শিক্ষকের হাত আরও শক্তিশালী হোক
খোলা কাগজ > ১৭ জুলাই ২০২১
মো. রহমত উল্লাহ্
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে জানা গেছে যে, 'রাজশাহীর বাগমারায় লকডাউন নিশ্চিত করতে গিয়ে এক কলেজ শিক্ষককে পিটিয়ে হাত ভেঙে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে এসি ল্যান্ডের (উপজেলা সহকারী কমিশনার-ভূমি) বিরুদ্ধে। ওই শিক্ষকের নাম আবদুল আজিজ। তিনি উপজেলার সাধনপুর পঙ্গু ও শিশু নিকেতন ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক।' এই সংবাদটি ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে শিক্ষক সমাজে। বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনের ফেসবুক পেইজে এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিচার দাবি করেছেন শিক্ষক সমাজ। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউন অবস্থা বিরাজ না করলে হয়ত এর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসতেন অনেকেই। আমাদের দেশে শিক্ষক লাঞ্চিত হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। বিশেষ করে অসহায় অভাবগ্রস্ত হওয়ার কারণে বেসরকারি শিক্ষকগণই লাঞ্চিত হয়ে থাকেন বারবার। কমিটির লোকজন দ্বারা লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাই ঘটে থাকে বেশি। কমিটির অনেক সদস্যই রক্ষকের ভূমিকা পালন করে না। তাই বিদ্যমান কমিটি ব্যবস্থা এখন প্রশ্নবিদ্ধ! বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিচারকদের কাছেই আশ্রয় নিতে হয় শিক্ষকদের। সেই বিচারকই যদি শিক্ষককে পিটিয়ে হাত ভেঙ্গে দেন তো শিক্ষকের আর আশ্রয় স্থল কোথায়?
'তবে, এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এসি ল্যান্ড মাহমুদুল হাসান। দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, লকডাউন কার্যকর করতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চলাকালে তিনি লোকজনকে ধাওয়া দিয়ে বাড়িতে পাঠানোর সময় কলেজ শিক্ষক আবদুল আজিজ মাটিতে পড়ে গিয়ে আহত হন।' এসিল্যান্ড সাহেবের বক্তব্য অনুসারে মনে হচ্ছে কলেজ শিক্ষক সাহেব মিথ্যা কথা বলেছেন। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এসিল্যান্ড মিথ্যাবাদী নাকি শিক্ষক মিথ্যাবাদী? স্থানীয়ভাবে বসবাসকারী একজন বেসরকারি শিক্ষক সরকারি প্রশাসনের স্থানীয় একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করবেন কেনো, কোন সাহসে? তাদের মধ্যে পূর্ব শত্রুতার কোন সংবাদ তো আমরা পাইনি।
প্রাপ্ত সংবাদ অনুসারে শিক্ষক হিসাবে আব্দুল আজিজ যথেষ্ট উদারতার পরিচয় দিয়েছিলেন এই ঘটনায়। তার স্ত্রী সংবাদদাতাকে বলেছেন যে, ‘এসি ল্যান্ড ক্ষমা চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, আমরা যদি তাকে ক্ষমা না করি, তবে তার চাকরি হুমকির মুখে পড়বে। তাই, আমরা তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। আমাদের আর কোনও অভিযোগ নেই।’ স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম সাজু সাহেব কর্তৃক আয়োজিত শিক্ষা টিভি'র এক আলোচনায় অংশ নিয়ে আব্দুল আজিজ সাহেব নিজেও বলেছেন যে, '…সকালবেলা টিএনও সাহেব এসিল্যান্ডকে নিয়ে আটটা সময় আমার বাসায় ঢুকেন। ঢোকার পরে আমাকে বলেন, আজিজ ভাই, কালকের অনাকাঙ্খিত ঘটনার জন্য আমাদের ভুল হয়ে গেছে। আমাদেরকে আপনি ক্ষমা করেন। আপনার চিকিৎসার খরচ আমরা করব। উনারা এসেছিলেন শুক্রবার দিন। আমি প্রাথমিকভাবে বলেছি, ক্ষমা করে দিব। …কিন্তু পরবর্তীতে তারা আমার সঙ্গে আর কোন যোগাযোগ করেননি!'
