সব দিক জেনে-বুঝে হোন বেসরকারি শিক্ষক
দৈনিক বাংলা, ১০ জুলাই ২০২৫
মো. রহমত উল্লাহ্
>বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দেশে ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সচল রাখার প্রয়োজনে বিপুলসংখ্যক বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যারা এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হতে আগ্রহী তাদের উচিত বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য জেনে-বুঝে বাস্তবতার আলোকে এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা। কেননা, অতি আবেগ তাড়িত হয়ে বা অন্য চাকরি না পেয়ে অথবা ভিন্ন কোন কারণে সব কিছু না জেনে না বুঝে বেসরকারি শিক্ষক হয়ে নিজের কর্মের উপর সন্তুষ্ট থাকতে না পারলে ব্যক্তিগত সফলতা অর্জন এবং দেশ ও জাতির কল্যাণ সাধন মোটেও সম্ভব নয়। সফল শিক্ষক ব্যতীত যোগ্য-দক্ষ নাগরিক-কর্মী তৈরি হয় না। একজন স্বেচ্ছা প্রণোদিত ও আত্ম নিবেদিত সুযোগ্য সফল শিক্ষক সারা জীবনে তৈরি করেন অগণিত সফল মানুষ। বিপরীত ক্রমে একজন অনাগ্রহী ও অসন্তুষ্ট শিক্ষক নিজের জান্তে বা অজান্তে সারা জীবনে তৈরি করেন অগণিত অযোগ্য নাগরিক। উত্তম শিক্ষকতার জন্য সন্তুষ্ট চিত্ত অত্যাবশ্যক। তাই বলছি, ভালোভাবে সবকিছু জেনেবুঝে ভেবেচিন্তে তবেই হওয়া উচিত শিক্ষক বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষক। এজন্যে প্রার্থীদের সুবিধার্থে সংক্ষিপ্তভাবে নিচে উপস্থাপন করছি কিছু বিবেচ্য বিষয়।
মনে রাখতে হবে, ভিন্ন ভিন্ন ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডি দ্বারা পরিচালিত প্রতিটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পৃথক, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি পদ সম্পূর্ণ পৃথক, চাকরির আবেদনের চয়েজ লিস্টের প্রতিটি চয়েজ পৃথক। পদ শূন্য থাকলে নিজের যোগ্যতা ও ইচ্ছা অনুসারে বাড়ির পাশে/ দূরে/ বহুদূরে/ শহরে/ গ্রামে অবস্থিত স্কুলে/ কলেজে/ মাদ্রাসায়/ কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আবেদন করা যায়। এক্ষেত্রে একজন প্রার্থী তার পছন্দের ক্রমানুসারে অনেকগুলো (ষষ্ঠ গণবিজ্ঞপ্তি অনুসারে ৪০ টি) প্রতিষ্ঠানে অল্টারনেটিভ চয়েজ দিয়ে স্বেচ্ছায় আবেদন করতে পারেন। তার পছন্দ তালিকার যেকোনো একটিতে যোগ্যতার ভিত্তিতে সে নিয়োগ পেতে পারেন। কর্তৃপক্ষ প্রার্থীর পছন্দ তালিকার বাইরের কোন প্রতিষ্ঠানে কাউকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করতে পারেন না। অর্থাৎ প্রার্থীর পছন্দ ও যোগ্যতার ভিত্তিতেই তাকে সুনির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়। ফলে নিয়োগের পর কাউকে অন্যত্র বদলি করতে কর্তৃপক্ষ বাধ্য নয়; যদি না সহানুভূতিশীল হয়। তাই আবেদন করার ও নিয়োগ পাওয়ার আগেই প্রার্থীকে অনেক বিষয় বিবেচনা করতে হবে।
