বেসরকারি শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন, Jagonews24.com, 18 August 2021

পত্রিকার লিংক

বেসরকারি শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন

Jagonews24.com, 18 August 2021

মো. রহমত উল্লাহ্

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকগণ বদলির দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে সোচ্চার। বিশেষ করে এনটিআরসি'র সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে দূর-দূরান্তে নিয়োগ নিয়ে কর্মরত শিক্ষকগণের বদলির দাবি সর্বাধিক উচ্চারিত। বাস্তবে নিবন্ধন এবং অনিবন্ধিত উভয় প্রকার ইনডেক্সধারী  শিক্ষকের ক্ষেত্রেই বদলি অত্যাবশ্যক।  এই দাবিটি তাদের প্রয়োজনের দিক থেকে খুবই মানবিক ও যৌক্তিক। চাকরিতে বদলির সুযোগ একদিকে কর্মীর অধিকার, অপরদিকে কর্তৃপক্ষের হাতিয়ার। সুযোগ থাকলে যেমন কর্মী উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে তার পছন্দমতো স্থানে বা দপ্তরে যেতে পারেন, তেমনি কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে বা শাস্তিসরূপ কর্মীকে অন্যত্র বদলি করতে পারে। এই ব্যবস্থাটি বিশ্বস্বীকৃত। যা একই প্রতিষ্ঠানে/ সংস্থায়/ ব্যাংকে/ এনজিওতে কর্মরত বিভিন্ন দপ্তর ও শাখার কর্মীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।


অপরিকল্পিতভাবে দীর্ঘদিনে গড়ে উঠা ও বেড়ে চলা আমাদের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের শিক্ষকদের ক্ষেত্রে এখনই তেমন সার্বজনীন বদলির সুযোগ দেওয়া খুবই কঠিন। এর অনেকগুলো কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- একটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য একটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি সম্পূর্ণ আলাদা। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীদের নিয়োগ, বেতনভাতা, পদোন্নতি, শাস্তি ইত্যাদি প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ আলাদা। এমনকি সরকারি বেতনভাতাও আলাদা কমিটির মাধ্যমেই প্রদান করা হয়ে থাকে।  


এমতাবস্থায় নতুন আইন ও নীতিমালা প্রবর্তন ব্যতীত বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি বাস্তবায়ন করা অসম্ভব। সম্ভবত এ কারণেই বেসরকারি শিক্ষকদের বদলির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এমপিও নীতিমালায় এমনকি উচ্চ আদালতেও 'বদলি' শব্দটির স্থলে 'প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন' কথাগুলো ব্যবহার করা হয়। আমাদের জোরালো দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তারা নীতিমালা প্রণয়ন করে বদলির বা প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের ব্যবস্থা করার কথা বলে থাকেন। সরাসরি বদলির আদেশ দেন না বা দিতে পারেন না। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দীর্ঘ দিনেও হচ্ছে না সেই নীতিমালা প্রণয়ন, হচ্ছে না আমাদের বদলির ব্যবস্থা। এই আন্দোলনে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি বারবার! আমার জানা মতে বদলি প্রত্যাশীরাও  সর্বজন গৃহীত একটি সুষ্ঠু নীতিমালা উপস্থাপন করতে পারেননি আজ অবধি।  আমাদের সেই কাঙ্খিত নীতিমালা কতদিনে হবে, কী রকম হবে, কোন শিক্ষক কিভাবে বদলির সুযোগ পাবেন তা সম্পূর্ণই অনিশ্চিত! 


বেসরকারি শিক্ষকদের বদলির বা প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তাই বারবার উত্থাপন করতে হবে বদলির দাবি এবং সেইসাথে নিতে হবে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের বিদ্যমান সুযোগ। এমপিও নীতিমালা ২০২১ অনুসারে নিবন্ধনধারী এমপিওভুক্ত বা এমপিও বহির্ভূত  শিক্ষকগণ অন্য প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পাওয়ার জন্য আবেদন করার সুযোগ পাবেন। এনটিআরসিএ কর্তৃক প্রকাশিত ৩য় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ২০২১ এও সেই সুযোগ রাখা হয়েছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের খুব বেশি সুযোগ পাননি বিদ্যমান শিক্ষকগণ। কেননা, নতুন শিক্ষক পদপ্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়েছে বিদ্যমান অভিজ্ঞ শিক্ষকদের পূর্বের নিবন্ধন পরীক্ষার নম্বরপত্র দিয়ে। এক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার কোন নম্বর পাননি বিদ্যমান শিক্ষকগণ! মোটেও যুক্তিযুক্ত নয় এ সকল বিষয়।



এদিকে জানা গেছে, তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে সুপারিশপ্রাপ্তদের চূড়ান্ত নিয়োগ শেষে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে শূন্যপদের চাহিদা সংগ্রহ করা হবে এবং মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষক নিয়োগের জন্য চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে। এমপিও নীতিমালা অনুসারে আসন্ন চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতেও নিশ্চয়ই নিবন্ধনধারী এমপিওভুক্ত ও এমপিও বহির্ভূত শিক্ষকদের আবেদন করার সুযোগ দেওয়া হবে অন্য প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ লাভের জন্য। 


