যায়যায়দিন- ১৪ নভেম্বর ২০১৫
টাকার পাগল চিকিৎসকদের চিকিৎসা করা জরুরি
মো. রহমত উল্লাহ্
অসুস্থ হলে প্রায় সবাই কম বেশি অসহায় বোধ করেন। প্রত্যাশা করেন ভালো চিকিৎসকের চিকিৎসা ও নিকটজনের সেবা। বিশেষ ভাবে নির্ভর করেন চিকিৎসকের উপর। আনেকেই মনে করেন চিকিৎসক হচ্ছেন রোগ মুক্তির দ্বিতীয় দেবতা। একজন উত্তম চিকিৎকের নিকট অসুস্থ এবং সুস্থ মানুষের কমপক্ষে পাঁচটি প্রত্যাশা থাকে। ধৈর্য্য, সহানুভূতি, ভালো ব্যবহার, অবানিজ্যিক মানসিকতা ও নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা।
অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে কাঙ্ক্ষিত ধৈর্য্য, সহানুভূতি, ভালো ব্যবহার ও অবানিজ্যিক মানসিকতা নিয়ে নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা দেবার মতো চিকিৎসকের সংখ্যা আমাদের বাংলাদেশে একেবারেই কম। হাতেগুনা দু’একজন আছেন। তাই একেবারে নেই বলা চলে না।
আমার জানা ও দেখা উত্তম চিকিৎসকগণের মধ্য থেকে একজনের কথা বলছি, তিনি বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্কোলজির সিনিয়র প্রফেসর। মেডিসিনেরও বিশেষজ্ঞ। পরিচিত রোগীদের নিয়ে গত ২০ বৎসরে অনেবার গিয়েছি তাঁর কাছে। মুগ্ধ হয়েছি বার বার। এমন অনেক দিন দেখেছি খুবই ধর্য্য ধরে শুনেছেন রোগীর প্রাসঙ্গিক অপ্রাসঙ্গিক সব কথা। তার পর লিখে দিয়েছেন অন্য একজন ডাক্তারের নাম ঠিকানা। ফিস দিতে গেলে বলেছেন: আমিতো চিকিৎসা দিইনি, যিনি চিকিৎসা দিবেন তিনি ফিস নিবেন। আমি অবশ্য ঔষধ লিখে দিতে পারতাম, কিন্তু এটি আমার বিষয় নয়। তাই ঔষধ লেখা আমার অনুচিত। এমনটি যুক্তিযুক্ত হলেও আমাদের দেশে খুব একটা দেখা যায় না।
হরহামেসা যা দেখা যায় তা হলো: কোন রোগী একবার হাতে পেলে হাতছাড়া করতে চায় না আর। তা সে এই চিকিৎসা জানুক আর নাই জানুক (এখন তো ভোগাস ডাক্তারের সংখ্যাও কম নয়), লিখতে থাকেন হাজারো ঔষধ আর পরিক্ষা-নিরীক্ষা।
শধু রোগীই নয়, রোগীর রিপোর্ট দেখেও বার বার আদায় করেন মোটা অংকের ফিস। আপরদিকে রিপোর্ট বাবদ রোগীর পরিশোধিত টাকার ভাগ আদায় করেন সংশ্লিষ্ট ডায়গস্টিক সেন্টার থেকে। তাদের মনের কথা যেনো একটাই; রোগী সুস্থ হোক না হোক, টাকা চাই, আরো টাকা।
দু’টি উদাহরণ দিই। দু’জনই মানসিক রোগের বিশেষজ্ঞ। দু’জনই রাজধানির সাইন্স ল্যাব এর কাছাকাছি চেম্বারে বসেন। একজন পুরুষ আর একজন মহিলা। একজন সরকারি ডাক্তার, দৈনিক রোগী দেখেন এ, বি, সি এই তিন সিরিয়েলে প্রায় ১৫০ জন। মাথাপিছু ফিস আদায় করেন ৮০০ টাকা। এমন সব ঔষধ লিখেন যার অধিকাংশই পাওয়া যায় না অন্য কোথাও। চড়া দামে কিনতে হয় তাঁর নিজস্ব দোকান থেকে। বিদেশ থেকে একমাত্র তিনিই নাকি আমদানি করেন সেইসব চড়া দামি ঔষধ। কখন জানি তিনি আবার পত্রিকা এবং বইও বেড় করেন। ঔষধের দোকানেই পাওয়া যায় তাঁর বই ও পত্রিকা। শুনলাম একটা প্রাইভেট হাসপাতাল করে সেখানেও রোগী দেখেন তিনি। একসময় জাতীয় মানসিক সাস্থ্য ইন্সটিটিউটের পরিচালকও ছিলেন তিনি। বিভিন্ন কৌশলে টাকা হাত করায় সুদক্ষ এই লোকটির কোন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান আছে বলে আমার জানা নেই।
আর একজন মহিলা সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার। দৈনিক রোগী দেখেন ২০/২৫ জন। একেক জনের নিকট থেকে ফিস আদায় করেন একেক রকম। মাথাপিছু ১ হাজার টাকা থেকে ২/৩ হাজার টাকাও আদায় করে থাকেন তিনি। একজন রোগী দেখতে যত সময় লাগবে তত টাকা হবে তার ফিস। আমার এক রোগী দেখার সময় একদিন তিনি দুঃখ করে বলছিলেন, তদ্বির/দলাদলি করতে পারেন না বলে, এতদিনে মাত্র সহকারি অধ্যাপক হয়েছেন। এই কাহিনী বলতে বলতে পাস করলেন ১০/১৫ মিনিট আর বাড়িয়ে দিলেন রোগীর ফিস। আরেকদিন এক রোগীর হাতে ডায়বেটিক হাসপাতালের বই দেখে মানসিক ঔষধের প্রেসক্রিপসনে লিখে দিলেন এক বিশাল খাদ্য তালিকা! এই অতিরিক্ত সময়ের জন্য আদায় করলেন অতিরিক্ত ফিস!
