রোল নম্বরের বিরূপ প্রভাব এবং আইডি নম্বর প্রদান প্রসঙ্গ। jagonews24.com 3 জানুয়ারি 2020

রোল নম্বরের বিরূপ প্রভাব এবং আইডি নম্বর প্রদান প্রসঙ্গ

মো. রহমত উল্লাহ্

Jagonews24.com, সম্পাদকীয় ডেস্ক 

০৩ জানুয়ারি ২০২১


রেলগাড়িতে পাশাপাশি সিটে বসেছে দুটি পরিবারের মা-বাবা ও ছেলে-মেয়ে। শুরুতেই পরিচিত হবার পালা। এক পরিবারের ছোট এক শিশুকে অন্য পরিবারের ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন তোমার নাম কি? কোন শ্রেণিতে পড়ো? রোল নম্বর কত? নিজের নাম ও শ্রেণি বলার পর রোল নম্বর বলতে গিয়েই চুপসে গেল শিশুটি! তড়িঘড়ি মুখ খুলে তার মা বললেন, এবার পরীক্ষার আগে তার জ্বর হয়েছিল তাই পরীক্ষায় তেমন ভালো করতে পারেনি। শিশুটি জানে, মা মিথ্যা বলেছেন। কেননা, ক্লাসে রোল নম্বর পিছনে থাকা খুবই অসম্মানজনক!


পুরো যাত্রাপথে আর সহজ হতে পারেনি এই অবুঝ শিশু। এমনকি তার পাশে বসা অপর পরিবারের সমবয়সী শিশুর সঙ্গেও সে মিশতে পারেনি সহজভাবে। শ্রেণি রোল নম্বর এর বিরূপ প্রভাবে এমনিভাবে হীনমন্যতায় ভুগছে আমাদের দেশের প্রায় সকল শিক্ষার্থী। শ্রেণি রোল নম্বর থাকার কারণে প্রতি শ্রেণির একজন মাত্র শিক্ষার্থী গর্ব বোধ করে, আর ওই শ্রেণির সকল শিক্ষার্থী হীনমন্যতায় ভোগে! তাদেরকে সর্বত্রই হেয় করে দেখা হয়, দুর্বল ভাবা হয়, ও অমনোযোগী ভাবা হয়, খারাপ ছাত্র ভাবা হয়। তারা যে ক্লাসের বাইরে আরও অনেক কিছুতেই প্রথম হয়, ভালো করে, এগিয়ে থাকে, সেইসব মূল্যায়ন করা হয় না ক্লাসে রোল নম্বর পিছনে থাকার কারণে। তাদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করা হয় না। এমনকি মা-বাবাও তাদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করেন না। শিক্ষকগণও তাদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করেন না। অপার সম্ভাবনাময় একজন শিশুর সকল গুনাগুন মূল্যায়নের মাপকাঠি হয়ে যায় ক্লাস রোল নম্বর। অনেক মা-বাবা আছেন, রোল নম্বর ১ না হলে সন্তানদের উপর চালায় নিষ্ঠুর নির্যাতন! তাই সন্তান সর্বদা ভয়ে তটস্থ থাকে রোল নম্বর ১ করার জন্য বা ১ এ ধরে রাখার জন্য।


ছোটবেলা থেকেই সে আয়ত্ত করতে থাকে বেশি নম্বর লাভের কৌশল। কোন বিষয়ে ভালোভাবে জানার চেয়ে ওই বিষয়ে কৌশল করে উত্তর দিয়ে বেশি নম্বর লাভের প্রতি তার মনোযোগ থাকে বেশি, আগ্রহ থাকে বেশি, চেষ্টা থাকে বেশি। ফলে শিক্ষার চেয়ে অন্যদিকেই তার সময় শ্রম ও মেধা খাটে বেশি। অধিক নম্বর লাভের চিন্তায় শিক্ষার আনন্দ থেকে সে বঞ্চিত হয়! এমনকি অসদুপায় অবলম্বন করার চিন্তাও করে থাকে কোন কোন শিক্ষার্থী!


রোল নম্বর ১ না হওয়ার কারণে বা প্রথম দিকে না থাকার কারণে সহপাঠীদের সঙ্গেও মিশতে পারে না অনেক শিক্ষার্থী। অভিভাবকগণও বলে থাকেন, যার রোল নম্বর পিছনে সে লাড্ডু, তার সঙ্গে তুমি মিশবে না। অলিখিত ভাবেই ক্লাস রোল নম্বরের ভিত্তিতে ভাগাভাগি হয়ে থাকে প্রতিটি ক্লাসের তথা দেশের সকল শিক্ষার্থী। প্রতিটি ক্লাসের ভিতরেই যেন সৃষ্টি হয় আরো অনেকগুলো ক্লাস! কেউ উত্তম ক্লাসের, কেউ মধ্যম ক্লাসের, কেউ অধম ক্লাসের!


