বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগে পুলিশ ভেরিফিকেশন [খোলা কাগজ, ১৩ আগস্ট ২০২১]

পত্রিকার লিংক 

বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগে পুলিশ ভেরিফিকেশন

[খোলা কাগজ, ১৩ আগস্ট ২০২১]

মো. রহমত উল্লাহ্

বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য প্রাথমিকভাবে সুপারিশপ্রাপ্ত ৩৮ হাজার ২৮৬ জন প্রার্থীর পুলিশ ভেরিফিকেশন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)। আগামী দুই মাসের মধ্যে পুলিশ ভেরিফিকেশন শেষ হওয়ার পরই চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত প্রার্থীদের তালিকা এনটিআরসিএর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে এবং চূড়ান্ত সুপারিশপত্র প্রদান করা হবে বলে জানা গেছে। চাকরিপ্রার্থীদের সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিয়োগ দেওয়ার জন্যই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশন এবারই প্রথম।  


সরকারি এমপিওভুক্ত, সম্ভাব্য এমপিওভুক্ত ও সম্ভাব্য সরকারিকৃত বিপুল সংখ্যক বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন প্রায় সকলেই। কেননা, যত বেশি পরীক্ষা নিয়ে ও যাচাইবাছাই করে নিয়োগ দেওয়া হবে ততোই বেসরকারি শিক্ষকদের মান ও সম্মান বৃদ্ধি পাবে। বেসরকারি শিক্ষকগণ বুক উঁচু করে বলতে পারবেন যে, আমাদের একাডেমিক রেজাল্ট ভালো, আমরা প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, ব্যবহারিক/ প্রায়োগিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, পুলিশ ভেরিফিকেশন ও ডোপ টেস্টে উত্তীর্ণ। যেহেতু সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই-বাছাইয়ে আমরা উত্তীর্ণ সেহেতু অধিক বেতন-ভাতা পাওয়ার যোগ্যতা আমাদের আছে, সত্যায়িত করার যোগ্যতা আমাদের আছে, সরকারি হবার যোগ্যতা আমাদের আছে, গেজেটভুক্ত হবার যোগ্যতা আমাদের আছে। কারুর চাইতে কোন অংশে আমরা কম নই। যারা শিক্ষার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে বেসরকারি শিক্ষকগণের মান-সম্মান ও বেতন-ভাতা  বৃদ্ধির পক্ষে তারা সবাই এমন ভাববেন এটাই স্বাভাবিক। 


বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনের এই উদ্যোগের যারা সমালোচনা করছেন তারা হয়ত বুঝতেই পারছেন না পুলিশ ভেরিফিকেশন কী এবং কেন তা প্রয়োজন। 'সাধারণত সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্বশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, পাসপোর্ট প্রাপ্তি, বিভিন্ন ধরণের লাইসেন্স প্রাপ্তি, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা (কেপিআই) ব্যবহার, ইত্যাদি ক্ষেত্রে আবেদনকারী কর্তৃক প্রদত্ত তথ্যাদি সঠিক আছে কিনা তা পুলিশ কর্তৃক যাচাই করাকে ভেরিফিকেশন বা সত্যতা প্রতিপাদন বলে। ভেরিফিকেশনকালে প্রার্থীর প্রদত্ত তথ্যাদির সত্যতা যাচাইয়ের পাশাপাশি প্রার্থীর চারিত্রিক ও সামাজিক অবস্থান সম্পর্কেও তথ্য নেয়া হয়।' 


পুলিশ ভেরিফিকেশন কালে যে সকল বিষয়ে তদন্ত করা হয় সেগুলো হচ্ছে:

১। প্রার্থীর পুরো নাম। 

২। প্রার্থীর জাতীয়তা।

৩। প্রার্থীর পিতার পুরো নাম ও জাতীয়তা।

৪। প্রার্থীর স্থায়ী ঠিকানা (বাড়ির দলিলের কপি বা বিদ্যুৎ বিল/গ্যাস বিল/ওয়াসার বিল/টেলিফোন বিল, ইত্যাদির কপি)।

৫। প্রার্থীর বর্তমান বাসস্থলের ঠিকানা। 

৬। প্রার্থীর বৈবাহিক অবস্থা। 

৭। প্রার্থী বিগত ৫ (পাঁচ) বছর যেসব ঠিকানায় অবস্থান করেছেন সেগুলোর ঠিকানা। 

৮। প্রার্থীর জন্ম তারিখ (মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট বা সমমানের পরীক্ষার সার্টিফিকেট বা জন্ম সনদ)। 

৯। প্রার্থীর জন্মস্থান (গ্রাম, ইউনিয়ন, থানা/উপজেলা, জেলা ইত্যাদি)। 

১০। প্রার্থীর ১৫ (পনের) বছর বয়স হতে যেসকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, ইত্যাদি) অধ্যয়ন করেছেন সেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তথ্য।

১১। প্রার্থী যদি কোনো সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত, আধা-স্বায়ত্বশাসিত, স্থানীয় সরকারের কোনো সংস্থা বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পূর্বে চাকুরি করে থাকেন বা বর্তমানে কর্মরত থেকে থাকেন, সেগুলোর তথ্য।

১২। প্রার্থী মুক্তিযোদ্ধার পুত্র/কন্যা/নাতি/নাতনি কিনা?

১৩। প্রার্থী অন্য কোনো কোটাধারী কিনা?

১৪। প্রার্থীর কোনো ধরণের প্রতিবন্ধীতা আছে কিনা?

