রুদ্ধ হোক অপসংস্কৃতি বিস্তারের পথ, দৈনিক বাংলা ১৩ মার্চ ২০২৪

পত্রিকার লিংক

রুদ্ধ হোক অপসংস্কৃতি বিস্তারের পথ  

মো. রহমত উল্লাহ্

দৈনিক বাংলা, ১৩ মার্চ ২০২৪

>হাজার বছরের সংগ্রাম ও সাহসী বুকের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের বাঙালিত্ব, বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ। সেই সাথে অর্জিত আমাদের নিজস্ব সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। আমাদের রয়েছে পরিশীলিত পোশাক-আশাক, চলন-বলন, রীতিনীতি, সাজগোজ, আচার-আচরণ, জীবনযাপন, খাদ্য-খাবার, রুচি-পছন্দ, বাদ্য-বাজনা, সুর-ছন্দ, নাচ-গান, ভাষা-সাহিত্য ইত্যাদি। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমরা আজ ভুলতে বসেছি অনেক কিছুই। হারাতে বসেছি আমাদের অতীত ঐতিহ্য ও নিজস্বতা। ইচ্ছে করে, ন্যাকামি করে, আধুনিকতা করে বিকৃত করছি মায়ের ভাষার উচ্চারণ। পরিধান করছি ভিন দেশিদের পোশাক। চুল কাটছি উদ্ভট করে। বিদেশি গান গাইছি ও শুনছি আঁকাবাঁকা হয়ে। বাংলা গানের কথায় জুড়ে চিচ্ছি ইংরেজি গানের সুর। এসব বিকৃত আধুনিকতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন একশ্রেণির ন্যায়নীতিহীন অভিভাবক এবং এসব প্রচার করছে কিছু ন্যায়নীতিহীন রেডিও-টেলিভিশন আর ওপেন কনসার্ট।


ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনসহ বিভিন্ন ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, প্রতিষ্ঠানিক অনুষ্ঠানিকতা উপলক্ষে এমনকি জাতীয় দিবসেও বড়-ছোট অনেক শহরে, কিছু কিছু উপশহরে, কোনো কোনো মফস্বল এলাকায় এমনকি বাসা-বাড়ির ছাদে বা সামনের রাস্তায় ওপেন বাজানো হচ্ছে বিকট শব্দে বিদেশি বাদ্যযন্ত্র, গাওয়া হচ্ছে ইংরেজি ও হিন্দি গান, করা হচ্ছে উদ্ভট নৃত্য! হারাম করে দেয়া হচ্ছে এলাকাবাসীর সারারাতের ঘুম। বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, গায়ে হলুদে, বিয়েতে, জন্মদিনে, মুসলমানিতে, ঈদে, পূজায়, বড়দিনে, ইংরেজি নববর্ষে, এমনকি বাংলা নববর্ষেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে অপসংস্কৃতির চর্চা হয়ে থাকে। অথচ এসবের প্রতিবাদ করার শক্তি সাহস, মনমানসিকতা যেন আজ আর অবশিষ্ট নেই কারোর মাঝেই। মনে হচ্ছে, যেখানে সেখানে, যখন তখন তাদের এসব অশান্তি করার অধিকার আছে; কিন্তু আমাদের নিজের ঘরে শান্তিতে ইবাদত করার, লেখাপড়া করার, ঘুমিয়ে থাকার কোনো অধিকার নেই। (বর্তমান পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশেই অন্যের অসুবিধা হয় এমন স্থানে ও সময়ে বিশেষ করে রাত ১০টার পরে লাউড স্পিকার চালানো যায় না।) অথচ নিজের দল ভারী করার আশায় এসবে সমর্থন ও অর্থ দিয়ে থাকে কেউ কেউ, অংশ নিয়ে থাকে তাদের অনুসারীরা। প্রকৃত বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী নেতৃবৃন্দ এড়াতে পারেন না এ দায়। বাস্তবে আমাদের পুলিশ ও সিভিল প্রশাসন আন্তরিক হলে এসব দমন করা যে অসম্ভব তা কিন্তু নয়। 


