অনলাইন ক্লাসের প্রয়োজনীয়তা ও সীমাবদ্ধতা
মো. রহমত উল্লাহ্
দৈনিক আমাদের সময়, ৩১ ডিসেম্বর ২০২০
পৃথিবীর বর্তমান বাস্তবতায় অনলাইন শিখন-শেখানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের ব্যস্ততা, অবস্থা, অবস্থান, আর্থিক সুবিধা-অসুবিধা, সময়ের স্বল্পতা ইত্যাদি কারণে উন্নত বিশ্বে অনলাইন শিক্ষা দীর্ঘদিন ধরেই চলমান ও জনপ্রিয়। বিশেষ করে বর্তমান কোভিড পরিস্থিতিতে মানুষ যখন প্রায় ঘরবন্দি, তখন শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার জন্য পৃথিবীর সব দেশেই এখন একমাত্র ভরসা হচ্ছে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম। এই কোভিড পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষা খাত। এর বিরূপ প্রভাব হবে অত্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি ও অপরিসীম। এই ক্ষতি কিছুটা কাটিয়ে ওঠার একমাত্র উপায় হিসেবে এখন দেখা হচ্ছে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমকে।
‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র’- এ বক্তব্য, ধারণা, চিন্তা ও সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গিরই বাস্তব রূপ দিয়েছে বর্তমান অনলাইন শিখন-শেখানো কার্যক্রম। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির বদৌলতে পৃথিবীর অনেক কিছুই বর্তমানে হাতের মুঠোয়। পৃথিবীর বাইরেও চলছে মানুষের অভিযান। সেখান থেকেও নেওয়া হচ্ছে শিক্ষার নানা উপাদান। তথ্য ও তত্ত্ব জ্ঞানলাভের প্রায় সবকিছুই পাওয়া যাচ্ছে ছোট্ট একটি মোবাইল ফোনে। বলা যায়, আমার মোবাইল ফোনেই আমার বিশ্বজোড়া পাঠশালা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এখন একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষক। আবার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে একজন শিক্ষকের শিক্ষার্থী। ইন্টারনেট সুবিধার কারণে শিক্ষকরা তাদের শ্রেষ্ঠ ক্লাসগুলো আপলোড করে রাখতে পারেন অনলাইনে।
প্রাতিষ্ঠানিক বা ফরমাল শিক্ষার ক্ষেত্রে বর্তমানে অনলাইন শিখন-শেখানোর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। আমাদের শিক্ষার্থীদের স্লোগান হচ্ছে ‘আমার ঘরে আমার স্কুল’। আজ ঘরে বসেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা অর্জন করছে শিক্ষা ও শিক্ষাসনদ। বর্তমান মহামারী করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা নিজেদের নিরাপদে রেখে অনলাইন শিখন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে তাদের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারছে- এটি অবশ্যই একটি ভালো দিক। শিক্ষকরাও নিরাপদে থেকে চালিয়ে যাচ্ছেন অনলাইন শেখানো কার্যক্রম। শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ই আয়ত্ত করছেন আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার। উত্তম শিক্ষকরা উদ্ভাবন করেছেন পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে নতুন নতুন পাঠদান কৌশল। প্রাতিষ্ঠানিক বা ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে আপলোড করছেন তার সিলেবাসভুক্ত নির্ধারিত চ্যাপ্টারের বিশেষ বিশেষ ক্লাস। প্রয়োজনে সেসব ক্লাস আপডেট করতে পারছেন যখন-তখন, করতে পারছেন নতুন নতুন ক্লাস আপলোড। ওই ক্লাসগুলো আর বারবার নিতে হচ্ছে না শিক্ষকের এবং বারবার অনুসরণ করতে পারছে অগণিত শিক্ষার্থী। ভালো শিক্ষকের পাঠদান কৌশল অনুসরণ করছেন অনেক আগ্রহী সাধারণ শিক্ষক। উভয়েই চালিয়ে যাচ্ছেন উৎকর্ষ সাধনের চেষ্টা। এতে লাভবান হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষা মূল্যায়নেও যুক্ত হয়েছে নতুন কৌশল ও প্রযুক্তি।