যাদের রোল নম্বর পিছনে তারা ছোটবেলা থেকেই যেন ক্লাসের, পরিবারের, সমাজের অবহেলিত মানুষ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে বেড়ে উঠতে থাকে। এমনকি তারা গল্পে, আড্ডায়, খেলাধুলায়ও অংশ নিতে পারে না যাদের রোল নম্বর সামনের দিকে থাকে তাদের সাথে। এই অবস্থা কোনভাবেই শিশুর জন্য কল্যাণকর নয়, মঙ্গল জনক নয়। শিশু নিজেকে নিয়ে গর্ববোধ করার মত মানসিকতায় বেড়ে ওঠা খুবই প্রয়োজন।


নিজেকে অযোগ্য ভেবে ভেবে বেড়ে উঠতে থাকা শিশুরা আত্মপ্রত্যয়ী হয়না, আত্মবিশ্বাসী হয় না, নিজের উপর আস্থাশীল হয়না। আমি পারি, আমি পারব, আমাকে পারতে হবে, এরকম প্রতিজ্ঞা তার মধ্যে তৈরি হয় না। বরং সে ভাবে আমি পারিনা, আমি পারবো না, আমাকে দিয়ে কোন কিছুই সম্ভব নয়, আমি অযোগ্য মানুষ। এরকম ভাবতে ভাবতে সে একসময় সত্যি সত্যিই আর যোগ্য হয়ে উঠতে পারে না। তারমধ্যে অন্যান্য যেসকল সম্ভাবনা থাকে সেগুলোরও অকাল মৃত্যু ঘটে সবার অজান্তে!


এই অবস্থার অবসান খুব বেশি জরুরি। তাই শ্রেণি রোল নম্বর প্রথা বিলুপ্ত করার সরকারি সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। সম্প্রতি এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, ‘রোল নম্বর নিয়ে একটা সমস্যা হয়। প্রত্যেক শ্রেণিতে যে রোল নম্বর থাকে, আমাদের রোল নম্বরের যে প্রথা রয়েছে, তার কারণে একটা অনভিপ্রেত প্রতিযোগিতা হয়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেক সময় যে সহযোগিতার মনোভাব, যেটি থাকার দরকার, অনেক সময় সেটির অভাব ঘটে রোল নম্বরের কারণে। সবাই সামনে আসতে চায়। তাই শিক্ষার্থীদের শ্রেণির রোল নম্বরের পরিবর্তে আইডি নম্বর প্রদানের চেষ্টা করছি। এতে পুরোনো রোল নম্বর প্রথার বিলুপ্তি হবে এবং অনভিপ্রেত প্রতিযোগিতা বন্ধ হয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা সৎ প্রতিযোগিতার মনোভাব তৈরি হবে বলে আশা করছি।’


এখন থেকে প্রায় একযুগ আগে একটি স্কুল ও কলেজের প্রধান হয়ে আমার প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক এসআইডি নম্বর প্রবর্তন করেছি আমি। কিন্তু সে আইডি নম্বর ব্যবহার করে একজন শিক্ষার্থীকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সকল শ্রেণিতে আইডেন্টিফাই করা এবং তাকে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করে তা একত্রে রেকর্ড রাখার কাজটি আমি করতে পারিনি। কেননা, আমাদের অধিকাংশ শিক্ষকগণ ও অভিভাবকগণ রোল নম্বরের গুরুত্ব বেশি মনে করে থাকেন। তারা মনে করেন রোল নম্বর না থাকলে শিক্ষার্থীরা ভালো করার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে চায় না, হবে না। অথচ তারা এমনটি ভাবেন না যে, রোল নম্বর প্রথা প্রবর্তিত থাকলে কেবলমাত্র প্রথম দিকের কয়েকজন জন শিক্ষার্থী প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে লেখাপড়া করে থাকে এবং অন্যরা নিজের রোল নম্বর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অর্থাৎ ১/২/৩ এ আনতে পারবে না মনে করে নিজেকে অক্ষম ভেবে হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকে। তাই তারা রোল নম্বরের পক্ষে নিজেদের মতামত দিয়ে থাকেন এবং রোল নম্বর প্রবর্তন করার জন্য চাপ প্রয়োগ করে থাকেন।


