যে করেই হোক বন্ধ করতে হবে সনদ জালিয়াতি
মো. রহমত উল্লাহ্
দৈনিক বাংলা, o৩ মে ২০২৪
>সম্প্রতি কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের কম্পিউটার সেলের সিস্টেম এনালিস্ট এ কে এম শামসুজ্জামান সনদ জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছে। সনদ জালিয়াতির ব্যাপারে তার স্বীকারোক্তি ও জবানবন্দীর পরিপ্রেক্ষিতে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সদ্যসাবেক চেয়ারম্যান আলী আকবর খান এর স্ত্রী সেহেলা পারভীনকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রয়োজনে আলী আকবর খানকেও গ্রেফতার করা হতে পারে। সেহেলা পারভীন সিস্টেম অ্যানালিস্ট এর সঙ্গে অবৈধ অর্থ লেনদেনের কথা স্বীকার করেছে। জানা গেছে আসামি একে এম শামসুজ্জামান বিপুলসংখ্যক জাল সার্টিফিকেট তৈরি করে দেশব্যাপী বিভিন্ন সার্টিফিকেট প্রত্যাশীদের কাছে বিক্রি করে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইটে আপলোড করেছে। অর্থাৎ সার্টিফিকেট জালিয়াতির কাজটি এমনভাবেই করা হয়েছে যে বোর্ডের ওয়েবসাইটে যাচাই করেও জাল সনদ চিহ্নিত করার কোন উপায় নেই! এমতাবস্থায় কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সকল সনদ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক নয় কি? যারা কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে প্রকৃতপক্ষে শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে বৈধ সনদের অধিকারী হয়েছেন তারাও এখন লজ্জিত, অপমানিত ও বিক্ষুব্ধ। বৈধ সনদের অধিকারীরাই অপরাধীদের বিরুদ্ধে সর্বাধিক সোচ্চার হওয়া উচিত এবং এটি তাদের নৈতিক দায়িত্ব।
যোগ্যতার সনদ জালিয়াতি বাস্তবে একটিমাত্র অপরাধ নয়; অনেক অনেক অপরাধের সূত্রপাত। জাল সনদ প্রদানকারী ও গ্রহণকারী উভয়ই অপরাধী। জাল সনদ গ্রহণকারী জাল সনদ ব্যবহার করে সারা জীবনে যাই করুক সবই অপরাধ। সে নিজেকে এ সনদ অর্জনকারী বলা অপরাধ, এই সনদ কোথাও দাখিল করা অপরাধ, এ সনদ দ্বারা চাকরির আবেদন করা অপরাধ, এ সনদ দ্বারা একজন যোগ্য লোককে বঞ্চিত করা অপরাধ, এ সনদ দ্বারা চাকরি করা অপরাধ, এ সনদে প্রাপ্ত কর্মের/ চাকরির আয় অবৈধ, এ আয় দ্বারা জীবনযাপন অপরাধ, এ আয় খেয়ে ইবাদত নিষ্ফল, এ সনদের যোগ্যতা ও কর্ম দেখিয়ে বৈবাহিক সম্পর্ক করা অপরাধ! এমন আরো অনেক অনেক অপরাধের অংশীদার কিন্তু সেই অবৈধ সনদ প্রদানকারীও। একজন অবৈধ সনদ প্রদানকারী কিন্তু বহু জনকে বহু অবৈধ কাজের সুযোগ সৃষ্টিকারী! সে হাজারো অপরাধের সূত্রপাত ঘটায়! সে অনেক মানুষের সারা জীবনের জন্য নৈতিক স্খলন ঘটায়! কেননা তার দেওয়া অবৈধ সনদ দ্বারা কেউ কোন কাজে নিয়োজিত হলে আজীবন ওই অপকর্মেই থেকে যায়। ভুয়া সনদ প্রদানকারী বহু অপরাধের হুতা, সর্বাধিক শাস্তিযোগ্য অপরাধী!
