শিশুতোষ গল্প- 'গুলতি'

শিশুতোষ গল্প- 'গুলতি'

গুলতি


মো. রহমত উল্লাহ্


আলো ঝলঝল সকাল। স্বপন হাতে নেয় গুলতি। পকেটে নেয় অনেক মারবেল। মার্বেলই গুলতির গুলি। বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। কথা বলে নিজে নিজে। পাখি শিকার করবোই আজ। ফিরবো না খালি হাতে। হাঁটে বাগানের দিকে। তার বয়স সাত বছর। সুঠাম দেহ। তামাটে গায়ের রং। কাল চুল। বড় চোখ। হাসি হাসি মুখ। চৌকস চেহারা। যেন, পাকা শিকারি।


আম জাম কাঁঠালের বাগান। সবুজে ভরপুর চারদিক। গাছে গাছে অনেক পাখি। ঐতো, একটা বুলবুলি। বসেছে পেয়ারা গাছে। তিড়িং বিড়িং করছে। কালছে গায়ের রং। পিছনে খানিকটা লাল। বাঁকা হয়ে দাঁড়ায় স্বপন। তাক করে গুলতি। নিশানা করে বুলবুলির লালে। ঠিক থাকেনা নিশানা। তিড়িং বিড়িং করে বুলবুলি। নড়ে যায় স্বপনের হাত। আবার ঠিক করে নিশানা। টানে গুলতির রাবার। ছুড়ে মারে মার্বেল। লাগেনা বুলবুলির গায়ে। উড়ে যায় ফুড়ুৎ করে। আফসোস করে স্বপন। ভাবে, তাড়াহুড়া ঠিক না।


আরো সামনে যায় স্বপন। দেখে, জামগাছে একটা দোয়েল। সাদাকালো গায়ের রং। লেজ নাড়ায় বার বার। গাছের নিচে যায় স্বপন। নিচেই একটা মাটির ঢিবি। দাঁড়ায় ঢিবিটার উপর। তাক করে গুলতি। ঠিক করে নিশানা। পায়ে কামড় দেয় পিঁপড়ায়। ইস! ব্যথা লাগে খুব। সয়ে নেয় সে ব্যথা। শিকারের নেশায় বিভোর এখন। সরে যায় অন্য ঢিবিতে। আবার ঠিক করে নিশানা। তাক করে গুলি। নিয়ে নেয় দম। বাড়ায় সাহস। ছুড়ে মারে মারবেল। টুস! লাগে ঠিক দোয়েলের গায়ে। উড়াল দেয় দোয়েল। বাড়ি খায় পাতায় পাতায়। পড়ে যায় নিচে। ঝাপটাতে থাকে ডানা। গর্বিত হয় স্বপন। শিকারে লাগাতে পেরেছে গুলি। খুশিতে ভরে ওঠে মন। ছুটে যায় দোয়েলের কাছে। ভয়ে পালাতে চায় দোয়েল। উড়তে চায়, উড়তে চায়। উড়ে যায় ফুড়ুৎ করে। আফসোস করে স্বপন। ইস, চলে গেলো! হয়তো তেমন লাগেনি গুলি। মারতে হবে আরো জোরে।


কুড়ড়, কুড়ড়, ডাকছে ঘুঘু। কোথায় ডাকছে? কোথায়? এদিক না। ওদিক না। উপরে তাকায় স্বপন। হুম, কাঁঠাল গাছে। নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। তাক করে গুলতি। না। ঠিক হয় না নিশানা। কী করা যায়? কী করা যায়? খুব সাবধানে উঠে গাছে। বসে, ডালের গোড়ায়। কাত করে মাথা। দূরবিন করে চোখ। তাকায় ঘুঘুর দিকে। সাদাছাই গায়ের রং। কিছুটা ছিটছিট। কবুতরের মতো শরীরের গঠন। স্বপন তাক করে গুলতি। হ্যা। ঠিক আছে এবার। কুড়ড়, কুড়ড়, কুড়ড়। একমনে ডাকছে ঘুঘু। ফুলে উঠছে গলার লোম। খেয়াল করছে না কিছুই। স্বপন ভাবে, এটাই সুযোগ। ঠিক করে নিশানা। বাড়ায় বুকের বল। ভাবে, সফল হবেই এবার। খুব জোরে টানে গুলতি। ছুড়ে মারে মারবেল। শব্দ হয় টস করে। আহত হয় ঘুঘু। দপ দপ দপ। বাড়ি খায় পাতায় পাতায়। লুটিয়ে পড়ে মাটিতে।


