গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিন
মো. রহমত উল্লাহ্
খোলা কাগজ, ০৪ মে ২০২১
মহামারী করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে শিক্ষাখাত। সরাসরি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে আমাদের প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থী। শিক্ষার ক্ষতি অত্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি ও বিভিন্নমুখী হওয়ায় সাধারণভাবে চোখে পড়ে না অনেকেরই। শিক্ষাখাতে এমন কিছু ক্ষতি আছে যা আর কখনই রিকভার করা সম্ভব হয় না। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় যে সকল শিক্ষার্থী স্থায়ীভাবে ঝরে পড়ে শিশুশ্রম ও বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে তাদের জীবন থেকে কখনোই আর মুছে দেওয়া সম্ভব হবে না এই ক্ষত। জানা যায়, ২০১৯ সালে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৭.৯ শতাংশ আর মাধ্যমিকে এই হার ছিল ৩৭.৬২ শতাংশ। ২০২১ সালে এই ঝরে পড়ার হার আরও বাড়বে এটাই নিশ্চিত। বিশেষ করে কন্যাশিশুরা এই ক্ষতির শিকার হয়েছে ও হবে সর্বাধিক। তাছাড়া অনেক বড় শিক্ষার্থীও পূর্ণ করতে পারেনি, পারবে না তাদের কাক্সিক্ষত শিক্ষা। অর্জন হয়নি, হবে না তাদের প্রত্যাশিত যোগ্যতা এবং নিয়োগ পায়নি, পাবে না যথাযোগ্য কর্মে। অনেকের অবসর মস্তিষ্ক হয়েছে ও হবে শয়তানের আড্ডাখানা ইত্যাদি নানামুখী কারণে দূর ও অদূর ভবিষ্যতে চরমভাবে ব্যাহত হবে জাতীয় অগ্রগতি।
গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পর ১৭ মার্চ ২০২০ তারিখ থেকে বন্ধ হয়ে আছে আমাদের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বিপর্যস্ত হয়ে আছে প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী ও তৎসংশ্লিষ্ট বেসরকারি শিক্ষকদের জীবন। শহরভিত্তিক কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনলাইন ক্লাস পরিচালনা সম্ভব হলেও গ্রামে অবস্থিত বিপুল সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তা সম্ভব হয়নি ইন্টারনেট সংযোগ, পর্যাপ্ত ডাটা ও ডিভাইসের অভাবে। গ্রামের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রয়োজনীয় আইসিটি দক্ষতা না থাকাও অনলাইন ক্লাস না হওয়ার আরও একটি কারণ। বিভিন্ন এলাকার কিছু সরকারি/ প্রাইভেট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হাতেগোনা আকর্ষণীয় ভিডিও ক্লাস ব্যতীত অনলাইন ক্লাস এর ক্ষেত্রে সারা দেশের প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হয়েছে সর্বাধিক। এমনকি শহরের অধিকাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতেও অনুষ্ঠিত হয়নি অনলাইন ক্লাস।
টেলিভিশনে ও রেডিওতে কিছু ক্লাস সম্প্রচার হলেও তার সফলতার হার নিয়ে রয়েছে বিভিন্ন মত। গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত গণসাক্ষরতা অভিযানের সমীক্ষায় দেখা যায় যে, প্রায় ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী দূরশিক্ষণে অংশ নিয়েছে। ব্র্যাকের একটি সমীক্ষা মতে, টেলিভিশন পাঠদানে ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছে। অর্থাৎ সরকারিভাবে পরিচালিত দূরশিক্ষণ কার্যক্রমের বাইরে অন্তত অর্ধেক শিক্ষার্থী। যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, ৯২ শতাংশ শিক্ষার্থী দূরশিক্ষণের অধীনে এসেছে। আর স্কুল শিক্ষকদের মাধ্যমে অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে ৮৫ শতাংশকে লেখাপড়ার মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছে। বাস্তব অবস্থা হচ্ছে, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে সব শিক্ষার্থীর কাছে বেতার-টিভির ক্লাস পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। তদুপরি দীর্ঘ ছুটিকালে শিক্ষার্থীদের এসব ক্লাসে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছেন অধিকাংশ অভিভাবক। বিশেষ করে গ্রামের অভিভাবকগণ শিক্ষার্থীদের ঘরে রাখতেই ব্যর্থ হচ্ছেন; ক্লাসে অংশগ্রহণ করানো তো আরও অনেক দূরের কথা।