একজন বিদ্যমান শিক্ষককে যদি বদলির লক্ষ্যে অন্য প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ নেওয়ার জন্য আবেদন করতে হয়; নিয়োগ পেলে এমপিও ট্রানস্ফার/বদলি করার সুযোগ দেওয়া হয়; এমপিও ট্রানস্ফার/বদলি হলে পূর্ব অভিজ্ঞতা গণনা করা হয়; তাহলে তিনি কেন চাকরিপ্রার্থী তথা সম্ভাব্য শিক্ষকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবেন? তিনি তো নতুন করে চাকরি চাচ্ছেন না, প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করতে চাচ্ছেন। তিনি তো শিক্ষক হয়েই আছেন। তিনি চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে আবেদন করবেন কেন? যদি আবেদন করতেই হয় তো প্রতিযোগিতায় তাঁর পূর্ব অভিজ্ঞতা গণনা ও মূল্যায়ন করা হবে না কেন? যেহেতু সুষ্ঠু নীতিমালার অভাবে বদলি বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না সেহেতু বিদ্যমান শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনকে অগ্রাধিকার দেওয়াই অধিক যুক্তিযুক্ত ও ন্যায় সঙ্গত নয় কি? 


সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, নতুন শিক্ষক নিয়োগের জন্য প্রতিবার বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার আগে বিদ্যমান শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের একটা সুযোগ দেওয়া উচিত। প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের এই সুযোগ পাওয়া বিদ্যমান শিক্ষকগণের অধিকার। বিদ্যমান শিক্ষকগণ প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করতে গিয়ে চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবেন এটি মোটেও সম্মানজনক নয়, উচিত নয়।  একজন বিদ্যমান শিক্ষক প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করতে গিয়ে সম্ভাব্য শিক্ষকদের সাথে প্রতিযোগিতায় হেরে গেলে প্রতিষ্ঠানে তার সম্মানহানি ঘটে। সে মর্মাহত হয় ও বিষণ্ণতায় ভোগে! 



এমতাবস্থায় বিদ্যমান নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত উভয় প্রকার এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনকে অগ্রাধিকার দেওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান শূন্য আসনে নতুন নিয়োগের পূর্বে সেচ্ছায় বদলির আবেদন চেয়ে এনটিআরসিএ প্রয়োজনমত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে পারে। বিজ্ঞপ্তি অনুসারে সমজাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সমপদে ও একই বিষয়ে কর্মরত সমঅভিজ্ঞ ইন্ডেক্সধারী আগ্রহী শিক্ষকদের যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অনলাইনে চয়েজ দিয়ে আবেদন করার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। একই প্রতিষ্ঠানের একই বিষয়ে ও পদে একাধিক আবেদনকারীর মধ্যে  শিক্ষাগত যোগ্যতা, আইসিটি জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা,  প্রশিক্ষণ, গবেষণা, প্রকাশনা, চারিত্রিক গুণাবলি, সহশিক্ষা ইত্যাদি (জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচনের নীতি অনুসারে) এরসাথে দূরত্ব বা জেলা ও উপজেলা কোটা বিবেচনা করে অধিক পয়েন্ট প্রাপ্ত শিক্ষককে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বদলির বা প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। 



এভাবে বদলি কার্যকর হবার পর যেসকল প্রতিষ্ঠানে শূন্য পদ সৃষ্টি হবে সেগুলোতে বিধিমোতাবেক নতুন নিয়োগ প্রদান করা হলে হ্রাস পাবে শূন্য পদ নির্ধারণের জটিলতা। কিছুটা হলেও লাঘব হবে বদলি প্রত্যাশী শিক্ষকগণের কষ্ট ও অসন্তোষ! বেসরকারি শিক্ষকদের যে পরিমাণ বেতন-ভাতা দেওয়া হয় তাতে নিজ বাড়ি থেকে দূর-দূরান্তে অবস্থান করে জীবনধারণ করা মোটেও সম্ভব নয়!  বদলি বা প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক শিক্ষকের জীবনে যদি সামান্যতম স্বস্তি বৃদ্ধি করা যায় তো অবশ্যই কিছুটা বৃদ্ধি পাবে সার্বিক শিক্ষার মান। এনটিআরসিএ সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলো বিশেষভাবে বিবেচনা করবেন আশা করি।



মো. রহমত উল্লাহ্

সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক। Email -  rahamot21@gmail.com  


অধ্যক্ষ - কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা।



দুই ভাগে হোক বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ, প্রথম আলো > ১৪ আগস্ট ২০২১

পত্রিকার লিংক 

পরামর্শ

দুই ভাগে হোক বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ

মো. রহমত উল্লাহ্

প্রথম আলো > ১৪ আগস্ট ২০২১


বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের তৃতীয় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে প্রত্যাশা ছিল অনেক। দীর্ঘদিন পর চাকরি পাবেন অনেক বেকার, পূর্ণ হবে প্রতিষ্ঠানের অনেক শূন্য পদ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হতাশায় পর্যবসিত হয়েছে সেই প্রত্যাশা। অর্ধলাখ শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে আশায় বুক বেঁধেছিলেন অনেক নিবন্ধনধারী প্রার্থী। কিন্তু অর্ধেকও পূর্ণ হয়নি তাঁদের সেই আশা। তাঁদের অভিযোগ হচ্ছে, বিদ্যমান এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পুনর্নিয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ দেওয়ার কারণে নিয়োগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন নতুন প্রার্থীরা। অপর দিকে বিদ্যমান এমপিওভুক্ত নিবন্ধনধারী শিক্ষকগণের অভিযোগ হচ্ছে, তাঁদের সঙ্গে নতুন প্রার্থীদের আবেদন করার সুযোগ দেওয়ার কারণে তাঁরা অনেকেই পুনর্নিয়োগ পাননি বিধায় যেতে পারেননি কাঙ্ক্ষিত প্রতিষ্ঠানে। তাঁরা বঞ্চিত হয়েছেন পরোক্ষ বদলির এই সুযোগ থেকে। ক্ষতির শিকার হয়েছেন উভয় পক্ষই। অপর দিকে শূন্য পদ পূর্ণ না হওয়ায় ক্ষতির শিকার হয়েছে প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ সংঘটিত হয়েছে ত্রিমুখী ক্ষতি!