অন্যদিকে কতিপয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নবীন বরণ, পিকনিক, রেগ-ডে, ক্লাস পার্টি, সংবর্ধনা প্রদান, বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদিসহ বিভিন্ন উপলক্ষে করা হচ্ছে চরম অশালীন বিদেশি নাচ-গানের আয়োজন। ব্যয় করা হচ্ছে অভিভাবকদের কাছ থেকে আদায় করা অর্থ। আর শিক্ষার্থীদের দেয়া হচ্ছে অপসংস্কৃতি অনুশীলন ও বাঙালি সংস্কৃতি পরিহারের কুশিক্ষা। অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও শিক্ষকরা বাধ্য হচ্ছেন এমন আয়োজন করতে। তাছাড়া কতিপয় বিবেকহীন অতি উৎসাহী শিক্ষার্থী, শিক্ষক, প্রতিষ্ঠান প্রধান ও পরিচালক আধুনিকতার নামে এসব অপসংস্কৃতি চর্চার আয়োজন করে থাকে। এসব যে শুধু ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই হয়ে থাকে তা কিন্তু নয়; আমাদের জাতীয় শিক্ষাক্রমের আওতাভক্ত কতিপয় বাংলা ও ইংলিশ ভার্শন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও কমবেশি এসব হয়। তাছাড়া বিভিন্ন পিকনিক স্পটে, পার্কে, রিসোর্টেও প্রতিনিয়ত হাই ভলিয়ামে বাজানো হয়ে থাকে বিদেশি নাচের গান-বাজনা। অথচ এসব যেন খেয়ালই করছে না সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ। দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিদেশি নাচ-গান বাদ্য-বাজনা নিষিদ্ধ করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি কঠোর আদেশ ও তার সঠিক বাস্তবায়ন তদারক করা একান্ত আবশ্যক। 


শুধু যে আনুষ্ঠানিকতার নামেই, বাড়িঘরের বাইরেই অপসংস্কৃতি চর্চা হচ্ছে তা কিন্তু নয়। দৃষ্টি নিজের দিকে সামান্য ফিরালেই দেখা যাবে- কী হচ্ছে ঘরে ঘরে? কী দেখা হচ্ছে টিভিতে? সারা বছর চলছে বিদেশি চ্যানেল, হিন্দি সিরিয়াল। অধিকাংশ বাসা-বাড়ির একটিমাত্র টিভির রিমোট বড়দের হাতে বিশেষ করে গৃহকর্ত্রীর হাতে থাকে বিধায় ছোটরাও দেখতে বাধ্য হচ্ছে বড়দের কূটচালে ভরা অতি নাটকীয় অবাস্তব হিন্দি সিরিয়াল। তাই আমাদের শিশুরা বেড়ে উঠতে বাধ্য হচ্ছে বিকৃত রুচি ও মানসিকতা নিয়ে। এই সিরিয়াল পাগলেরা এমনই পাগল যে, শহিদ দিবসে, স্বাধীনতা দিবসে, বিজয় দিবসে, ঈদের দিনে, পূজার দিনে, পহেলা বৈশাখে, এমনকি শোকের দিনেও দেখেন না বাংলাদেশের অনুষ্ঠান। ফলে ছোটরাও দেখতে পারে না আমাদের দেশের অনেক শিক্ষণীয় বাংলা অনুষ্ঠান। শুনতে পারে না আমাদের গুণীজনদের কথা। জানতে পারে না আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। অর্থাৎ বিশেষ বিশেষ দিবসেও আমাদের শিশুদের মাথায় ঠেলে দেয়া হচ্ছে ভিনদেশি সংস্কৃতি। 


