ভাষীদের ঐকমত্যই ভাষার শৃঙ্খলা ও শক্তি। মো. রহমত উল্লাহ্
দৈনিক বাংলা, ০১ মার্চ ২০২৪
>ভাষা আন্দোলন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি আমাদের এ আন্দোলনে সফলতা লাভের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে মাত্র। আমাদের রক্তে রঞ্জিত সেই ২১শে ফেব্রুয়ারি এখন ইউনেসকো স্বীকৃত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। গত ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ তারিখে ১৮৮ দেশের সমর্থনে এই স্বীকৃতি অর্জিত হয়। বিশ্বের ১৯৪ টি দেশ আজ উদযাপন করছে আমাদের শহিদদিবস তথা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের ও গৌরবের। ভাষীর সংখ্যা বিবেচনায় বাংলা ভাষার স্থান এখন ৫ম। বহুল ব্যবহৃত ভাষা হিসেবে বিশ্বে বাংলার অবস্থান ৭ম। প্রায় ৩০ কোটি মানুষ কথা বলে বাংলায়; যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ। সময় চলে যাচ্ছে মূল্যায়নের। নিজেকে প্রশ্ন করে জানা অপরিহার্য; বাংলা ভাষার আন্দোলনে তথা সঠিক বাংলা চর্চায় আমরা কতটা সফল?
বাস্তবে বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি অর্জনে আমাদের সফলতা কোন ক্ষেত্রেই সন্তোষজনক নয়। এমনকি সবাই সকল শব্দ একইভাবে বাংলায় লেখার ক্ষেত্রেও আমরা বিভিন্ন কারণে ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি! 'শহিদমিনার' শব্দটিও আমরা একেকজন একেকভাবে লিখে থাকি। যেমন, শহীদ মিনার, শহীদমিনার, শহিদ মিনার, শহিদমিনার অর্থাৎ এক শব্দে, দুই শব্দে, ঈ-কার দিয়ে, ই-কার দিয়ে লিখি! অথচ সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট’ কর্তৃক প্রকাশিত এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় চারজন পন্ডিত আনিসুজ্জামান, ওয়াহিদুল হক, জামিল চৌধুরী ও নরেন বিশ্বাস কর্তৃক যৌথভাবে সম্পাদিত ব্যবহারিক বাংলা উচ্চারণ অভিধানে ‘শহিদমিনার’ এভাবে ই-কার দিয়ে এক শব্দে লেখা আছে। যার অর্থ শহিদদের উদ্দেশে নির্মিত স্মৃতিসৌধ। স্মৃতিসৌধ ও শহিদমিনার দুটোই সমাসবদ্ধ পদ বিধায় এক শব্দে লেখা উচিত। শহিদমিনার বিদেশি শব্দ বিধায় এটি ই-কার দিয়ে লেখাই বাংলা একাডেমির বিধান। অথচ এটি অনুসরণ করেন না অনেক ব্যক্তি, অনুসরণ করা হয় না অনেক সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। শুধু তাই নয় ‘ফেব্রুয়ারি’ ‘প্রভাতফেরি’ বানানও আমরা কেউ কেউ ই-কার দিয়ে আবার কেউ কেউ ঈ-কার দিয়ে লিখে থাকি। আবার কেউ কেউ ‘প্রভাত’ ‘ফেরি’ আলাদা করে লিখে থাকি। ‘শহিদদিবস’ কেউ একসঙ্গে লিখি, কেউ আলাদা ‘শহিদ’ ‘দিবস’ লিখি। এমন বিস্তর উদাহরণ দেওয়া যাবে। এর কারণ যেমন অনেক, তেমনি মতপার্থক্যও কম নয়। অন্তত শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সকল সরকারি প্রতিষ্ঠান, সকল সরকারি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও তালিকাভুক্ত গণমাধ্যম সমূহ যদি একই কথা/শব্দ সদা-সর্বদা একই রকম করে লিখত তাহলে এতদিনে অনেকটা কেটে যেত আমাদের বিভ্রান্তি। কিন্তু এই বিভ্রান্তির ভিতর বেড়ে ওঠা, শিক্ষা লাভ করা সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী, সকল গণমাধ্যম কর্মী, এমনকি সকল শিক্ষকও এসব বিভ্রান্তির উর্ধ্বে নয়!