এনটিআরসিএর তৃতীয় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুসারে ৮৯ লাখ আবেদন জমা পড়েছিল। নিয়োগ সুপারিশ পাওয়ার কথা ছিল ৫১ হাজার ৭৬১ জনের। কিন্তু নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে ৩৮ হাজার ২৮৬ জনকে। নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা যায়নি ১৫ হাজার ৩২৫ জনকে। এনটিআরসিএ জানায়, নারী কোটায় প্রার্থী না পাওয়ায় ৬ হাজার ৭৭৭ জনকে সুপারিশ করা যায়নি এবং আবেদন না পাওয়ায় ৮ হাজার ৪৪৮ জনকে সুপারিশ করা যায়নি। প্রার্থীদের অভিযোগ, সুপারিশপ্রাপ্ত ৩৮ হাজারের প্রায় অর্ধেক পদ ইনডেক্সধারীদের দখলে চলে গেছে। অর্থাৎ তাঁরা আগে থেকেই বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন এবং এমপিওভুক্ত আছেন। তাঁরা প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করেছেনমাত্র। এক প্রতিষ্ঠানের পদ শূন্য করে অন্য প্রতিষ্ঠানের শূন্য পদে নিয়োগ পেয়েছেন। মোট শূন্য পদ পূরণে কোনো ভূমিকা রাখেননি। ফলে এই বিশাল নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পরও শূন্য রয়েছে প্রায় ৫০ হাজার পদ, যা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়! প্রতিটি আবেদনের জন্য পৃথকভাবে ফি জমা দিয়ে একেকজন প্রার্থী ১০-২০টি আবেদন করেও নিয়োগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। আগামীতে হয়তো আবেদন করার বয়সই থাকবে না এদের অনেকের।


মূলত সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে একদিকে বিপুলসংখ্যক পদ শূন্য রয়েছে, অপর দিকে বিপুলসংখ্যক নতুন প্রার্থী নিয়োগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এরূপ অযৌক্তিক প্রক্রিয়া চলতে থাকলে বারবার তৈরি হবে এমন চিত্র! বারবার প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন থেকে বঞ্চিত হবেন অনেক শিক্ষক, বারবার নিয়োগ থেকে বঞ্চিত হবেন অনেক নতুন প্রার্থী, বারবার শূন্য থেকে যাবে অনেক অনেক পদ, প্রতিবারই অসন্তোষ বাড়তে থাকবে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের ওপর; যা কারও কাম্য হওয়া উচিত নয়। অথচ সামান্য সদিচ্ছা থাকলে এবং পরিকল্পনা করে এগুলে খুব সহজেই এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে বর্তমান নিয়োগ প্রক্রিয়াকে দুই ভাগে বিভক্ত করতে হবে। প্রতিবছর পৃথকভাবে সম্পাদন করতে হবে দুটি নিয়োগ প্রক্রিয়া। প্রথমে প্রদান করতে হবে শুধু এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পুনর্নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি। এ ক্ষেত্রে কোনো নতুন প্রার্থী আবেদন করতে পারবে না। কেবল বিদ্যমান এমপিওভুক্ত ও নিবন্ধিত শিক্ষকগণই আবেদন করতে পারবেন। এদের পুনর্নিয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন সম্পন্ন করার পরবর্তী শূন্য পদ চিহ্নিত করতে হবে। সেই শূন্য পদে নতুন প্রার্থীদের নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে কোনো এমপিওভুক্ত শিক্ষক আবেদন করতে পারবেন না। কেবল নিবন্ধিত ও ননএমপিও প্রার্থীগণ আবেদন করবেন। তাঁদের নিয়োগের মাধ্যমে বিদ্যমান শূন্য পদগুলো পূর্ণ করা সম্ভব হবে। এভাবে প্রতিবছর বিদ্যমান এমপিওভুক্ত নিবন্ধিত শিক্ষকদের পুনর্নিয়োগের জন্য একটি এবং ননএমপিও নিবন্ধিত শিক্ষকদের নতুন নিয়োগের জন্য একটি করে মোট দুটি নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হলে অবশ্যই অনেকাংশে সমাধান হবে এই সমস্যার।


মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশের বেসরকারি শিক্ষকদের বদলির দাবিটি তাঁদের প্রয়োজনের দিক থেকে খুবই মানবিক ও যৌক্তিক। এ কারণেই একাধিক এমপিও নীতিমালায় বদলির প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে একটি সুষ্ঠু নীতিমালা তৈরির মাধ্যমে বদলি বাস্তবায়ন করার জন্য বলা হয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত বদলি নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ শিক্ষকদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেওয়া উচিত। কেননা, তাঁরা আগে নিয়োগ পেয়েছেন এবং অনেক দিন ধরে কষ্ট করে দূরে চাকরি করছেন। কোনোভাবেই নতুন নিয়োগ প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামানো উচিত নয় বদলিপ্রত্যাশী বিদ্যমান এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের।


