শিশুতোষ গল্প- 'শোভনের স্বপ্ন' -জল পড়ে পাতা নড়ে- জুন ২০১৬

শোভনের স্বপ্নজল পড়ে পাতা নড়ে, ষষ্ঠ সংখ্যা, জুন ২০১৬
শোভনের স্বপ্ন
মো. রহমত উল্লাহ্‌
কাগজ কুড়াতে কুড়াতে ক্লান্তি আসে শোভনের। কতক্ষণ হাঁটা যায় নুয়ে নুয়ে। সেই দুপুর থেকে কাগজ কুড়ানো শুরু। মাত্র অর্ধেক হয়েছে পিঠের বস্তা। আগের মত পাওয়া যায় না কাগজ। পলিথিনে বাজার করে সবাই। ছেঁড়া কাগজের দামও কম। কোত্থেকে যে আসে এত টোকাই! কুড়িয়ে নিয়ে যায় সব। কখন ভরবে এই বস্তা। না হলে জুটবে না রাতের খাবার। দ্রুত হাত- পা চালায় শোভন। পিপাসায় শুকিয়ে যায় বুক। কাঁপতে থাকে লিকলিকে হাঁটু। বাসি গোলাপের মতো হয়ে যায় গায়ের রং। কোসা নৌকার মত বেঁকে যায় শরীর। ঘুম লাগে ভাসাভাসা চোখে। শুয়ে পড়ে পার্কের পাকা বেঞ্চিতে। সামান্য ব্যথা পায় পিঠের হাড়ে। শুয়ে থাকে কষ্ট করে। ধীরে ধীরে সোজা হয় শিরদাঁড়া। কিছুটা আরাম লাগে পিঠে। টান পড়ে পেটে। যেন ছিঁড়ে যাবে চামড়া। বেড়ে যায় ক্ষুধার আগুন! হাত-পা ছেড়ে শুয়ে থাকে চোখ বন্ধ করে। ভাবে, এর চেয়ে ভালো ছিল গ্রামে। এতো কষ্ট ছিল না মতি কাকার বাড়িতে। ভাত দিত তিন বেলা। কাজ বলতে ছিল কয়েকটি গরু চরানো। সুযোগ পাওয়া যেত খেলার। গলা ছেড়ে গাওয়া যেত গান। আঁকাবাঁকা পথে চালানো যেত বেতের চাকা। জিরানো যেতো আমের ছায়ায়। কেন যে এই বস্তিতে চলে এলেন মা। আজো বুঝেনি শোভন। মনে আছে মায়ের সেই কথা- ‘চল বাবা, এখানে আর থাকা যাবে না। এর চেয়ে মরে যাওয়া ভালো।’
মুখে পানির ছিটা লাগে। ছন্দ পতন হয় শোভনের ভাবনায়। চোখ খুলে। দেখে একগাল হাসি। দাঁড়িয়ে আছে কনক। পালিয়ে যায় সব কষ্ট। চট্করে বসেপড়ে শোভন। কনকের হাত থেকে টেনে নেয় পানির জগ। গড়গড় গিলে দুই/ তিন স পানি। পাউরুটি বাড়িয়ে দেয় কনক। ‘নেও এক জনে দিছে।’ শোভনের ছোট বোন কনক। পানি বিক্রি করে পার্কে। অর্ধেক পাউরুটি ভাগ করে খায় ভাই-বোনে। ‘এই টুক্ কাগজ টোকাইছ মাত্র! মজা বুঝবানে রাতে!’ শোভনকে মায়ের বকুনির ভয় দেখায় কনক। চিপ দিয়ে উঠে শোভনের বুকের ভিতর! বলে- ‘কনক, কিছু কাগজ টোকাইয়া দে না আমার লগে।’ না, বলে ঘাড় বাঁকা করে কনক। ছুটতে থাকে ‘এই পানি, এই ঠান্ডা পানি ’ বলতে বলতে।

আবার কাগজ কুড়াতে শুরু করে শোভন। লজ্জা লাগে কাগজ টোকানি। এর চেয়ে ভালো হতো টেম্পুর ভাড়া কাটা। প্রতিদিনই পাওয়া যায় নগদ টাকা। চালকও হওয়া যায় এক সময়। কিন্তু পরিচিত লোক ছাড়া পাওয়া যায় না সে কাজ। দ্রুত কুড়াতে থাকে কাগজ। পেয়ে যায় বেশ ক’টি খালি বোতল। পুরা হয়ে যায় বস্তা। আনন্দে ভরে উঠে বুক ! ফিরে যায় বস্তির দিকে।
বিশাল আবাসিক এলাকা। স্কুলের সমনে পাকা রাস্তা। মাঠ নেই। রাস্তাটুকুই হাঁটা-চলা ও খেলাধুলার জায়গা। সাইকেল চালায় ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা। এখানে এলে শোভনের খুব ভাল লাগে। সময় পেলেই সে আসে এখানে। বসে থাকে একাএকা। বস্তিতে থাকে বলে অংশ নিতে পারে না খেলাধুলায়। অন্য দিনের চেয়ে বেশি ভালো লাগে আজ। অনেক সুন্দর মনে হয় সাইকেলগুলো! একেকটা একেক রকম! একটার চাকা পিচঢালা রাস্তার মত কালো। জিহ্বার মত লাল অন্যটির টায়ার। নারিকেল পাতার মত সবুজ কোনটার প্যাডেল। সিটের রং যেন কুটুমপাখির হলুদ। ক্রিং ক্রিং, টুং টাং শব্দ করে ছুটছে সাইকেল। প্রতিযোগিতায় নেমেছে তিনজন। অপলক তাকিয়ে আছে শোভন। দেখতে দেখতে মনে হয় সে নিজেও চালাচ্ছে একটি। নেমেছে প্রতিযোগিতায় । কার আগে যেতে পারে কে। প্যাডেল চালায় দ্রুত। শোভন নিজেকে কল্পনা করে সবার আগে। ক্রিং ক্রিং, ক্রিং ক্রিং। হঠাৎ মনে হয় সাইকেল চড়ে স্কুলে যাচ্ছে সে! পরনে আকাশি শার্ট ও নেভি ব্লু প্যান্ট। পিঠের উপর বই-খাতা ভর্তি ব্যাগ। টিফিন বক্রে ডিম, পরটা, মিষ্টি, কলা...। নিজেকে কল্পনা করে ক্লাসের ফার্স্ট বেঞ্চের ছাত্র। সবার আগে বলতে পারে পড়া। করতে পারে অংক। অনেক আদর করেন স্যারেরা। খেলায় ডেকে নেয় বন্ধুরা।

মসজিদের মাইক থেকে ভেসে আসে মাগরিবের আযান। সাইকেল নিয়ে সবাই চলে যায় নিজ নিজ বাসায়। বন্ধ হয়ে যায় বাসা-বাড়ির লোহার গেট। সে গেটের বাইরে ঠেকে থাকে শোভনের অপলক দৃষ্টি !
Previous Post
Next Post

0 মন্তব্য(গুলি):