স্কুল-কলেজ এবং মাদ্রাসার শিক্ষকগণ একই রকম বানান অনুসরণ করেন না এমন অনেক শব্দ আছে। স্কুল-কলেজের অধিকাংশ শিক্ষক এনসিটিবির তথা বাংলা একাডেমির বানান রীতি অনুসরণে একমত হলেও অধিকাংশ মাদ্রাসার শিক্ষক সেটি পুরোপুরি অনুসরণ করতে নারাজ বলেই প্রতিমান হয়। বিশেষ করে মাদ্রাসার হুজুরগণ ব্যক্তিগতভাবে যে সকল বই বা কিতাব বাংলায় লিখে থাকেন সেগুলোতে তারা প্রায় সবাই সর্বাধিক আরবি, উর্দু, ফার্সি ভাষার শব্দ ব্যবহার করে থাকেন এবং ঐ সকল শব্দের উচ্চারণ অনুযায়ী বানান লেখাকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন বিভিন্ন যুক্তিতে। তাদের এই প্রবণতা ইংরেজিসহ অন্যান্য ভাষার শব্দ বাংলায় লেখার ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা যায়। যদিও বিশ্বের অনেক দেশের অনেক ভাষার অনেক শব্দই উচ্চারণ অনুযায়ী লেখা হয় না বা বানান অনুযায়ী উচ্চারণ হয় না। যেমন, judge, character, lieutenant ইত্যাদি। বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয় যে, মাদ্রাসা সংশ্লিষ্টরা অধিকাংশ বিদেশি শব্দে ঈ-কার প্রয়োগ করে থাকেন। এ কিতাবগুলো যারা পড়ান ও যারা পড়েন তারা সবাই বিদেশি শব্দসহ অন্যান্য অনেক শব্দে ঈ-কার প্রয়োগে অভ্যস্ত হয়ে উঠেন। এ ধারার বিপুসংখ্যক শিক্ষার্থী যখন হুজুর হন বা অন্য কর্মক্ষেত্রে যান বা লেখালেখি করেন তখন তারা অনেক শব্দের তেমন (উচ্চারণ অনুযায়ী) বানান অর্থাৎ বাংলা একাডেমির বিধি বহির্ভূত বানানই লিখে থাকেন বেশি। সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন মিডিয়াতেও এটি লক্ষ্য করা যায়। অথচ স্কুল-কলেজের সাথে সম্পৃক্ত অধিকাংশরাই এরূপ উচ্চারণ অনুযায়ী সকল বানান লেখার ব্যাপারে একমত পোষণ করেন না। ফলে অনেক শব্দের বানান বাংলায় লেখার ক্ষেত্রে আমরা জাতিগতভাবে মোটাদাগে দুইভাগে বিভক্ত এবং একে অপরের লেখাকে ভুল বলায় লিপ্ত। শিক্ষাধারার ভিত্তিতে সৃষ্ট আমাদের এ দুই ভাগের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ভাষা বিষয়ক জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় একটি চলমান অন্তরায়।
অন্য বাস্তবতা হচ্ছে শিক্ষার্থীরা কোনো একটি শব্দের বানান তাদের পাঠ্যপুস্তক থেকে একরকম শিখে, আবার যখন অন্যান্য বইয়ে, পত্রপত্রিকায়, প্রজ্ঞাপনে, টেলিভিশনে, লিফলেটে, ফেস্টুনে, ব্যানারে, নোটিশে, চিঠিপত্রে অন্যরকম দেখে, তখন বিভ্রান্তি নিয়েই বেড়ে ওঠে। তাই সঠিক শিক্ষাটি তাদের অন্তরে/ অস্তিত্বে স্থায়ীত্ব লাভ করে না, করতে পারে না। তাই তারা নিজেরাও একেক সময় একেক ক্ষেত্রে একেকরকম লিখে থাকে। বড় হয়ে নিজের এই দুর্বলতা বা অনাস্থা আড়াল করার জন্য কেউ কেউ বলে থাকে, একভাবে লিখলেই হয়, কোনটাই ভুল নয়! তেমন বিভ্রান্তি ও মনোভাব নিয়েই বেড়ে উঠেছি আমি ও আমরা অনেকেই। এর বাইরে নিজের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ও বিশেষ কারো সহযোগিতায় ব্যতিক্রম হয়ে ওঠার উদাহরণ খুব বেশি নেই।
বাংলা শব্দের বানান বিভ্রাটের আরও একটি বড় কারণ যুক্ত হয়েছে সম্প্রতি। সেটি হলো মোবাইল ফোনে ও কম্পিউটারে লেখার ক্ষেত্রে অ্যাপ বা সফটওয়্যারের ভুল সাজেশন। বিশেষ করে বহুল ব্যবহৃত মোবাইল ফোন সেটে ইউনিকোড ফন্টে লেখার ক্ষেত্রে ও ভয়েস টাইপ করার ক্ষেত্রে এই সমস্যাটি অত্যন্ত প্রকট। যা আমি নিজেও অত্যন্ত বিরক্তি সহকারে ফেস করি প্রতিনিয়ত। মোবাইল ফোন সেটে বাংলা লেখার কিবোর্ড অভ্র, রিদমিক, জি-বোর্ড ইত্যাদি অ্যাপ/ সফটওয়্যা তৈরিতে বাংলা একাডেমির বানান রীতি পুরোপুরি অনুসরণ করা হয়নি বিধায় অনেক ভুল বানান সাজেশন দিয়ে থাকে। বিশেষ করে বিদেশি শব্দসমূহে ঈ-কার যুক্ত বানান লিখে/দেখিয়ে থাকে এবং সমাসবদ্ধ পদগুলোকে পৃথকভাবে লিখে/দেখিয়ে থাকে। যেমন শহীদ মিনার, শহীদ দিবস, ভাষা শহীদ, ফেব্রুয়ারী, জানুয়ারী, সরকারী, ইংরেজী, বীমা, শ্রেণী, ফ্রী ইত্যাদি। অপরদিকে যতিচিহ্ন প্রয়োগের ক্ষেত্রেও সমস্যা হয়ে থাকে। যেমন, (.) একবিন্দু ও (:) কোলনকে (ঃ) বিসর্গ লিখে/দেখিয়ে থাকে। তাই বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারী বিশেষকরে অগণিত ফেসবুক ব্যবহারকারী এই ভুল বানানগুলো দেখতে দেখতে ও লিখতে লিখতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। ফলে তারা ভুল-শুদ্ধের বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়! ভুলের ছড়াছড়িতে শুদ্ধটিও ভুলে যায়!