*মো. রহমত উল্লাহ্, শিক্ষক ও কলাম লেখক



বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগে পুলিশ ভেরিফিকেশন [খোলা কাগজ, ১৩ আগস্ট ২০২১]

পত্রিকার লিংক 

বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগে পুলিশ ভেরিফিকেশন

[খোলা কাগজ, ১৩ আগস্ট ২০২১]

মো. রহমত উল্লাহ্

বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য প্রাথমিকভাবে সুপারিশপ্রাপ্ত ৩৮ হাজার ২৮৬ জন প্রার্থীর পুলিশ ভেরিফিকেশন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)। আগামী দুই মাসের মধ্যে পুলিশ ভেরিফিকেশন শেষ হওয়ার পরই চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত প্রার্থীদের তালিকা এনটিআরসিএর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে এবং চূড়ান্ত সুপারিশপত্র প্রদান করা হবে বলে জানা গেছে। চাকরিপ্রার্থীদের সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিয়োগ দেওয়ার জন্যই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশন এবারই প্রথম।  


সরকারি এমপিওভুক্ত, সম্ভাব্য এমপিওভুক্ত ও সম্ভাব্য সরকারিকৃত বিপুল সংখ্যক বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন প্রায় সকলেই। কেননা, যত বেশি পরীক্ষা নিয়ে ও যাচাইবাছাই করে নিয়োগ দেওয়া হবে ততোই বেসরকারি শিক্ষকদের মান ও সম্মান বৃদ্ধি পাবে। বেসরকারি শিক্ষকগণ বুক উঁচু করে বলতে পারবেন যে, আমাদের একাডেমিক রেজাল্ট ভালো, আমরা প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, ব্যবহারিক/ প্রায়োগিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, পুলিশ ভেরিফিকেশন ও ডোপ টেস্টে উত্তীর্ণ। যেহেতু সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই-বাছাইয়ে আমরা উত্তীর্ণ সেহেতু অধিক বেতন-ভাতা পাওয়ার যোগ্যতা আমাদের আছে, সত্যায়িত করার যোগ্যতা আমাদের আছে, সরকারি হবার যোগ্যতা আমাদের আছে, গেজেটভুক্ত হবার যোগ্যতা আমাদের আছে। কারুর চাইতে কোন অংশে আমরা কম নই। যারা শিক্ষার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে বেসরকারি শিক্ষকগণের মান-সম্মান ও বেতন-ভাতা  বৃদ্ধির পক্ষে তারা সবাই এমন ভাববেন এটাই স্বাভাবিক। 


বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনের এই উদ্যোগের যারা সমালোচনা করছেন তারা হয়ত বুঝতেই পারছেন না পুলিশ ভেরিফিকেশন কী এবং কেন তা প্রয়োজন। 'সাধারণত সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্বশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, পাসপোর্ট প্রাপ্তি, বিভিন্ন ধরণের লাইসেন্স প্রাপ্তি, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা (কেপিআই) ব্যবহার, ইত্যাদি ক্ষেত্রে আবেদনকারী কর্তৃক প্রদত্ত তথ্যাদি সঠিক আছে কিনা তা পুলিশ কর্তৃক যাচাই করাকে ভেরিফিকেশন বা সত্যতা প্রতিপাদন বলে। ভেরিফিকেশনকালে প্রার্থীর প্রদত্ত তথ্যাদির সত্যতা যাচাইয়ের পাশাপাশি প্রার্থীর চারিত্রিক ও সামাজিক অবস্থান সম্পর্কেও তথ্য নেয়া হয়।' 


পুলিশ ভেরিফিকেশন কালে যে সকল বিষয়ে তদন্ত করা হয় সেগুলো হচ্ছে:

১। প্রার্থীর পুরো নাম। 

২। প্রার্থীর জাতীয়তা।

৩। প্রার্থীর পিতার পুরো নাম ও জাতীয়তা।

৪। প্রার্থীর স্থায়ী ঠিকানা (বাড়ির দলিলের কপি বা বিদ্যুৎ বিল/গ্যাস বিল/ওয়াসার বিল/টেলিফোন বিল, ইত্যাদির কপি)।

৫। প্রার্থীর বর্তমান বাসস্থলের ঠিকানা। 

৬। প্রার্থীর বৈবাহিক অবস্থা। 

৭। প্রার্থী বিগত ৫ (পাঁচ) বছর যেসব ঠিকানায় অবস্থান করেছেন সেগুলোর ঠিকানা। 

৮। প্রার্থীর জন্ম তারিখ (মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট বা সমমানের পরীক্ষার সার্টিফিকেট বা জন্ম সনদ)। 

৯। প্রার্থীর জন্মস্থান (গ্রাম, ইউনিয়ন, থানা/উপজেলা, জেলা ইত্যাদি)। 

১০। প্রার্থীর ১৫ (পনের) বছর বয়স হতে যেসকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, ইত্যাদি) অধ্যয়ন করেছেন সেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তথ্য।

১১। প্রার্থী যদি কোনো সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত, আধা-স্বায়ত্বশাসিত, স্থানীয় সরকারের কোনো সংস্থা বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পূর্বে চাকুরি করে থাকেন বা বর্তমানে কর্মরত থেকে থাকেন, সেগুলোর তথ্য।

১২। প্রার্থী মুক্তিযোদ্ধার পুত্র/কন্যা/নাতি/নাতনি কিনা?

