থ পরিশোধ করাই সর্বোত্তম। এতে শতভাগ জাকাত প্রদান নিশ্চিত হবে এবং অতিরিক্ত অর্থ প্রদানের জন্য আল্লাহ তায়ালা অতিরিক্ত নেকি দান করবেন। অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা মানুষের অন্তর বোঝেন।
ইসলাম ধর্মের অনুসারী ধনী ব্যক্তির জন্য শতকরা আড়াই টাকা হারে জাকাত প্রদানের বিধান করা হয়েছে। অর্থাৎ মালদারের প্রতি ১০০ টাকার মধ্যে আড়াই টাকা গরিবের। এটি ধনীর দায় এবং গরিবের হক।

প্রশ্ন হচ্ছে, কী পরিমাণ ধনসম্পদের অধিকারী হলে জাকাত ফরজ হবে? যে ব্যক্তি সাড়ে ৫২ তোলা রুপা বা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণের কিংবা তৎমূল্যের টাকা বা ধনসম্পদের মালিক হয় এবং তার কাছে ওই পরিমাণ টাকা বা ধনসম্পদ পূর্ণ এক বছরকাল স্থায়ী থাকে, সেই ব্যক্তির ওপর জাকাত ফরজ হয়। এর চেয়ে কম হলে জাকাত ফরজ হয় না। তবে বেশি হলে অবশ্যই ফরজ হবে। জাকাতযোগ্য এই ধনসম্পদের পরিমাণকে নিসাব বলা হয় এবং যে ব্যক্তি (প্রাপ্তবয়স্ক-অপ্রাপ্ত বয়স্ক, নারী-পুরুষ) জাকাতযোগ্য ধনসম্পদের মালিক হয়, তাকে মালিকে নিসাব বা সাহেবে নিসাব বলা হয়।

আমাদের সমাজের অনেকেই মনে করেন, যেহেতু আমার কাছে সাড়ে ৫২ তোলা রুপা বা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ নেই, সেহেতু (অন্য ধনসম্পদ যতই থাকুক) আমাকে জাকাত দিতে হবে না। আসলে এটা সঠিক নয়। এ ক্ষেত্রে রুপা বা স্বর্ণ থাকা বা না থাকা কোনো বিষয় নয়। রুপা বা স্বর্ণের পরিবর্তে জাকাতযোগ্য অন্য ধনসম্পদ থাকলেও জাকাত প্রদান ফরজ হবে। রুপা বা স্বর্ণ হচ্ছে নিসাবের পরিমাণ নির্ধারণের একটি মাধ্যম/একক মাত্র। এক বিন্দু রুপা বা স্বর্ণ না থাকলেও ওই ব্যক্তির জন্য জাকাত প্রদান ফরজ হবে, যার মালিকানায় নিসাব পরিমাণ কিংবা তার চেয়ে বেশি পরিমাণ জাকাতযোগ্য সম্পদ জাকাতবর্ষ-এর শুরু থেকে শেষে পর্যন্ত থাকে। এ ক্ষেত্রে সঠিকভাবে মালিকে নিসাব এবং জাকাত প্রদেয় সময় চিহ্নিত করার জন্য তিনটি প্রধান বিষয় বিশেষভাবে বিবেচ্য।

প্রথমত, নিসাবের পরিমাণ নির্ধারণের মাধ্যম হিসেবে রুপার মূল্য ধরা হবে, নাকি স্বর্ণের মূল্য ধরা হবে?

দ্বিতীয়ত, নিসাবের পরিমাণ হিসাব করার সময় কোন কোন সম্পত্তি যোগ-বিয়োগ করতে হবে?

তৃতীয়ত, কিভাবে জাকাতবর্ষ গণনা করা হবে?
১. নিসাবের পরিমাণ নির্ধারণের মাধ্যম হিসেবে রুপার মূল্য ধরাই অধিক যুক্তিযুক্ত। কারণ সাড়ে ৫২ তোলা রুপার বর্তমান মূল্য সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণের চেয়ে অনেক কম। তাই মাধ্যম হিসেবে রুপার মূল্য ধরা হলে জাকাত প্রদানকারীর সংখ্যা ও জাকাতের পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি পায় এবং গরিব মানুষ অধিক লাভবান হয়। ফলে আল্লাহ পাক যে উদ্দেশ্যে জাকাত ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছেন, তা অধিক কার্যকর হয়। আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের ওপর অধিক খুশি হন। লক্ষণীয়, এই হাদিসে বারবারই আগে রুপা শব্দটি এবং পরে স্বর্ণ শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে। তথাপি কেউ যদি সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণের মূল্যকেই নিসাবের পরিমাপ নির্ধারণের মানদণ্ড ধরে জাকাত দেওয়া বা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে জোর আপত্তির সুযোগ নেই। যেকোনো একটিকে মানদণ্ড ধরে নিসাব পরিমান নির্ধারণ করা যাবে।
২. নিসাব পরিমাণ সম্পত্তি (জাকাতযোগ্য সম্পত্তি) হিসাব করার সময় যা কিছুর মূল্য যোগ এবং বিয়োগ হবে, তা হচ্ছে-
(ক) যোগ করতে হবে : নিজের মালিকানায় থাকা সব নগদ টাকা-পয়সা, লগ্নিকৃত/বিনিয়োগকৃত টাকা-পয়সা এবং এর ওপর প্রাপ্ত লাভ, রুপা ও স্বর্ণের (ব্যবহৃত/অব্যবহৃত) বাজারমূল্য, ব্যবসায়িক পণ্য (অর্থাৎ বিক্রি করে লাভ করার নিয়তে ক্রয়কৃত সব ধরনের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি), ভাড়ায় খাটানো স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত ভাড়ার টাকা, আদায় হওয়ার সম্ভাবনা আছে এমন পাওনাদি ইত্যাদি।
(খ) যোগ করতে হবে না : নিজেদের ব্যবহৃত বা ব্যবহারের নিয়তে ক্রয়কৃত সব ধরনের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি (রুপা ও সোনা ব্যতীত), ভাড়ায় খাটানো সব ধরনের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি, বাবা-মা ও স্বামী-সন্তানের মালিকানায় থাকা সম্পত্তি (কারণ প্রত্যেকের হিসাব পৃথক হবে), আদায় হওয়ার সম্ভাবনা নেই এমন পাওনাদি ইত্যাদি।
(গ) বিয়োগ করতে হবে : সব ধরনের দায়দেনা।
৩. জাকাতবর্ষ হিসাব করার দুইটি ক্ষেত্র আছে:

(ক) প্রথম জাকাত দাতার জাকাত বর্ষ গণনা: যিনি আগের বছরগুলোতে ধারাবাহিক ভাবে জাকাত যোগ্য সম্পদের মালিক ছিলেন না বিধায় জাকাত আদায় করেননি তাঁর ক্ষেত্রে জাকাত বর্ষের গণনাটি হবে নিম্নরূপ-

ধরা যাক, জনাব কাদির মোল্লা ০১ জানুয়ারি তারিখে প্রথম নিসাব পরিমাণ ধনসম্পদের মালিক হলেন। এই ০১ জানুয়ারি তারিখ থেকেই তার জাকাত বর্ষের শুরু হবার নিয়ম। কিন্তু যদি কয়েক দিন/মাস পরেই তার এই ধনসম্পদের মূল্য/পরিমান নিসাব স্তরের নিচে নেমে যায় তো তার জাকার বর্ষ ০১ জানুয়ারি তারিখ থেকে শুরু হবে না। বরং আবার যে মাসের যে তারিখে তিনি নিসাব পরিমান ধনসম্পদের মালিক হবেন সে মাসের সেই তারিখ থেকেই তাঁর জাকাত বর্ষ গণনা শুরু হবে যদি পরবর্তি ১২ মাস তার নিসার পরিমান ধনসম্পদের মালিকানা বজায় থাকে। যদি ১২ মাস পূর্ণ হবার আগেই আবারো তার ধনসম্পদের মূল্য/পরিমান নিসাব স্তরের নিচে নেমে যায় তো তার জাকাত বর্ষ গণনা আবারো বাতিল হবে। পরে আবার যে মাসের যে তারিখে তিনি নিসাব পরিমান ধনসম্পদের মালিক হবেন সে মাসের সে তারিখ থেকে তাঁর জাকাত বর্ষ গণনা শুরু হবে যদি তিনি টানা ১২ মাস নিসাব পরিমান বা এর অধিক পরিমান ধনসম্পদের মালিক থাকেন। এবং যেদিন এই ১২ মাস পূর্ণ হবে সেদিনই তিনি জাকাত দাতা হবেন। সেদিনের সম্পদের মূল্য/পরিমানের ভিত্তিতেই তাঁর জাকাতের পরিমান নির্ধারিত হবে।