বিভিন্ন সময় দফায় দফায় হাজার হাজার জাল সনদধারী শিক্ষকের খোঁজ পাওয়া গেছে! এটি আমাদের শিক্ষক সমাজের জন্য, দেশের জন্য, জাতির জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক, লজ্জাজনক ও কলঙ্কজনক! সম্পূর্ণ অযোগ্য, জাল সনদধারী, চরম অনৈতিক হাজারো দুষ্ট লোক যে দেশে শিক্ষক হতে পারে, শিক্ষকতায় নিয়োজিত থাকতে পারে, সে দেশের শিক্ষার মান কেমন হবে তা তো যে কেউ অনুমান করতে পারবেন। এমন দুষ্ট লোকদের কাছে শিক্ষার্থীরা কেমন শিক্ষা লাভ করবে তা তো অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ! ভুয়া/ জাল/ অবৈধ সনদধারী কেউ যাতে শিক্ষাক্ষেত্রে থাকতে না পারে এবং শিক্ষকতায় আসতে না পারে সেজন্য সর্তকতা অবলম্বন করা ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। তদুপরি কোন অজুহাতে যাতে অযোগ্যরা আবারো শিক্ষক হতে না পারে সে ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখা আবশ্যক এবং শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে অধিক যোগ্য ও আদর্শ মানুষদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করা দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে অত্যন্ত প্রয়োজন। তড়িঘড়ি করে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করার চেয়ে বিলম্ব করে অধিক যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করা দীর্ঘমেয়াদে অধিক কল্যাণকর। তাই কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন এক বছর মেয়াদী এ্যাডভান্স সার্টিফিকেট ইন ফাইন আর্টস (চারু-কারুকলা) এবং কম্পিউটার টেকনোলজি (ICT) কোর্সের সনদ তড়িঘড়ি নিয়ে যারা সহজেই বেসরকারি শিক্ষক হবার ব্যাপক সুযোগ পাচ্ছেন তাদের এ সনদ ও যোগ্যতা নিয়ে পরে যেন কোন প্রশ্ন দেখা দিতে না পারে সে ব্যাপারে এখনই সতর্ক ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সম্প্রতি এ দুটি বিষয়ে অতি সংক্ষিপ্ত সময়ে বিপুলসংখ্যক সনদ অর্জনকারীদের সনদের সত্যতা, কোর্স সম্পন্ন করানো প্রতিষ্ঠান গুলোর বৈধতা ও উপযুক্ততা এবং অনুমোদন প্রদানের যথার্থতা, প্রশিক্ষণ প্রদানকারী প্রশিক্ষকদের প্রকৃত যোগ্যতা ও পর্যাপ্ততা, প্রশিক্ষণার্থী ভর্তির তারিখ থেকে কোর্স সমাপ্তির বাস্তব ডিউরেশন (অর্থাৎ ১২ মাসের কোর্সের ৮-৯ মাস কিংবা তারও বেশি সময় চলে যাওয়ার পর শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে কিনা!), প্রকৃতপক্ষে যথাযথ প্রশিক্ষণ গ্রহণের সত্যতা, প্রশিক্ষণে সফলতা অর্জনের সত্যতা ইত্যাদি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে বিশেষ কমিটি গঠন করে পিছন থেকে যাচাই-বাছাই করা আবশ্যক।
শুধুমাত্র শিক্ষকতায়ই নয় অন্যান্য চাকরিতেও অবৈধ সনদধারী থাকার সম্ভাবনা আছে। বিশেষ করে যে সকল কর্মে/ চাকরিতে অষ্টম শ্রেণি পাশের সনদ দিয়ে নিয়োজিত হওয়া যায় সে সকল ক্ষেত্রে সর্বাধিক ভুয়া সনদধারী পাওয়ার সম্ভাবনা বিদ্যমান। শুধুমাত্র নাম দস্তখত করতে জানেন, আর কিছুই লিখতে পড়তে পারেন না, এমন অনেকেই অষ্টম শ্রেণি পাস সনদ দিয়ে বিভিন্ন সেক্টরে নিয়োজিত ছিলেন, আছেন। জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা বাতিল হওয়ায় আবারও তেমনটি ঘটবে বলে পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। অপরদিকে টেকনিক্যাল ট্রেনিং ও প্র্যাকটিক্যাল এডুকেশন রিলেটেড সার্টিফিকেট দিয়ে যে সকল কর্মে নিয়োজিত হওয়া যায় সে সকল ক্ষেত্রেও ভুয়া সনদধারী থাকার সম্ভাবনা বেশি। এমন অনেক চাকরিজীবী আছেন যারা তাদের সনদে লিখিত যোগ্যতা ও দক্ষতা ন্যূনতম প্রমাণে সক্ষম নন। লোভে বা চাপে এমন অনেক ভুয়া বা অবৈধ সনদ দিয়ে থাকেন বা দিতে বাধ্য হন অনেক প্রতিষ্ঠান প্রধান। এ সকল বাস্তবতায় জাল বা অবৈধ কিংবা ভুয়া বা আংশিক ভুয়া সনদ কিন্তু অনেক রকম হতে পারে। এক. কোন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়নি, নির্ধারিত কোর্স সম্পন্ন করেনি, পরীক্ষায় বা কাজে অংশগ্রহণ করেনি এমন কাউকে কোন পরীক্ষা পাশের বা কাজের দক্ষতা লাভের সনদ তৈরি করে দেওয়া। দুই. প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছে কিন্তু কোর্স সম্পন্ন করেনি ও পরীক্ষায় বা কাজে অংশগ্রহণ করেনি এমন কাউকে কোন পরীক্ষা পাশের বা কাজের দক্ষতা লাভের সনদ দেওয়া। তিন. প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছে কিন্তু নির্ধারিত কোর্স সম্পন্ন করেনি ও পরীক্ষায় বা কাজে অংশগ্রহণ করে কৃতকার্য হয়নি এমন কাউকে সনদ দেওয়া। চার. প্রতিষ্ঠানে বিলম্বে ভর্তি হয়েছে বিধায় বা অন্য কোন কারণে নির্ধারিত কোর্স সম্পন্ন করেনি বা করতে পারেনি তাকে অনৈতিকভাবে পাস দেখিয়ে/করিয়ে সনদ দেওয়া। পাঁচ. পরীক্ষায় বা মূল্যায়নে নকল করার অবাধ/উন্মুক্ত সুযোগ দিয়ে পাস করিয়ে সনদ দেওয়া। ছয়. প্রকৃত প্রাপ্ত গ্রেডকে অবৈধ ভাবে আপগ্রেড করে সনদ দেওয়া। অর্থাৎ জাল বা অবৈধ সনদ কিংবা ভুয়া বা আংশিক ভুয়া সনদ যথাযথ কর্তৃপক্ষের প্রকৃত কাগজে প্রকৃত সিল-স্বাক্ষর যুক্ত হয়েও তৈরি হতে পারে, আবার সবকিছুই নকল হতে পারে। যখন সবকিছুই নকল হয় তখন শুধুমাত্র সনদ যাচাই করে সত্যতা/ অসত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। কিন্তু যখন যথাযথ কর্তৃপক্ষের আসল কাগজে আসল সিল-স্বাক্ষর যুক্ত হয়ে অবৈধ বা ভুয়া কিংবা আংশিক ভুয়া সার্টিফিকেট তৈরি হয় তখন সেটির যাচাই কাজ অনেক পিছন থেকে শুরু করতে হয়। তাই সে প্রক্রিয়াটি অনেক গভীর ও দীর্ঘ হয়। তেমন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সনদের সত্যতা যাচাই করা হয় না বললেই চলে। তাই অনেক ভুয়া বা অবৈধ সনদধারীরা আলোচনার ও ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। তারা টেকনিক্যাল এডুকেশন এবং সাধারণ শিক্ষা উভয় ধরনের বা একেক জন একেক ধরনের সনদধারী হতে পারে। বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে সার্বিকভাবে বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত রাখা অত্যাবশ্যক। তা না হলে একসময় জাল সনদের জালে আটকে যেতে পারে আমাদের অনেক ক্ষেত্র। যে করেই হোক ভুয়া শিক্ষকের শিক্ষকতা ও ভুয়া চিকিৎসকের চিকিৎসা থেকে মুক্ত হওয়াসহ ভুয়া বা অবৈধ সনদধারীমুক্ত করতে হবে আমাদের দেশের প্রতিটি ব্যক্তি, প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ও সবকটি ক্ষেত্র।<
লেখক: অধ্যক্ষ, শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
https://epaper.dainikbangla.com.bd/home/displaypage/news_2024-05-03_5_15_b