১৩। প্রার্থী অন্য কোনো কোটাধারী কিনা?

১৪। প্রার্থীর কোনো ধরণের প্রতিবন্ধীতা আছে কিনা?

১৫। প্রার্থী ফৌজদারি, রাজনৈতিক, বা অন্য কোনো মামলায় অভিযুক্ত, গ্রেফতার, বা দন্ডিত এবং নজরবন্দি বা কোনো বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা হতে বহিঃষ্কার হয়ে থাকলে তার তথ্য।

১৬। প্রার্থীর নিকট আত্বিয়-স্বজন (পিতা, মাতা, ভাই, বোন, আপন মামা, চাচা, খালু, ইত্যাতি বা শশুরের দিকের অনুরূপ কোনো নিকট আত্বিয়) বাংলাদেশ সরকারের কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানে চাকুরিরত থাকলে সেগুলোর তথ্য।

১৭। প্রার্থী কোনো মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বা নৈতিক স্খলনের রেকর্ড রয়েছে কিনা?

১৮। প্রার্থী ইতোপূর্বে কোনো সরকারি চাকুরি থেকে বরখাস্ত হয়েছেন কিনা?

১৯। প্রার্থী কোনো রাষ্ট্রদ্রোহী বা নাশকতামূলক কর্যকলাপে জড়িত আছেন/ছিলেন কিনা?

২০। প্রার্থীর চারিত্রিক ও সামাজিক অবস্থান।

২১। এছাড়াও আবেদনের ধরণ অনুযায়ী প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় অন্য যেকোনো বিষয়ে তদন্ত হতে পারে।

[সূত্র: বাংলাদেশ পুলিশ’র ফেইসবুক পেইজ]

সকল চাকরিজীবীর এ সকল তথ্যের সত্যতা কর্তৃপক্ষের কাছে নিশ্চিত থাকা উচিত। এমনকি আমার ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। একজন ভালো লোক চাকরি প্রার্থী হলে ও ভালো পুলিশ তদন্তকারী হলে নিশ্চয়ই উল্লিখিত তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে কারো কোন আপত্তি থাকার কথা নয় এবং পুলিশ ভেরিফিকেশনের বিরোধিতা করার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে যদি এমন হয় যে, ভালো লোক অবৈধ টাকা না দিলে মন্দ রিপোর্ট পান আর মন্দ লোক অবৈধ টাকা দিলে ভালো রিপোর্ট পান অথবা ভালো/মন্দ সবাই টাকা দিলে ভালো রিপোর্ট পেয়ে যান তো বিতর্কিত হবে এই কার্যক্রম, ব্যহত হবে এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য। এক্ষেত্রে শিক্ষক নিয়োগের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য অবশ্যই শতভাগ স্বচ্ছ হওয়া উচিত পুলিশ ভেরিফিকেশন। কোনভাবেই অতিক্রান্ত হওয়া উচিত নয় নির্ধারিত সময়। তদন্তকারী কর্মকর্তাকে হতে হবে অত্যন্ত সৎ, যোগ্য, নিরপেক্ষ, আইসিটি জ্ঞানসম্পন্ন, দায়িত্বশীল, দেশপ্রেমিক। বিশেষ করে আইসিটি জ্ঞান না থাকলে বর্তমান ডিজিটাল যুগের একজন মানুষের অনলাইন একটিভিটিস   সম্পর্কে তদন্তকারী কর্মকর্তা কিছুই জানতে পারবেন না! আশা করি এসকল বিষয়ে  সজাগ দৃষ্টি রাখবেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। যেন এই পুলিশ ভেরিফিকেশনের মধ্য দিয়ে সঠিক তথ্য প্রদানকারী সকল ভাল লোক শিক্ষক হতে পারেন এবং মিথ্যা তথ্য প্রদানকারী কোন মন্দলোক শিক্ষক হতে না পারেন। সেইসাথে যুক্ত করা উচিত ডোপ টেস্টের ফলাফল। কোন মাদকাসক্ত ব্যক্তির শিক্ষক হবার সুযোগ যেন না থাকে। এমনকি আমাকেও আনা উচিত এই ডোপ টেস্টের আওতায়। মাদকাসক্ত হলে আমিও যেন থাকতে না পারি শিক্ষকতায়। অবশ্যই সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই-বাছাই হতে হবে অত্যন্ত সচ্ছ, নিরপেক্ষ, অবিতর্কিত এবং হয়রানিমুক্ত। 


কোন ভালো প্রার্থী হয়রানির শিকার হলে থাকতে হবে তার সহজে প্রতিকার পাওয়ার ব্যবস্থা। জানা যায়, 'পুলিশ ভেরিফিকেশন চলাকালে প্রার্থী যদি তদন্তকারী কর্মকর্তা কর্তৃক কোনো প্রকার হয়রানির শিকার হন, সেক্ষেত্রে ঐ তদন্তকারী কর্মকর্তার সরাসরি নিয়ন্ত্রনকারী কর্মকর্তার নিকট অথবা বিশেষ পুলিশ সুপার (ভিআর) বা অতিরিক্ত আইজিপি, স্পেশাল ব্রাঞ্চ, বাংলাদেশ পুলিশ, রাজারবাগ, ঢাকা বরাবর লিখিত বা মৌখিক অভিযোগ জানাতে পারেন।' এসকল ব্যবস্থার পাশাপাশি অনলাইনে অভিযোগ করার সহজ ব্যবস্থা প্রকাশিত থাকা উচিত। সেই অভিযোগের একটা কপি যেন অনলাইনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোন দপ্তরে প্রেরণ করার সুযোগ থাকে তেমন ব্যবস্থাও রাখা উচিত। এ ব্যাপারে সকল গণমাধ্যম ও জনপ্রতিনিধিদের স্বচ্ছ সহযোগিতা একান্ত আবশ্যক। যেন কোনভাবেই সম্ভাব্য শিক্ষকদের ঘুষ দিয়ে শুরু করতে না হয় শিক্ষকতা জীবন। 