তিনি ওই ধনসম্পদের জাকাত দিয়েছিলেন। এই নিসাব পরিমান বজায় থেকে তারপর যেকোনো কারণেই হোক, কয়েক মাস তার ধনসম্পদ নিসাব পরিমাণের চেয়ে কমে গিয়েছিল। কিন্তু আল্লাহর রহমতে ডিসেম্বর মাসের শেষ দিনে আবার নিসাব পরিমাণ ধনসম্পদ তাঁর মালিকানায় এসেছে। এমতাবস্থায় ওই মালের ওপর শতকরা আড়াই টাকা হারে জাকাত পরিশোধ করতে হবে। ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর- এই ১২ মাসই হবে তাঁর জাকাতবর্ষ। জাকাত শুধু গরিব ব্যক্তির হক। আল্লাহ তায়ালা আমাদের তাওফিক দিন, আমরা যেন যথাযথভাবে জাকাত পরিশোধ করতে পারি, আমাদের নিয়ত যেন সহিহ্ থাকে, হৃদয় যেন গরিবদের পক্ষে থাকে।

মো. রহমত উল্লাহ লেখক: অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ

প্রবন্ধ- শিক্ষাক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে হবে অব্যাহত অগ্রগতি- ইত্তেফাক- ০২ জানুয়ারি ২০১২


শিক্ষা ক্ষেত্র নিশ্চিত করতে হবে অব্যহত অগ্রগতি

প্রবন্ধ: শিক্ষার্থী ভর্তির নীতিমালায় আনতে হবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন -ইত্তেফাক- ২১ এপ্রিল ২০১২


শিশুতোষ গল্প- শোভনের স্বপ্ন -দৈনিক ইনকিলাব-১৮ জুলাই ২০০৮



শোভনের স্বপ্ন
মো. রহমত উল্লাহ্‌

কাগজ কুড়াতে কুড়াতে ক্লান্তি আসে শোভনের। কতক্ষণ হাঁটা যায় নুয়ে নুয়ে। সেই দুপুর থেকে কাগজ কুড়ানো শুরু। মাত্র অর্ধেক হয়েছে পিঠের বস্তা। আগের মত পাওয়া যায় না কাগজ। পলিথিনে বাজার করে সবাই। ছেঁড়া কাগজের দামও কম। কোত্থেকে যে আসে এত টোকাই! কুড়িয়ে নিয়ে যায় সব। কখন ভরবে এই বস্তা। না হলে জুটবে না রাতের খাবার। দ্রুত হাত- পা চালায় শোভন। পিপাসায় শুকিয়ে যায় বুক। কাঁপতে থাকে লিকলিকে হাঁটু। বাসি গোলাপের মতো হয়ে যায় গায়ের রং। কোসা নৌকার মত বেঁকে যায় শরীর। ঘুম লাগে ভাসাভাসা চোখে। শুয়ে পড়ে পার্কের পাকা বেঞ্চিতে। সামান্য ব্যথা পায় পিঠের হাড়ে। শুয়ে থাকে কষ্ট করে। ধীরে ধীরে সোজা হয় শিরদাঁড়া। কিছুটা আরাম লাগে পিঠে। টান পড়ে পেটে। যেন ছিঁড়ে যাবে চামড়া। বেড়ে যায় ক্ষুধার আগুন! হাত-পা ছেড়ে শুয়ে থাকে চোখ বন্ধ করে। ভাবে, এর চেয়ে ভালো ছিল গ্রামে। এতো কষ্ট ছিল না মতি কাকার বাড়িতে। ভাত দিত তিন বেলা। কাজ বলতে ছিল কয়েকটি গরু চরানো। সুযোগ পাওয়া যেত খেলার। গলা ছেড়ে গাওয়া যেত গান। আঁকাবাঁকা পথে চালানো যেত বেতের চাকা। জিরানো যেতো আমের ছায়ায়। কেন যে এই বস্তিতে চলে এলেন মা। আজো বুঝেনি শোভন। মনে আছে মায়ের সেই কথা- ‘চল বাবা, এখানে আর থাকা যাবে না। এর চেয়ে মরে যাওয়া ভালো।’
মুখে পানির ছিটা লাগে। ছন্দ পতন হয় শোভনের ভাবনায়। চোখ খুলে। দেখে একগাল হাসি। দাঁড়িয়ে আছে কনক। পালিয়ে যায় সব কষ্ট। চট্করে বসেপড়ে শোভন। কনকের হাত থেকে টেনে নেয় পানির জগ। গড়গড় গিলে দুই/ তিন স পানি। পাউরুটি বাড়িয়ে দেয় কনক। ‘নেও এক জনে দিছে।’ শোভনের ছোট বোন কনক। পানি বিক্রি করে পার্কে। অর্ধেক পাউরুটি ভাগ করে খায় ভাই-বোনে। ‘এই টুক্ কাগজ টোকাইছ মাত্র! মজা বুঝবানে রাতে!’ শোভনকে মায়ের বকুনির ভয় দেখায় কনক। চিপ দিয়ে উঠে শোভনের বুকের ভিতর! বলে- ‘কনক, কিছু কাগজ টোকাইয়া দে না আমার লগে।’ না, বলে ঘাড় বাঁকা করে কনক। ছুটতে থাকে ‘এই পানি, এই ঠান্ডা পানি ’ বলতে বলতে।

আবার কাগজ কুড়াতে শুরু করে শোভন। লজ্জা লাগে কাগজ টোকানি। এর চেয়ে ভালো হতো টেম্পুর ভাড়া কাটা। প্রতিদিনই পাওয়া যায় নগদ টাকা। চালকও হওয়া যায় এক সময়। কিন্তু পরিচিত লোক ছাড়া পাওয়া যায় না সে কাজ। দ্রুত কুড়াতে থাকে কাগজ। পেয়ে যায় বেশ ক’টি খালি বোতল। পুরা হয়ে যায় বস্তা। আনন্দে ভরে উঠে বুক ! ফিরে যায় বস্তির দিকে।
বিশাল আবাসিক এলাকা। স্কুলের সমনে পাকা রাস্তা। মাঠ নেই। রাস্তাটুকুই হাঁটা-চলা ও খেলাধুলার জায়গা। সাইকেল চালায় ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা। এখানে এলে শোভনের খুব ভাল লাগে। সময় পেলেই সে আসে এখানে। বসে থাকে একাএকা। বস্তিতে থাকে বলে অংশ নিতে পারে না খেলাধুলায়। অন্য দিনের চেয়ে বেশি ভালো লাগে আজ। অনেক সুন্দর মনে হয় সাইকেলগুলো! একেকটা একেক রকম! একটার চাকা পিচঢালা রাস্তার মত কালো। জিহ্বার মত লাল অন্যটির টায়ার। নারিকেল পাতার মত সবুজ কোনটার প্যাডেল। সিটের রং যেন কুটুমপাখির হলুদ। ক্রিং ক্রিং, টুং টাং শব্দ করে ছুটছে সাইকেল। প্রতিযোগিতায় নেমেছে তিনজন। অপলক তাকিয়ে আছে শোভন। দেখতে দেখতে মনে হয় সে নিজেও চালাচ্ছে একটি। নেমেছে প্রতিযোগিতায় । কার আগে যেতে পারে কে। প্যাডেল চালায় দ্রুত। শোভন নিজেকে কল্পনা করে সবার আগে। ক্রিং ক্রিং, ক্রিং ক্রিং। হঠাৎ মনে হয় সাইকেল চড়ে স্কুলে যাচ্ছে সে! পরনে আকাশি শার্ট ও নেভি ব্লু প্যান্ট। পিঠের উপর বই-খাতা ভর্তি ব্যাগ। টিফিন বক্রে ডিম, পরটা, মিষ্টি, কলা...। নিজেকে কল্পনা করে ক্লাসের ফার্স্ট বেঞ্চের ছাত্র। সবার আগে বলতে পারে পড়া। করতে পারে অংক। অনেক আদর করেন স্যারেরা। খেলায় ডেকে নেয় বন্ধুরা।

মসজিদের মাইক থেকে ভেসে আসে মাগরিবের আযান। সাইকেল নিয়ে সবাই চলে যায় নিজ নিজ বাসায়। বন্ধ হয়ে যায় বাসা-বাড়ির লোহার গেট। সে গেটের বাইরে ঠেকে থাকে শোভনের অপলক দৃষ্টি ! /



প্রবন্ধ- 'সহিহ হোক কোরবানি' -কালের কন্ঠ- ২৬ অক্টোবর ২০১২

প্রবন্ধ- 'সহিহ হোক কোরবানি' -কালের কন্ঠ- ২৬ অক্টোবর ২০১২
সহিহ হোক কোরবানিকালের কন্ঠ