এতকিছুর পরও এ কথা বলার উপায় নেই, আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে এতটুকু কমে গেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তথা অফলাইন ক্লাসের প্রয়োজনীয়তা। বিশেষ করে শিশু-কিশোর, যুবা-যুবক শিক্ষার্থীদের জন্য ফরমাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়া খুব বেশি জরুরি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে না যাওয়ার কারণে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এবং উদ্যমহীন ও বিষণœ হয়ে পড়ছে। দৌড়ঝাঁপ, খেলাধুলা, হাসি-তামাশা না থাকায় তারা ধরে রাখতে পারছে না শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা। কেউ কেউ নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছে অবাধ ইন্টারনেটের অন্ধকার আসক্তিতে। প্রত্যক্ষ যোগাযোগের অভাবে তারা হয়ে উঠছে অসামাজিক। শিখছে না প্রকৃত বন্ধুত্ব, মানুষের জন্য ত্যাগ, সামাজিক দায়িত্ব-কর্তব্য। অর্জন করছে না সুন্দর করে কোনো কিছু মুখ খুলে বলার যোগ্যতা। সরাসরি শিক্ষকদের সঙ্গে ওঠাবসা না থাকায় তারা আয়ত্ত করতে পারছে না আদর্শ চলন-বলন, পোশাক-আশাক। উত্তম শিক্ষকের ন্যায়-নীতিবোধ প্রোথিত হচ্ছে না শিক্ষার্থীর মনে। প্রাতিষ্ঠানিক ওঠা-বসা না থাকায় তারা শিখছে না সময়ানুবর্তিতা ও নিয়ম-শৃঙ্খলা। রপ্ত করছে না ম্যানার্স অ্যান্ড এটিকেটস। সবকিছুই খুব সহজে ইন্টারনেট থেকে পেয়ে যাওয়ার কারণে শানিত করছে না নিজের সৃজনশীলতা। হারিয়ে ফেলছে দেশ ও জাতির কল্যাণে এক পা এগিয়ে আসার উদ্দীপনা ও মানসিকতা। শারীরিকভাবেও হয়ে যাচ্ছে শক্তিহীন ও অলস।
অন্যদিকে সব শিক্ষার্থী সমানভাবে পাচ্ছে না অনলাইন শিখন সুবিধা। বিশেষ করে আমাদের দেশের মতো দরিদ্র দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী অবস্থান করছে ইন্টারনেট সুবিধার বাইরে। আবার অনেকেরই সাধ্য নেই ডিভাইস ক্রয় ও ইন্টারনেট বিল পরিশোধের। তাই আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় পিছিয়ে পড়ছে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী। তারা পিছিয়ে থাকবে পরবর্তী শিক্ষা ও কর্মে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে শিক্ষা, যোগ্যতা ও দক্ষতায় তৈরি হবে বিশাল অসমতা। এটি খুবই ভাবনার বিষয়!
এদিকে অনলাইন শিখন-শেখানোয় বিদ্যমান নেই ব্যবহারিক শিক্ষার কোনো সুযোগ। এমন কিছু চ্যাপ্টার বা বিষয় আছে- যেগুলোর সফল পাঠদান সম্ভব হয় না অনলাইন ক্লাসে। মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো অনেক বিষয় আছে- যেগুলোর দুই-একটি চ্যাপ্টার অনলাইনে পড়ানো সম্ভব হলেও সম্পূর্ণ কোর্স সম্পন্ন করা মোটেও সম্ভব নয়। নাচ, গান, হামদ, নাত, চিত্রাঙ্কন, বক্তৃতা, বিতর্ক, আবৃত্তি, খেলাধুলা ইত্যাদি সহশিক্ষার সঠিক অনুশীলন অনলাইন ক্লাসে অসম্ভব। প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষক তৈরি করতে পারেন না মানসম্পন্ন ডিজিটাল কনটেন্ট। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তিতে আগ্রহ ও দক্ষতা নেই সব শিক্ষকের। এমনও শিক্ষক আছেন- যারা ধর্মীয় কারণ দেখিয়ে ক্যামেরার সামনে এসে বলতে চান না কথা, নিতে চান না অনলাইন ক্লাস। ফলে তৈরি হয় না শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থীর ইন্টারেকশন বা মিথস্ক্রিয়া। নিজের দুর্বলতা প্রকাশের ভয়ও আছে অনেক শিক্ষকের। অনলাইন ক্লাস ও পরীক্ষার মাধ্যমে সম্ভব হয় না পরিপূর্ণ শিক্ষার মূল্যায়ন। কিছু অ্যাপের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর স্মরণশক্তি ও আইকিউ যাচাই করা সম্ভব হলেও সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনী শক্তি মূল্যায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না সঠিকভাবে।
আলোচিত সুবিধা ও অসুবিধার আলোকে নিশ্চিত করেই বলা চলে, আনুষ্ঠানিক শ্রেণিপাঠের জন্য কোনোভাবেই অফলাইন বা সাধারণ ক্লাসের বিকল্প হতে পারে না অনলাইন ক্লাস। প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষে সরাসরি পাঠদানের মাধ্যমেই সর্বাধিক অর্জন করা সম্ভব শিখন-শেখানোর সফলতা তথা ‘সুস্থ দেহে সুস্থ মন গঠন’। বিশেষ করে শিশু-কিশোর, যুবা-যুবক শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে অনানুষ্ঠানিক ও বয়স্কদের শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে অনলাইন শিখন-শেখানোর প্রয়োজনীয়তা এই ডিজিটাল যুগে অনস্বীকার্য। মোট কথা, একটি অন্যটির পরিপূর্ণ বিকল্প নয়। বর্তমান ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতির অবসান হলেও চলমান থাকবে অনলাইন শিখন-শেখানো কার্যক্রম। স্বাভাবিক শ্রেণি কার্যক্রমের পাশাপাশি চলবে অনলাইন ক্লাস। এ বাস্তবতা মেনে নিয়েই শিক্ষকদের হয়ে উঠতে হবে উভয় পদ্ধতিতে অধিক যোগ্য ও দক্ষ।
মো. রহমত উল্লাহ্ : অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।
0 মন্তব্য(গুলি):