মো. রহমত উল্লাহ্

সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক 

Email - rahamot21@gmail.com


23 July 2021




এসাইনমেন্টে শিক্ষা : কী করছি আমরা? খোলা কাগজ, ০২ আগস্ট ২০২১

পত্রিকার লিংক  

এসাইনমেন্টের মাধ্যমে শিক্ষা:

কী করতে গিয়ে কী করছি আমরা? 

খোলা কাগজ > ০২ আগস্ট ২০২১

মো. রহমত উল্লাহ্


করোনাকালীন শিক্ষায় এসাইনমেন্টের গুরুত্ব অপরিসীম। যেহেতু মৃত্যু ঝুঁকির কারণে সম্ভব হচ্ছে না সরাসরি পাঠদান; পর্যাপ্ত ডিভাইস, ইন্টারনেট ও প্রশিক্ষণ না থাকায় সম্ভব হচ্ছেনা সম্পূর্ণভাবে অনলাইন পাঠদান ও মূল্যায়ন; সেহেতু ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য এসাইনমেন্টকেই মনে করা হচ্ছে উত্তম ব্যবস্থা। প্রথমত এসাইনমেন্ট দ্বারা শিক্ষা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে এবং দ্বিতীয়ত এসাইনমেন্ট মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষা মূল্যায়নের চেষ্টা করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা যাতে প্রতিটি এসাইনমেন্ট সংশ্লিষ্ট চেপ্টার ভালোভাবে পড়ে, বুঝে, স্টাডি করে লিখতে পারে সেজন্য দেওয়া হচ্ছে এক সপ্তাহ সময়। শিক্ষকগণের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে এসাইনমেন্ট (প্রশ্ন-উত্তর প্রবন্ধ-নিবন্ধ, গণিত-বিজ্ঞান ইত্যাদি) লেখার কলাকৌশল। শিক্ষকগণকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে এসাইনমেন্ট মূল্যায়নের বিভিন্ন মানদন্ড এবং বাতলে দেওয়া হয়েছে মূল্যায়নের ও শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়নের বিভিন্ন উপায়। এক্ষেত্রে শিক্ষকগণের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 


এসাইনমেন্ট/Assignment এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে duty, job, task ইত্যাদি। শুধু লেখার কাজটি এসাইনমেন্ট নয়; স্টাডি করা, জ্ঞান অর্জন করা, তথ্য সংগ্রহ করা, তথ্য উপস্থাপনের কৌশল উদ্ভাবন করা ইত্যাদি কাজের মাধ্যমে নির্ধারিত বিষয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষা লাভ করাই মূলত এসাইনমেন্ট। লেখার কাজটি হচ্ছে এই এসাইনমেন্টের বা নির্ধারিত কর্মসমূহের সুন্দর পরিবেশনা। এসাইনমেন্ট এর জন্য স্টাডি করা হচ্ছে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা এবং সেই এসাইনমেন্ট লিখিতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে পরীক্ষার উত্তরপত্র তৈরি করা। এই দুটো কাজই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হয়, যদি সরাসরি পরীক্ষা গ্রহণ সম্ভব না হয়, তাহলে হয়তো এই এসাইনমেন্টের মাধ্যমেই নির্ধারিত হবে পরীক্ষার ফলাফল তথা শিক্ষা মূল্যায়ন। অর্থাৎ শিক্ষা ও সনদ এ দুটোই লাভ করতে হবে এই নির্দিষ্ট কাজের বা এসাইনমেন্টের মাধ্যমে।


অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই এসাইনমেন্ট কার্যক্রম সম্পর্কে ফেসবুকে বিভিন্ন মন্তব্য দেখে খুবই বিচলিত হয়েছি আমি। একটি সরকারি কলেজের প্রভাষক ডক্টর আনিসুর রহমান লিখেছেন, "বাংলাদেশের লেখাপড়া যেমন শেষ করে দিয়েছে বাজারের নোট বই, তেমনি চমৎকার এসাইনমেন্ট পদ্ধতি শেষ করে দিচ্ছে ইউটিউব  নোট, শিক্ষকদের নিরুৎসাহ, শিক্ষার্থীদের পরনির্ভরতা ইত্যাদি।  কবে আমরা মানব হব!" মোতালিব হোসেন নামে একজন লিখেছেন, "যে এসাইনমেন্ট দেওয়া হচ্ছে, তার সব সমাধান ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। প্রায় সকল শিক্ষার্থীই তা দেখে লিখে। এতে যে কতটা উপকার হয়েছে সেটা সবাই জানি। যদি শিক্ষাবোর্ড গুলো এসাইনমেন্ট এর একটা ফরমেট করে দিতেন,  আর শিক্ষকরা এসাইনমেন্ট এর শিরোনাম / বিষয় নির্ধারণ করে দিতেন তাহলে এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যেত। বর্তমানের এস্যাইনেন্ট যে কতটা কার্যকরী(!!!) তা সবাই বুঝতেছে।" মোখলেছুর রহমান স্বপন নামে একজন লিখেছেন, "কথা ঠিক। কিন্তু সারাদেশে একই রকম এ্যাসাইনমেন্ট হওয়ার কারণে উত্তর গুলো ইউটিউবে পাওয়া যায়। ফলে শিক্ষার্থী তা দেখে হুবহু লিখে ফেলে।" বস্তুত এমন কিছু মন্তব্যের কারণেই এই লেখাটির তাগিদ অনুভব করেছি আমি। 


আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এই এসাইনমেন্ট ব্যবস্থাটি হচ্ছে সকল বিকল্পের  মধ্যে মন্দের ভালো। এই ব্যবস্থাটি যদি অকার্যকর হয়ে যায় তাহলে আর অবশিষ্ট তেমন কিছুই থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। মন্তব্যকারীদের সমালোচনায় যে বাস্তব চিত্র উঠে এসেছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। বর্তমানে অনেক শিক্ষার্থীর হাতে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট কানেকশন বিদ্যমান। প্রায় সবার হাতের কাছেই ইন্টারনেট কানেক্টেড কম্পিউটারের দোকান। অধিকাংশ অভিভাবক জানেন না, বুঝেন না, মোবাইল ফোনে কী করছে তার সন্তান! তারা জানেন, তার সন্তান এখন মোবাইল ফোনে লেখাপড়া করছে। ইন্টারনেট কানেক্টেড কম্পিউটারের দোকান থেকে আরও ভালো লেখাপড়া নিয়ে আসছে। কিছু অভিভাবক আছেন জীবন-জীবিকা নিয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত। আর কিছু অভিভাবক আছেন যারা টেলিভিশন ছাড়া আর কিছুই দেখেন না! তাই শিক্ষার্থীদের হাতে এখন অবাধ সুযোগ। 


যেহেতু নির্ধারিত ক্লাসের সারাদেশের শিক্ষার্থীর জন্য একই এসাইনমেন্ট প্রায় একসপ্তাহ আগে প্রকাশ করা হয় সেহেতু সেই এসাইনমেন্টের রেডি পেপার (সলুশন) ইন্টারনেটে বা কম্পিউটারের দোকানে পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। সারা দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী সেই রেডি পেপার কপি করাটাও অস্বাভাবিক নয়! তাছাড়া প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের একই ক্লাসের শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরস্পরের যোগাযোগ বিদ্যমান। একজন শিক্ষার্থী সলুশন পেয়ে গেলে বা তৈরি করতে সক্ষম হলে অন্যরা তা পেয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। যে ক'জন অভিভাবক নিয়মিত সন্তানের খোঁজখবর রাখেন তাদের মধ্যে কত সংখ্যক আছেন যারা এসাইনমেন্ট কপি করার এই সুযোগ থেকে নিজের সন্তানকে বিরত রাখতে পারবেন বা রাখবেন? আমরা যতই উপদেশ দিই না কেনো, এই পরীক্ষা ও সনদ নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থায় কতটুকু সততা বজায় রাখবে এই অপ্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীরা? একই ক্লাসের সব শিক্ষার্থী একই রকম কপি জমা দিলে কি-ই বা করতে পারবেন শিক্ষকগণ? এসাইনমেন্ট উপস্থাপনার মান ঠিক থাকলে নম্বর না দিয়ে পারবেন কি কোন শিক্ষক? একই এসাইনমেন্ট বারবার করতে বলা হলে শিক্ষার্থীরা তো তা করবেও না, জমাও দিবে না! তখন উপায় কী? 


উল্লিখিত বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে, কী করতে গিয়ে কী করছি আমরা! শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট কার্যক্রম বিশ্বস্বীকৃত একটি ভালো ব্যবস্থা। শিশু শিক্ষার্থীদের জন্য এটি মূলত বাড়ির কাজ বা হোম ওয়ার্ক। সেই ভালো কাজটি ভালোভাবে হচ্ছে কিনা, সেই ভালো কাজের ভালো উদ্দেশ্যগুলো সফল হচ্ছে কিনা, ইত্যাদি ভেবে দেখা প্রয়োজন! এসাইনমেন্ট করতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা যদি স্টাডি না করে তাহলে এসাইনমেন্ট দ্বারা শিক্ষা নিশ্চিত হয় না। শিক্ষার্থীরা যদি অন্যের এসাইনমেন্ট পেপার কপি করে তাহলে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা নিশ্চিত হয় না। শিক্ষকগণ যদি এসাইনমেন্ট মূল্যায়ন করতে গিয়ে অলসতা করেন, দায়িত্বে অবহেলা করেন, নিরপেক্ষতা ভঙ্গ করেন তাহলে শিক্ষা মূল্যায়ন সঠিক হয় না। আমাদের বর্তমান এসাইনমেন্ট  কার্যক্রমের বাস্তবতায় এমন সকল অশুভ সম্ভাবনাই বিদ্যমান! 