ঢাকা, শুক্রবার ২৬ অক্টোবর ২০১২, ১১ কার্তিক ১৪১৯, ৯ জিলহজ ১৪৩৩

সহিহ হোক কোরবানি
মো. রহমত উল্লাহ্
নবুয়ত লাভের ১৩ বছরেরও অধিক সময় পর হজরত মুহাম্মদ (সা.) মদিনায় থাকাকালে আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে কোরবানির আদেশপ্রাপ্ত হন। এই আদেশপ্রাপ্তির পরই তিনি নিজে কোরবানি শুরু করেন। এরপর তিনি যে ১০ বছর বেঁচেছিলেন, সে ১০ বছরই এক বা একাধিক পশু কোরবানি দিয়েছেন। কোরবানি মুসলমানদের জন্য ফরজ ইবাদত নয়। বেশির ভাগ নির্ভরযোগ্য হাদিস অনুসারে কোরবানি সুন্নাতে মোয়াক্কাদা। ইবাদতের গুরুত্বের দিক বিবেচনায় অনেকেই এটিকে ওয়াজিব হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
ইসলাম ধর্মের বিধান অনুসারে যে মুসলমান বালেগ বা নাবালেগ, নারী-পুরুষ ন্যূনতম জাকাতযোগ্য বা নিসাব পরিমাণ (সাড়ে ৫২ তোলা রুপা অথবা সাড়ে সাত তোলা সোনার মূল্য পরিমাণ) অথবা এর চেয়ে বেশি মালের মালিক, সে-ই কোরবানি দেবে। যার সম্পত্তির মূল্য নিসাব পরিমাণের চেয়ে কম, ইচ্ছা করলে সে-ও কোরবানি দিতে পারবে এবং নেকিপ্রাপ্ত হবে। একটি ভেড়া, ছাগল, দুম্বা, হরিণ একটি কোরবানি হিসেবে গণ্য হবে। আবার একটি গরু, মহিষ, উট সাতটি কোরবানি হিসেবে গণ্য হবে। মনে রাখতে হবে, উলি্লখিত পশুর বাচ্চা কোরবানির যোগ্য পশু হিসেবে গণ্য হবে না। কেবল বাচ্চা বয়স অতিক্রমকারী সুস্থ, সবল, হালাল এবং গর্ভবতী নয়- এমন পশুই কোরবানির জন্য যোগ্য। (যে পশুর চোয়ালের নিচের পাটির সামনের দুটি প্রথম বা দুধের দাঁত নিজে নিজে পড়ে গিয়ে আবার নতুন দুটি বড় বড় দাঁত গজিয়েছে, সে পশুটি তার শিশুকাল অতিক্রম করেছে।) সাধ্য অনুসারে একজন ব্যক্তি নিজে এক বা একাধিক কোরবানি দিতে পারবে এবং তা দেওয়া উচিত। তবে নিজের নামে নয়; কোরবানি দিতে হবে নিজের পক্ষে আল্লাহর নামে। নিজের পক্ষে কোরবানি করা প্রথম শর্ত। সাধ্য বেশি থাকলে বালেগ বা নাবালেগ, জীবিত বা মৃত মা, বাবা, ভাই, বোন, পুত্র, কন্যা এবং মুহাম্মদ (সা.)-এর পক্ষেও কোরবানি করা যাবে। তবে নিজের পক্ষে কোরবানি না করে অন্য কারো পক্ষে কোরবানি করা যাবে না। কোরবানির পশু জবাই করার সময় কোনো ব্যক্তির নাম লেখা বা বলা বাধ্যতামূলক নয়। এতে করে অনেকেরই মনে হতে পারে, ওই ব্যক্তির নামে কোরবানি করা হয়েছে। যা মোটেও সঠিক নয়। কোরবানি মুসলিম মুমিন ব্যক্তির পক্ষে একমাত্র মহান আল্লাহ তায়ালার নামেই উৎসর্গীকৃত। যা অবশ্যই হতে হবে সৎ উপার্জনে এবং খালেস নিয়তে। কোরবানির নামে লোকদেখানোর জন্য বা কোনো দুনিয়াবি উদ্দেশ্যে বড় বড় পশু জবাই করে গোশত বিলানো বা খায়ানো আসলে কোরবানি নয়। কেননা এটির সুফল দুনিয়ায়ই পাওয়া যেতে পারে, আখেরাতে নয়। আমাদের সমাজে এমন অনেকেই আছে, যারা সঠিকভাবে জাকাত আদায় (ফরজ ইবাদত) করে না, অথচ কোরবানির ঈদ উপলক্ষে লাখ লাখ টাকার পশু প্রদর্শন ও জবাই করে।
মহান আল্লাহ তায়ালা কোরবানির পশুর গোশত খাওয়া মুসলমানদের জন্য হালাল করে দিয়েছেন। কেউ যদি নিজের কোরবানির পশুর সব গোশতই নিজে বা নিজেরা খেয়ে নেয়, তার কোরবানির নির্ধারিত সওয়াব কমবে না। কিন্তু গরিব-মিসকিনদের বিলিয়ে দিলে যে অতিরিক্ত সওয়াব পেত, তা থেকে বঞ্চিত হবে। কোরবানির পশুর গোশত গরিব-মিসকিনদের বিলিয়ে দেওয়া অত্যধিক সওয়াবের কাজ। কেননা ইসলাম ধর্মের বিধান অনুসারে কোরবানি দিতে সক্ষম ব্যক্তিদের ওপর অক্ষম ব্যক্তিদের একটা হক রয়েছে। এমনকি কোরবানির পশুর চামড়া, পশম, শিং, দাঁত- সবই কোরবানিদাতা সরাসরি নিজের প্রয়োজনে সদ্ব্যবহার করতে পারবেন। কিন্তু এসব প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিক্রি করে প্রাপ্ত টাকা-পয়সা কোনো অবস্থায়ই নিজে ভোগ করতে পারবে না। সে টাকা-পয়সা অবশ্যই গরিব-মিসকিনদের বিলিয়ে দিতে হবে। যদি কোরবানির পশুর গোশতসহ যেকোনো অংশের বদলে কোরবানিদাতা কোনো অর্থ আয় করেন বা কোনো ব্যয় থেকে আংশিক অথবা সম্পূর্ণ মুক্তিলাভ করেন, তো যতই সৎ উপার্জনে ও খালেস নিয়তে কোরবানি দিয়ে থাকুক, তার কোরবানি আর সঠিক থাকবে না।
দুনিয়াবি কোনো ফায়দা হাসিলের বিন্দুমাত্র উদ্দেশ্যে কোরবানি দেওয়া এবং কোরবানির পশুর কোনো অংশ বিলি-বণ্টন করা হলে তা আর কোরবানি হিসেবে গণ্য হবে না। কোরবানি হতে হবে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর মতো ত্যাগের অপার মহিমায় কেবল মহান আল্লাহ তায়ালাকে রাজি-খুশি করার প্রত্যাশায় এবং সেই সঙ্গে জবাই বা নিধন করতে হবে নিজের মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা অকল্যাণকর অদৃশ্য হিংস্র পশুর দল। তবেই পূর্ণতা পাবে কোরবানির মাহাত্ম্য। সত্যিকারের ঈদময় হবে কোরবানির ঈদ!
লেখক : অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ
মোহাম্মদপুর, ঢাকা।
md.rahamotullah52@gmail.com

কবিতা- 'সহজ' -নরসিংদীর কথা- ১১ নভেম্বর ২০০৩

কবিতা- 'সহজ' -নরসিংদীর কথা- ১১ নভেম্বর ২০০৩

সহজ


মো. রহমত উল্লাহ্‌ (রানা ইশতিয়াক)



নদীর বুকেতে সাগর


সাগরের বুকেতে নদী



বাতাসের ভিতরে প্রাণী


প্রাণীর ভিতরে বাতাস



কবির হৃদয়ে কবিতা


কবিতার হৃদয়ে কবি...



এমন যখন দু'জন


সহজ তখন সবই।



[১৯ মে ২০০৩, পলাশ, নরসিংদী]



সহজ

গল্প- অন্য জীবন -আজকের কাগজ-০১ জুন ২০০৩


প্রবন্ধ- 'সাত লাখ আসন ফাঁকা থাকার দায় কার?' -দৈনিক শিক্ষা- ২১ জুন ২০১৬


সাত লাখ আসন ফাঁকা থাকার দায় কার?