মনে রাখতে হবে, এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে সরাসরি বদলি হওয়ার বা প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ এখনো অত্যন্ত সীমিত। কেন সীমিত তার ব্যাখ্যা অনেক বিস্তৃত, অনেক বিতর্কিত। তাই দ্রুত বদলি হবার মানসিকতা পরিহার করে যেখানে নিয়োগ পাবেন সেখানেই দীর্ঘদিন চাকরি করবেন এমন মানসিকতা নিয়ে আবেদন করা উচিত। কেউ কোনদিন প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ পেলেও সেটি তার পছন্দ মতো নাও হতে পারে। আবারো অনেকগুলো চয়েজ দিয়ে কোন একটিতে সুযোগ পেতে পারেন। তখনো তাকে অন্য একটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই যেতে হবে এবং সেটির ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডির অধীনস্থ হয়েই চাকরি করতে হবে।
মোট শূন্য পদের বিপরীতে মোট প্রার্থীসংখ্যা যাই থাকুক না কেন ভালো/ সচ্ছল/ সুবিধাজনক প্রতিষ্ঠানে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংখ্যা বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। নিবন্ধন পরীক্ষায় বেশি নম্বর প্রাপ্ত হয়ে থাকলেও ভালো প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পেতে চাইলে একাধিক প্রতিষ্ঠানে আবেদন করার প্রয়োজন হবে। যাদের নিবন্ধন পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর তুলনামূলক কম তাদের আরো বেশি সংখ্যক প্রতিষ্ঠানে আবেদন করার প্রয়োজন হবে। সে ক্ষেত্রে নিজের বাড়ির আশেপাশে অবস্থিত একাধিক প্রতিষ্ঠানে এবং অনেক দূর-দূরান্তে অবস্থিত একাধিক প্রতিষ্ঠানে আবেদন করার তাগিদ অনুভব করতে পারেন।
যে প্রতিষ্ঠানেই আবেদন করুন না কেন; ধরে নিতে হবে ওই প্রতিষ্ঠানেই আপনার চাকরি হবে এবং আপনি অবশ্যই সেখানে চাকরি করতে যাবেন। তাই একজন প্রার্থীর নিম্নে লিখিত বিষয়গুলো ভালোভাবে বিবেচনায় রেখে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চয়েজ করে সিলেকশন করা বা আবেদন করা উচিত।
অনেক বছর আগে থেকেই এদেশের শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা অত্যন্ত কম ছিল। তখনকার শিক্ষকগণের প্রায় সবাই স্বেচ্ছায় স্বপ্রণোদিত হয়ে, আত্মনিবেদিত হয়ে শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন। তাঁদের কাছে শিক্ষকতা প্রায় শতভাগ ব্রত ছিল। তখনকার জীবনযাপনের প্রেক্ষাপটে শিক্ষকতার মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্য মুখ্য ছিল না। তবে বর্তমান বাস্তবতায় শিক্ষকদের ন্যূনতম জীবন ধারণের প্রয়োজনেই শিক্ষকতার মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের বিষয়টি অনেকাংশে মুখ্য হয়ে উঠেছে। তথাপি আমাদের দেশের শিক্ষকদের বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় খুবই নগণ্য! বর্তমানে এমপিও এর মাধ্যমে সরকার মাধ্যমিক স্তরের একজন প্রশিক্ষণ বিহীন সহকারি শিক্ষককে মূল বেতন দিয়ে থাকে মাত্র ১২,৫০০ টাকা! উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ের একজন প্রভাষককে প্রাথমিক মূল বেতন দেওয়া হয় ২২,০০০ টাকা। এছাড়া সকল স্তরের শিক্ষকদের বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট অনধিক ৫ শতাংশ, বাড়ি ভাড়া ভাতা ১,০০০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা, উৎসব ভাতা ৫০ শতাংশ, বাংলা নববর্ষ ভাতা ২০ শতাংশ দেওয়া হয়ে থাকে। অপরদিকে এই মূল বেতন থেকে অবসর + কল্যাণ তহবিলের জন্য ১০ শতাংশ টাকা জমা রাখা হয়। নিয়মিত ২৫ বা ততোধিক বৎসর চাকরি করে অবসরে গেলে কল্যাণ + অবসর তহবিল থেকে সর্বশেষ মূল বেতনের প্রায় ১০০ গুন টাকা পাওয়ার বিধান বিদ্যমান। তবে তা পেতে অনেক বৎসর অপেক্ষা করতে হয়!