তাড়াতাড়ি নেমে আসে স্বপন। ডানা ঝাপটাতে থাকে ঘুঘু। উড়তে পারেনা। গুলি লেগেছে খুব জোরে। কাছে থেকে দেখে স্বপন। কমে আসে ঘুঘুর ঝাপটানো। হেলিয়ে দেয় মাথা। তাকায় স্বপনের দিকে। হা, করে বার বার। যেন, বলছে বাঁচাও বাঁচাও। মায়া হয় স্বপনের। ভার লাগে বুক। অনুতাপ জাগে মনে। হাতে নেয় ঘুঘু। কাঁধে ঝুলায় গুলতি। ছুটে যায় পুকুর ঘাটে। পানি দেয় ঘুঘুর মুখে। এক ফোঁটা, দুই ফোঁটা। বসে থাকে অনেক সময়। কিছুটা সেরে ওঠে ঘুঘু। নাড়াতে শুরু করে চোখ। মাথা তুলে। বসে। দাঁড়ায়। হাঁটে। পাখা মেলে। আশার আলো দেখে স্বপন। উড়ে যেতে চায় ঘুঘু। বাধা দেয় না স্বপন। উড়াল দেয়। কিছু দূর যায়। মাটিতে বসে। উড়াল দেয় আবার। হাততালি দেয় স্বপন। আকাশে উড়ে যায় ঘুঘু।


স্বপন বসে থাকে চুপচাপ। মনে পড়ে মায়ের কথা। শিকার করা মায়ের নিষেধ। গুলতি হাতে নেয় স্বপন। দেখে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। দেখে বার বার। অন্যরকম লাগে গুলতিটা। ছুড়ে ফেলে দেয় পুকুরে।//


[সংশোধিত - নভেম্বর ২০১৭]


(শিশুদের এই গল্পটির কোন বাক্যে চারটির বেশি শব্দ নেই এবং কোন শব্দে যুক্তবর্ণ নেই।)


[29 January 2016 at 8am to 9am
Dinning Room, CCDB Home, Savar.]

শিশুতোষ গল্প- 'চাকা'

শিশুতোষ গল্প- 'চাকা'

চাকা
মো. রহমত উল্লাহ্
চাকা চালায় নিশাত। সাইকেলের পুরাতন চাকা। টায়ার নেই। টিউব নেই। ইসপুক নেই। কেবল রিং। দাদাভাই দিয়েছেন এটি। পুরাতন সাইকেলের রিং। নতুন রিং লাগিয়েছেন সাইকেলে। তাই পুরাতনটি বাতিল। এটি এখন নিশাতের খেলনা। নিশাত এটি চালায়। চালু করে হাতে ঠেলে। তারপর ঠেলে কাঠি দিয়ে। চলতে থাকে চাকা। ছুটতে থাকে নিশাত। দৌড়ায় চাকার পিছুপিছু। চষে বেড়ায় গ্রাম।


