এসাইনমেন্টে শিক্ষা : কী করছি আমরা? খোলা কাগজ, ০২ আগস্ট ২০২১

পত্রিকার লিংক  

এসাইনমেন্টের মাধ্যমে শিক্ষা:

কী করতে গিয়ে কী করছি আমরা? 

খোলা কাগজ > ০২ আগস্ট ২০২১

মো. রহমত উল্লাহ্


করোনাকালীন শিক্ষায় এসাইনমেন্টের গুরুত্ব অপরিসীম। যেহেতু মৃত্যু ঝুঁকির কারণে সম্ভব হচ্ছে না সরাসরি পাঠদান; পর্যাপ্ত ডিভাইস, ইন্টারনেট ও প্রশিক্ষণ না থাকায় সম্ভব হচ্ছেনা সম্পূর্ণভাবে অনলাইন পাঠদান ও মূল্যায়ন; সেহেতু ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য এসাইনমেন্টকেই মনে করা হচ্ছে উত্তম ব্যবস্থা। প্রথমত এসাইনমেন্ট দ্বারা শিক্ষা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে এবং দ্বিতীয়ত এসাইনমেন্ট মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষা মূল্যায়নের চেষ্টা করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা যাতে প্রতিটি এসাইনমেন্ট সংশ্লিষ্ট চেপ্টার ভালোভাবে পড়ে, বুঝে, স্টাডি করে লিখতে পারে সেজন্য দেওয়া হচ্ছে এক সপ্তাহ সময়। শিক্ষকগণের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে এসাইনমেন্ট (প্রশ্ন-উত্তর প্রবন্ধ-নিবন্ধ, গণিত-বিজ্ঞান ইত্যাদি) লেখার কলাকৌশল। শিক্ষকগণকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে এসাইনমেন্ট মূল্যায়নের বিভিন্ন মানদন্ড এবং বাতলে দেওয়া হয়েছে মূল্যায়নের ও শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়নের বিভিন্ন উপায়। এক্ষেত্রে শিক্ষকগণের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 


এসাইনমেন্ট/Assignment এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে duty, job, task ইত্যাদি। শুধু লেখার কাজটি এসাইনমেন্ট নয়; স্টাডি করা, জ্ঞান অর্জন করা, তথ্য সংগ্রহ করা, তথ্য উপস্থাপনের কৌশল উদ্ভাবন করা ইত্যাদি কাজের মাধ্যমে নির্ধারিত বিষয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষা লাভ করাই মূলত এসাইনমেন্ট। লেখার কাজটি হচ্ছে এই এসাইনমেন্টের বা নির্ধারিত কর্মসমূহের সুন্দর পরিবেশনা। এসাইনমেন্ট এর জন্য স্টাডি করা হচ্ছে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা এবং সেই এসাইনমেন্ট লিখিতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে পরীক্ষার উত্তরপত্র তৈরি করা। এই দুটো কাজই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হয়, যদি সরাসরি পরীক্ষা গ্রহণ সম্ভব না হয়, তাহলে হয়তো এই এসাইনমেন্টের মাধ্যমেই নির্ধারিত হবে পরীক্ষার ফলাফল তথা শিক্ষা মূল্যায়ন। অর্থাৎ শিক্ষা ও সনদ এ দুটোই লাভ করতে হবে এই নির্দিষ্ট কাজের বা এসাইনমেন্টের মাধ্যমে।


অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই এসাইনমেন্ট কার্যক্রম সম্পর্কে ফেসবুকে বিভিন্ন মন্তব্য দেখে খুবই বিচলিত হয়েছি আমি। একটি সরকারি কলেজের প্রভাষক ডক্টর আনিসুর রহমান লিখেছেন, "বাংলাদেশের লেখাপড়া যেমন শেষ করে দিয়েছে বাজারের নোট বই, তেমনি চমৎকার এসাইনমেন্ট পদ্ধতি শেষ করে দিচ্ছে ইউটিউব  নোট, শিক্ষকদের নিরুৎসাহ, শিক্ষার্থীদের পরনির্ভরতা ইত্যাদি।  কবে আমরা মানব হব!" মোতালিব হোসেন নামে একজন লিখেছেন, "যে এসাইনমেন্ট দেওয়া হচ্ছে, তার সব সমাধান ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। প্রায় সকল শিক্ষার্থীই তা দেখে লিখে। এতে যে কতটা উপকার হয়েছে সেটা সবাই জানি। যদি শিক্ষাবোর্ড গুলো এসাইনমেন্ট এর একটা ফরমেট করে দিতেন,  আর শিক্ষকরা এসাইনমেন্ট এর শিরোনাম / বিষয় নির্ধারণ করে দিতেন তাহলে এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যেত। বর্তমানের এস্যাইনেন্ট যে কতটা কার্যকরী(!!!) তা সবাই বুঝতেছে।" মোখলেছুর রহমান স্বপন নামে একজন লিখেছেন, "কথা ঠিক। কিন্তু সারাদেশে একই রকম এ্যাসাইনমেন্ট হওয়ার কারণে উত্তর গুলো ইউটিউবে পাওয়া যায়। ফলে শিক্ষার্থী তা দেখে হুবহু লিখে ফেলে।" বস্তুত এমন কিছু মন্তব্যের কারণেই এই লেখাটির তাগিদ অনুভব করেছি আমি। 


আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এই এসাইনমেন্ট ব্যবস্থাটি হচ্ছে সকল বিকল্পের  মধ্যে মন্দের ভালো। এই ব্যবস্থাটি যদি অকার্যকর হয়ে যায় তাহলে আর অবশিষ্ট তেমন কিছুই থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। মন্তব্যকারীদের সমালোচনায় যে বাস্তব চিত্র উঠে এসেছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। বর্তমানে অনেক শিক্ষার্থীর হাতে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট কানেকশন বিদ্যমান। প্রায় সবার হাতের কাছেই ইন্টারনেট কানেক্টেড কম্পিউটারের দোকান। অধিকাংশ অভিভাবক জানেন না, বুঝেন না, মোবাইল ফোনে কী করছে তার সন্তান! তারা জানেন, তার সন্তান এখন মোবাইল ফোনে লেখাপড়া করছে। ইন্টারনেট কানেক্টেড কম্পিউটারের দোকান থেকে আরও ভালো লেখাপড়া নিয়ে আসছে। কিছু অভিভাবক আছেন জীবন-জীবিকা নিয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত। আর কিছু অভিভাবক আছেন যারা টেলিভিশন ছাড়া আর কিছুই দেখেন না! তাই শিক্ষার্থীদের হাতে এখন অবাধ সুযোগ। 


যেহেতু নির্ধারিত ক্লাসের সারাদেশের শিক্ষার্থীর জন্য একই এসাইনমেন্ট প্রায় একসপ্তাহ আগে প্রকাশ করা হয় সেহেতু সেই এসাইনমেন্টের রেডি পেপার (সলুশন) ইন্টারনেটে বা কম্পিউটারের দোকানে পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। সারা দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী সেই রেডি পেপার কপি করাটাও অস্বাভাবিক নয়! তাছাড়া প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের একই ক্লাসের শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরস্পরের যোগাযোগ বিদ্যমান। একজন শিক্ষার্থী সলুশন পেয়ে গেলে বা তৈরি করতে সক্ষম হলে অন্যরা তা পেয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। যে ক'জন অভিভাবক নিয়মিত সন্তানের খোঁজখবর রাখেন তাদের মধ্যে কত সংখ্যক আছেন যারা এসাইনমেন্ট কপি করার এই সুযোগ থেকে নিজের সন্তানকে বিরত রাখতে পারবেন বা রাখবেন? আমরা যতই উপদেশ দিই না কেনো, এই পরীক্ষা ও সনদ নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থায় কতটুকু সততা বজায় রাখবে এই অপ্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীরা? একই ক্লাসের সব শিক্ষার্থী একই রকম কপি জমা দিলে কি-ই বা করতে পারবেন শিক্ষকগণ? এসাইনমেন্ট উপস্থাপনার মান ঠিক থাকলে নম্বর না দিয়ে পারবেন কি কোন শিক্ষক? একই এসাইনমেন্ট বারবার করতে বলা হলে শিক্ষার্থীরা তো তা করবেও না, জমাও দিবে না! তখন উপায় কী? 