১৫। প্রার্থী ফৌজদারি, রাজনৈতিক, বা অন্য কোনো মামলায় অভিযুক্ত, গ্রেফতার, বা দন্ডিত এবং নজরবন্দি বা কোনো বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা হতে বহিঃষ্কার হয়ে থাকলে তার তথ্য।

১৬। প্রার্থীর নিকট আত্বিয়-স্বজন (পিতা, মাতা, ভাই, বোন, আপন মামা, চাচা, খালু, ইত্যাতি বা শশুরের দিকের অনুরূপ কোনো নিকট আত্বিয়) বাংলাদেশ সরকারের কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানে চাকুরিরত থাকলে সেগুলোর তথ্য।

১৭। প্রার্থী কোনো মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বা নৈতিক স্খলনের রেকর্ড রয়েছে কিনা?

১৮। প্রার্থী ইতোপূর্বে কোনো সরকারি চাকুরি থেকে বরখাস্ত হয়েছেন কিনা?

১৯। প্রার্থী কোনো রাষ্ট্রদ্রোহী বা নাশকতামূলক কর্যকলাপে জড়িত আছেন/ছিলেন কিনা?

২০। প্রার্থীর চারিত্রিক ও সামাজিক অবস্থান।

২১। এছাড়াও আবেদনের ধরণ অনুযায়ী প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় অন্য যেকোনো বিষয়ে তদন্ত হতে পারে।

[সূত্র: বাংলাদেশ পুলিশ’র ফেইসবুক পেইজ]

সকল চাকরিজীবীর এ সকল তথ্যের সত্যতা কর্তৃপক্ষের কাছে নিশ্চিত থাকা উচিত। এমনকি আমার ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। একজন ভালো লোক চাকরি প্রার্থী হলে ও ভালো পুলিশ তদন্তকারী হলে নিশ্চয়ই উল্লিখিত তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে কারো কোন আপত্তি থাকার কথা নয় এবং পুলিশ ভেরিফিকেশনের বিরোধিতা করার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে যদি এমন হয় যে, ভালো লোক অবৈধ টাকা না দিলে মন্দ রিপোর্ট পান আর মন্দ লোক অবৈধ টাকা দিলে ভালো রিপোর্ট পান অথবা ভালো/মন্দ সবাই টাকা দিলে ভালো রিপোর্ট পেয়ে যান তো বিতর্কিত হবে এই কার্যক্রম, ব্যহত হবে এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য। এক্ষেত্রে শিক্ষক নিয়োগের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য অবশ্যই শতভাগ স্বচ্ছ হওয়া উচিত পুলিশ ভেরিফিকেশন। কোনভাবেই অতিক্রান্ত হওয়া উচিত নয় নির্ধারিত সময়। তদন্তকারী কর্মকর্তাকে হতে হবে অত্যন্ত সৎ, যোগ্য, নিরপেক্ষ, আইসিটি জ্ঞানসম্পন্ন, দায়িত্বশীল, দেশপ্রেমিক। বিশেষ করে আইসিটি জ্ঞান না থাকলে বর্তমান ডিজিটাল যুগের একজন মানুষের অনলাইন একটিভিটিস   সম্পর্কে তদন্তকারী কর্মকর্তা কিছুই জানতে পারবেন না! আশা করি এসকল বিষয়ে  সজাগ দৃষ্টি রাখবেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। যেন এই পুলিশ ভেরিফিকেশনের মধ্য দিয়ে সঠিক তথ্য প্রদানকারী সকল ভাল লোক শিক্ষক হতে পারেন এবং মিথ্যা তথ্য প্রদানকারী কোন মন্দলোক শিক্ষক হতে না পারেন। সেইসাথে যুক্ত করা উচিত ডোপ টেস্টের ফলাফল। কোন মাদকাসক্ত ব্যক্তির শিক্ষক হবার সুযোগ যেন না থাকে। এমনকি আমাকেও আনা উচিত এই ডোপ টেস্টের আওতায়। মাদকাসক্ত হলে আমিও যেন থাকতে না পারি শিক্ষকতায়। অবশ্যই সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই-বাছাই হতে হবে অত্যন্ত সচ্ছ, নিরপেক্ষ, অবিতর্কিত এবং হয়রানিমুক্ত। 


কোন ভালো প্রার্থী হয়রানির শিকার হলে থাকতে হবে তার সহজে প্রতিকার পাওয়ার ব্যবস্থা। জানা যায়, 'পুলিশ ভেরিফিকেশন চলাকালে প্রার্থী যদি তদন্তকারী কর্মকর্তা কর্তৃক কোনো প্রকার হয়রানির শিকার হন, সেক্ষেত্রে ঐ তদন্তকারী কর্মকর্তার সরাসরি নিয়ন্ত্রনকারী কর্মকর্তার নিকট অথবা বিশেষ পুলিশ সুপার (ভিআর) বা অতিরিক্ত আইজিপি, স্পেশাল ব্রাঞ্চ, বাংলাদেশ পুলিশ, রাজারবাগ, ঢাকা বরাবর লিখিত বা মৌখিক অভিযোগ জানাতে পারেন।' এসকল ব্যবস্থার পাশাপাশি অনলাইনে অভিযোগ করার সহজ ব্যবস্থা প্রকাশিত থাকা উচিত। সেই অভিযোগের একটা কপি যেন অনলাইনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোন দপ্তরে প্রেরণ করার সুযোগ থাকে তেমন ব্যবস্থাও রাখা উচিত। এ ব্যাপারে সকল গণমাধ্যম ও জনপ্রতিনিধিদের স্বচ্ছ সহযোগিতা একান্ত আবশ্যক। যেন কোনভাবেই সম্ভাব্য শিক্ষকদের ঘুষ দিয়ে শুরু করতে না হয় শিক্ষকতা জীবন। 


মো. রহমত উল্লাহ্

সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক 

Email - rahamot21@gmail.com


23 July 2021




Previous Post
Next Post

About Author

0 মন্তব্য(গুলি):