অপরদিকে বাংলার পন্ডিতগণের একদল বলেন, সমাসবদ্ধ পদ একত্রে মিশে বসবে। তা না হলে ভুল হবে। আবার অন্যদল বলেন, সমাসবদ্ধ পদ একত্রে মিশে না বসলেও ভুল হবে না। অর্থাৎ ফাঁক রেখে পাশাপাশি বসলেও শুদ্ধ হবে। একেকজনের যুক্তি এক এক রকম। লক্ষণীয়, ‘Education reporter- এডুকেশন রিপোর্টার’ ফাঁক রেখে দুই শব্দে লেখার ব্যাপারে সবাই একমত হলেও ‘শিক্ষা প্রতিবেদক’ বা ‘শিক্ষা সাংবাদিক’ ফাঁক রেখে দুই শব্দে লেখার ব্যাপারে সবাই একমত নন। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে এমন উদাহরণ অনেক। আমি মনে করি, সমাসবদ্ধ পদ মিশিয়ে বা ফাঁক রেখে যেভাবে যেখানে লিখলে সঠিক অর্থ প্রকাশ পায়, সংক্ষিপ্ত হয়, শ্রুতিমধুর হয়, লিখতে/বলতে ও বুঝতে সহজ হয় সেখানে সেভাবে লেখাই উত্তম। যেমন, মুক্তিসেনা, স্মৃতিসৌধ, মাতৃভাষা, শহিদমিনার, শহিদদিবস, ভাষাশহিদ, পুষ্পাঞ্জলি, নবীন বরণ, প্রধান শিক্ষক, শিক্ষক সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ সরকার, সংবাদপত্র পরিচালক ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রে অগণিত সমাসবদ্ধ পদ একত্র বা সন্ধি করতে গিয়ে অতি দীর্ঘ জটিল শব্দ তৈরি করাও উচিত নয়। কেননা, অতি দীর্ঘ জটিল শব্দ লিখতে, পড়তে ও মনে রাখতে অধিক চাপ নিতে হয়। যা শিশুদের জন্য আরও বেশি কষ্টকর হয়। তাই দুটির অধিক সমাসবদ্ধ পদ একত্রিত না করা এবং অধিক বর্ণ যুক্ত জটিল শব্দ তৈরি না করার বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছা যায় কিনা ভেবে দেখা উচিত।
মোট কথা, সকল বিভ্রান্তি নিরসন করে ভাষা যত সহজ করা যায়, বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো যায়, সাধারণ মানুষের উপযোগী করা যায় ততই মঙ্গলজনক। কেননা, ভাষার ব্যবহার বৃদ্ধি ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এসব অপরিহার্য। সেই সাথে সকল সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সকল ধরনের ও পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সকল প্রকার এনজিও, সকল ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া, সকল প্রকাশনা সংস্থা, বাংলা লেখার অ্যাপ বা সফটওয়্যার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এবং এ সকল প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সবাই যাতে একই শব্দ বাংলায় একইভাবে লিখতে বাধ্য হন তেমন ঐক্য প্রতিষ্ঠার কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যক। যত বেশি শব্দ তেমন ঐক্যের আওতায় আনা যাবে ভাষা তত বেশি শক্তিশালী হবে। লেখায়, বলায়, ভাব প্রকাশে ভাষীদের ঐকমত্যই ভাষার শৃঙ্খলা ও শক্তি।
লেখক: অধ্যক্ষ, গবেষক ও প্রাবন্ধিক
https://epaper.dainikbangla.com.bd/home/displaypage/news_2024-03-01_5_15_b
0 মন্তব্য(গুলি):