মো. রহমত উল্লাহ্‌ | দৈনিক শিক্ষা ডট কম। জুন ২১, ২০১৬ | মতামত
Rahamat Ullah
মো. রহমত উল্লাহ্‌
>দৈনিক শিক্ষায় একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়-`দেশে বিদ্যমান সাড়ে ৪ হাজার উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ ও মাদ্রাসার মধ্যে সাড়ে ৭শ’ প্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চ ২০টি করে ভর্তির আবেদন জমা পড়েছে। মোট প্রতিষ্ঠানের হিসাবে এটা সাড়ে ১৬ শতাংশ।
মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ১৪ লাখ ৫৫ হাজার ৩৬৫ শিক্ষার্থীর মধ্যে এবার ১৩ লাখ ১ হাজার ৯৯ জন কলেজ-মাদ্রাসায় ভর্তির আবেদন করে। সরকারি হিসাবে, এবার সরকারি-বেসরকারি কলেজগুলোতে একাদশে ভর্তিতে ২১ লাখ ১৪ হাজার ২৬৫টি আসন রয়েছে।
শিক্ষার্থী অনুসারে প্রায় ৭ লাখ আসন এবার ফাঁকা থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, `উল্লিখিত সাড়ে ৭শ প্রতিষ্ঠান যদি এমপিওভুক্ত হয়ে থাকে, তাহলে এসব প্রতিষ্ঠানের পেছনে বছরে গচ্চা যাবে অন্ততপক্ষে ১২৬ কোটি ৩২ লাখ টাকা। কেননা, এসব প্রতিষ্ঠানে সর্বনিম্ন ৫০ জন ছাত্র-ছাত্রী থাকার কথা। কিন্তু এখন শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা হবে বেশি। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক ড. আশফাকুস সালেহীন বলেন, সাধারণত একটি কলেজকে স্বীকৃতি বিশেষ করে এমপিও পেতে হলে ৫০ জন ছাত্র-ছাত্রী থাকতে হয়। যেহেতু নানা ‘ফ্যাক্টরের’ কারণে চাইলে এসব প্রতিষ্ঠানের পাঠদান বাতিল করতে পারি না। তাই আমরা সাধারণত চিহ্নিত এ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে ‘ওয়ার্নিং’ (সতর্কতা) দেই। এবারও সেই ব্যবস্থা নেয়া হবে।‘
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এত ফাঁকা আসন সৃষ্টি/বৃদ্ধি করা হলো কেন? এমতাবস্থায় সকল কলেজ কাম্য শিক্ষার্থী পাবে কীভাবে?
কলেজ পরিদর্শক একদিকে কিছু কলেজে অতিরিক্ত আসন বাড়াবেন আর অন্যদিকে কিছু কলেজে আরো শিক্ষার্থী বাড়াতে বলবেন তা কি যৌক্তিক? তদুপরি আরো নতুন নতুন সাধারন কলেজ, কারিগরি কলেজ, মাদ্রাসা অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে কেন? কেন পুরাতন এত প্রতিষ্ঠান রেখে তার পাশেই নতুন করে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে সরকারি কলেজ?
একটা উদাহরণ দিই, ঢাকার মোহাম্মদপুরে তো কলেজের কোন অভাব ছিল না, তা হলে “ঢাকা উদ্যান সরকারি কলেজ” নামে গত বছর কেন নতুন করে তৈরি করা হলো আরো একটি কলেজ? এবার কেন আবার সাতমসজিদ রোডের একটি কারিগরি প্রতিষ্ঠানকে করা হলো “মোহাম্মদপুর সরকারি কলেজ” নামে সাধারণ সরকারি কলেজ? এটি যদি করাই হবে তো এত এত টাকা ব্যয় করে গত বছর কেন তৈরি করা হলো “ঢাকা উদ্যান সরকারি কলেজ”?
এর আগেও ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কজেজের পেটের ভিতরে তৈরি করা হলো মোহাম্মদপুর মডেল কলেজ। যার ঠিক উলটা পাশেই অবস্থিত আল হেরা কলেজ। আশেপাশেই অবস্থিত আরো ৮/১০টি কলেজ, মাদ্রাসা এবং স্কুল এন্ড কলেজ। এরপরও কেন এই মোহাম্মদপুরেই অনুমতি দেওয়া হচ্ছে মাইল স্টোনের ক্যাম্পাস? একই এলাকায় এত কলেজ হলে কীভাবে পূর্ণ হবে সবার আসন? এত এত সরকারি কলেজ, মডেল কলেজ, মিশন কলেজ, স্কুল এন্ড কলেজ, বিশেষ কলেজ, প্রাইভেট কলেজ, কারিগরি কলেজ, মাদ্রাসা যে এলাকায় থাকবে সে এলাকায় এমপিও কলেজে সিট ফাঁকা থাকাটা কি খুবই অস্বাভাবিক? এই সিট ফাঁকা থাকার দায় কি কেবল এমপিও কলেজের? যারা একই এলাকায় এত কলেজ অনুমোদন দিল তাদের কি কোনই দায় নেই? কেন কলেজ শিক্ষকগণ ছুটবেন শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি? সরকারের পরিকল্পনা হীন কাজের জন্য পস্তাবে কেন শিক্ষকগণ?
এমনি ভাবে সারা দেশেই অপরিকল্পিত ভাবে সাধারণ কলেজ, কারিগরি কলেজ ও মাদ্রাসা অনুমোদন দিয়ে এবং এমপিও দিয়ে জামেলা পাকিয়ে রেখেছে কর্তৃপক্ষ। তাই এখন ফাঁকা থাকছে এত আসন। কম/শূন্য ছাত্রের কলেজগুলো যদি বাঁচিয়ে রাখার সদিচ্ছা থাকে, তো বড় কলেজগুলোর আসন এখনই কমিয়ে দেওয়া এবং ছোট কলেজগুলোর প্রতি আরো বেশি নজর দেওয়া উচিৎ কর্তৃপক্ষের।
লেখক: শিক্ষাবিদ এবং অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।

গল্প- 'মিতুর পণ' -দৈনিক জনকন্ঠ- ১৭ জুন ২০১৬

গল্প- 'মিতুর পণ' -দৈনিক জনকন্ঠ- ১৭ জুন ২০১৬
দৈনিক জনকন্ঠ> ১৭ জুন ২০১৬

মিতুর পণ
জাকিয়া মায়িশা
ভোরে ঘুম থেকে ওঠে মিতু। যায় বাবার রুমে। বাবা জাগেননি এখনও। মনে হয় রাত জেগে ছিলেন। বাবার রাতজাগা নিষেধ। মিতু জানে। মানা করতে মন চায়। তবু মানা করে না। রাত না জেগে লিখবেন কখন। সারাদিন অফিস আর কাজ। বাবার লেখা খুব ভাল লাগে মিতুর। মাথার কাছে বসে থাকে চুপচাপ। ডাক দেয় না। হাত বুলায় বাবার চুলে। জেগে ওঠেন বাবা। কী মিতু মনি? মিতু বলে, আজ আমাদের রেজাল্ট দেবে। বাবা বলেন, ও তাই নাকি? খুব ভাল খবর। কি হবে তুমি, প্রথম না দ্বিতীয়? মিতু বলে, অবশ্যই প্রথম। তোমার মেয়ে না আমি। দ্বিতীয় হব কেন? বাবা বলেন, ভেরি গুড। মনে সাহস থাকা চাই। মনের বলই সবচেয়ে বড় বল। ঠিক আছে, রেডি হও। আমিও যাব তোমার সঙ্গে।

স্কুলের ড্রেস পরে রেডি হয় মিতু। বাবার আগেই চলে আসে খাবার টেবিলে। সব কিছুতেই আগে থাকে সে। ডাকে মাকে, মা তাড়াতাড়ি নাস্তা দাও। মা রুটি আর ডিম নিয়ে আসেন। মিতু বলে, ডিম খাব না। আলু ভাজি দাও। শুরু হয় মায়ের বকুনি। মেয়েটা ডিম, দুধ, শাক-সবজি একদমই খেতে চায় না। সবজি না খেতে না খেতে চোখের অবস্থা কী বানিয়েছে! একটুখানি মেয়ে, এত্তবড় চশমা। আমরা যখন ছোট ছিলাম...। মায়ের এসব কথার কোন জবাব দেয় না মিতু। ডাকে বাবাকে। বাবা, তাড়াতাড়ি কর। সাতটা বাজে। খাবার টেবিলে আসেন বাবা। বলেন, আহা হয়েছে তো। এবার থামাও তোমার ছোটবেলার ইতিহাস। দেখ, ক্লাস সেভেনে উঠেই শাক-সবজি খাওয়া শুরু করবে মিতু। তাই না মামুনি? খেয়ে নাও, খেয়ে নাও। এখন যা আছে তাই খাও। না হয় দেরি হয়ে যাবে। চটপট নাস্তা সেরে বেরিয়ে পড়ে দু’জন। বড় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে মিতু আর বাবা। আজও দেরি করছে স্কুল বাস। এখান থেকেই প্রতিদিন স্কুল বাসে উঠতে হয় মিতুকে। সকালে তাকে তুলে দিয়ে অফিসে যান বাবা। অনেক কষ্টকর মিতুর যাওয়া আসা। বান্ধবীরা যায় নিজেদের গাড়িতে। তারা সঙ্গে নিতে চায় মিতুকে। তাদের সঙ্গে যায় না সে। তার চেয়ে স্কুল বাসই ভাল। কাছে এসে থামে স্কুল বাস। মিতুর সঙ্গে বাসে উঠতে যান বাবা। বাবাকে নিতে রাজি হয় না বাসের লোকেরা। মন খারাপ হয় মিতুর। নেমে আসে বাস থেকে। রিক্সায় চড়ে দু’জন। বাবা বলেন, কী হতো আমাকে নিলে? বাসে তো সিট খালিই ছিল। মিতু বলে, বাবা, আমি ডাক্তার হয়ে তোমাকে একটা গাড়ি কিনে দেব। মিতুকে জড়িয়ে ধরেন বাবা। বলেন হ্যাঁ, তুমি অবশ্যই পারবে। মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। জানো, কোন্ সে স্বপ্ন? যে স্বপ্ন মানুষ জেগে জেগে দেখে। যে স্বপ্ন সফল করার জন্য মানুষ পণ করে, শ্রম দেয়, মেধা দেয়, মন দেয়, জেগে থাকে। তুমি যদি তাই কর তবেই সফল হবে তোমার স্বপ্ন। মুখ খুলে কিছুই বলে না মিতু। পণ করে মনে মনে।