ঘটনাটি সেই শুক্রবারেই শেষ হয়ে যেতে পারত এবং তা হতো সবচেয়ে উত্তম। ভুল/অপরাধ করে অনুতপ্ত হলে, দুঃখ প্রকাশ করলে, ক্ষমা চাইলে কেউ খাটো হয় না। ক্ষমা করলেও কেউ খাটো হয় না। সম্ভবত উভয়ই তাদের অবস্থান কম/বেশি পরিবর্তন করার কারণে আপস মিমাংসা সফল হয়ে ওঠেনি। কেননা, এই অভিযোগ অস্বীকার করে এসি ল্যান্ড মাহমুদুল হাসান জানান, 'আদালতের অভিযান পরিচালনা করছিলাম বলে আমাকে দোষ দেওয়া হচ্ছে। তিনি লোকজনের মধ্যে দৌঁড়ে যাওয়ার সময় পড়ে গিয়ে আহত হয়েছেন। তার আঘাত পাওয়ার খবর শুনে আমরা তার সঙ্গে কথা বলার জন্য বাড়িতে গিয়েছিলাম।’ ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টিও অস্বীকার করেন এসি ল্যান্ড মাহমুদুল হাসান। এদিকে আবদুল আজিজ সাহেবও এখন এই ঘটনা নিয়ে সোচ্চার। আবারো সেই প্রশ্ন: স্থানীয়ভাবে বসবাসকারী একজন বেসরকারি শিক্ষক সরকারি প্রশাসনের স্থানীয় দুইজন প্রভাবশালী কর্মকর্তার উপর এমন মিথ্যা কথা বলবেন কেনো, কোন সাহসে? শিক্ষক কেন বলবেন, এসিল্যান্ড সাহেব আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন, আমি ক্ষমা করে দিয়েছি বা ক্ষমা করে দিব? বিশেষ করে যেখানে উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা মহোদয়ের উপস্থিতির কথাও বলা হচ্ছে! এত বড় সাহস তিনি কোথায় পাবেন? তিনি বলেছেন, এসিল্যান্ড সাহেব পুলিশের হাত থেকে লাঠি নিয়ে তাকে বাড়ি মেরেছেন। অর্থাৎ দুটি ঘটনার জন্য দুজন সরকারি লোককেই শিক্ষক সাক্ষী মানছেন। তাকে আঘাত করার সাক্ষী পুলিশ সাহেব আর তার কাছে ক্ষমা চাওয়ার সাক্ষী টিএনও সাহেব। তাঁর মধ্যে কোনো দুরভিসন্ধি থাকলে তিনি সরকারি লোকদের সাক্ষী মানবেন কেন? ক্ষমা চাওয়ার কথা বা ক্ষমা দেওয়ার কথা স্বীকার করবেন কেন? শিক্ষক সাহেবের হাত ভাঙার দায়ে যদি এসিল্যান্ড সাহেব কোন কারণে অনুতপ্ত না হয়ে থাকেন তাহলে শিক্ষকের বাসায় তিনি যাওয়ার তাগাদা অনুভব করলেন কেন? এর পরেও কি আমরা বলবো, একজন শিক্ষক সব কথাই মিথ্যা বলছেন? মার খেয়ে তিনি কোনো মামলা করেছেন বলেও তো শুনিনি!
এখন যেহেতু বিষয়টি জাতীয়ভাবে জানাজানি হয়ে গেছে এবং যেহেতু পরস্পর পরস্পরকে দোষারোপ করা শুরু করেছেন, সেহেতু সকল সত্যতা উন্মোচিত হওয়া আবশ্যক। আমরা জানতে চাই কোথায় আসল সত্য লুকিয়ে আছে? কে সত্যি বলছেন আর কে মিথ্যা বলছেন? আপস যদি হয়ে থাকে তাহলে মীমাংসা হয়নি কেন? শিক্ষক বেসরকারি বলে তাঁকে তুচ্ছ মনে করা হয়েছে বা হচ্ছে কিনা? এসিল্যান্ড সরকারি বলে প্রশাসন ওনার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে বা নিচ্ছে কিনা? বাস্তবে এমন যদি হয়ে থাকে তো এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছুই হতে পারে না! এমনটি হতে দেওয়াও উচিত নয়, মেনে নেওয়াও উচিত নয়। সত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া, ন্যায় বিচার নিশ্চিত হওয়া সবার জন্যই মঙ্গল। প্রকাশ্য দিবালোকে ঘটে যাওয়া সেই দুটি ঘটনার নিশ্চয়ই আরো অনেক সাক্ষী বিদ্যমান। শিক্ষক সাহেব মিথ্যা বলে থাকলে অবশ্যই তাঁর শাস্তি হওয়া উচিত। আর এসিল্যান্ড সাহেব যদি আসলেই শিক্ষককে লাঠিপেটা করে থাকেন এবং সেজন্য অনুতপ্ত না হয়ে থাকেন, দুঃখ প্রকাশ না করে থাকেন, ক্ষমা প্রার্থনা না করে থাকেন, তাহলে তাঁরও যথাযথ বিচার হওয়া উচিত।
মনে রাখতে হবে, সবারই কেউ না কেউ শিক্ষক ছিলেন, শিক্ষক আছেন। শিক্ষকের হাতেই মানুষ হবার চেষ্টা করেছেন আমাদের পূর্বপুরুষ। শিক্ষকের হাতেই মানুষ হবার চেষ্টা করেছি/করছি আমরা। শিক্ষকের হাতেই মানুষ হবার চেষ্টা করবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। শিক্ষকের হাত দুর্বল হলেই দুর্বল হবে আমাদের সন্তান। শিক্ষকের মনোবল ভেঙ্গে দিলে তৈরি হবে না সন্তানের মনোবল! শিক্ষক অসহায় হলে তৈরি হবে দিশেহারা সমাজ। বারবার মার খাওয়া শিক্ষকের হাতে তৈরি হবে বারবার মার খাওয়া জাতি! সুতরাং শিক্ষকের হাত ভেঙে দিলে চলবে না, ভেঙে দেওয়া যাবে না, ভেঙে দেওয়া সম্ভব না! বরং সবদিক থেকে আরও অনেক শক্তিশালী করতে হবে সকল শিক্ষকের হাত। তবেই সবদিক থেকে আরও শক্তিশালী হবে আমাদের জাতি।
মো. রহমত উল্লাহ্
শিক্ষক, সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক
অধ্যক্ষ -কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।
0 মন্তব্য(গুলি):