গ্রামে অবস্থানকারী আমার আপন ছোট ভাই কিছুদিন পর পর ফোন করে জানাচ্ছে বিভিন্ন সমস্যা, জানতে চাচ্ছে স্কুল খোলার খবর। ‘ইস্কুল কবে খুলবে? আর তো পারি না! পোলাপান নিয়া খুব অশান্তিতে আছি! এগুলি সারাদিন কই যায়, কই থাকে, খুঁজে পাই না। কোনো লেখাপড়া নাই। একটা কাজও করে না। কোনো কথা শোনে না। খাওয়া-দাওয়া করে না। বাড়িতে থাকে না। এখানে সেখানে চলে যায়। খেলাধুলা করে, ঝগড়া-বিবাদ করে, মারামারি করে। খুব অশান্তিতে আছি! আর ভাল্লাগে না। ইস্কুল খোলা হবে কবে? কীসের করোনা? গ্রামে তো কোনো করোনা দেখি না? সবাই হাটে যায়, বাজারে যায়, ক্যারাম খেলে, দোকানে আড্ডা দেয়। কেউ মাস্ক পরে না। গ্রামের ইস্কুল বন্ধ কেন? শুধু ইস্কুলেই কি করোনা? শহরে করোনা থাকলে শহরের ইস্কুল বন্ধ থাকুক। আপনি কী লেখালেখি করেন? সরকারকে বলেন, গ্রামের ইস্কুল খুলে দিতে। আমাদের পোলাপান তো শেষ! এগুলি আর কোনো কাজেই লাগবে না!’
আমার এই ছোট ভাইয়ের কথাগুলো নিশ্চয়ই অধিকাংশ গ্রামীণ অভিভাবকের কথা। কেননা, এটি হচ্ছে গ্রাম-বাংলার প্রকৃত চিত্র। এটি অবশ্যই আমাদের জন্য অনেক বড় সুখবর ও সম্ভাবনা। এই সুযোগ ও সম্ভাবনাকে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগিয়ে শিক্ষা খাতের লাগাতার ক্ষতি কিছুটা হলেও ঠেকিয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল এবং আছে। গত প্রায় ছয় মাস আগে থেকেই আমি বলে আসছি, অন্তত পরীক্ষামূলকভাবে হলেও গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া হোক। বিশেষ করে যে সকল এলাকায় কোনো করোনা রোগী শনাক্ত হয়নি সে সকল এলাকার প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিয়ে পল্লী চিকিৎসকদের দ্বারা গঠিত একটি কমিটির মাধ্যমে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা যেতে পারে। অবস্থার অবনতি হলে আবার বন্ধ করে দেওয়া এবং অবনতি না হলে ধাপে ধাপে আরও অধিক প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া যাবে। আমরা যে যা-ই বলি না কেন সরাসরি ক্লাসের শতভাগ বিকল্প নয় অন্য কোনো পদ্ধতির ক্লাস।
দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনটনে পড়ে গেছেন বেসরকারি ও প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। ইতোমধ্যেই সাইনবোর্ড উঠে গেছে হাজার হাজার প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। বেকার হয়ে গেছেন লাখ লাখ প্রাইভেট শিক্ষক। অপরদিকে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা সামান্য সরকারি বেতন পেলেও অধিকাংশই প্রতিষ্ঠান থেকে পাচ্ছেন না তেমন কিছু। গ্রামের স্কুলগুলোতে ক্লাস বন্ধ থাকায় অভিভাবকরা কোনো টাকা দিচ্ছেন না। শহরকেন্দ্রিক যে কয়টি প্রতিষ্ঠানে অনলাইন ক্লাস হয় সেগুলোর অধিকাংশ অভিভাবকই টিউশন ফি দিতে চান না। এমতাবস্থায় সরকারি শিক্ষক যা-ই বলুক, বেসরকারি শিক্ষকরা ঐকান্তিকভাবেই চাচ্ছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হোক। জীবন ও জীবিকার সমন্বয় সাধন করা হোক। পৃথিবী করোনামুক্ত হলে তারপর খুলে দেওয়া হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান; এমন চিন্তা করে বসে থাকলে চলবে না। মহামারী করোনাকে মোকাবিলা করেই এগিয়ে যেতে হবে আমাদের। অতীতেও অনেক প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে বিজয়ী হয়েছে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ।