স্কুলের গেটে এসেই দৌড়ে ভেতরে চলে যায় সে। বাইরে অপেক্ষা করেন বাবা। রেজাল্ট নিয়ে বেরিয়ে আসে সবাই। মিতু আসে না। দারোয়ানকে বলে ভেতরে যান বাবা। দেখেন, করিডরে দাঁড়িয়ে আছে মিতু। চুপিচুপি গিয়ে মিতুর মাথায় হাত রাখেন বাবা। বাবাকে দেখেই কেঁদে ওঠে মিতু। বলে, বাবা আমি ফার্স্ট হতে পারিনি। সেকেন্ড হয়েছি। হরতালে স্কুল মিস হয়েছিল কয়েকদিন। তাই হাজিরায় কম পেয়েছি এক নম্বর। মিতুকে জড়িয়ে ধরেন বাবা। বলেন, তাতে কী হয়েছে? এটা তো ফার্স্ট টার্ম। সেকেন্ড টার্মে তুমি দুই নম্বর বেশি পেলেই তো ফাইনালে ফার্স্ট। মনে মনে পণ করে মিতু, ফাইনালে ফার্স্ট হবেই হবে তাকে।

৭ম শ্রেণী, ক্যাডেট নং-৬০১

ফেনী গার্লস ক্যাডেট কলেজ, ফেনী

- See more at: https://www.dailyjanakantha.com/details/article/198333/%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A7%81%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A6%A3#sthash.2EpmPgiR.dpuf

শিশুতোষ গল্প- 'শোভনের স্বপ্ন' -জল পড়ে পাতা নড়ে- জুন ২০১৬

শিশুতোষ গল্প- 'শোভনের স্বপ্ন' -জল পড়ে পাতা নড়ে- জুন ২০১৬
শোভনের স্বপ্নজল পড়ে পাতা নড়ে, ষষ্ঠ সংখ্যা, জুন ২০১৬
শোভনের স্বপ্ন
মো. রহমত উল্লাহ্‌
কাগজ কুড়াতে কুড়াতে ক্লান্তি আসে শোভনের। কতক্ষণ হাঁটা যায় নুয়ে নুয়ে। সেই দুপুর থেকে কাগজ কুড়ানো শুরু। মাত্র অর্ধেক হয়েছে পিঠের বস্তা। আগের মত পাওয়া যায় না কাগজ। পলিথিনে বাজার করে সবাই। ছেঁড়া কাগজের দামও কম। কোত্থেকে যে আসে এত টোকাই! কুড়িয়ে নিয়ে যায় সব। কখন ভরবে এই বস্তা। না হলে জুটবে না রাতের খাবার। দ্রুত হাত- পা চালায় শোভন। পিপাসায় শুকিয়ে যায় বুক। কাঁপতে থাকে লিকলিকে হাঁটু। বাসি গোলাপের মতো হয়ে যায় গায়ের রং। কোসা নৌকার মত বেঁকে যায় শরীর। ঘুম লাগে ভাসাভাসা চোখে। শুয়ে পড়ে পার্কের পাকা বেঞ্চিতে। সামান্য ব্যথা পায় পিঠের হাড়ে। শুয়ে থাকে কষ্ট করে। ধীরে ধীরে সোজা হয় শিরদাঁড়া। কিছুটা আরাম লাগে পিঠে। টান পড়ে পেটে। যেন ছিঁড়ে যাবে চামড়া। বেড়ে যায় ক্ষুধার আগুন! হাত-পা ছেড়ে শুয়ে থাকে চোখ বন্ধ করে। ভাবে, এর চেয়ে ভালো ছিল গ্রামে। এতো কষ্ট ছিল না মতি কাকার বাড়িতে। ভাত দিত তিন বেলা। কাজ বলতে ছিল কয়েকটি গরু চরানো। সুযোগ পাওয়া যেত খেলার। গলা ছেড়ে গাওয়া যেত গান। আঁকাবাঁকা পথে চালানো যেত বেতের চাকা। জিরানো যেতো আমের ছায়ায়। কেন যে এই বস্তিতে চলে এলেন মা। আজো বুঝেনি শোভন। মনে আছে মায়ের সেই কথা- ‘চল বাবা, এখানে আর থাকা যাবে না। এর চেয়ে মরে যাওয়া ভালো।’
মুখে পানির ছিটা লাগে। ছন্দ পতন হয় শোভনের ভাবনায়। চোখ খুলে। দেখে একগাল হাসি। দাঁড়িয়ে আছে কনক। পালিয়ে যায় সব কষ্ট। চট্করে বসেপড়ে শোভন। কনকের হাত থেকে টেনে নেয় পানির জগ। গড়গড় গিলে দুই/ তিন স পানি। পাউরুটি বাড়িয়ে দেয় কনক। ‘নেও এক জনে দিছে।’ শোভনের ছোট বোন কনক। পানি বিক্রি করে পার্কে। অর্ধেক পাউরুটি ভাগ করে খায় ভাই-বোনে। ‘এই টুক্ কাগজ টোকাইছ মাত্র! মজা বুঝবানে রাতে!’ শোভনকে মায়ের বকুনির ভয় দেখায় কনক। চিপ দিয়ে উঠে শোভনের বুকের ভিতর! বলে- ‘কনক, কিছু কাগজ টোকাইয়া দে না আমার লগে।’ না, বলে ঘাড় বাঁকা করে কনক। ছুটতে থাকে ‘এই পানি, এই ঠান্ডা পানি ’ বলতে বলতে।

আবার কাগজ কুড়াতে শুরু করে শোভন। লজ্জা লাগে কাগজ টোকানি। এর চেয়ে ভালো হতো টেম্পুর ভাড়া কাটা। প্রতিদিনই পাওয়া যায় নগদ টাকা। চালকও হওয়া যায় এক সময়। কিন্তু পরিচিত লোক ছাড়া পাওয়া যায় না সে কাজ। দ্রুত কুড়াতে থাকে কাগজ। পেয়ে যায় বেশ ক’টি খালি বোতল। পুরা হয়ে যায় বস্তা। আনন্দে ভরে উঠে বুক ! ফিরে যায় বস্তির দিকে।
বিশাল আবাসিক এলাকা। স্কুলের সমনে পাকা রাস্তা। মাঠ নেই। রাস্তাটুকুই হাঁটা-চলা ও খেলাধুলার জায়গা। সাইকেল চালায় ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা। এখানে এলে শোভনের খুব ভাল লাগে। সময় পেলেই সে আসে এখানে। বসে থাকে একাএকা। বস্তিতে থাকে বলে অংশ নিতে পারে না খেলাধুলায়। অন্য দিনের চেয়ে বেশি ভালো লাগে আজ। অনেক সুন্দর মনে হয় সাইকেলগুলো! একেকটা একেক রকম! একটার চাকা পিচঢালা রাস্তার মত কালো। জিহ্বার মত লাল অন্যটির টায়ার। নারিকেল পাতার মত সবুজ কোনটার প্যাডেল। সিটের রং যেন কুটুমপাখির হলুদ। ক্রিং ক্রিং, টুং টাং শব্দ করে ছুটছে সাইকেল। প্রতিযোগিতায় নেমেছে তিনজন। অপলক তাকিয়ে আছে শোভন। দেখতে দেখতে মনে হয় সে নিজেও চালাচ্ছে একটি। নেমেছে প্রতিযোগিতায় । কার আগে যেতে পারে কে। প্যাডেল চালায় দ্রুত। শোভন নিজেকে কল্পনা করে সবার আগে। ক্রিং ক্রিং, ক্রিং ক্রিং। হঠাৎ মনে হয় সাইকেল চড়ে স্কুলে যাচ্ছে সে! পরনে আকাশি শার্ট ও নেভি ব্লু প্যান্ট। পিঠের উপর বই-খাতা ভর্তি ব্যাগ। টিফিন বক্রে ডিম, পরটা, মিষ্টি, কলা...। নিজেকে কল্পনা করে ক্লাসের ফার্স্ট বেঞ্চের ছাত্র। সবার আগে বলতে পারে পড়া। করতে পারে অংক। অনেক আদর করেন স্যারেরা। খেলায় ডেকে নেয় বন্ধুরা।

মসজিদের মাইক থেকে ভেসে আসে মাগরিবের আযান। সাইকেল নিয়ে সবাই চলে যায় নিজ নিজ বাসায়। বন্ধ হয়ে যায় বাসা-বাড়ির লোহার গেট। সে গেটের বাইরে ঠেকে থাকে শোভনের অপলক দৃষ্টি !

