শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান নিয়োগ: কী হওয়া উচিত বিবেচ্য বিষয়? সমকাল, ১০ জুন ২০১৯

শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান-প্রধান নিয়োগ:

কী হওয়া উচিত বিবেচ্য বিষয়?

সমকাল > ১০ জুন ২০১৯ (পরিমার্জিত) 



মো. রহমত উল্লাহ্‌

স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার প্রধান নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রায়শই অনিয়মের অভিযোগ উঠে থাকে। বেসরকারি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এই অনিয়মের অভিযোগ অত্যধিক। শিক্ষক অযোগ্য হলে দীর্ঘমেয়াদী অপুরণীয় ক্ষতি হয় দেশ ও জাতির। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান-প্রধান অযোগ্য হলে জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায় সেই ক্ষতির পরিমান। শিক্ষক ও পরিচালনা পরিষদ ভাল হলে একটি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের প্রধানের উপর অনেকাংশে নির্ভর করে ঐ প্রতিষ্ঠানের সফলতা। যোগ্য প্রতিষ্ঠান-প্রধানই প্রতিষ্ঠানের সার্বিক উন্নয়নে গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেন স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি বিভিন্ন পরিকল্পনা। নিশ্চিত করেন শিক্ষার সুন্দর পরিবেশ ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা। বিভিন্ন মুখি সহশিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের করে তোলেন মননশীল। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের প্রতিনিয়ত প্রদান করেন উদ্দীপনা, বৃদ্ধি করেন কর্ম উদ্যম, নিশ্চিত করেন সফলতা। শিক্ষার্থীদের প্রদান করেন নৈতিক, অধুনিক ও বিজ্ঞানমনষ্ক শিক্ষা। গড়ে তোলেন ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক সুসম্পর্ক। নিশ্চিত করেন প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনের সচ্ছতা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন। এছাড়াও একজন ভাল প্রতিষ্ঠান-প্রধান প্রতিনিয়ত করে থাকেন আরও অনেক অনেক শুভ কাজ। এককথায় জুতা সেলাই থেকে চন্ডিপাঠ পর্যন্ত করতে হয় একজন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান-প্রধানকে। তাই তাঁর থাকতে হয় নানামুখি যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা। যা তালিকা করে শেষ করা অসম্ভব। তাই শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের মান, ধরন, অবস্থা ও অবস্থান অনুসারে যথাযোগ্য প্রধান বাছাই করা খুব সহজ কাজ নয়। যারা বাছাই করবেন তাদেরও থাকতে হবে ততোধিক সততা, দক্ষতা, নিরপেক্ষতা ও দূরদর্শিতা।


কেবল একাডিক রেজাল্ট দেখে কিংবা লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে প্রতিষ্ঠান-প্রধান হবার যোগ্যতা পরিমাপ করা প্রায় অসম্ভব। এসব পরীক্ষায় কেউ বেশি নম্বর পেলেই তাকে প্রতিষ্ঠান প্রধান হবার জন্য সুযোগ্য মনে করা সঠিক নয়। কেননা, অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রার্থীর সংখ্যা কমানোর উদ্দেশ্যে অধিক নম্বরের অপ্রাসঙ্গিক ও অতিজাটিল প্রশ্নে নেওয়া হয় এসব লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা। আসলে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান-প্রধান হবার যোগ্যতার মাপকাঠি আরো অনেক বিস্তৃত। এটি অভিজ্ঞতা ভিত্তিক একটি জটিল প্রশাসনিক পদ। এই পদে প্রশাসন থেকে ব্যবস্থাপনাই বেশি। এইরূপ নির্বাহী পদে অধিক পাকা/পরিপক্ক লোক নিয়োগের জন্য বাছাই প্রক্রিয়ায় হাতে লিখিত পরীক্ষার গুরুত্ব অনভিজ্ঞ এন্ট্রি পোস্টের তুলনায় অনেক কম। ব্যাংক-বীমাসহ দেশী-বিদেশী অধিকাংশ আর্থিক/অনার্থিক প্রতিষ্ঠানেই নির্বাহী/উচ্চ পদে নিয়োগের জন্য প্রার্থীর জীবন-বৃত্তান্ত বিবেচনা করে সাক্ষাতকার নেওয়া হয়ে থাকে। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান-প্রধানের কলমের জোরের পাশাপাশি পারিপার্শিক জ্ঞান, মনোবৈজ্ঞানিক জ্ঞান, বাস্তব অভিজ্ঞতা, তাতক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, মানবীয় গুণাবলি ও সতসাহস থাকা অত্যাবশ্যক। প্রতিষ্ঠানের প্রধান বিখ্যাত ও সুযোগ্য হলে তাঁকে নিয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক গর্বিত হয়। তাঁর কারণে প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। শিক্ষার্থীরা বিখ্যাত ও সুযোগ্য হবার স্বপ্ন দেখে। কর্মে, কথায়, ধর্মে, জ্ঞানে তিনি হবেন সকল মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র। শিক্ষার্থীদের জন্য হবেন সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আপন মানুষ। তাই কাউকে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান-প্রধান করার আগে শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অবদান, মন-মানসিকতা, আচার-আচরন, নৈতিক চরিত্র, জাতীয়তা বোধ, দেশপ্রেম, ইত্যাদিসহ দীর্ঘ অতীত জীবনের কর্মকান্ড সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া খুব জরুরি। ছোট বেলা থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রদত্ত নেতৃত্ব ও অর্জিত কৃতিত্বসহ ভালভাবে মূল্যায়ন করা উচিত তাঁর পূর্ণ জীবন-বৃত্তান্ত। নেওয়া উচিত প্রার্থীর দীর্ঘ সাক্ষাতকার (দমবন্ধ মৌখিক পরীক্ষা নয়)। উন্নত বিশ্বে অন-লাইনেও হয়ে থাকে সেই সাক্ষাতকার। গুগল বা সোসাল মিডিয়া থেকেও নেওয়া হয় প্রার্থী সম্পর্কিত তথ্যাদি।