দীপনদের উঠানে আসে নিশাত। শুনা যায় কড়কড় কড়কড়। চাকা চালায় কয়েক পাক। দেখে দীপন। যায় পিছনে পিছনে। একটু চালাতে চায় সে। দেয় না নিশাত। আবার চায় দীপন। দেয় না নিশাত। আরো জোরছে চালায়। ভাব দেখায়। ডাঁট দেখায় খুব। চলে যায় অন্য দিকে। সবার উঠানে যায়। একা একা চালায়। দেয় না কাউকেই। আফসোস করে সবাই। জেদ লাগে দীপনের। তারও চাকা চাই।
বাবার কাছে যায় দীপন। বাবা, আমার চাকা চাই। নিশাতের চাকার মত। আমিও চালাতে চাই। চালাবো তার আগে আগে। আমাকে চালাতে দেয়নি নিশাত। মুখ খুলেন বাবা। পুরাতন চাকা পাবো কই? আমাদেরতো নতুন সাইকেল। বাতিল চাকা নেই। তাই দেওয়া যাবে না। শুনে, ফিরে আসে দীপন। ভাবে, কী করা যায়।


বাড়ির কাছেই বাজার। সেখানে যায় দীপন। যায় সাইকেল মেকারের দোকানে। চায় পুরাতন রিং। মেকার বলেন, নেই। দীপনদের পরিচিত মেকার। বলেন, পাওয়া গেলে রাখবো। পরে নিও। সহজে মিলে না। কে জানে কখন মিলে। বুঝতে পারে দীপন। পাওয়ার আশা নেই। ফিরে আসে বাড়িতে। ভাবে, কী করা যায়। কী করা যায়...। আসে দীপনের বোন। বসে গা ঘেঁষে। বলে, মন খারাপ করো না। সাহস রাখো। মাথা খাটাও। আরো খোঁজো। উপায় একটা হবেই।


পরদিন সকাল। স্কুলে যায় দীপন। দেখা হয় পলকের সাথে। কথা হয় চাকা নিয়ে। আসে শিপন। যোগদেয় সেও। কথা হয় তিনজনে। চাকা বানাতে বলে দীপন। খুলে বলে বানানোর কৌশল। একমত হয় সবাই। চাকা বানাবে তারা। সবার মুখে হাসি। সমবয়সী তিনজন। বয়স ছয় কি সাত। দেখতে সবার বড় দীপন। গায়ের রং তামাটে। সুঠাম দেহ। কালো চোখ। কালো চুল। চৌকশ চেহারা। সে বলে, ঠিক আছে। মনে থাকে যেনো।


দুইদিন পর। ছুটির দিন। একসাথে হয় তিনজন। দা নেয়। সূতা নেয়। যায় বনবাদাড়ে। ঢুকে অনেক ভিতর। তিনটি শাখ কাটে। ঘোরগিল গাছের শাখ। দীর্ঘ চিকন শাখ। আগা গোড়া এক রকম। পুরোটাই সরু। পুরোটাই মসৃণ। সহজেই বাঁকানো যায়। ভাঙে না। ফাটে না। মচকে না। চাকা বানানোর উপযোগী। তিনজনের হাতে তিনটি শাখ।


তারা ফিরে আসে জামতলায়। নিয়ে আসে শাখ গুলো। ছাঁটায় শাখের দুই মাথা। বাঁকা করে একটি। কৌশলে মিলায় দুই মাথা। ধরে দুই জনে। বাঁধে এক জনে। হয়ে যায় চাকা। নিশাতের চাকার চেয়ে বড়। হাহ্ হা। হেসে উঠে সবাই। বানায় আরেকটি। আরো বড়। বানায় আরো একটি। আরো বড়। সবার বড়টা নেয় দীপন।


এরপর কাটে জামের ডাল। তিনটি ডাল নেয়। গুলতির বাঁটের মতো। বানায় তিনটি হাতল। এমন হাতলেই চলে চাকা। বিশেষ চাকার বিশেষ হাতল। এখন সব রেডি। এখন সবাই খুশি। সবার মুখে হাসি। শুরু করে চাকা চালানো।