শিশুপাঠ্য গল্প- 'মার্বেল' -যায়যায়দিন- ১৫ জুন ২০১৬

শিশুপাঠ্য গল্প- 'মার্বেল' -যায়যায়দিন- ১৫ জুন ২০১৬
IMG_20180425_152647_1যায়যায়দিন লিংক
যায়যায়দনি, ১৫ জুন ২০১৬, বুধবার

মার্বেল
মো. রহমত উল্লাহ্
মার্বেল খেলছে হানিফ, শিমুল, শাওন, পলাশ। বটতলায়। টনটনে মাটি। উঠানের মতো। ঘাস নেই। সমান জায়গা। তাদের মার্বেল খেলার মাঠ। মার্বেল যেমন ছোট। মাঠও তেমন ছোট।
প্রথমে একের দান। চারজনে জমা দেয় মার্বেল। একের দানে একটি করে। জমা হয় চারটি। মেলায় একের দান। খেলায় নামে হানিফ। হাতে নেয় পাঁচটি মার্বেল। একের দানের চারটি। নিজের আরো একটি। দাঁড়ায় নির্ধারিত দাগে। মাঠে ছড়ায় চারটি মার্বেল। হাতে রাখে একটি। এটিকেই ছুড়তে হবে। এটির নাম গুলি। লাগাতে হবে মাঠের একটিতে। যেটি দেখাবে প্রতিযোগীরা। লাগাতে হবে ঠিক সেটিতেই। সেটির নাম শিকার। সাদা মার্বেলটি দেখায় পলাশ। বলে, এটি শিকার। একমত হয় সবাই। নিশানা ঠিক করে হানিফ। না, ঠিক থাকে না। কেঁপে ওঠে হাত। ঠিক করে আবার। মারে। না, লাগে না। শেষ হয় না একের দান। বদল হয় খেলোয়াড়।
এবার শিমুলের পালা। হাতে নেয় মার্বেল। একের দানের চারটি। সঙ্গে নেয় নিজের একটি। এটি তার গুলি। দাঁড়ায় দাগে। ছড়ায় মার্বেল। চারটি মাঠে। আর গুলিটি হাতে। মাঠের লালটি দেখায় শাওন। বলে, এটি শিকার। এতে একমত হয় সবাই। গুলি ছুড়তে হবে এটিতে। নিশানা ঠিক করে শিমুল। ভয় ভয় লাগে তার। নড়ে যায় নিশানা। আবার ঠিক করে। টুক টুক করে বুক। হাত কাঁপে। বল পায় না মনে। ভাবে, পারবে না। হারবে হানিফের মতোই। কিছুটা সময় নেয়। দম নেয়। ছুড়ে মারে গুলি। আহ হা। লেগেছে অন্যটিতে। হেরে গেছে শিমুল। হারিয়েছে তার গুলিটি। সেটি এখন দানের মার্বেল। মন খারাপ হয় তার। শেষ হয় না একের দান। একটা বাড়ে দানের মার্বেল। আরো চলবে এ দানের খেলা। আবার বদল হয় খেলোয়াড়।
এবার পালা শাওনের। হাতে নেয় ছয়টি মার্বেল। একের দানের পাঁচটি। আর নিজের একটি। নিজেরটা তার গুলি। দাঁড়ায় দাগে। ছড়ায় দান। মাঠে পাঁচটি মার্বেল। নীল মার্বেলটি দেখায় শিমুল। বলে, এটি শিকার। এতে সায় দেয় সবাই। নিশানা ঠিক করে শাওন। ভয় পায় না। ছুড়ে মারে গুলি। টুস। লাগে ঠিক শিকারে। হাহ্ হা। জিতে যায় শাওন। দুই হাতে কুড়ায় মার্বেল। ঢোকায় নিজের পকেটে। শেষ হয় একের দান।
এবার খেলবে পলাশ। দুয়ের দান। মার্বেল দেয় দুটি করে। চারজনে দেয় আটটি। পলাশ হাতে নেয় নয়টি। আটটি দুইয়ের দানের। একটি তার গুলি। দাঁড়ায় দাগে। ছড়ায় দান। মাঠে আটটি মার্বেল। হলুদটি দেখায় হানিফ। বলে, এটি শিকার। তাতে একমত হয় সবাই। নিশানা ঠিক করে পলাশ। ভাবে না তেমন। ছুড়ে মারে গুলি। টুস। লাগে ঠিক ঠিক। হাহ্ হা। জিতে যায় পলাশ। কুড়িয়ে নেয় সাতটি মার্বেল। পকেটে রাখে আর হাসে। শেষ হয় দুয়ের দান।
শিমুল খেলবে আবার। এবার হবে তিনের দান। মার্বেল দেয় চারজনে। একেকজনে দেয় তিনটি করে। তেরোটি মার্বেল শিমুলের হাতে। বারোটি তিনের দানের। আর একটি তার গুলি। দাঁড়ায় দাগে। ছড়ায় দানের মার্বেল। মাঠে বারোটি। শিমুলের হাতে একটি। সবুজ মার্বেলটি দেখায় পলাশ। বলে, এটি শিকার। একমত হয় সবাই। হাত তাক করে শিমুল। ভাবে, জিততে হবে এবার। এটি তিনের দান। মার্বেল বেশি। আবার শুরু হবে একের দান। সেটিতে জিতে লাভ নেই। মার্বেল থাকে কম। খেলতে হবে সাহস করে। যেমন খেলে শাওন। যেমন জেতে পলাশ। ভয় পেলে চলবে না। শাওন পারে, আমিও পারব। পলাশ পারে, আমিও পারব। সাহসে ভরে ওঠে বুক। একটুও কাঁপে না হাত। ঠিক করে নিশানা। ছুড়ে মারে গুলি। টুস। লাগে ঠিক ঠিক। হাহ্ হা। হুর রে। জিতে যায় শিমুল।

গল্প- আতঙ্ক -আজকের কাগজ-১৯ মে ২০০৪


শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিচালনা কমিটির প্রয়োজন কী?

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিচালনা কমিটির প্রয়োজন কী?
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিচালনা কমিটির প্রয়োজন কী?

