যায়যায়দিন, ঢাকা, শনিবার, অক্টোবর ৩০, ২০১০, কার্তিক ১৫, ১৪১৭ বঙ্গাব্দ, ২১ জিলকদ, ১৪৩১ হিজরি, রেজি: নং-১২৯৩, বছর ০৫, সংখ্যা ১৪২
পুলিশ নির্যাতন করে কেন
মো. রহমত উল্লাহ্
পত্রিকার পাতা খুললে প্রায়ই চোখে পড়ে পলিশি নির্যাতনে আহত/ নিহত হবার মর্মান্তিক খবর। এটি নতুন নয়। দেশ স্বাধীনের আগেও ছিল। তখন আমরা পরাধীন ছিলাম। মনে করতাম দেশ স্বাধীন করতে পারলেই মুক্তি পাবো এই অমানবিক নির্যাতন থেকে। অবর্ণনীয় ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন করলাম দেশ। নিজেরা তৈরি করলাম নিজেদের সংবিধান। এখন আর নেই সেই নরপশু ইয়াহিয়া খান। নেই সেই খাকি পোশাকের পুলিশ। বদল করা হয়েছে পোশাকের রং ও ব্যাজ। নিয়োগ পাচ্ছে আমাদেরই ভাই-বোন। বদলায় নি আচরন! এখনো আছে নির্যাতন। আছে নির্যাতনের দুঃখজনক খবর! এই খবরের বাইরেও থেকে যাচ্ছে হাজারো খবর। কারণ, বিশেষ ব্যক্তিদের খবর ছাপিয়ে সাধারণের খবর পৌঁছে না আমাদের কানে। পুলিশের বিরুদ্ধে মুখ খুলবে এমন বুকের পাটা আছে ক’জনের? আমাদের সংবিধানে পুলিশি নির্যাতন একটি মারাত্মক অন্যায় ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু এই আইন জানা নেই ৯০ ভাগ সাধারণ মানুষের। নির্যাতনের দায়ে পুলিশের শাস্তি হয়েছে এই উদাহরণ পুলিশি নির্যাতনের ঘটনার তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য। তাই সাধারণ মানুষের ধারনা, অপরাধীকে নির্যাতন করা পুলিশের আইনগত অধিকার। অনেক পুলিশের মনোভাবও অনুরূপ! একটু খতিয়ে দেখা প্রয়োজন সংবিধান পরিপস্থী হওয়া সত্তেও পুলিশ নির্যাতন করে কেন? শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব তো পুলিশের নয়, আদালতের। পুলিশ এ দায়দায়িত্ব নিচ্ছে কেন বার বার? এসবের জন্য কি শুধু পুলিশই দায়ী? এ কথা সত্য যে, বেশিরভাগ পুলিশই ঘুষের টাকা না পেলে আসামিকে নির্যাতন করে। জড়িয়ে দেয় আরো দু-একটি মিথ্যা মামলায়। যুক্ত করে জামিন অযোগ্য ধারা। এটি অবশ্যই পুলিশের অপরাধ। এর অন্তরালে বিদ্যমান আরো অনেক কারণ। ঘুষ বা অবৈধ টাকা আদায়ের কূট-কৌশল তো সরকারি ডিপার্টমেন্টের অনেক লোকেরাই প্রয়োগ করে। পুলিশ বাদ থাকবে এটি ভাববার সুযোগ কই? তবে তাদের কৌশলটা অধিক নিষ্ঠুর!
স্বাধীনতা পূর্ব কালের মত উত্তর কালেও বিরোধী দলকে রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়ে কম/বেশি পুলিশকে ব্যবহার করে আসছে সরকার ও সরকারি দল। সরকারি দলের কথা যত অযৌক্তিক হোক, না শুনলে, না মানলে পরিণতি কতটা খারাপ হতে পারে পুলিশের এই অভিজ্ঞতা অনেক দীর্ঘ। পুলিশ এখন সরকারি দলের নেতা, কর্মী, ক্যাডারকেই মনে করে ‘সরকার’! তাই সরকারি দলের লোকদের কথা মত নির্যাতন চালায় বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর। আবার ক্ষমতার পালা বদলের সাথে সাথে ঘুরিয়ে দেয় লাঠি!