তিন জনে চালায় চাকা। ছুটে গ্রামের পথে পথে। যায় নিশাতদের উঠানে। চালাতে থাকে জোরছে। নিশাতও চালায় তাদের সাথে। শুরু হয় প্রতিযোগিতা। সবার আগে দীপন। দীপনের চাকা বড়। বড় চাকা বেশি চলে। সবার পিছনে নিশাত। নিশাতের চাকা ছোট। লোহার তৈরি। বেশ ভারি। তাই কম চলে। শরম লাগে তার। চালায় না সবার সাথে। বসে থাকে চুপচাপ। বুঝতে পারে দীপন। কেন নিশাতের মুখ ভার।


নিশাতের কাছে যায় দীপন। চালাতে দেয় নিজের চাকা। বলে, এই নাও। আমার বড়টি তুমি চালাও। সবার আগে যাও তুমি। প্রথম হও। তোমার ছোটটি আমাকে দাও। আজ তোমারটি আমি চালাই। আরেকটি বানিয়ে নিবো কাল। দীপনের কথায়
অবাক নিশাত। তাকায় দীপনের মুখের দিকে। মনে পড়ে আগের কথা। দীপনকে ডাঁট দেখানোর কথা। চাকা না দেওয়ার কথা। অনুতাপ জাগে। ভাবে মনে মনে। ডাঁট দেখানো ঠিক না। কখনো দেখাবে না ডাঁট।
একসাথে চাকা চালায় চারজনে। হাহ্ হা। হোহ্ হো। হুর্ রে। <


[সংশোধিত - নভেম্বর ২০১৭]


(শিশুদের জন্য লেখা এই গল্পটির কোন বাক্যে চারটির বেশি শব্দ নেই এবং কোন শব্দে যুক্তবর্ণ নেই।)


শিশুতোষ গল্প- 'লাটিম'

শিশুতোষ গল্প- 'লাটিম'

লাটিম
মো. রহমত উল্লাহ্


লাটিম খেলা চলছে। একসাথে খেলছে তিনজন। কেউ সূতা প্যাঁচায়। কেউ ছুড়ে মারে। লাটিম ঘুরে। ঝিম ধরে। পুনপুন করে। কেউ হাতে নেয়। তালুতে রাখে। তালুতেই ঘুরে লাটিম। দেখতে খুব ভালো লাগে। পলাশের হাতে ঘুরে। বকুলের হাতে ঘুরে। তারা বাহাদুরি করে। তারা ডাঁট দেখায়। অপমান লাগে শিমুলের।


লাটিম ছুড়ে শিমুল। তেমন ঘুরে না। তাওড় খায়। পড়ে যায়। আবার হাতে নেয়। সূতা প্যাঁচায় লাটিমে। ছুড়ে মারে জোরছে। একটু ঘুরে। আগের মতই। পড়ে যায় হেলেদুলে। আবার মারে। পড়ে যায়। আবার মারে। আবার পড়ে যায়। মন ভার শিমুলের। মলিন ফরসা মুখ!


শিমুল পারে না। বলাবলি করে সবাই। হাসাহাসি করে সবাই। চাতুরি করে পলাশ। খোঁচা মারে বকুল। সমবয়সী সবাই। শরম লাগে শিমুলের। নুয়ে যায় দেহ। সুঠাম শিমুল। বয়স সাত। হয়ে যায় ছোট। জেদ হয়। নিজের উপর। নিজের লাটিমের উপর। চলে আসে বাড়িতে।


তাকায় লাটিমের দিকে। দেখে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। খেয়াল করে পেরেকটা। লাটিমের নিচের পেরেক। পেরেকেই ঘুরে লাটিম। হুম, পেয়েছি। কথা বলে নিজেই। পেরেকটা হয়ত বাঁকা। হুম, তাইতো। বাঁকাইতো। একটু বাঁকা আছে। তাই পড়ে যায়। ঘুরে না তেমন। পেয়ে গেছি কারণ! দেখা যাক এখন। কী করা যায়।