মো. রহমত উল্লাহ্‌ |দৈনিক শিক্ষা, জুন ১৪, ২০১৬ | মতামত
Rahamat Ullah
মো. রহমত উল্লাহ্‌
সম্প্রতি ঘোষিত আদালতের একটি রায়ে মনে হয় খুব খুশি হয়েছেন বেসরকারি শিক্ষকগণ। তাদের হাসি দেখে মনে পড়ছে, সেই প্রবাদের কথা- বোকার তিন হাসি: একটা দেখে/শুনে, আরেকটা বুঝে/নাবুঝে, অন্যটা এমনিতেই। এই প্রবাদের কথা বলছি এই কারণে যে, আদালতের রায়ে আসলে তাদের খুশি হবার মত কিছুই ঘটেনি।
এই রায়ের ফলে এমপিগণ সভাপতি হতে পারবেন না, এমনটি নয়। রায়ে যা বলা হয়েছে তার অর্থ হচ্ছে, এমপিগণ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি হতে হলে কমিটির সদস্যগণের ভোটে নির্বাচিত হতে হবে। তারা এখন আর চারটি মাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নয়, যত ইচ্ছা ততটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি হতে পারবেন।
কেননা, কমিটির সদস্যগণ তাদেরই লোক। তারা তাদের পেয়ারের নেতাকেই সভাপতি বানাবেন। অন্য কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগই দিবেন না। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতি হবেন এমপিগণ। তারা এখন হবেন এলাকার সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি। তাই যারা এমপিগণ বা এমপিগণের কর্মীগণ সভাপতি/সদস্য থাকছেন না মনে করে খুশি হয়েছেন, তাদের হাসি হচ্ছে বোকার হাসি।
প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটিতে এমপিগণের সভাপতিত্ব বিলোপ হচ্ছে এমন ধারণায় শিক্ষকগণ খুশি হবার কারণ কী? কারণ, কমিটি গুলোকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য আর কল্যাণকর মনে করেননা অনেকেই। তারা মনে করেন কমিটি হচ্ছে রাহু। কমিটি নামক এই রাহুর কবলে পড়ে আজ অধিকাংশ বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার প্রধান এবং শিক্ষকগণ অতিষ্ঠ। যা প্রকাশ করার সাহস ও সুযোগ থাকে না শিক্ষকদের। কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত কমিটির অশিক্ষিত, কুশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত লোকদের মন মতো কাজকর্ম না করলে, প্রতিদিনই প্রতিষ্ঠান প্রধান ও শিক্ষকদের চাকরি খান দুই তিন বেলা। সব কমিটির সব লোকই যে এমন মন্দ তা নয়। তবে ভালোর সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। এই কথাগুলো আমি আগেও বলেছি আমার একাধিক লেখায়।
এমন একসময় ছিল, যখন কমিটির লোকজন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করত, নিজেরা জমি দিত, টাকা দিত, শিক্ষকদের বেতন দিত, ঘর তৈরি করে দিত, শিক্ষাসামগ্রী দিত, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সহায়তা দিত। তারপর এমন একসময় গেছে, যখন কমিটির লোকেরা নিজেদের অযোগ্য সন্তানদের বা টাকা খেয়ে অন্যের অযোগ্য সন্তানদের অথবা দলীয় ক্যাডারদের শিক্ষক বানাতো। সেই অযোগ্যদের কারণেই আজ যোগ্য শিক্ষকের বড় অভাব এই দেশে। যা খোদ শিক্ষামন্ত্রীও স্বীকার করেছেন কিছুদিন আগে। কমিটির নিকট থেকে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা অতিসম্প্রতি কেড়ে নিয়ে রাষ্ট্রই স্বীকার করে নিয়েছে যে, কমিটি শিক্ষক নিয়োগে চরম অনিয়ম করত। আর এখন কমিটি অলিখিত অঘোষিতভাবে শুরু করেছে প্রতিষ্ঠান প্রধান নিয়োগের বা বদলের অনিয়ম। কমিটির লোকদের এখন আর কাজ কী?
বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের সরকার শতভাগ বেতন দেয়। সাধ্যমতো ভাতা দেয়। প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো তৈরি করে দেয়। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়। বিনামূল্যে বই দেয়। শিক্ষাসামগ্রী দেয়। আর শিক্ষার মান যাচাই করার জন্য, শিক্ষকদের কাজ তদারক করার জন্য প্রতি থানায়/উপজেলায় রয়েছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার, সহকারী অফিসার ও পরিদর্শক। সরকারের পক্ষে তারাইতো পারে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন দিক দেখবাল করতে। এ ছাড়াও প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কার্যবিবরণী অনলাইনের মাধ্যমে জমা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে।
ডায়নামিক ওয়েব এপ্লিকেশনের মাধ্যমে নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ও একাডেমিক কাজের সচ্ছতা। ভর্তি হচ্ছে অনলাইনে, ভর্তি ফি নির্ধারণ করছে সরকার, টিউশন ফি নির্ধারণ করছে সরকার। শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছে সরকার। তাহলে এখন আর কেন প্রয়োজন পরিচালনা কমিটি নামক এই রাহু? কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত নিজেদের মালিক আর শিক্ষকদের তাদের কেনা গোলাম ভেবে অহেতুক দাবড়ানো ছাড়া তাদের আর ভালো কাজ কী এখন? তারা অনেকেই মনে করেন প্রতিষ্ঠানের টাকা মানেই তাদের টাকা।
তারা প্রতিষ্ঠানের পুকুরের মাছ নেয়, খামারের ফসল নেয়, গাছের ফল নেয়, দোকানের ভাড়া নেয়, জমির দখল নেয়, গাছপালা নেয়, ফ্যান-লাইট নেয়, ইটা-বালি-সিমেন্ট নেয়, ঠিকাদারি নেয়, সাপ্লাই কাজ নেয়, ছাপা কাজ নেয়, টিফিন সাপ্লাই দেয়, শিক্ষকদের ডিউটির টাকার ভাগ নেয়, টিএ-ডিএ নেয়, মিটিং করার দিন সম্মানীর নামে টাকা নেয়, নিজেদের কাজে প্রতিষ্ঠানের গাড়ি নেয়, প্রতিষ্ঠানে আয়া-পিয়ন বাসায় নেয়, ফেল/বখাটে শিক্ষার্থীর পক্ষ নেয়, নিজের পছন্দের শিক্ষকদের ইংরেজি/অঙ্ক ক্লাস দেয়, ক্লাসে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সামনেই শিক্ষকের ভুল ধরার নামে বকাবকি করে, কথায় কথায় সোকেস (সোকজ বলতে জানেনা) দেয়, নিজেদের সন্তানদের বিনা টাকায় প্রতিষ্ঠানে এমনকি প্রাইভেটেও পড়াতে বাধ্য করে। আরো কত কী যে করে তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি/সদস্য হওয়া এখন আর সেবামূলক কাজ নয়; বিভিন্নমুখী লাভজক কাজ। তাই তা হওয়ার জন্য সবাই মরিয়া। এমপিরা-মন্ত্রীরা এই পদ/পদের ক্ষমতা ছাড়তে চান না। তারা নিজেরা বা তাদের কর্মী-সমর্থকদের দখলে রাখতে চান কমিটির সব পদ। আবার ডিসি-ইউএনওরাও হতে চান সকল প্রতিষ্ঠানের সভাপতি। তারা ২০/৩০ টি প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হতে পারলে প্রতি প্রতিষ্ঠানের প্রতি মিটিং এ সম্মানী বাবদ পেয়ে যান হাজার হাজার টাকা। তাদের দপ্তরে গিয়ে করতে হয় মিটিং। তাই খুশি রাখতে হয় তাদের অফিস ম্যানদের। সেখানেও ব্যয় হয় প্রতিষ্ঠানের। শিক্ষকগণ বেতন-ভাতা পাক বা না পাক এই সব সম্মানী পরিশোধ করতে হয় প্রতিষ্ঠানের তহবিল থেকে। সভাপতি নিজেই নির্ধারণ করেন তিনার সম্মানীর পরিমান। যে প্রতিষ্ঠান বেশি টাকা দিতে সক্ষম সে প্রতিষ্ঠানের কাজ হয় দ্রুত। ঝাড়ি খেতে থাকেন গরিব প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণ। এসব জেনেও যেন না জানার ভান করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
তাছাড়া প্রতিষ্ঠান থেকে যে সামান্য ভাতাদি পান শিক্ষকগণ, তা যেন কমিটির লোকদের দয়ার দান। শিক্ষামন্ত্রী নিজে শিক্ষকদের স্যার বলেন কিন্তু কমিটির লোকেরা শিক্ষকদের স্যার বলতে চান না; বরং তারা চান যে শিক্ষকরা ও প্রধানরা জনসম্মুখে তাদের স্যার স্যার করুক। হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকুক। তাদের কথায় কান ধরে উঠবস করুক এবং তাই হয় অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে। তারা ভুলে থাকেন যে শিক্ষকরা তাদের চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষিত। এমনকি যে শিক্ষার্থীর বাবা-মা কমিটির সদস্য হন সেই শিক্ষার্থীও খবরদারি করেন শিক্ষকগণের ওপর। শুধু তাই নয়, কমিটির সভাপতি/সদস্যের দলের, বয়সের, বাড়িঘরের সবাই খবরদারি করেন শিক্ষকদের ওপর এবং তা মানতে বাধ্যও হন শিক্ষকরা। না হলে চোখ মুখ বন্ধ করে মেনে নিতে হয় এই শ্যামল কান্তির মতো পরিণতি। আমি আবারো বলছি, সব কমিটির সব লোকই যে মন্দ তা নয়। তবে ভালোর সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য।
এহেন পরিস্থিতিতে প্রচলিত কমিটির মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার বিধান বাতিল করে শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের নির্বিঘ্নে শিক্ষকতা করার ও প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করার পরিবেশ নিশ্চিত করা এখন সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। সেইসাথে প্রয়োজন শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ।
লেখক: শিক্ষাবিদ এবং অধ্যক্ষ- কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।

প্রবন্ধ: আমাদের একটি জাতীয় শপথ থাকা জরুরি। কালের কন্ঠ- ১৫ মে ২০১২



কালের কন্ঠ- ১৫ মে ২০১২
আমাদের একটি জাতীয় শপথ থাকা জরুরি

মো. রহমত উল্লাহ্‌

আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারি ভাবে নির্ধারিত কোন শপথ আছে কিনা তা জানার চেষ্টা করতে গিয়ে গত ২০১১ সালে কথা বলেছি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষক গণের সাথে । ফোন করেছি বিভিন্ন দপ্তরে ও প্রতিষ্ঠানে। কেউই দিতে পারেননি নিশ্চিত তথ্য। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদশর্ক জানান- স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের জন্য বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত কোন শপথ আছে এমনটি তাঁর জানা নেই। ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিসার বলেন- আমার অফিসে এই মর্মে কোন সার্কুলার আদৌ আছে কি না আমি বলতে পারবো না।