উল্লিখিত সরকারি সুবিধার অতিরিক্ত কোন সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব স্বচ্ছলতা ও বিধি-বিধানের উপর নির্ভরশীল। প্রতিষ্ঠান সচ্ছল হলে আরো কিছু সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। কিন্তু প্রতিষ্ঠান অসচ্ছল হলে সরকারি টাকার বাইরে উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই পাওয়া যায় না! এই ডিজিটাল যুগে নিজেকে তৈরি করতে জানলে এর চেয়ে অধিক উপার্জনের বহুমুখী সুযোগ দেশে ও বিদেশে অবারিত। বেসরকারি শিক্ষকদের বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা কতদিনে কতটুকু বৃদ্ধি পাবে তা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। কতবছরে কতটি প্রতিষ্ঠান সরকারি হবে তা আরো বেশি অনিশ্চিত। আমার দীর্ঘ অতীত অভিজ্ঞতা তাই বলে বারবার।
কেউ যদি ধারণা করেন, অন্যান্য চাকরির তুলনায় শিক্ষকতায় সময়, শ্রম ও মেধা কম দিতে হয় তো সেটি ভুল। শিক্ষকতায় কাজের পরিধি এখন অনেক বিস্তৃত। নিত্যনতুন বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সঠিক জ্ঞান দেওয়ার জন্য শিক্ষককে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হয় প্রতিনিয়ত। আয়ত্ত করতে হয় অত্যাধুনিক পাঠদান ও মূল্যায়ন কৌশল। আত্মনিবেদিত থাকতে হয় সর্বক্ষণ। বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদযাপনের জন্য ছুটির দিনেও আসতে হয় প্রতিষ্ঠানে। শিক্ষার্থীর কল্যাণার্থে চিন্তাচেতনার দিক থেকে প্রকৃত শিক্ষকের কোনো ছুটি নেই। এসবই করা চাই অত্যন্ত আগ্রহ ও আনন্দের সঙ্গে। শিক্ষকতা শিক্ষকের জন্য আনন্দদায়ক না হলে শিক্ষা লাভ শিক্ষার্থীদের জন্য আনন্দদায়ক হয় না, সফল হয় না। শিক্ষক হবার আগে অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে এসব।
মোট কথা হচ্ছে, সব দিক না জেনে, না বুঝে, শিক্ষকতায় এসে কেউ যদি হতাশায় ভোগেন তো তিনি নিজে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হন তেমনি শিক্ষার্থীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই সবকিছু জেনে বুঝে, মেনে নিয়ে, মনে নিয়ে, তবেই আসা উচিত শিক্ষকতায় বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকতায়। আমি বলতে চাচ্ছি, সবার শিক্ষক হওয়া উচিত নয়। যারা সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত, ভোগের চেয়ে ত্যাগে আনন্দিত, শিক্ষা অর্জনে ঐকান্তিক, শিক্ষাদানে উজ্জীবিত, মননশীল ও সৃষ্টিশীল, মহৎ চিন্তায় ও কাজে নিবেদিত, শিক্ষার্থীদের কল্যাণে নিরলস, শিক্ষার্থীদের মাঝে অমর হতে ইচ্ছুক তাদেরই হওয়া উচিত এদেশের শিক্ষক। তা না হলে এ মহৎ কাজে এসে সারাক্ষণ মন খারাপ করে, দাবিদাওয়া করে, আন্দোলন করে, দলাদলি করে, অন্যকে দোষারোপ করে, অন্যের সাথে নিজেকে তুলনা করে, বিক্ষুব্ধ বা হতাশাগ্রস্ত হয়ে নিজের পেশাকে মন্দ বলে বলে মন্দ সময় পার করে; না হওয়া যায় শিক্ষক, না পাওয়া যায় আনন্দ, না পাওয়া যায় শান্তি!<
লেখক: অধ্যক্ষ, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও কলামিস্ট
Email - rahamot21@gmail.com
পত্রিকার লিংক:
https://epaper.dainikbangla.com.bd/home/displaypage/news_2025-07-10_5_15_b
0 মন্তব্য(গুলি):