মো. রহমত উল্লাহ্
খোলা কাগজ, ৩০ মে ২০২১
>মহামারি করোনার কারণে গত ১৭ মার্চ ২০২০ তারিখ থেকে ১৪ মাস ধরে বন্ধ হয়ে আছে আমাদের দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রত্যক্ষ প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত হয়ে আছে শিক্ষার্থীরা। তাই সবাইকে অটোপ্রমোশন দিয়ে তুলে দেওয়া হয়েছে উপরের ক্লাসে, পরীক্ষা ব্যতীতই দেওয়া হয়েছে সরকারি পরীক্ষায় পাসের সনদ! শিক্ষার্থীরা বুঝে গেছে পরীক্ষায় পাসের জন্য লেখাপড়ার প্রয়োজন নেই! তাই তারা ছেড়ে দিয়েছে লেখাপড়া। যদিও নেওয়া হয়েছে কিছু অনলাইন ক্লাস এবং বেতার-টিভিতে সম্প্রচার করা হয়েছে কিছু পাঠ। বাস্তবে বিভিন্ন কারণে অধিকাংশ শিক্ষার্থী বঞ্চিত রয়েছে এ সকল অনলাইন ক্লাস ও বেতার-টিভির পাঠগ্রহণ থেকে। যারা সুযোগ পেয়েছে তারাও আগ্রহ দেখায়নি এসকল ভার্চুয়াল ক্লাসে। অতি অল্প কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত এখনো এসকল ভার্চুয়াল ক্লাসে উপস্থিতি ও অংশগ্রহণের হার অত্যন্ত কম এবং যারা উপস্থিত হয় তারাও হাজিরা দিয়ে বেরিয়ে যায় প্রায় সবাই। ভার্চুয়াল ক্লাস নেওয়ার প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও দক্ষতা দেশের সকল শিক্ষকের এখনো নেই এটি স্বীকার করতেই হবে। অপরদিকে নিচের ক্লাসের শিক্ষার্থীদের ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে পূর্ণ শিক্ষাদান প্রায় অসম্ভব। অধিকাংশ অভিভাবক এসকল ব্যবস্থায় অজ্ঞ ও অক্ষম। এমতাবস্থায় ভার্চুয়াল ক্লাসের সংখ্যা ও পরিধি যতই বৃদ্ধি করা হোক; সময়, শ্রম ও অর্থব্যয় যতই বৃদ্ধি করা হোক; সকল শিক্ষার্থীর কাছে অনলাইন ও বেতার-টিভির ক্লাস সফল করা সহসা সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। তাই লেখাপড়া থেকে শিক্ষার্থীরা দূরেই থেকে যাচ্ছে।
বারবার ঘোষণা দিয়েও করোনার ভয়ে যাওয়া যাচ্ছে না খোলা যাচ্ছে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যাওয়া যাচ্ছে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ধারেকাছে। যদিও যাওয়া যাচ্ছে কারখানায়, গার্মেন্টসে, শপিংমলে, লঞ্চে, বসে, পার্কে, হাটে, মাঠে, ঘটে ও অন্যান্য অনেক স্থানেই। কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যতীত শিক্ষার্থীরাও যেতে পারছে সর্বত্র। দিতে পারছে আড্ডা, খেলতে পারছে গেম, করতে পারছে ঘুরাঘুরি, মারামারি এবং আরো অনেক কিছুই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই দীর্ঘ ছুটিতে কেমন আছে শিক্ষার্থীরা? কেমন আছে আমাদের সন্তানেরা? কেমন আছে এদেশের ভবিষ্যত নাগরিকেরা? কেমন কাটছে তাদের দিন কাল? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এই দীর্ঘ ছুটিতে কোন দিকে যাচ্ছে তারা, কোন দিকে যাচ্ছে আমাদের দেশ?
একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে, বিভিন্ন উন্মুক্ত স্থানে বা অলিতে-গলিতে, ঝোপ-ঝাড়ে, মাঠে-ঘাটে, কালভার্টে অত্যন্ত গাদাগাদি হয়ে বসে/দাঁড়িয়ে আছে অনেক শিক্ষার্থী। সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন, সবার দৃষ্টি মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে, সবাই খেলছে অনলাইন গেম 'পাবজি' বা 'ফ্রি ফায়ার'। তারা এভাবেই কাটিয়ে দেয় দিন। কীভাবে যে সংসার চলে খোঁজ রাখে না তারা। বাবা-মা ভাই-বোন আত্মীয়-স্বজন কারোর খোঁজ রাখার সময় নেই, মানসিকতা নেই তাদের। এগিয়ে যেতে চায় না কারো বিপদে। এমনকি ফোন করলেও ধরে না, ধরলেও কথা লম্বা করে না। ফিরিয়ে ফোন করা তো অনেক দূরের কথা। দিনে দিনে তারা হয়ে উঠছে চরম স্বার্থপর! তাদের চাহিদা পূর্ণ করতে, তাদের মন খুশি রাখতে সদা ব্যস্ত-তটস্থ থাকতে হয় বাবা-মায়ের। প্রয়োজনীয় টাকার অভাব হলেই চড়াও হয় বাবা-মায়ের ওপর। কেউ কেউ বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ!