এখন থেকে ১০০ বছর আগেও আজকের এমন পরিস্থিতিতে পড়েছিল পৃথিবী। আমেরিকার রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের তথ্য মতে, বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইউরোপে ও আমেরিকায় যক্ষ্মায় মারা যেত প্রতি সাতজনে একজন। সেই মহামারী পরিস্থিতিতে শিশুরা যাতে নিরাপদে স্কুলে ফিরতে পারে তার সমাধান হিসেবে জন্ম নিয়েছিল খোলা মাঠে স্কুল ব্যবস্থা। তখনো অনির্দিষ্টকালের জন্য বিনষ্ট হতে দেওয়া হয়নি শিক্ষার্থীদের মূল্যবান সময়। জার্মানি ও বেলজিয়ামে ১৯০৪ সালে প্রথম চালু হয় ওপেন এয়ার স্কুল। হালকা ওজনের টেবিল ও চেয়ার নিয়ে যাওয়া হয় বাগানে। টিচাররা মাঠে বসে প্রকৃতির সান্নিধ্যে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিতে শুরু করেন।
অল্পদিনের মধ্যেই এটি একটি আন্দোলন হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে অন্য দেশে। চলতে থাকে শিক্ষা কার্যক্রম। প্রচ- শীত উপেক্ষা করেও শিক্ষার্থীরা অংশ নেয় খোলা মাঠে অনুষ্ঠিত ক্লাসে। ব্যাপক ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায় শিক্ষার্থীরা। অথচ আরও অনেক পরে ১৯২১ সালে এসে আবিষ্কৃত হয় যক্ষ্মার প্রতিষেধক টিকা। যা বিশ্বের সকল দেশে পৌঁছাতে সময় লাগে আরও বেশ কয়েক বছর। কিন্তু সে সময় পর্যন্ত থেমে থাকেনি শিক্ষা।
প্রয়োজনে আমাদের আবার ফিরে যেতে হবে সেই ১০০ বছর আগের পদ্ধতিতে। বর্তমানে আমাদের প্রায় সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই রয়েছে পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ। প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই রয়েছে পর্যাপ্ত টেবিল চেয়ার ও বেঞ্চ। গ্রামে গ্রামে রয়েছে ছোট/ বড় ঈদগাহ ও খেলার মাঠ। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষেই নিরাপদ দূরত্বে শিক্ষার্থীদের বসিয়ে ক্লাস নেওয়া সম্ভব। যেখানে তেমন ব্যবস্থা অপ্রতুল সেখানে নেওয়া যেতে পারে ওপেন ফিল্ড ক্লাস। স্কুলে আনা যেতে পারে একেকদিন একেক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে মাস্ক পরিধানসহ সকল স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। সেই গ্রামে/ প্রতিষ্ঠানে নিষিদ্ধ থাকতে হবে বহিরাগতদের যাতায়াত। ক্লাস পরিচালনা সফল হলে পরীক্ষা নেওয়ার কথাও ভাবা যাবে এই পদ্ধতিতে।
শুধু সহকারী পরীক্ষা নয়, শ্রেণির পরীক্ষাগুলো নেওয়াও অত্যন্ত জরুরি। কোনোভাবেই আর অটো প্রমোশন কাম্য নয়। অটো প্রমোশনে উপরের ক্লাসে উঠে যাওয়া এমন অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা তাদের গতবারের পাঠ্যবইয়ের নামও বলতে পারবে না এখন! অটো প্রমোশন শিক্ষার্থীদের পাঠবিমুখ করে, মর্যাদাহানি করে, মূল্যমান কমায় ও হীনম্মন্যতায় ভোগায়। শতবর্ষ আগের অভিজ্ঞতায় আজও সম্ভব শিক্ষার্থীদের ক্লাস ও পরীক্ষা পরিচালনা করা। প্রয়োজনে যুগোপযোগী করে নিতে হবে সেই পদ্ধতি। তাই আবারো বলছি, প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে অন্তত পরীক্ষামূলকভাবে হলেও আপাতত করোনামুক্ত গ্রামসমূহের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিন।
মো. রহমত উল্লাহ্ : অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা
http://m.kholakagojbd.com/public-opinion/76451
0 মন্তব্য(গুলি):