সর্বাত্মক লকডাউনের বিকল্প
মো. রহমত উল্লাহ্ |
খোলা কাগজ, ২৭ এপ্রিল ২০২১
বারবার সর্বাত্মক লকডাউন দেওয়া হলে অনাহারে মরে যাবে অনেক খেটে খাওয়া মানুষ। যারা একদিন উপার্জন করতে না পারলে না খেয়ে থাকতে হয় তারা ১০-১৫ দিন লকডাউন মানবে কেমন করে? কাজ করতে না পারলে কোথায় পাবে টাকা, কী খেয়ে বেঁচে থাকবে পরিবার-পরিজন নিয়ে? আমাদের দেশে তো দৈনিক খেটে খাওয়া মানুষের সংখ্যা অনেক। রিকশাচালক, ভ্যানচালক, গাড়িচালক, দোকানের কর্মচারী, হোটেলের কর্মচারী, গাড়ির হেলপার, রাস্তাঘাটের হকার, উন্নয়ন কাজের লেবার, সেলুনের কর্মী, জুতা সেলাই কর্মী, বাসা-বাড়ির কাজের বুয়া ইত্যাদি অনেক রকম খেটে খাওয়া মানুষ আছেন আমাদের দেশে যাদের পরিবার চলে তাদের দৈনিক আয়ের উপর। এক দিন সর্বাত্মক লকডাউন মানেই তাদের পরিবারের সবাই এক দিন না খেয়ে থাকা!
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ (২০১৭) অনুযায়ী, আমাদের দেশে মোট ৬ কোটি ৮ লাখ লোক মজুরির বিনিময়ে কোনো না কোনো কাজ করেন। এর মধ্যে ৫ কোটি ১৭ লাখ শ্রমিকের কাজ স্বাভাবিক অবস্থাতেই অনানুষ্ঠানিক বা অনিশ্চিত। করোনাকালে তাদের অবস্থা আরও অনেক বেশি ভয়াবহ! অগণিত ভিক্ষুকের অবস্থা তো আরও বেশি খারাপ! অপরদিকে বিশ্বব্যাংকের মতে, যাদের দৈনিক আয় ১০ ডলার থেকে ৫০ ডলারের মধ্যে তারা মধ্যবিত্ত। এই হিসাবে বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি। উপার্জন বন্ধ থাকলে তারা না চাইতে পারেন, না খাইতে পারেন!
নিত্য খেটে খাওয়া মানুষের ক্ষুধার রাজ্যে নেই কোনো মরণের ভয়। একজন সেলুনকর্মী আমাকে বলছিলেন- ‘স্যার, কাজ না করলে খাব কী? না খেয়ে মারা গেলে সন্তান অভিশাপ দেবে, জাতির বদনাম হবে, দেশের বদনাম হবে। তারচেয়ে করুণায় মারা যাওয়া ভালো। কত রোগেই তো মারা যায় মানুষ। মাস্ক পরি, হাত ধুই, সেভলন লাগাই। চেষ্টা করি বেঁচে থাকার। বাকি আল্লাহর ইচ্ছা।’ তার এই অল্প কথায় নিহিত আছে অনেক কথা। নিহিত আছে পরিবার-পরিজনের প্রতি দায়িত্ববোধ, দেশ ও জাতির প্রতি সম্মানবোধ, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রতি আনুগত্য এবং নিজের উপার্জন খেয়ে বেঁচে থাকার ইচ্ছা। কিন্তু সর্বাত্মক লকডাউনে কোথায় পাবে সে কাস্টমার?
