প্রবন্ধ - শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি নজরদারি। ২৫ এপ্রিল ২০২১

 পত্রিকার লিংক

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকারি নজরদারি



মো. রহমত উল্লাহ্ |  

দৈনিক খোলা কাগজ, ২৫ এপ্রিল ২০২১


একটা দেশে অগণিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হতে থাকবে কিন্তু সরকার জানবে না, সরকারের কাছে কোনো হিসাব থাকবে না, তা তো হতে পারে না। অথচ আমাদের দেশে মাদ্রাসা ও কেজি স্কুলের সংখ্যা কত তার সঠিক হিসাব নেই সরকারের কোনো দফতরেই। কিছু আলিয়া মাদ্রাসার হিসাব জানা থাকলেও দেশের আনাচে-কানাচে বিভিন্ন নামে বেনামে প্রতিদিন হতে থাকা কওমি (পুরুষ ও মহিলা) মাদ্রাসা ও কেজি স্কুলের কোনো হিসাব কারও জানা নেই। কেজি স্কুলগুলো পৃথকভাবে গড়ে উঠলেও অধিকাংশ মক্তব-মাদ্রাসা মসজিদভিত্তিক। এসবের হিসাব ও কর্মকা- সম্পর্কে তাদের নিজস্ব কিছু সংগঠনের জানা থাকলেও থাকতে পারে যা আমাদের অজানা।


অনুমোদন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা না থাকায় যার যখন ইচ্ছে, যেখানে ইচ্ছে মক্তব-মাদ্রাসা, কেজি স্কুল ও কোচিং সেন্টার গড়ে তুলছেন। এ সকল প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার আগে বা পরে কোনো কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হবে কিনা তাও তারা জানেন না। এক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা প্রশাসনের কোনো দায়-দায়িত্ব আছে বলে মনে হয় না। অবস্থা দৃষ্টে ধারণা করা যায় কওমি মাদ্রাসা ও কেজি স্কুলের সংখ্যা সর্বাধিক। বিশেষ করে মক্তব-মাদ্রাসা তৈরি করার ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের তেমন কোনো অর্থ বিনিয়োগ করতে হয় না বিধায় দেশের শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত সর্বত্রই প্রতিদিন নতুন নতুন মক্তব-মাদ্রাসা তৈরি হচ্ছে। শুধু গ্রামে নয় শহরেও বিভিন্ন অলিগলিতে ভাড়া বাড়িতে দেখা যায় অগণিত মাদ্রাসার সাইনবোর্ড। আবার সাইনবোর্ডবিহীনও রয়েছে অনেক মহিলা মাদ্রাসা।


বিবিসি বাংলায় ১১ মে ২০২০ তারিখে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে ১৪ হাজার ৩৯৭টি কওমি মাদ্রাসা রয়েছে। তবে কওমি সংশ্লিষ্টদের দাবি, সারা দেশে মাদ্রাসার সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। এসব প্রতিষ্ঠানে ২২ লাখের বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে বলে তারা বলছেন।’ অথচ সরকারের কাছে এর কতটির সঠিক হিসাব ও প্রকৃত চিত্র আছে তা জানা নেই!


অপরদিকে কেজি স্কুল ও কোচিং সেন্টারের সঠিক সংখ্যা নিয়েও রয়েছে বিভিন্ন রকম তথ্য। দৈনিক ভোরের কাগজে প্রকাশিত ১৯ নভেম্বর ২০১৪ তারিখের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ উপলক্ষে প্রতীতি নামে ২০১৪ সালে প্রকাশিত স্মরণিকায় সারা দেশে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের সংখ্যা ১৪ হাজার ৯৪টি উল্লেখ করা হয়েছে।’ অথচ বিভিন্ন কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, দেশে কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা ৪০ হাজারেরও অধিক। এসব প্রতিষ্ঠানের সঠিক হিসাব এবং প্রকৃত চিত্র কতটুকু সরকারের কাছে আছে তাও বলা যাচ্ছে না।


উল্লিখিত অগণিত মক্তব-মাদ্রাসা ও কেজি স্কুলগুলোতে কারা শিক্ষক হচ্ছেন; কী পড়ানো হচ্ছে; জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুসরণ করা হচ্ছে কি না; লাখ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে জাতীয়তা বোধ জাগ্রত করা হচ্ছে কি না; নাগরিক দায়িত্ব-কর্তব্য বোধ সৃষ্টি করা হচ্ছে কি না; স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব সৃষ্টি করা হচ্ছে কি না; সমাজের অন্যান্য মানুষের প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করা হচ্ছে কি না; কর্মমুখী ও বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা-চেতনা বা শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে কি না; শিশু শিক্ষার্থীদের শারীরিক, মানসিক ও পাশবিক নির্যাতন করা হচ্ছে কি না; প্রকৃত ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত করা হচ্ছে কি না ইত্যাদি বিষয় তদারকি করা অবশ্যই সরকারের গুরুদায়িত্ব। অথচ এই দায়িত্ব পরিপূর্ণভাবে পালন করেছে বলে মনে হয় না আমাদের কোনো সরকার। তাই বিভেদ বৃদ্ধি পাচ্ছে বিভিন্নমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত নাগরিকদের মধ্যে। ভাইয়ের মুখোমুখি হয়ে যাচ্ছে ভাই!