উল্লিখিত বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে, কী করতে গিয়ে কী করছি আমরা! শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট কার্যক্রম বিশ্বস্বীকৃত একটি ভালো ব্যবস্থা। শিশু শিক্ষার্থীদের জন্য এটি মূলত বাড়ির কাজ বা হোম ওয়ার্ক। সেই ভালো কাজটি ভালোভাবে হচ্ছে কিনা, সেই ভালো কাজের ভালো উদ্দেশ্যগুলো সফল হচ্ছে কিনা, ইত্যাদি ভেবে দেখা প্রয়োজন! এসাইনমেন্ট করতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা যদি স্টাডি না করে তাহলে এসাইনমেন্ট দ্বারা শিক্ষা নিশ্চিত হয় না। শিক্ষার্থীরা যদি অন্যের এসাইনমেন্ট পেপার কপি করে তাহলে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা নিশ্চিত হয় না। শিক্ষকগণ যদি এসাইনমেন্ট মূল্যায়ন করতে গিয়ে অলসতা করেন, দায়িত্বে অবহেলা করেন, নিরপেক্ষতা ভঙ্গ করেন তাহলে শিক্ষা মূল্যায়ন সঠিক হয় না। আমাদের বর্তমান এসাইনমেন্ট  কার্যক্রমের বাস্তবতায় এমন সকল অশুভ সম্ভাবনাই বিদ্যমান! 


এমনিতেই শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা থেকে অনেক বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে।  তার উপরে যদি কপি করে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে তাহলে সেটি হবে আমাদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতির কারণ। উঠতি বয়সের এই শিক্ষার্থীরা কপি করতে করতে ধ্বংস করে ফেলবে নিজেদের সৃজনশীলতা। আর কোনোদিন তারা হয়ে উঠবে না সৃজনশীল, নিজে থেকে কখনোই লিখতে পারবে না কিছুই। স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু হলেও তাদের অনেকেই আর ফিরে আসতে পারবে না সৃজনশীলতায়। সকল মূল্যায়ন  পরীক্ষায় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে নকল প্রবণতা। এমনকি কর্মজীবনে যেয়েও অধিকাংশরা পরিণত হবে মাছিমারা কেরানিতে। এ সকল অশুভ সম্ভাবনার গলিতে দাঁড়িয়ে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগে যে, এসাইনমেন্ট  কার্যক্রম করতে গিয়ে আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের 'মধু কই কই বিষ' খাওয়াচ্ছি কিনা এবং তৃপ্তির ঢেকুর তোলার চেষ্টা করছি কিনা? 