আমি এক পর্যায়ে বাধ্য হয়েই আইডি নম্বর এর পাশাপাশি রোল নম্বর প্রথা বলবৎ রেখে শিক্ষার্থীদের আইডেন্টিফাই করার ব্যবস্থা চলমান রাখি। তখন সরকারি সিদ্ধান্ত না থাকার কারণে আমি শক্ত অবস্থান নিতে পারেনি। এখন সরকারি সিদ্ধান্ত হলে ইউনিক আইডি নম্বরের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আইডেন্টিফাই করার এবং শিক্ষার্থীর সারা শিক্ষাজীবনের আমলনামা একটি নির্দিষ্ট আইডির আওতায় ধারাবাহিকভাবে লিপিবদ্ধ করার ব্যবস্থা করা হলে অবশ্যই অনেক অনেক ভালো হবে। শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও এইরূপ ইউনিক আইডি থাকা খুব বেশি প্রয়োজন। ধারাবাহিক মূল্যায়নে প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু করে উপরের প্রতিটি শ্রেণিতেই সে কখন কেমন ফলাফল করেছে, কোন বিষয়ে ভালো করেছে, কোন বিষয়ে ভালো করেনি, আচার-আচরণ কেমন ছিল, বড়দের সঙ্গে মেলামেশায় কেমন ছিল, শিক্ষকদের সঙ্গে মেলামেশায় কেমন ছিল, সহপাঠীদের সঙ্গে মেলামেশায় কেমন ছিল, উপস্থিতির হার কেমন ছিল, শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা কেমন ছিল, দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ কেমন ছিল, সমাজসেবায় ও পরোপকারে সক্রিয় ছিল কিনা, কোন বিশেষ কাজের প্রতি বিশেষ ঝোঁক বা শখ ছিল কিনা।


খেলাধুলা ও অন্যান্য সহশিক্ষা কার্যক্রম তথা নাচে-গানে, আবৃত্তিতে, বিতর্কে, বক্তৃতায়, লেখালেখিতে, গল্প বলায়, চিত্রাংকনে ইত্যাদি কোন ক্ষেত্রে তার দক্ষতা কোন শ্রেণিতে থাকাকলে কেমন ছিল সেসব ধারাবাহিকভাবে মূল্যায়ন করে অনলাইন রেকর্ড সংগ্রহ করে তাকে দিক নির্দেশনা দেওয়া সম্ভব হবে এবং যেকোন সময় তাকে পুরো মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে। সেখানে শিক্ষার্থীর প্রতি শ্রেণির একাডেমিক ফলাফলও ধারাবাহিকভাবে সংযুক্ত থাকবে।


ইউনিক আইডি ব্যবস্থাটি শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক পর্যায় থেকেই প্রবর্তন করা উচিত। NID (National Identification) নম্বর এর মত রাষ্ট্রীয়ভাবে SID (Student Identification) নম্বর প্রবর্তন করা গেলে সেটি হবে সর্বোত্তম। একজন শিক্ষার্থী যেসকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করবে তার সম্পর্কে সেসকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক ও ধারাবাহিক মূল্যায়ন তথ্য তার ইউনিক এসআইডি নম্বরে সংযুক্ত থাকবে। যদি এখনই রাষ্ট্রীয়ভাবে তা করা সম্ভব না হয় তো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সেমি ইউনিক এসআইডি প্রবর্তন করা উচিত এবং প্রতিষ্ঠানভিত্তিক এসআইডির তথ্যসমূহ অনলাইনে বা একটি সার্ভারে আপলোড করার ব্যবস্থা করা উচিত। যাতে একজন শিক্ষার্থী কোন পর্যায়ে কোন কোন ক্ষেত্রে কিরকম ফলাফল করেছে, কোন পর্যায় পর্যন্ত লেখাপড়া করে ড্রপ আউট হয়েছে বা ব্রেক অফ স্টাডি হয়ছে কি-না এ সকল তথ্য একসঙ্গে পাওয়া যায়। কোনো শিক্ষার্থী শিক্ষাজীবনে বা শিক্ষাজীবন শেষে চাকরি প্রার্থী হলে নিয়োগকর্তা যেন তার উপযুক্ততা মূল্যায়ন করার জন্য এই ইউনিক এসআইডির তথ্যের উপর নির্ভর করতে পারে। তদুপরি অন্যান্য ক্ষেত্রেও যেন এই তথ্য কাজে লাগানো যায়।


লেখক : সাহিত্যিক এবং অধ্যক্ষ কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা।

পত্রিকার লিংক

https://www.jagonews24.com/opinion/article/633587


Previous Post
Next Post

About Author

0 মন্তব্য(গুলি):