এর চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে রাতে! সারারাত জেগে ছেলেমেয়েরা খেলছে এসব গেম এবং সাঁতরে বেড়াচ্ছে সারা পৃথিবীর পর্নো জগতে। ডুবে যাচ্ছে কূল-কিনারহীন নীল নেশার অতল সাগরে। এসব অনলাইন খেলায় ও সীমাহীন পর্নো আদান-প্রদানে যোগ দেয় দেশ-বিদেশে অবস্থিত জানা-অজানা অনেক ছেলেমেয়ে। এভাবে তারা বিনিময় করে তাদের চিন্তা-চেতনা। একে আয়ত্ত করে, অনুসরণ করে, অনুকরণ করে অন্যের চলন-বলন। ধ্বংস করে নিজের পারিবারিক ও সামাজিক কৃষ্টি, কালচার, মূল্যবোধ। শিখে না অথবা ভুলে যায় আবশ্যকীয় ম্যানার্স এন্ড এটিকেটস।
অনেক শিক্ষার্থী জড়িয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন অপরাধকারী গ্যাং এর সঙ্গে। চলে গেছে অভিভাবকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তারা সঙ্গবদ্ধ হয়ে করছে বিভিন্ন অপরাধ। গ্রুপে গ্রুপে করছে মারামারি। মেগাবাইট ও নেশাখাদ্য ক্রয়ের টাকা সংগ্রহের জন্য হানা দিচ্ছে নিজেদের ঘরে, অন্যের ফলের বাগানে, ফসলের মাঠে, মাছের পুকুরে, মুরগির ফার্মে, গাড়ির গ্যারেজে, পথচারীর পকেটে! এরই মধ্যে হয়তো একদল জড়িয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন আন্ডারগ্রাউন্ড সংগঠনের সঙ্গে। শিক্ষার্থীদের অবসর মস্তিষ্কে ঢুকে যাচ্ছে বিভিন্ন বৈধ-অবৈধ সংগঠনের মতাদর্শ এবং হিসাবহীন অর্থ হস্তগত করার নেশা।
সারারাত জেগে, সারাদিন ঘুমিয়ে মেজাজ খিটখিটে করে নিকটজনের সঙ্গে করছে খারাপ ব্যবহার। অমনোযোগী হয়ে গেছে লেখাপড়ায়। হারিয়ে ফেলছে সৃজনশীল চিন্তা করার ক্ষমতা। হয়ে পড়ছে চরম ধৈর্যহীন! কেউ কেউ হয়ে পড়ছে অত্যধিক হিংস্র! আবার কেউ কেউ হয়ে পড়ছে একেবারে নির্জীব। আক্রান্ত হয়ে পড়ছে চরম বিষন্নতায়। নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছে হতাশায়। হারিয়ে ফেলছে কর্ম উদ্যম। হয়ে যাচ্ছে নেশাগ্রস্ত!
নিকটজনের সঙ্গে যখন তখন করছে চরম দুর্ব্যবহার। সঠিকভাবে করছে না নাওয়া-খাওয়া। হচ্ছে না স্বাস্থ্য সচেতন। অর্জন করছে না রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। অর্জন করছে না প্রয়োজনীয় শক্তি-সাহস। চরমভাবে হয়ে পড়ছে দায়িত্ব-কর্তব্য হীন। নিজের প্রতি যেমন যত্ন নিচ্ছে না, তেমনি অন্যের প্রতি দায়িত্ব পালনে হচ্ছে না সচেতন। কারো অসুস্থতার খবর, মৃত্যুর খবর এদের মনে কোন প্রভাব ফেলে না। এসব এরা শুনে আর ভুলে যায়। এদের স্মরণশক্তি হ্রাস পাচ্ছে অতি দ্রুত।
দেশের প্রতি তাদের কোন ভালবাসা তৈরি হচ্ছে না। জাতির প্রতিও কোন ভালবাসা তৈরি হচ্ছে না। সামাজিক দায়-দায়িত্ব থেকেও এরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। মননশীল বই থেকে সরে গেছে অনেক দূরে। জানে না তাদের পাঠ্য বইয়ের ও চ্যাপ্টারের নাম। অর্জন করছে না মনের উদারতা। তাদের অনেকেই আবার খেলার মাঠ থেকে চলে গেছে পথের ধারে বা অন্ধকার ঘরে। তারা নিচ্ছেনা সূর্যের আলোর পরশ, মুক্ত বাতাসের ছোঁয়া। দীর্ঘ ছুটিতে আমাদের ঘরে-বাইরে নিরবে তৈরি হচ্ছে শিক্ষাহীন এক অসার ও অপরাধী জেনারেশন। দ্রুত অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে দেশ ও জাতি!
এমতাবস্থায় আবারও সবিনয়ে বলছি, আর বৃদ্ধি করবেন না ছুটি। এবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিন। অন্ততপক্ষে করোনামুক্ত গ্রামসমূহের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরীক্ষামূলক ভাবে আগে খুলে দিন। গ্রামের একটি শিক্ষার্থীও যদি বিপথ থেকে মুক্ত থাকতে পারে, লেখাপড়ায় এগিয়ে যেতে পারে তো সে এদেশেরই সম্পদ হবে। গ্রামের অবস্থার অবনতি না হলে পর্যায়ক্রমে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিন। সেইসাথে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা নিন। সবই তো চলছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর বন্ধ থাকবে কেন? শিশু শিক্ষার্থীদের উপযোগী পর্যাপ্ত টিকা পাওয়া তো এখনো অনিশ্চিত। দেশের প্রায় পাঁচ কোটি শিক্ষার্থীর টিকা নিশ্চিত করতে যদি আরও কয়েক বছর সময় লাগে তো ততদিন কি বন্ধ রাখা হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান? যদি তাই হয় তো কোথায় গিয়ে ঠেকবে এ জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্ম? অদূর ভবিষ্যতে কাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে এ দেশ?
মো. রহমত উল্লাহ্
শিক্ষক, সাহিত্যিক ও কলামিস্ট
Email- rahamot21@gmail.com