আমাদের দেশে বেসরকারি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের প্রধান নিয়োগে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার একটা প্রচলন বিদ্যমান। অথচ এই লিখিত এবং/অথবা মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার লিখিত কোন বিধান বা বাধ্যবাদকতা নেই। তদুপরি নেওয়া হলে কোন কোন বিষয়ক প্রশ্নে শতকরা কত নম্বরের লিখিত এবং কত নম্বরের মৌখিক পরীক্ষা নিতে হবে তাও নির্ধারিত নেই। তাই এক্ষেত্রে নিয়োগ নির্বাচনী কমিটির সেচ্ছাচারিতার অবাধ সুযোগ বিদ্যমান। আমি মনেকরি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান-প্রধান নিয়গের জন্য বাছাই প্রকৃয়ায় একজন প্রার্থীর কোন কোন বিষয়/দিক কীভাবে কতটুকু মূল্যায়্ণ করতে হবে তার একটা সুনির্দিষ্ট নীতিমালা জারি থাকা আবশ্যক। সেক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্টেটাস অনুসারে যথাযোগ্য প্রধান নিয়োগের বাছাই প্রকৃয়ায় প্রাসঙ্গিক লিখিত পরীক্ষা ও দীর্ঘ সাক্ষাতকারের পাশাপাশি অনুসরণ করা যেতে পারে আমাদের জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ও শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান প্রধান নির্বাচনের জন্য প্রবর্তীত কিছু কৌশল বা নীতিমালা। যার আলোকে মূল্যায়ণ করা যেতে পারে একজন প্রার্থীর: (১) শিক্ষাগত যোগ্যতা (২) অভিজ্ঞতা (৩) জ্ঞান ও নিষ্ঠা (৪) পরিবেশ সচেতনতা, সৃজনশীলতা ও দূরদর্শিতা (৫) ছাত্র-ছাত্রী ও সহকর্মীদের উপর প্রভাব এবং অভিভাবক ও কর্তৃপক্ষের সাথে সহযোগিতার প্রবনতা (৬) চারিত্রিক দৃঢ়তা, ব্যক্তিত্ব, সততা ও সুনাম (৭) দায়িত্ব-কর্তব্য বোধ এবং প্রশাসনিক দক্ষতা ও আর্থিক শৃঙ্খলা (৮) মাল্টিমিডিয়া ক্লাসে আগ্রহ ও আইসিটি বিষয়ে দক্ষতা (৯) সহশিক্ষা বিষয়াদিতে আগ্রহ ও দক্ষতা (১০) পাঠ্যপুস্তক প্রনয়ণ ও পেশাগত/গবেষণামূলক সৃজনশীল প্রকাশনা (১১) গুণগত মানের শিক্ষায় উদ্ভাবনী/সৃজনশীল উদ্যোগ ও উত্তম চর্চার নিদর্শন (১২) দেশপ্রেম ও জাতীয়তা বোধ। উল্লিখিত বিষয়সমূহে থাকা উচিত শতকরা ষাট ভাগ নম্বর। যদিও এসকল বিষয় সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা কষ্ঠসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ কাজ। এক্ষেত্রে, যে প্রার্থী ছাত্র জীবনে ভাল ছাত্র ছিলেন, ক্লাসে কেপ্টেইন ছিলেন, রোভার স্কাউট বা গার্স গাইড লিডার ছিলেন, বিএনসিসি লিডার ছিলেন, অসহায়দের সহায়তায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন আয়োজনে নেতা ছিলেন, ক্রীড়া সংগঠক ছিলেন, সাংবাদিকতা/লেখালেখিতে সক্রিয় ছিলেন, রচনা-বক্তৃতা-বিতর্কে বিজয়ী ছিলেন, জাতীয় দিবস উদযাপনে সক্রিয় ছিলেন, কল্যাণমূখি ক্লাব বা সংগঠনের উদ্যোক্তা/নেতা ছিলেন, সাধারন শিক্ষার্থীদের আপন ছিলেন, স্টুডেন্ড কেবিনেট/কাউন্সিলে নির্বাচিত ছিলেন, শিক্ষকগণের খুব প্রিয় পাত্র ছিলেন, সর্বোপরি শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থী নির্বাচিত হয়ে ছিলেন এবং যিনি শিক্ষকতা জীবনে এসে শিক্ষার্থীদের প্রিয় শিক্ষক হয়েছেন, শিক্ষকদের প্রতিনিধি হয়েছেন, পরিচালনা কমিটির সদস্য হয়েছেন, অত্যন্ত সততারসাথে অডিট ও উন্নয়ন কমিটিতে কাজ করেছেন, বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনে ও জাতীয় দিবস উদযাপনে অগ্রণী ভুমিকা রেখেছেন, বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বক্তব্য রেখেছেন, প্রতিষ্ঠানের ক্লাস রূটিন ও বাজেট তৈরির করেছেন, পরীক্ষা পরিচালনা করেছেন, বোর্ড/বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষক হয়েছেন, প্রশাসনের বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করেছেন, দাপ্তরিক কাজে বিভিন্ন অফিসে গিয়েছেন, অভিভাবকদের সাথে সুসম্পর্ক রেখেছেন, পাঠ্যবই/মননশীল বই বা শিক্ষা বিষয়ক লেখালেখি করছেন, চিন্তা-চেতনায় বিজ্ঞানমনস্ক ও জাতীয়তা বোধে সমৃদ্ধ হয়েছেন, সর্বোপরি শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন এবং যিনি কোন প্রতিষ্ঠানের প্রধান হয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সততা, দক্ষতা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন বা শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান প্রধান নির্বাচিত হয়েছেন; এমন প্রার্থী/প্রার্থীগণ পেতে  পারেন অন্যের তুলনায় অধিক নম্বর।      