এটি নিশ্চিত যে সরাসরি পাঠদান ও পরীক্ষা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। এর বিকল্প হিসেবে যাই করা হোক না কেনো সবই হয় মন্দ, নয় মন্দের ভালো। মহামারী করোনা পরিস্থিতিতে সকল বিকল্প বিবেচনায় আমি নিজেও এসাইনমেন্টের পক্ষে অনেক কথা লিখেছি ও বলেছি। কিন্তু এসাইনমেন্ট করতে গিয়ে যদি উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয় তাহলে অবশ্যই তা পুনর্বিবেচনা করা উচিত। সারা বাংলাদেশের এসাইনমেন্টের শিরোনামগুলো কেন্দ্র থেকে নির্ধারণ ও প্রকাশ না করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক বিষয় শিক্ষকগণের দ্বারা নির্ধারণ ও বিতরণ করা হলে এসাইনমেন্টগুলো জাতীয়ভাবে কপি বা নকল হওয়ার সুযোগ থাকবে না। শিক্ষকগণকে চেপ্টার নির্ধারণ করে কিছু গাইডলাইন দিয়ে দিলে নিশ্চয়ই তারা সেভাবে শিক্ষার্থীদের পড়িয়ে এসাইনমেন্ট এর শিরোনাম নিজের মতো করে নির্ধারণ ও বিতরণ করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে শিক্ষকদের দক্ষতা ও জবাবদিহিতা আরো বৃদ্ধি পাবে। প্রতিষ্ঠানভিত্তিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে কিছু আদান-প্রদান হবার সম্ভাবনা থাকলেও এসাইনমেন্ট করা ও জমা দেওয়া জন্য অতি অল্প সময় বেঁধে দিয়ে শিক্ষকগণ তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে পারবেন। তখন কপি বা নকল হবার সুযোগ ও সম্ভাবনা অনেকাংশেই কমে যাবে। আমার প্রস্তাবিত এই ব্যবস্থায় শিক্ষকগণ যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পাদন করেন তাহলে অবশ্যই বৃদ্ধি পাবে এসাইনমেন্ট কার্যক্রমের সুফল। 


এসাইনমেন্ট কার্যক্রমকে অতি গুরুত্ব দিতে গিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষাসমূহ বাতিল করে শিক্ষার্থীদের কল্যাণ কতটা হ্রাস/বৃদ্ধি পেয়েছে তাও বিবেচনা করা উচিত। প্রতিষ্ঠানভিত্তিক অনলাইনে সিটি ও অন্যান্য পরীক্ষা চালু থাকলে শিক্ষার্থীদের ক্লাসের যোগদান বৃদ্ধি পায়, লেখাপড়ায় আগ্রহ বৃদ্ধি পায়, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়, শিক্ষকগণ বেশি একটিভ থাকেন, শিক্ষার্থীরা অধিক লাভবান হয়। পরীক্ষা বিষয়টিকে শিক্ষার্থী ও অভিভাবক উভয়ই গুরুত্ব দেয়। ফলে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় টিউশন ফি আদায়ের ক্ষেত্রে এটি সহায়ক ভূমিকা রাখে। শিক্ষকগণের জীবনধারণের জন্য এটিও কিন্তু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার ফি আদায় করা/কম করা/না করা নিয়ে বিধি-নিষেধ আরোপ করা যেতে পারে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানভিত্তিক অনলাইন পরীক্ষাসমূহ চালু রাখা আবশ্যক। 


উন্নত বিশ্বে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক শিক্ষা প্রদান, শিক্ষা মূল্যায়ন ও সনদ প্রদান স্বীকৃত ব্যবস্থা। অনেক বাস্তব কারণে আমাদের দেশে সেই রকম ব্যবস্থা এখনও পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু এই কোভিড পরিস্থিতিতে সামান্য বাস্তবায়ন না করে উপায় নেই। এই যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে পাঠদান করছেন এটি কিন্তু যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। তাই আমি মনে করি সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহিতার মধ্যে রেখে প্রাতিষ্ঠানিক  ব্যবস্থাপনায় ক্লাসসমূহ পরিচালনা, এসাইনমেন্ট কার্যক্রম পরিচালনা ও অভ্যন্তরীণ  পরীক্ষা পরিচালনা করা হলে এই করোনা পরিস্থিতিতে কিছুটা হলেও অধিক সফল হবে আমাদের সন্তানদের শিক্ষা। 


মো. রহমত উল্লাহ্

প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ এবং অধ্যক্ষ - কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।



Previous Post
Next Post

About Author

0 মন্তব্য(গুলি):