শাস্তি দেওয়া সহজ, শিক্ষা দেওয়া কঠিন

 


পত্রিকার লিংক


শাস্তি দেওয়া সহজ, শিক্ষা দেওয়া কঠিন

দৈনিক বাংলা, ১০ জানুয়ারি ২০২৪

মো. রহমত উল্লাহ্

আমাদের দেশের অনেক স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার কতিপয় শিক্ষক এখনো শিক্ষার্থীদের শাস্তি দেওয়াকেই শিক্ষা দেওয়ার সবচেয়ে কার্যকর উপায় বলে মনে করেন। কেননা, তারা সহজে শাস্তি দিয়ে শিক্ষা নিশ্চিত করতে চান। বাস্তবে শাস্তি দেওয়া যত সহজ শিক্ষা দেওয়া তত সহজ নয়! শাস্তি দেওয়ার জন্য তেমন সময়, শ্রম, মেধা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু সঠিক শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজনীয় পরিচর্যার জন্য অনেক সময়, শ্রম, মেধা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রয়োগ করতে হয়। অর্থাৎ প্রকৃত শিক্ষা দেওয়ার জন্য অনেক অনেক যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রয়োজন হয়। যিনি শিক্ষার্থীদের শাস্তি না দিয়ে সঠিক শিক্ষা প্রদানে তথা আচরণের অনুকূল স্থায়ী পরিবর্তন সাধনে সক্ষম তিনি অবশ্যই উত্তম শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের শাস্তি দিয়ে বা ভয় দেখিয়ে নয়; বরং অনুকরণীয় অনুসরণীয় আদর্শ ব্যক্তিত্ব দিয়ে, সত্যিকারের আদর দিয়ে, উৎসাহ-উদ্দীপনা দিয়ে, বিবেক জাগ্রত করে, মানব ও দেশ প্রেমে উদ্ভূদ্ধ করে, বাস্তবতাপূর্ণ উচ্চাশা দিয়ে, সোনালি ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনতে দিয়ে, আর সবার মত সেও পারে এমন সৎসাহস দিয়ে, ভয়ভীতি হীন আনন্দঘন পরিবেশ দিয়েই সুনিশ্চিত করা যায় মেধানুযায়ী সুশিক্ষা। 


পরীক্ষায় এ+ গ্রেড এবং কর্ম জীবনে অধিক আর্থিক সুবিধা হাত করা মানেই যে এ+ মানুষ হওয়া নয়; তা আমরা অনেকেই বুঝিনা, বুঝতে চাইনা বলেই নিষ্ঠুরভাবে চালাই ‘মানব সন্তান’দের পিটিয়ে মানুষ করার প্রতিযোগিতা। ফলে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য মানবিক গুণাবলি জাগ্রত করার পরিবর্তে আমরা প্রতিনিয়ত শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন করে করে চিরতরে হটিয়ে দিই অনেকের ভিতরের অধিকাংশ জন্মগত মানবিক গুণাবলী। সাধিত হয় না তাদের আচরণের স্থায়ী অনুকূল পরিবর্তন। অর্জিত হয় না কাঙ্খিত সফট স্কিল। ফলে লেখাপড়া শিখেও তারা হয়ে উঠে আরো বেশি লোভি, নিষ্ঠুর ও আত্মকেন্দ্রিক। স্বপ্রনোদিত হয়ে এগিয়ে আসে না অপরের কল্যাণে। পরিবার, রাষ্ট্র ও সমাজে বৃদ্ধি পায় অনাচার এবং অস্থিতিশীলতা। 


মনে রাখতে হবে, বর্তমান শিক্ষার্থীরা আগের মত নয়। এখন তারা অনেক তথ্য সমৃদ্ধ, আবেগপ্রবণ, অধিকার সচেতন ও আত্মমর্যাদা বোধ সম্পন্ন। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্বময় বিস্তৃত তাদের দৃষ্টি। বিশ্বজুড়ে তাদের পাঠশালা। অনেক রকম তাদের শিক্ষার ক্ষেত্র। অনেক রকম তাদের শিক্ষক। অনেক বেশি তাদের ইনফরমাল এডুকেশন। অনেক বেশি এখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা। আগের দিনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতো না সবাই। হাতেগোনা যারা ভর্তি হতো তারাও টিকে থাকতো না লেখাপড়ায়। শিক্ষকদের মার খেয়ে প্রত্যক্ষ প্রতিবাদ না করলেও অধিকাংশরাই নিরব প্রতিবাদ করে, নিজেকে অযোগ্য মনে করে, পালিয়ে যেতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। তাদের আর কোনদিন ফিরে আসা হতো না শিক্ষায়! চিহ্নিত হতোনা তাদের মেধার ক্ষেত্র। অর্জিত হতো না সঠিক যোগ্যতা ও দক্ষতা। শেষমেষ লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত থেকে যেতো বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে। যারা টিকে থাকতো তারা জন্মগতভাবে অত্যন্ত মেধাবী ও ব্যক্তিগত বা পারিবারিকভাবে নম্র-ভদ্র এবং শিক্ষা লাভে বদ্ধপরিকর হাতেগোনা কয়েকজন। তখনকার প্রায় শতভাগ অভিভাবক ও শিক্ষক মনে করতেন যে, কঠিন শাস্তি দিয়েই শিক্ষা দিতে হয়। অভিভাবক শিক্ষককে বলেই দিতেন, তার সন্তানকে বকাবকি ও মারধর করে মানুষ করার জন্য। যিনি শিক্ষার্থীদের বেশি পেটাতেন তাকেই ভালো শিক্ষক মনে করা হতো! তখন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ের সংখ্যাই ছিল কম। সেভাবে ভাবলে আর চলবে না এখন। পাল্টাতে হবে নিয়ন্ত্রণ কৌশল। শক্তি খাটিয়ে নয়, বুদ্ধি খাটিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে বর্তমান ছেলেমেয়েদের। শতভাগে উন্নীত করতে হবে শিক্ষার হার। সবাইকেই ধরে রাখতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে শিক্ষার্থীদের সঠিক জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ। যেনো তারা হয়ে উঠতে পারে বিশ্বমানের নাগরিক। সেই অসাধ্য সাধন করার জন্য শিক্ষকদের হতে হবে সর্বাধিক যোগ্য ও দক্ষ। তাই বদলাতে হবে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনমান।  

লেখক: অধ্যক্ষ, শিক্ষাবিদ ও শিশুসাহিত্যিক


পত্রিকার লিংক:

https://epaper.dainikbangla.com.bd/home/displaypage/news_2024-01-10_5_14_b

Previous Post
Next Post

About Author

0 মন্তব্য(গুলি):