২০২০ সালে মাত্র ৫০ লাখ নিম্নবিত্ত পরিবারকে ২৫০০ টাকা হারে এককালীন অর্থ সাহায্য দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এবারও নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় এই সহায়তার পরিমাণ অত্যন্ত কম। তদুপরি বিপুল সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষকে দিনের পর দিন প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা প্রদান করার সক্ষমতাও আমাদের নেই। তাই জীবিকার পথে বারবার দীর্ঘ লকডাউন এলে অনেকেরই না খেয়ে মরতে হবে নিশ্চিত। সেজন্যই ভাবতে হবে সর্বাত্মক কঠোর লকডাউনের বিকল্প।
লকডাউনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করা। অর্থাৎ জনসমাগম বন্ধ করা বা মানুষের সঙ্গে মানুষের শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করা। ২০২০ সালের শুরুর দিকে যখন আমরা করোনার ভয়ে তটস্থ ছিলাম, স্বেচ্ছায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে ছিলাম তখন আমাদের আক্রান্তের হার ছিল কম, মৃত্যুর হার ছিল দৈনিক ১০ থেকে ১৫ জন। পরে যখন আমরা উদাসীন হয়ে গেলাম, যত্রতত্র জমায়েত শুরু করে দিলাম, ছোটাছুটি শুরু করে দিলাম, আনন্দ উৎসব করতে শুরু করে দিলাম, মাস্ক পরিহার করলাম, হাত ধোয়া বন্ধ করলাম তখনই দেখা দিল ভয়াবহ রূপ! করোনায় আক্রান্ত হয়ে দৈনিক মৃত্যুর হার উঠে গেল এক শ’তে। আবার কঠোর লকডাউনে যেতে বাধ্য হলো সরকার।
আমরা নিজেরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলব না। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মরে গেলে সরকারকে দায়ী করব। সরকার লকডাউন দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে গেলেও আমরা মানতে চাইব না। দল বেঁধে বাড়িতে ছুটব, গাদাগাদি করে গাড়িতে চড়ব, ঠেলাঠেলি করে লঞ্চে উঠব, নিয়ম ভেঙে রাস্তায় নামব, সামান্য বিষয়ে অসামান্য বিবাদে জড়াব। আর সবকিছুর জন্যই সরকারকে দায়ী করব। কঠোর লকডাউন দিয়ে সরকার আমাদেরকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করলে আমরা কর্মহীন হয়ে যাব, অর্ধাহারে কষ্ট পাব, অনাহারে মারা যাব এবং এখানেও সরকারকেই দায়ী করব। এই দুরবস্থা তো বেশিদিন চলতে পারে না কোনোভাবেই।
আমাদের মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধি, সরকারকেও ভাবতে হবে সর্বাত্মক লকডাউনের বিকল্প। যার টাকার প্রয়োজন সে ব্যাংকে যাবেই। যার চাল-ডাল প্রয়োজন সে বাজারে যাবেই। যার ভিক্ষা করা প্রয়োজন সে বাইরে বেরোবেই। যার যেখানে যাওয়ার প্রয়োজন সে সেখানে যাবেইÑ একদিন আগে হোক আর দুদিন পরে হোক। মালিক ও শ্রমিকরা যানবাহন চালাতে চাইবেই, কারখানা খোলা রাখতে চাইবেই, ব্যাংক-বীমা খোলা রাখতে চাইবেই, দোকানপাট খোলা রাখতে চাইবেই। ছাত্র-শিক্ষক স্কুল-কোচিংয়ে যেতে চাইবেই। এটাই বাস্তবতা, এটাই প্রয়োজনীয়তা। দীর্ঘদিন এসব বন্ধ রাখাও যাবে না, অল্পদিনে করোনামুক্ত হওয়াও যাবে না। এই মহামারী করোনা মোকাবিলা করেই এগিয়ে যেতে হবে আমাদের।
বাস্তবতার আলোকে প্রণয়ন করতে হবে পরিকল্পনা। ভেবে দেখতে হবে সপ্তাহে দুই দিন ২ ঘণ্টা করে ব্যাংক খোলা রেখে গাদাগাদি করে ২ হাজার মানুষের সেবা দেওয়া অধিক স্বাস্থ্যসম্মত নাকি মাসে প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা করে খোলা রেখে শারীরিক দূরত্ব বজায় ২ হাজার মানুষের সেবা দেওয়া অধিক স্বাস্থ্যসম্মত। এমন আরও অনেক প্রতিষ্ঠান ও ক্ষেত্র আছে যেগুলো বেশি সময় খোলা রাখলেও বেশি মানুষ যাবে না আবার কম সময় খোলা রাখলেও যাদের প্রয়োজন তারা যাবেই। এমন বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সার্বক্ষণিক খোলা/ চালু রাখার বিষয় বিবেচনা করা উচিত। আবার যে সকল ক্ষেত্র আংশিক চালু/ খোলা রাখা হলে আংশিক লোকের উপস্থিতি ঘটবে এবং যে সকল ক্ষেত্র সাময়িক বন্ধ রাখা হলেও মানুষের তেমন অসুবিধা হবে না সেগুলো চালু/ খোলা বা বন্ধ রাখার শিডিউল সেভাবেই প্রণয়ন করা উচিত। অর্থাৎ সর্বাত্মক লকডাউন পরিহার করে যে ক্ষেত্রে যখন যা না করলেই নয় তাই করা উচিত। ক্ষেত্র বিবেচনায় বিধি নিষেধ, লকডাউন, কঠোর লকডাউন, যাই দেওয়া হোক না কেন, থাকতে হবে জীবন ও জীবিকা দুই-ই বাঁচানোর সর্বাধিক যৌক্তিক প্রচেষ্টা।
সর্বোপরি সবাই মিলে সর্বত্র শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে বিদ্যমান স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। সেই সঙ্গে উদ্ভাবন করার চেষ্টা করতে হবে করোনাকে পরাস্ত করার অধিক কার্যকর কৌশল। অবশ্যই অতীতের মতো ভবিষ্যতেও বিজয়ী হবে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ।
মো. রহমত উল্লাহ্ : অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা
0 মন্তব্য(গুলি):