এমনিতেই শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা থেকে অনেক বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে।  তার উপরে যদি কপি করে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে তাহলে সেটি হবে আমাদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতির কারণ। উঠতি বয়সের এই শিক্ষার্থীরা কপি করতে করতে ধ্বংস করে ফেলবে নিজেদের সৃজনশীলতা। আর কোনোদিন তারা হয়ে উঠবে না সৃজনশীল, নিজে থেকে কখনোই লিখতে পারবে না কিছুই। স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু হলেও তাদের অনেকেই আর ফিরে আসতে পারবে না সৃজনশীলতায়। সকল মূল্যায়ন  পরীক্ষায় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে নকল প্রবণতা। এমনকি কর্মজীবনে যেয়েও অধিকাংশরা পরিণত হবে মাছিমারা কেরানিতে। এ সকল অশুভ সম্ভাবনার গলিতে দাঁড়িয়ে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগে যে, এসাইনমেন্ট  কার্যক্রম করতে গিয়ে আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের 'মধু কই কই বিষ' খাওয়াচ্ছি কিনা এবং তৃপ্তির ঢেকুর তোলার চেষ্টা করছি কিনা? 


এটি নিশ্চিত যে সরাসরি পাঠদান ও পরীক্ষা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। এর বিকল্প হিসেবে যাই করা হোক না কেনো সবই হয় মন্দ, নয় মন্দের ভালো। মহামারী করোনা পরিস্থিতিতে সকল বিকল্প বিবেচনায় আমি নিজেও এসাইনমেন্টের পক্ষে অনেক কথা লিখেছি ও বলেছি। কিন্তু এসাইনমেন্ট করতে গিয়ে যদি উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয় তাহলে অবশ্যই তা পুনর্বিবেচনা করা উচিত। সারা বাংলাদেশের এসাইনমেন্টের শিরোনামগুলো কেন্দ্র থেকে নির্ধারণ ও প্রকাশ না করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক বিষয় শিক্ষকগণের দ্বারা নির্ধারণ ও বিতরণ করা হলে এসাইনমেন্টগুলো জাতীয়ভাবে কপি বা নকল হওয়ার সুযোগ থাকবে না। শিক্ষকগণকে চেপ্টার নির্ধারণ করে কিছু গাইডলাইন দিয়ে দিলে নিশ্চয়ই তারা সেভাবে শিক্ষার্থীদের পড়িয়ে এসাইনমেন্ট এর শিরোনাম নিজের মতো করে নির্ধারণ ও বিতরণ করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে শিক্ষকদের দক্ষতা ও জবাবদিহিতা আরো বৃদ্ধি পাবে। প্রতিষ্ঠানভিত্তিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে কিছু আদান-প্রদান হবার সম্ভাবনা থাকলেও এসাইনমেন্ট করা ও জমা দেওয়া জন্য অতি অল্প সময় বেঁধে দিয়ে শিক্ষকগণ তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে পারবেন। তখন কপি বা নকল হবার সুযোগ ও সম্ভাবনা অনেকাংশেই কমে যাবে। আমার প্রস্তাবিত এই ব্যবস্থায় শিক্ষকগণ যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পাদন করেন তাহলে অবশ্যই বৃদ্ধি পাবে এসাইনমেন্ট কার্যক্রমের সুফল। 


এসাইনমেন্ট কার্যক্রমকে অতি গুরুত্ব দিতে গিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষাসমূহ বাতিল করে শিক্ষার্থীদের কল্যাণ কতটা হ্রাস/বৃদ্ধি পেয়েছে তাও বিবেচনা করা উচিত। প্রতিষ্ঠানভিত্তিক অনলাইনে সিটি ও অন্যান্য পরীক্ষা চালু থাকলে শিক্ষার্থীদের ক্লাসের যোগদান বৃদ্ধি পায়, লেখাপড়ায় আগ্রহ বৃদ্ধি পায়, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়, শিক্ষকগণ বেশি একটিভ থাকেন, শিক্ষার্থীরা অধিক লাভবান হয়। পরীক্ষা বিষয়টিকে শিক্ষার্থী ও অভিভাবক উভয়ই গুরুত্ব দেয়। ফলে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় টিউশন ফি আদায়ের ক্ষেত্রে এটি সহায়ক ভূমিকা রাখে। শিক্ষকগণের জীবনধারণের জন্য এটিও কিন্তু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার ফি আদায় করা/কম করা/না করা নিয়ে বিধি-নিষেধ আরোপ করা যেতে পারে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানভিত্তিক অনলাইন পরীক্ষাসমূহ চালু রাখা আবশ্যক। 


উন্নত বিশ্বে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক শিক্ষা প্রদান, শিক্ষা মূল্যায়ন ও সনদ প্রদান স্বীকৃত ব্যবস্থা। অনেক বাস্তব কারণে আমাদের দেশে সেই রকম ব্যবস্থা এখনও পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু এই কোভিড পরিস্থিতিতে সামান্য বাস্তবায়ন না করে উপায় নেই। এই যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে পাঠদান করছেন এটি কিন্তু যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। তাই আমি মনে করি সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহিতার মধ্যে রেখে প্রাতিষ্ঠানিক  ব্যবস্থাপনায় ক্লাসসমূহ পরিচালনা, এসাইনমেন্ট কার্যক্রম পরিচালনা ও অভ্যন্তরীণ  পরীক্ষা পরিচালনা করা হলে এই করোনা পরিস্থিতিতে কিছুটা হলেও অধিক সফল হবে আমাদের সন্তানদের শিক্ষা। 


মো. রহমত উল্লাহ্

প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ এবং অধ্যক্ষ - কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।