দোকানে যায় শিমুল। লাটিমের দোকান। পরখ করে লাটিম। একটা, দুইটা, তিনটা। চারটা, পাঁচটা, ছয়টা। সাতটা, আটটা, নয়টা। একে একে দেখে। অনেক গুলো দেখে। বাছাই করে একটা। কাঠ ভালো। আকার ভালো। গা সমান। লাল দাগ দেওয়া। পেরেক সোজা। যেমন চেয়েছে। নিয়ে আসে সেটি।


বাড়িতে আসে শিমুল। ছুটে যায় উঠানে। হাতে নতুন লাটিম। সূতা প্যাঁচায় লাটিমে। ছুড়ে মারে। ওয়াও! ঘুরছে। আবার সূতা প্যাঁচায়। আবার ঘুরায়। ওয়াও! কী মজা! ভালোই পারে। আবার করে। আরো ভাল পারে। আবার করে। আরো ভাল পারে। ঝিম ধরে লাটিম। ঘুরে পুনপুন করে। হাতে তুলে শিমুল। হাতের তালুতে লাটিম। ঘুরে আর ঘুরে। এভাবেই চলে অনুশীলন। হা হা, হা হা। কী মজা! কী মজা! অনুশীলনেই সফলতা।


তিনদিন পর। মাঠে যায় শিমুল। নেয় নতুন লাটিম। পলাশ আসে। বকুল আসে। সবার হাতে লাটিম। শুরু হয় ঘুরানো। চলছে প্রতিযোগিতা। একসাথে ছুড়ছে সবাই। ঘুরছে সবার লাটিম। তুলছে হাতের তালুতে। হাতেই ঘুরছে লাটিম! ঘুরছে তো ঘুরছে। পলাশের লাটিম থেমেছে। বকুলের লাটিম থেমেছে। শিমুলের লাটিম ঘুরছে। সবাইতো অবাক।


শুরু হলো আবার। একসাথে ছুড়ছে সবাই। ঘুরছে সবার লাটিম। তুলছে হাতের তালুতে। লাটিম ঘুরছে। সবার হাতে হাতে। বকুলের লাটিম থেমেছে। পলাশের লাটিম থেমেছে। তাদের মুখ মলিন। শিমুলের মুখে হাসি। হাতের তালুতে লাটিম। ঘুরছে তো ঘুরছে!<


[সংশোধিত- নভেম্বর ২০১৭]


(শিশুদের জন্য লেখা এই গল্পটির কোন বাক্যে তিনটির বেশি শব্দ নেই এবং কোন শব্দে যুক্ত বর্ণ নেই।)

প্রবন্ধ- 'বিসর্গের দুঃখ' -ইত্তেফাক- ১১ নভেম্বর ২০১৭

প্রবন্ধ- 'বিসর্গের দুঃখ' -ইত্তেফাক- ১১ নভেম্বর ২০১৭
P_20171111_164819_1_1_1[দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ নভেম্বর ২০১৭]
:ভাষাপ্রেম:
বিসর্গের দুঃখ
মো. রহমত উল্লাহ্