     

যতই কষ্টসাধ্য যুক্তিযুক্ত মান নির্ধারন করে উল্লিখিত বিষয়গুলোর আলোকে সঠিক জীবন-বৃত্তান্ত মূল্যায়নের মাধ্যমে নিরপেক্ষ ভাবে বাছাই করে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান-প্রধান নিয়োগ করা হলে অবশ্যই অধিক লাভবান হবে শিক্ষার্থী। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান হচ্ছেন জীবন্ত আইকন। তাঁর দিকে চোখ পড়ে সবারই। বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা তাঁকে পেতে চায় সূর্যের মত আলোপ্রদ, বটবৃক্ষের মত ছায়াপ্রদ, আকাশের মত অসীম, প্রকৃতির মত যুক্তিবাদী, মুক্তি সেনার মত প্রতিবাদী, অপরিসীম জ্ঞান ও দক্ষতার অধিকারী এক পূজনীয় ব্যক্তিত্ব রূপে। কেননা, তিনি হচ্ছেন সবার বড় স্যার। সচেতন ও অবচেতন ভাবে এই বড় স্যারকেই অনুকরণ ও অনুসরণ করে অধিকাংশ শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। ধারন করে বড় স্যারের ন্যায়নীতি, সতাদর্শ ও সদাচরন। হয়ে উঠে এ+ মানুষ। তাই এসব দিক বিবেচনায় রেখে সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রয়োগের মাধ্যমে নিরপেক্ষভাবে বাছাই করে নিয়োগ করা উচিত অধিক যোগ্য শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান-প্রধান।


মো. রহমত উল্লাহ্‌

অধ্যক্ষ

কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ

মোহাম্মদপুর, ঢাকা। ০১৭১১১৪৭৫৭০ 

Previous Post
Next Post

About Author

0 মন্তব্য(গুলি):