সম্প্রতি সংগ্রহ করা হচ্ছে মাদ্রাসাসমূহের তথ্য। মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা প্রশাসনকে মাত্র কয়েকদিন সময় দিয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এই তথ্য সংগ্রহের। প্রতিটি থানায় বা উপজেলায় যত্রতত্র যত সংখ্যক মাদ্রাসা বিদ্যমান সব ক’টির সঠিক তথ্য এত স্বল্প সময়ে সংগ্রহ করা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের পক্ষে আদৌ সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। ফলে তারা দায়সারা আদেশ পালন করার আশঙ্কাই বেশি।


অর্থাৎ সঠিক চিত্র পাওয়ার সম্ভাবনা কম। বাস্তবে যদি তাই হয় তো ভুল তথ্যের ওপর গৃহীত পরবর্তী সকল সিদ্ধান্তই ভুল হবে। ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে।


পর্যাপ্ত সময় দিয়ে একাধিক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া উচিত এ সকল মক্তব-মাদ্রাসার পাশাপাশি কেজি স্কুলের তথ্য সংগ্রহের জন্য। সাধারণ প্রশাসনের পাশাপাশি পুলিশ প্রশাসন, শিক্ষা প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের দেওয়া উচিত তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব। বাস্তবে জনপ্রতিনিধিদের পক্ষেই অতি অল্প সময়ে অধিক শুদ্ধ তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব। প্রত্যেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ইউপি মেম্বার আন্তরিক হলে সহজেই দিতে পারবেন তার এলাকায় অবস্থিত মক্তব-মাদ্রাসা ও কেজি স্কুল সংক্রান্ত সঠিক তথ্য। পুলিশ প্রশাসন তথ্য সংগ্রহ করতে পারবেন পুলিশ ও গ্রামপুলিশের মাধ্যমে। সাধারণ প্রশাসন তথ্য সংগ্রহ করতে পারবেন কৃষি বিভাগের ব্লক সুপারভাইজার ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের মাঠকর্মীদের মাধ্যমে।


শিক্ষা প্রশাসন তথ্য সংগ্রহ করতে পারবেন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদের মাধ্যমে। তাছাড়াও এনজিও ব্যুরো তথ্য সংগ্রহ করতে পারবেন মাঠ পর্যায়ে কর্মরত বিভিন্ন এনজিওকর্মীদের মাধ্যমে। উপযোগিতা অনুসারে উল্লিখিত একাধিক উপায়ে সংগৃহীত তথ্যগুলো কম্পাইল করে তৈরি করতে হবে চূড়ান্ত তালিকা। যাতে প্রতিটি মক্তব-মাদ্রাসা ও কেজি স্কুল সম্পর্কে থাকবে বিস্তারিত তথ্য।


প্রতিনিয়ত গড়ে ওঠা বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের তথ্য সংগ্রহের জন্য অবশ্যই থাকতে হবে একটি ধারাবাহিক চলমান প্রক্রিয়া। সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ড ও ব্যানবেইসকেই নিতে হবে সেই দায়িত্ব। মক্তব-মাদ্রাসা, কেজি স্কুল, কোচিং সেন্টার ইত্যাদি তৈরি ও পরিচালনার জন্য থাকতে হবে পূর্বানুমতির ব্যবস্থা। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই তা বিদ্যমান। নিজের টাকায় কোনো প্রতিষ্ঠান করতে গেলেও অনুমতি নিতে হয় সরকারের। যারা সঠিক শিক্ষাদানের সৎ উদ্দেশ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করবেন তাদেরও থাকা উচিত স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করার মানসিকতা ও সৎ সাহস। প্রতিনিয়ত স্বেচ্ছায় দেওয়া উচিত প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সকল তথ্য। এটি ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই কাম্য।


মো. রহমত উল্লাহ্ : শিক্ষক, সাহিত্যিক ও কলাম লেখক 


http://m.kholakagojbd.com/public-opinion/75852

Previous Post
Next Post

About Author

0 মন্তব্য(গুলি):