আমরা জীবন দিয়ে রক্ষা করেছি আমাদের মাতৃভাষা। আমাদের শহীদ দিবসেই আজ বিশ্বব্যাপী পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। অথচ সঠিক চর্চা ও পরিচর্যার মাধ্যমে মাতৃভাষার উত্কর্ষ সাধনে আমরা অনেকেই এখনো অনেক বেশি উদাসীন। এমনকি অক্ষরের প্রয়োগ, শব্দের বানান, শব্দ গঠন, শব্দ সংক্ষেপণ, শব্দের প্রয়োগ, বাক্য গঠন, যতিচিহ্নের ব্যবহার ইত্যাদি সাধারণ বিষয়েও আমরা প্রায় সবাই এত বেশি ভুল লিখি যা স্বল্প পরিসরে আলোচনা সম্ভব নয়। তাই এই নিবন্ধে কেবল বিসর্গের (ঃ) ব্যাপক অপব্যবহারের আংশিক চিত্র তুলে ধরা হলো।
ভাষার গতিবৃদ্ধির জন্য শব্দসংক্ষেপ অপরিহার্য। তাই শব্দ সংক্ষেপ করার জন্যও প্রত্যেক ভাষারই থাকা চাই সর্বজনবিদিত একটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম। আমাদেরও আছে। কিন্তু সে নিয়ম অনুসরণ করছি না আমরা সবাই।
যেমন: ‘ডাঃ মোঃ সাঃ জাঃ ফয়েজ, এমঃ বিঃ বিঃ এসঃ’। এক্ষেত্রে বিসর্গ (ঃ) গুলোর অপব্যবহার করা হয়েছে যতিচিহ্ন (শব্দ সংক্ষেপণ চিহ্ন) হিসেবে। অর্থাত্ ‘ডাক্তার মোহাম্মদ সারোয়ার জাহান ফয়েজ’, ‘ব্যাচেলর অফ মেডিক্যাল সাইন্স’ কথাগুলোকে সংক্ষিপ্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়েছে বিসর্গ দিয়ে।
আবার ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্মারক নম্বর’ কথাগুলোকে সংক্ষেপে লেখা হচ্ছে—‘শিঃ মঃ স্মাঃ নং’ এভাবে। গভঃ দিয়ে গভর্নমেন্ট, প্রাঃ দিয়ে প্রাইভেট, লিঃ দিয়ে লিমিটেড, হঃ দিয়ে হযরত, ছঃ দিয়ে ‘ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া ছাল্লাম’, রাঃ দিয়ে ‘রাদিয়াল্লা হু আন হু’ ইত্যাদি লেখা হয়ে থাকে। এভাবে বিসর্গ (ঃ) দিয়ে শব্দ সংক্ষেপ করা সঠিক নয়।
বিসর্গ (ঃ) কে যতিচিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করা যায় না। যতিচিহ্নের কোনো উচ্চারণ ধ্বনি নেই। কেননা, কোনো যতিচিহ্নই বর্ণ নয়। বিসর্গ (ঃ) একটি বর্ণ। বিসর্গের (ঃ) আছে উচ্চারণ ধ্বনি। আছে সঠিক ব্যবহারের নিয়মকানুন। অথচ আমরা অনেকেই না জেনে, না বুঝে এই বিসর্গ (ঃ) ধ্বনিকে ব্যবহার করছি যতিচিহ্ন হিসেবে। এতে বিলুপ্ত হচ্ছে বিসর্গ (ঃ) এর উচ্চারণ ধ্বনি ও অস্তিত্ব। আবার এইরূপ অপব্যবহূত বিসর্গ (ঃ) এর উচ্চারণ করতে গেলেও অর্থ দাঁড়াচ্ছে অন্যরকম। যেমন— ‘হাইমচর হামদর্দ হাসপাতাল’কে বিসর্গযোগে সংক্ষিপ্ত করতে গেলে হবে ‘হাঃ হাঃ হাঃ’। উচ্চারণ হবে ‘হাহ্ হাহ্ হাহ্’। অর্থ দাঁড়াবে উচ্চৈঃস্বরে হাসির শব্দ।
শব্দ সংক্ষেপ করার জন্য ব্যবহার করতে হবে যতিচিহ্ন। একমাত্র দাঁড়ি (। ) ব্যতীত সকল যতিচিহ্নই আমরা পেয়েছি বা নিয়েছি ইংরেজি ভাষা থেকে। তাই ব্যবহারও হচ্ছে ইংরেজি ভাষার রীতি অনুসারেই। সেমতে শব্দ সংক্ষেপ করার জন্য ব্যবহূত হবে ডট (.)। বাংলায় আমরা এর নাম দিয়েছি এক বিন্দু (.) বা শব্দ সংক্ষেপণ চিহ্ন। যেমন: ডা. মো. সা. জা. ফয়েজ, এম. বি. বি. এস.। শি. ম.স্মা., এস. এস. সি., এম. এসসি., বি. এড., বি. ডি. আর. ইত্যাদি।