শুধু যে টাকা আদায় করেন তাই নয়। অধিকাংশ বড়(?) ডাক্তারেরা এমন আচরন করেন রোগীদেরসাথে; যেনো সব রোগীরা সিঁদেল চোর আর ডাক্তার সাহেব বড় দারোগা। কথা বলতে গেলে এমন খেপে উঠেন, যেনো রোগীরা বিনা টিকেটের রেল যাত্রী আর ডাক্তার সাহেব মোবাইল কোর্টের বিচারক। কোর্টের পেসকারের মতো তার আবার এসিসটেন্ট ডাক্তার থাকেন। তিনি রোগির কথা শুনেন ও লেখেন। কয়েকজন রোগি একত্রে বসিয়ে তিনি ফাইল করেন কেস। যেখানে গোপন কথা বলার কোন সুযোগই থাকে না রোগিদের। তারপর কেস ফাইল নিয়ে আসামির মতো হাজির হতে হয় সেই বড়(?) ডাক্তারের সামনে। রোগির কোন কথা না শুনে, তিনি একই সাথে লিখেন অনেক গুলো পরিক্ষা ও ঔষধ। পরিক্ষা দিলেন কী রোগ ধরার জন্য, আর ঔষধ দিলেন কী রোগ ধরে, তা জানার অধিকার নেই রোগির বা রোগির সংগীর। টাকা দিয়ে প্রাইভেট চেম্বারে গেলেই এই অবস্থা। আর সরকারি হাসপাতালে তাদের সামনে রোগি যাবে কোন সাহসে?
এমনও ডাক্তার আছেন যারা রোগী দেখেন বিকাল থেকে রাত বারোটা / একটা পর্যন্ত। কখন তারা ঘুমান, কখন নাওয়া খাওয়া করেন, কখন সকালে উঠেন, কখন সরকারি হাসপাতালে যান, কতক্ষণ থাকেন সেখানে, ক’টা রোগির চিকিৎসা দেন ঠিকমত, কীভাবে আবার চেম্বারে আসেন সঠিক সময়ে? শুনেছি অনেক দেশেই বিচারকদের হিসাব দিতে হয়, তিনি কতটা মামলার শুনানি করেছেন, কতটা মামলার রায় দিয়েছেন, কতটা রায় আপিলে গিয়ে টিকেছে বা বাতিল হয়েছে ইত্যাদি। গুয়েন্দা কর্মীদেরঅকেও হিসাব দিতে হয়, কতটা কেস ফাইল করছেন, কতটা কেস তদন্ত করেছেন, কতটা সময় ও অর্থ ব্যয় করেছেন, কতটাতে সফল আর কতটাতে ব্যার্থ হয়েছেন ইত্যাদি। আবার ডাক্তারদেরও নাকি হিসাব দিতে হয়, কতটা রোগী দেখেছেন, কতটার সফল চিকিৎসা দিয়েছেন, রোগির সাথে কী রকম আচরন করেছেন, কোন ভুল চিকিৎসা দিয়েছেন কি না ইত্যাদি। এইসব বিষয়ের উপর নির্ভর করে তাদের প্রমোশন। আমাদের ডাক্তারদের প্রমোশনের বেলায় কি এমন কোন মানদন্ড আদৌ আছে? যদি থাকতো তাহলে তো সেই মহিলা ডাক্তারের এমন অভিযোগ থাকতো না যে, তিনি দালালি ও দলাদলি করতে পারেন না বলে প্রমোশন পাচ্ছেন না। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ডাক্তার ও নার্সদের কাজের পরিধি পরিমাপের ব্যবস্থা করে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা গেলে বর্তমান বাজেট ও কাঠামোতেই চিকিৎসা পেতে পারে আরো তিনগুণ বেশি রোগি। অবশ্যই কমবে ডাক্তারদের প্রাভেট চেম্বারের ভিড়। বর্তমান ডিজিটাল ব্যবস্থায় (প্রতিটি রোগির পৃথক ও স্থায়ী আডি নম্বর দিয়ে) দু’একটি সফটওয়ার তৈরি ও প্রয়োগ করে সহজেই হিসাব রাখা সম্ভব প্রতিদিন কতটা রোগির টিকেট বিক্রি হচ্ছে, কোন কোন ডাক্তার কতজন নতুন ও কতজন পুরাতন রোগি দেখেছেন, একজন রোগি একই রোগের চিকিৎসা নিতে কতবার এসেছেন ইত্যাদি। তেমন ব্যবস্থা করা গেলে আর ঢাকায় এসে চেম্বারে বসে থাকতে পারবে না মফস্বল হাসপাতালে যাদের পোস্টিং।
বর্তমান সরকার শিক্ষকদের প্রাইভেট কোচিং বন্ধের ব্যাপারে যতটা সোচ্চার ও সক্রিয় ডাক্তারদের প্রাইভেট প্রেক্টিস কমানোর বা বন্ধের ব্যাপারে এক আনাও সক্রিয় আছে বলে মনে হয় না। যারা টাকার জন্য পাগল হয়ে গেছে, তারা তো আর সুস্থ স্বাভাবিক নয়; জাতীয় স্বার্থেই তাদের সামান্য চিকিৎসা করা জরুরি।//
0 মন্তব্য(গুলি):