আদালতের অনুমতিসাপেক্ষে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে রিমান্ডে এনে নির্যাতন চালায় পুলিশ। এটি এত বেশি প্রচলিত যে, মানুষ মনে করে রিমান্ড মানেই নির্যাতন! রিমান্ড মানে হচ্ছে- অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা প্রমাণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আদালত কর্র্তৃক পুলিশকে অনুমতি দেওয়া। রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের বিশেষ করে শারীরিক নির্যাতনের কোনো বিধান নেই। তবুও অমানসিক নির্যাতন চালায় পুলিশ। আহত করে, নিহত হয়! অনেক সময় বিগত/আগত এম.পি., মন্ত্রীরাও রেহাই পায় না এই নির্যাতন থেকে। রিমান্ডে নিয়ে ‘নির্যাতন করা যাবে না’ লিখে দিয়ে অনেক বারই আদালত ¯^ীকার করে নিয়েছে যে, পুলিশ তা করে। প্রশ্ন হচ্ছে, পুলিশ করবে কী ? প্রতিনিয়তই কাউকে না কাউকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে (৫৪ ধারায়) গ্রেফতার করতে হয়। প্রাথমিকভাবে প্রমাণও করতে হয় এই গ্রেফতারের কারণ। তাই চালাতে হয় স্বীকারমূলক জবান আদায়ের চেষ্টা। এটি অবশ্যই অত্যন্ত উঁচু স্তরের মনস্তাত্তি¡ক বিষয়। বিভিন্ন কৌশলে কথা বলে ও প্রশ্ন করে সত্য/মিথ্যা উদঘাটন করার জন্য প্রয়োজন অনেক বুদ্ধিমত্তার। অপরাধিরা অনেক চতুর। কিন্তু আমাদের পুলিশের (বিশেষ করে মাঠ পর্যায়ে) এমন যোগ্যতা, বুদ্ধিমত্তা ও প্রশিক্ষণ আছে কি, যার দ্বারা চতুর লোকের মাথা থেকে সত্য/মিথ্যা বের করে আনবে? তাই অপরাধীর(?) উপর চালায় অমানবিক নির্যাতন।
অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, আমাদের প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা যেন প্রজাতন্ত্রের নয়; রাজনৈতিক দলের। পুলিশও এর ব্যতিক্রম নয়। তারা যেন কোনো না কোনো দলের পক্ষে কাজ করার জন্য নিয়োজিত। সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে তাদের দায়িত্ব বদলই এর প্রমাণ। এই বদল নিরপেক্ষতার নামে হলেও, এর উদ্দেশ্য প্রশ্নবিদ্ধ। ফলে তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর নির্যাতন চালানোর সুযোগ কাজে লাগাতে আগ্রহী হতে পারে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের মতোই। কেননা দলীয়করনের মাধ্যমে নিয়োগপ্রপ্তরা কোন না কোন রাজনৈতি দলের সাবেক কর্মী/ক্যাডার। তাদের নিয়ে সরকারও বিপাকে পড়ে কোন কোন সময়। এদের অতি উৎসাহ বা প্রতিহিংসা মূলক মনোভাবাপন্ন আচরনে নির্যাতনের শিকার হয় ভালো/মন্দ অনেকেই।
গত দিন পর্যন্ত যাদের অঙ্গুলি নির্দেশে পুলিশ উঠাবসা করতো, আজই লাঠিপেটা করে রাস্তায় শুইয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে তাদের। অথবা গত পাঁচ বছর যাদের নির্যাতন করে ঠিক রাখতে হয়েছে নিজের চাকরি ও পোস্টিং, আজ তাদেরকেই রক্ষা করতে হচ্ছে জান-প্রাণ দিয়ে। ফলে ছোট বড় কারোর প্রতিই আন্তরিক শ্রদ্ধা রাখতে পারছেনা পুলিশ। আমাদের এমপি, মন্ত্রী, নেতাদের চরিত্র তো ভালো করেই জানে তারা। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য অপব্যবহৃত হতে হতে অন্য অনেকের মতই লোপ পেয়েছে/পাচ্ছে পুলিশের মানবিক মূল্যবোধ। নিরপরাধ মানুষকেও নির্যাতন করতে তাদের বিবেকে বাধে না এখন আর।
মোটকথা এসব আলোচিত এবং অন্যান্য অনালোচিত অশুভ কার্যকারণ নিরসনে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। অন্যথায় কোন দিনই জনগণের বন্ধু হবেনা পুলিশ। আমাদের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশর উপর থেকে সরবে না পুলিশি রাষ্ট্রের অভিযোগ।//
[ লেখক- অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা। E-mail:md.rahamotullah@yahoo]
0 মন্তব্য(গুলি):