শুধু শব্দ সংক্ষিপ্ত করার জন্যই যে বিসর্গের (ঃ) অপব্যবহার হচ্ছে তা নয়, বিশ্লেষণ করার জন্যও অহরহ অপব্যবহূত হচ্ছে বিসর্গ (ঃ) নামক ধ্বনি। ‘যেমন—/ যেমন:’-কে বিসর্গ দিয়ে লেখা হচ্ছে ‘যেমনঃ’। ‘নাম—/ নাম:’-কে লেখা হচ্ছে ‘নামঃ’। ‘গ্রাম—/ গ্রাম:’-কে লেখা হচ্ছে ‘গ্রামঃ’। ‘পোস্ট—/ পোস্ট:’-কে লেখা হচ্ছে ‘পোস্টঃ’। বিসর্গের মতো এমন অনেক ধ্বনি, বর্ণ এবং যতিচিহ্ন প্রয়োগ আমাদের খামখেয়ালির জন্য বাংলা ভাষা আজ ক্ষত-বিক্ষত ও দুঃখভারাক্রান্ত।
অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও বাস্তব যে, বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নামফলক, চিঠিপত্র, টেলিভিশন এমনকি অনেক প্রকাশিত বই-পত্রপত্রিকায় এমনি ভুলভাবে বিসর্গের অহরহ প্রয়োগ দীর্ঘদিন দেখতে দেখতে এখন নতুন প্রজন্মসহ আমরা অনেকেই মনে করি তা-ই সঠিক। এমনকি আমাদের অধিকাংশ শিক্ষিত মানুষের নামের সংক্ষিপ্তরূপ আমাদের শিক্ষা সনদে লেখা হয়েছেও হচ্ছে (ঃ) বিসর্গ দিয়ে। যেমন—মো., মোসা., মি. এসবকে লেখা হচ্ছে মোঃ, মোসাঃ, মিঃ, ইত্যাদি। আজীবন এই ভুল বয়ে বেড়াচ্ছি সবাই।
অথচ শিক্ষা বোর্ড এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ একটু সচেতন হলেই বন্ধ করা যায় এই চলমান / প্রচলিত ভুল। তা করা হলে নিজের সনদ দেখেই আমাদের সন্তানেরা শিখতে পারবে শব্দ সংক্ষেপণ চিহ্নের ব্যবহার এবং পরিহার করতে পারবে (ঃ) বিসর্গের অপব্যবহার। এ ব্যাপারে যথাশীঘ্র সম্ভব বাংলা একাডেমিসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন সকল প্রতিষ্ঠান ও প্রিন্ট মিডিয়াসমূহ ঐকমত্যে এসে একই নিয়ম অনুসরণ অত্যাবশ্যক। মনে রাখতে হবে সামান্য অবহেলায় ভাষার ভেতরে কোনো ভুল বিস্তৃত হয়ে পড়লে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভাষা; যা কাটিয়ে ওঠা হয়ে পড়ে অত্যন্ত কঠিন ও সময়সাপেক্ষ।
n লেখক :অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা
বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা
ই-মেইল :rahamot21@gmail.com

http://www.ittefaq.com.bd/print-edition/sub-editorial/2017/11/11/235588.html

আধুনিক গান- 'আলোর আড়ালে থাকে আঁধার...'

আধুনিক গান- 'আলোর আড়ালে থাকে আঁধার...'

<আধুনিক গান>


আলোর আড়ালে থাকে


আঁধার কালো


আঁধারের আড়ালেই


থাকে আলো।।


দিনের পরে আসে রাত


রাতের পরে আসে রাত।


দুখ আছে তাই সুখ


লাগে ভালো।।


ভাটার পরে আসে টান


টানের পরেই আসে বান।


বিরহ আছে তাই


মিলন ভালো।।


গীতিকার- মো. রহমত উল্লাহ্‌


+8801711147570


(কথা ও সুর: ফেব্রুয়ারি ২০১৭, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।)