এমতাবস্থায় দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন বক্তব্যে ও ভাষায়  শিক্ষার্থীদের শপথ বাক্য পাঠ অস্বাভাবিক নয়। হয়ত সে কারণেই বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ডায়রিতে বিভিন্ন রকম শপথ বাক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সাধু বা চলিত অথবা মিশ্র ভাষায় লিখিত বাক্য গুলো মোটামুটি নিম্নরূপ: “আমি অঙ্গীকার করিতেছি যে, মানুষের সেবায় সব সময় নিজেকে নিয়োজিত রাখিব। দেশের প্রতি অনুগত থাকিব। দেশের একতা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখিবার জন্য সচেষ্ট থাকিব। হে আল্লাহ্, আমাকে শক্তি দিন, আমি যেন দেশের সেবা করিতে পারি এবং বাংলাদেশকে একটি আদর্শ ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসাবে গড়িয়া তুলিতে পারি। আমীন।”  অথবা “আমি শপথ করছি যে, কলেজের সকল নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলব। নিষ্ঠা ও মনোযোগসহকারে লেখাপড়া করব। কলেজের সুখ্যাতি ও মান-উন্নয়নে সচেষ্ট থাকব। দেশ ও মানুষের সেবায় সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখব। স্বধর্মের সকল বিধি-বিধান মেনে চলব। হে আল্লাহ্, আমাকে শক্তি দিন। আমি যেন কলেজের ভাবমূর্তিকে উজ্জল করতে পারি। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের সেবা করতে পারি। আমীন।”

আবার অনেক প্রতিষ্ঠানের ডায়রিতে কোন শপথ বাক্য নেই। দেশের লাখো প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কোন ডায়রি নেই। অন্য কোথাও লিখিত কোন শপথ বাক্য নেই। শপথ বাক্য পাঠের কোন আয়োজন নেই। সুনির্দিষ্ট শপথ বাক্য পাঠের কোন বাধ্য-বাদকতা নেই। এমতাবস্থায় বিশেষ করে যেসকল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সদা মারতে ও মরতে প্রস্তুত, তারা কী (সৃজণশীল?) শপথ গ্রহণ করে তা গভীর ভাবে ভেবে দেখা প্রয়োজন।

সচেতন ও দায়িত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ মনে করেন, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান, যেমন ইচ্ছে তেমন শপথ দেশ ও জাতির জন্য মোটেও কল্যাণকর নয়। প্রথমত: এতে করে ভিন্ন ভিন্ন মন-মনসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠছে নতুন প্রজন্ম। ক্রমে বেড়েই চলছে আমাদের ও আমাদের উত্তরাধিকারদের বিভক্তি। আদর্শ হীন, দয়ীত্ব-কর্তব্যহীন, দেশপ্রেমহীন, মানবতাহীন, চরিত্রহীন হচ্ছে আমাদের অধিকাংশ সন্তান।

দ্বিতীয়ত : আমাদর সকল ক্লাসের পাঠ্য বই ও সাহিত্য চলতি ভাষায় রচিত। বি.সি.এস. পরিক্ষাসহ সকল পরিক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর চলতি ভাষায়। আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ও রণ সঙ্গীত চলতি ভাষায়। জাতীয় সংসদ সদস্যদের শপথ হয় চলতি ভাষায়। ছড়া, কথা, গান, কবিতা, বিতর্ক, বক্তৃতা সবই হয় চলতি ভাষায়। অথচ স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের শপথ বাক্য হবে তাদের অপরিচিত দুর্বুদ্ধ সাধু ভাষায় তা মেটেও যৌক্তিক নয়। যার ভাব/বক্তব্য ও দায়িত্ব/কর্তব্য প্রাথমিক-মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থী; এমন কি এস.এস.সি. পাস প্রাথমিক শিক্ষক গণের পক্ষেও অনুধাবন করা কঠিন। তৃতীয়ত: এই শপথ বাক্য গুলো মনে হয় সামরিক বাহিনীর জন্য অধিক উপযোগী।

জীবনের শুরুতে সকলের জন্য চাই- সুশিক্ষা অর্জনের শপথ। সঠিক ভাবে নিজেকে ও নিজের বিবেককে তৈরি করার শপথ। সৎ ও নীতিবান থাকার শপথ। দুর্নীতি মুক্ত থাকার শপথ। জাতীয়তা বোধ তৈরির শপথ। যেই মজবুত শপথ বুকে নিয়ে সহজেই সম্ভব  দেশ, জাতি ও মানুষের সত্যিকার কল্যাণ।

শুধু মাত্র নিচের ক্লাসের অবুঝ শিক্ষার্থীদের প্রতিদিনের পাঠের জন্যই নয়, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ শ্রেণি-পেশা-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্যই বাধ্যতামূলক থাকা চাই একটি সহজবুদ্ধ অর্থবহ নিরপেক্ষ শপথ। যা হবে আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের মতই জতীয় শপথ। এই শপথ থাকতে পারে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল পাঠ্য বইয়ের শুরুতে। সরকারি-বেসরকারিসহ সকল প্রতিষ্ঠানের  প্রোসপেকটাস ও বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত ম্যাগাজিন, পত্র, পত্রিকায়। সকল প্রশিক্ষণ একাডেমিতে। আমাদের রাষ্ট্রীয় সংবিধানে। বিভিন্ন  জাতীয়দিবসে আমাদের জাতীয় সংগীতের আগে/পরে ছাত্র, শিক্ষক, চাকুরে, সাংসদ, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, রষ্ট্রপতিসহ সর্বস্তরের মানুষ খুলা ডানহাত বাম বুকে(হৃদয়ে) অথবা ভূমির সমান্তরালে(ভূমিতে) রেখে বার বার গ্রহণ করতে পারেন আমাদের নির্ধারিত জাতীয় শপথ। নবীন বরণ, বিদায়, সমাবর্তনসহ বিভিন্ন ছোট-বড় অধিবেশন ও অনুষ্ঠানের শুরুতে ধর্মগ্রন্থ পাঠের পর পরই হতে পারে, ভালো হওয়ার ও ভালো করার সুদৃঢ় শপথ। যাতে বার বার জাগ্রত হয় আমাদের বিবেক, শানিত হয় আমাদের চেতনা, উজ্জীবিত হয় দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ। সঞ্জীবিত হয় প্রতিবাদ-প্রতিরোধের অসীম শক্তি। সেই শপথটি হতে পারে এই রূপ: [‘আমি শপথ করছি যে, -সদা সত্য কথা বলবো ও সৎ পথে চলবো। ছোটদের স্নেহ ও বড়দের মান্য করবো। সুশিক্ষা অর্জনে আমরণ আন্তরিক থাকবো। প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র ও স্বধর্মের সকল বিধি-বিধান মেনে চলবো। ভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, জাতি ও সম্প্রদায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবো। আমাদের জাতীয় চেতনা, একতা ও স্বাধীনতা সুরক্ষায় সর্বদা সক্রিয় থাকবো। হে সর্বশক্তিমান, আমাকে শক্তি দিন, আমি যেন সুনাগরিক হয়ে- প্রতিষ্ঠান, মাতৃভূমি ও মানুষের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করতে পারি।’ ] আমিন (প্রার্থনা পূর্ণ হোক)

 

[লেখক: শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, ছড়াকার, এবং তালিকাভুক্ত গীতিকার- বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার।
অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা। Web ID: rahamot21@gmail.com, Cell- +88 017 11 14 75 70]

লিখিত- ২৭ জানুয়ারি ২০১১
পরিমার্জিত- ০৫ অক্টোবর ২০১৫

শিশুতোষ ছড়া - বাংলার ফল -জনকন্ঠ- ০৪ জুন ২০১৬


বাংলার ফল

মো. রহমত উল্লাহ্


রসে ভরা লাল লিচু আনারস জামরুল
তাজা তাজা ফল খেতে গ্রামে আসে কামরুল।


পাকা আম খেয়ে খুকি বলে- ‘ভারি মিষ্টি’
কাঁঠালের কোয়া গুলো কী দারুন সৃষ্টি।


আনার বা ডালিমের দানা গুলো টস টস
আতা মেওয়া সফেদার কোয়া গুলো রস রস।


কচকচে গোলা’জাম পেয়ারা ও পানিফল
টক মজা তৈকর, টিপা- চুকা- আঁশফল।


খরমুজ তরমুজ মনেহয় ভাই ভাই
খেজুরের কমলার যেন কোন জুড়ি নাই।


কামরাঙা লটকন করমচা কেউয়া
জামবুরা জলপাই অরবরি ডেউয়া


হরিতকি সাতকরা বিলম্বি বেতফল
আমলকি আমড়া লেবু কুল গাবফল।


ফুটি-বাঙি বেশি মজা চিনি দিলে সঙ্গে
কচিতাল চালতার একই রূপ অঙ্গে।


বারমাস পাওয়া যায় কলা পেঁপে নারিকেল
খুব মজা শরবত গুড়ে দিলে পাকাবেল।


কদবেল, বহেড়া, ডুমুর, ডেফল
চাম্বুল, তেঁতু্ল, এ ফল সে ফল…


নূনে-ঝালে গুনে ভরা টক্ ফল ভর্তা
খেয়ে খুশি মেয়ে-ছেলে গৃহিনী ও কর্তা।


দাঁতরাঙা পাকা জামে মুখ হয় রাঙ্গা
বাংলার ফল খেয়ে দেহ-মন চাঙ্গা।<
------------------------


[গত ০৪ জুন ২০১৬ তারিখের দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এই ছড়াটি পড়ে শিশুরা  বাংলার ৫২টি ফলের নাম শিখতে পারবে। তাই , যত পারুন , শেয়ার  করুন।]