আশির দশকে এমন একটা সময় ছিল, যখন এসব হিন্দি চ্যানেল আমাদের টিভিতে দেখা যেত না। আমাদের এত টিভি চ্যানেলও ছিল না। তখন সবাই বিটিভির অনুষ্ঠানই দেখতে বাধ্য ছিল। আর তখন ছিল আমাদের ইতিহাস বিকৃত ও ঐতিহ্য ধ্বংস করার যুগ। চির বিজয়ী বীরবাঙালি জাতিকে বিভক্ত করে ভীতু বাংলাদেশি বানানোর যুগ। তখন সঠিক ইতিহাস প্রচার করা হতো না আমাদের টিভিতে। তাই বাধ্য হয়ে ভুলটাই সবাই দেখতে হতো তখন। প্রকৃত ইতিহাস সমৃদ্ধ বইও ছিল কম। পাঠ্য বইয়েও ছিল অনেক ভুল তথ্য। এখনকার মত ওপেন সোর্স ছিল না তখন। ছিলনা এত স্বাধীনভাবে সবকিছু যাচাই করার ও জানার সুযোগ। ডিজিটাল বা স্মার্ট ছিল না দেশ। বিভ্রান্তিতে আক্রান্ত ছিল আমাদের ভাষা, দেশ ও জাতির ইতিহাস। সেই সময়ের বিভ্রান্তরাই এখনকার বেশির ভাগ দাদা-দাদি, নানা-নানি, মা-বাবা, চাচা-মামা, ফুফু-খালা। তাদের হাতেই এখন বেশিরভাগ টিভি সেটের রিমোট। তাদের কারো কারো প্রকৃত বাঙালিত্ব বোধ না থাকায় বা দুর্বল থাকায় এবং প্রত্যাশিত মানের অনুষ্ঠান কম থাকায় অনেকেরই ভালো লাগে না বাংলাদেশের অনুষ্ঠান। তারাই বেশি পাগল হয় হিন্দি সিরিয়াল দেখার জন্য। তারা না করে বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা, না করে ইসলামি সংস্কৃতির চর্চা।


এখন যখন আমাদের অনেক টিভি চ্যানেল। এখন যখন আমাদের অধিকাংশ টিভিতে আমাদের সঠিক ইতিহাস ও ঐতিহ্য কম-বেশি প্রচারিত হচ্ছে; তখন আমাদের ওপর জেঁকে বসেছে বিদেশি চ্যানেল বিশেষ করে ভারতীয় হিন্দি চ্যানেল। অর্থাৎ বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা আগে শিখেছে ভুল ইতিহাস আর এখন শিখছে ভিনদেশি কালচার। এমতাবস্থায় দাবি উঠছে, কয়েকটি বিদেশি চ্যানেল বন্ধ করার। মতামত রয়েছে এই দাবির পক্ষে বিপক্ষে। সেটি বন্ধ হলে ভালো। না হলে, কমপক্ষে আমাদের শহিদ দিবসে, স্বাধীনতা দিবসে, বিজয় দিবসে, শোক দিবসে, পহেলা বৈশাখে এবং অন্যান্য বিশেষ দিবসে বন্ধ রাখা হোক সব বিদেশি চ্যানেল, বিদেশি নাচ-গান ও বাদ্য-বাজনার ওপেন কনসার্ট। যাতে অন্তত এ কয়েকটা দিন আমাদের কিছু সংখ্যক সন্তানরা দেখতে পারে আমাদের চেহারা, আমাদের দেশের সৌন্দর্য, আমাদের সংস্কৃতির রূপ; শুনতে পারে আমাদের কথা, জানতে পারে আমাদের অতীত, জাগ্রত করতে পারে জাতীয় চেতনা, বর্ধিত করতে পারে দেশপ্রেম, তৈরি করতে পারে সুরুচি, রচনা করতে পারে সঠিক ভবিষ্যৎ।


লেখক: অধ্যক্ষ, শিক্ষাবিদ ও শিশুসাহিত্যিক


১০.০৩.২০২৪


https://epaper.dainikbangla.com.bd/home/displaypage/news_2024-03-13_5_15_b

Previous Post
Next Post

About Author

0 মন্তব্য(গুলি):