প্রসঙ্গ: ভালো কলেজ, মন্দ কলেজ
দৈনিক বাংলা, ০১ জানুয়ারি ২০২৪
মো. রহমত উল্লাহ্
>বাছাই করা ভালো শিক্ষার্থীদের কৃতিত্বে ‘ভালো কলেজ’ নামে খ্যাত শহরকেন্দ্রিক কিছু কলেজে রয়েছে হাজার হাজার শিক্ষার্থী। এখানে শিক্ষকের তুলনায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা আদর্শ অনুপাতের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। তদুপরি তারাই অনুমতি পায় একাধিক শিফট ও শাখা খুলে আরো বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করার। অপরদিকে, সারাদেশে বিদ্যমান হাজার হাজার কলেজ-মাদ্রাসায় রয়েছে কাম্য শিক্ষার্থীর তীব্র সংকট। প্রতি বৎসর উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে ফাঁকা থাকছে কমবেশি ১০ লাখ আসন। তদুপরি স্থাপিত হচ্ছে আরো নতুন নতুন কলেজ ও মাদ্রাসা। কাম্য শিক্ষার্থী পাচ্ছে না অনেক এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
৫০ থেকে ১০০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে বছরের পর বছর চলে আসছে এমন দু-চারটি করে কলেজ-মাদ্রাসা পাওয়া যাবে প্রায় প্রতিটি থানা/ উপজেলাতেই। শিক্ষকের তুলনায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা আদর্শ অনুপাতের চেয়ে অনেক কম হলেও সেসব কলেজের শিক্ষক, প্রশাসক, ভবন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় আনা হলে সবই যে মন্দ, তা কিন্তু নয়। তথাপি সেসবকে বলা হচ্ছে ‘মন্দ কলেজ’। অর্থাৎ সেসব কলেজে পাশের হার কম তাই সেগুলো ভালো কলেজ নয়। ২০২৩ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায় অনেক সরকারি/ বেসরকারি কলেজের তুলনায় প্রাইভেট, মিশনারি ও বিশেষায়িত কলেজগুলো এগিয়ে। অতীতেও এমনটি লক্ষ্য করা গেছে। অথচ সরকারি কলেজে বিসিএস ক্যাডার শিক্ষক ছাড়াও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা তুলনামূলকভাবে বেশি। লক্ষণীয় যে, অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে এখন শুধু ভালো শিক্ষক ও ভালো সুযোগ-সুবিধা নয়, বাছাই করা ভালো শিক্ষার্থী ভালো ফলাফলের তথাকথিত ‘ভালো কলেজে’র প্রধান উপাদান বা নিয়ামক। তাছাড়া কমিটির ও রাজনীতির অশুভ প্রভাব মুক্ত থাকাও একটি বিশেষ বিষয়।
আলোচিত ভালো কলেজগুলোর আশেপাশে অবস্থিত কোচিং সেন্টার ও শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানোর দিকে সামান্য নজর দিলে সহজেই বোঝা যায় সেসব কলেজে কেমন লেখাপড়া হয়। যাদের ছেলেমেয়ে সেসব কলেজে পড়ে, তারা কলেজের বেতন-ফি ও কোচিং-প্রাইভেট পড়ার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পান ‘ভালো কলেজ’ কাকে বলে! আসলে ভালো কলেজ তো হবার কথা সেসব কলেজ যেখানে এসএসসিতে জিপিএ ২, ৩, ৪ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের ভর্তি করে শুধুমাত্র ক্লাসে পড়িয়ে এইচএসসিতে জিপিএ ৩, ৪, ৫ প্রাপ্ত নরম যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষার্থী বের করা হয় এবং তারা বেরিয়ে গিয়ে দেশ ও মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করে। যে সকল কলেজ শতকরা ১০০ ভাগ জিপিএ ৫ প্রাপ্ত (এসএসসিতে) শিক্ষার্থী ভর্তি করে শতকরা ৬০-৮০ ভাগ জিপিএ ৫ প্রাপ্ত (এইচএসসিতে) শিক্ষার্থী বের করে তারা কীভাবে ভালো কলেজ হয়? সব ভালো শিক্ষার্থী নিয়েও তো তারা সবার ভালো ফলাফল নিশ্চিত করতে পারেনি। তারা যদি এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে আনুপাতিক হারে এ, বি, সি, ডি প্রাপ্ত সব গ্রেডের শিক্ষার্থী ভর্তি করতো তাহলেই দেখা যেতো ভালো সুতা দিয়ে ভালো কাপড় বোনা সেসব কারিগরদের দক্ষতা কতটুকু! সেক্ষেত্রে অসুস্থ প্রতিযোগিতার ফলে মন্দ কলেজ নামে চিহ্নিত হয়ে যাওয়া কলেজেও ভর্তি হতো কিছু ভালো শিক্ষার্থী। সেসব কলেজ থেকেও পাওয়া যেত আরও ভালো ফলাফল। কিছুটা হলেও কমে আসতো ভালো-মন্দের ব্যবধান। শহরমুখী হতো না সবাই। হ্রাস পেতো ‘ভালো কলেজ’ নামে পরিচিত কলেজে ভর্তির অসুস্থ প্রতিযোগিতা। হ্রাস পেতো অনেকের শিক্ষা বাণিজ্যের অবাধ সুযোগ। দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের মনে এতোটা আঘাত হানতো না তথাকথিত ভালো কলেজে ভর্তি হতে না পারার অযৌক্তিক কষ্ট। সবদিক বিবেচনা করে সকল অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে এলাকাভিত্তিক কাম্যসংখ্যক কলেজ মানসম্পন্ন করে তোলা কি সরকারের দায়িত্ব নয়? বাড়ির পাশে একটি ভালো কলেজ পাওয়া কি শিক্ষার্থীর অধিকার নয়?
মো. রহমত উল্লাহ্
শিক্ষক ও শিক্ষা বিশ্লেষক
https://epaper.dainikbangla.com.bd/home/displaypage/news_2024-01-01_5_14_b
0 মন্তব্য(গুলি):