মো. রহমত উল্লাহ্
কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত বাংলাদেশের শিশু সাহিত্য শিশুদের জন্য আসলে কতটা উপযোগী তা নতুন করে বিচার বিশ্লেষণ করার প্রয়োজনীয়তার কথা চিন্তাশীল ব্যক্তি মাত্রই স্বীকার করেবেন। বিশেষ করে শিশু সাহিত্য হিসেবে চালিয়ে দেওয়া সাহিত্যে যে সকল অবোধগম্য শব্দ প্রয়োগ করা হচ্ছে, যে সকল কঠিন বানান ব্যবহার করা হচ্ছে, যে সকল দীর্ঘ-জটিল বাক্য ব্যবহার করা হচ্ছে এবং যে সকল চিত্র/এনিমেশন ব্যবহার করা হচ্ছে; তা সেই শিশুদের পাঠের, বোঝার ও অনুভব করার সাধ্য আছে কিনা তা ভালোভাবে বিচার বিশ্লষণ করা জরুরি।
বাংলাদেশের প্রচলিত শিশু সাহিত্য গুলো এদেশের প্রকৃতি ও সমাজ বাস্তবতার সাথে কতটা সংগতিপূর্ণ, কতটা বিজ্ঞান মনষ্ক, কতটা যুক্তিযুক্ত, কতটা আধুনিক, কতটা শিক্ষণীয়, কতটা জীবন দক্ষতা সহায়ক, কতটা ধর্ম নিরপেক্ষ, কতটা সৃজনশীল তা ব্যাপক গবেষণার দাবি রাখে। কেননা, দেশের প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের পাঠ্য হিসেবেও এসকল প্রচলিত সাহিত্যই পড়ানো হচ্ছে; যার মাধ্যমে দেশ ও জাতি কাঙ্খিত সুনাগরিক তৈরির প্রচেষ্টায় দীর্ঘদিন যাবত ব্যাপক অর্থ, সময় ও মেধা বিনিয়োগ করে চলেছে আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র যন্ত্র।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক প্রবর্তিত প্রথম শ্রেণির ‘আমার বাংলা বই’ এর কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি আজ।
"আতা গাছে তোতা পাখি
ডালিম গাছে মউ।
এত ডাকি তবু কথা
কও না কেন বউ।"
[পৃষ্ঠা-৫]
"বাগবাকুম পায়রা
মাথায় দিয়ে টায়রা
বউ সাজবে কাল কি
চড়বে সোনার পালকি।"
[পৃষ্ঠা-৩০]
ছোট বেলা থেকেই আমরা ও আমাদের সন্তানেরা এইরূপ অনেক ছড়া-কবিতা/গল্প-গাথা শুনে শুনে বা পড়ে পড়ে বড় হয়েছি এবং হচ্ছি। এ ছাড়াও চড়ই ভাতি খেলার নামে অনেক পারিবারিক গল্প-কবিতা আমরা ও আমাদের শিশুরা শুনে, পড়ে বড় হয়েছি এবং হচ্ছি। অথচ আমরা এটি চিন্তা করছি যে, ৪/৫ বৎসরের এতো ছোট শিশুটিকে তার সেই খেলা বেলার ও শিক্ষা শুরু বেলার কী প্রয়োজনে 'জামাই-বউ' সম্পর্কিত বিষয়কে পাঠ্য তালিকাভুক্ত করছি। আমরা এটিও বিবেচনা করছি না যে, এইরূপ শিক্ষা আমাদের বাংলাদেশের শিশুদেরকে বাল্যবিবাহে উদ্ভূদ্ধ করছে কি না কিংবা বাল্যবিবাহ প্রতিরোধী হবার অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে কি না। আমাদের ছোট্ট শিশুকে আমরা কি বউ সেজে পালকি চড়ার স্বপ্ন দেখাবো, না পাইলট হয়ে বিমান চড়ার স্বপ্ন দেখাবো? মানুষতো তার স্বপ্নের সমান বড়। যে স্বপ্ন সে জেগে জেগে দেখে। যে স্বপ্ন বাস্তবায়ের জন্য সে প্রতিজ্ঞা করে, পরিকল্পনা করে, পরিশ্রম করে এবং বাস্তবায়ন করে সেই স্বপ্নের সমান বড় হয়।
একই বই থেকে নেওয়া আরো দু'একটি অসংগতির উদাহরণ দেখা যাক। যেমন:
(ক)
“ইতল বিতল গাছের পাতা
গাছের তলায় ব্যাঙের ছাতা।
বৃষ্টি পড়ে ভাঙে ছাতা
ডুবায় ডুবে ব্যাঙের মাথা।”
[পৃষ্ঠা- ১৮]
এই ছড়া-কবিতায় ব্যবহৃত "ইতল" শব্দটি কোনো অভিধানে নেই। এর কোনো অর্থ বা প্রতিশব্দ অথবা বিপরীত শব্দ অথবা কোন কিছুর ঝংকার হিসেবেও এই শব্দ শিক্ষকের জানা নেই। "বিতল" শব্দের আবিধানিক অর্থ হচ্ছে 'হিন্দু পুরাণোক্ত দ্বিতীয় পাতাল'; যা এই কবিতার সাথে সংগতি পূর্ণ নয় এবং ছোট শিশুদের তা জানার এখনও প্রয়োজন নেই। এদু’টি শব্দ কোন কিছুর ধ্বণি বা ঝংকার হিসেবেও আমাদের কাছে পরিচিত নয়। যা শিশুদের বলে বুঝানো সম্ভব।
(খ)
“অজ আসে। অলি হাসে।”
“ইট আনি। ইলিশ কিনি”
“উট চলে। উষা কালে।”
“ঋতু যায়। ঋতু আসে। ঋষি ঐ বসে আছে।”
“চশমা রাখি। ছবি দেখি।”
“বক গাছে। বালুক নাচে”
“ঝড় থামে। আষাঢ় নামে।”
“বীণা আনি। গীত শুনি।” ইত্যাদি।
[পৃষ্ঠা- ১১ থেকে ৪৬]
এই লাইন গুলো দ্বারা শিশুদের ছন্দে ছন্দে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের ব্যবহার শেখানো এবং বিভিন্ন জিনিসের সাথে পরিচিত করানোর চেষ্টা করা হয়েছে। অথচ কোনো ছন্দেরই (স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত) সঠিক প্রয়োগ এখানে সফল হয়নি। অত্যন্ত দুর্বল হয়েছে অন্তমিল। যেমন: ‘রাখি’ এর সাথে ‘দেখি’, ‘গাছে’ এর সাথে ‘নাচে’ , 'আসে' এর সাথে 'আছে', ‘আনি’ এর সাথে ‘শুনি’ ইত্যাদি। ‘অজ’ শব্দটির অর্থ জানেন ক’জন শিক্ষক? কোন এলাকার পরিচিত শব্দ এটি? আবার লেখা হয়েছে- "ঝড় থামে <> আষাঢ় নামে"। 'আষাঢ়' তো একটি মাসের নাম। এটি নামে কীভাবে? বরং বলা যেতে পারতো 'আষাঢ় মাসে বৃষ্টি নামে'।
(গ)
পৃষ্ঠা ৬, ৭ ও ৮ এর কিছু বাক্যে সঠিক শব্দ ব্যবহার করে এবং ব্যবহৃত শব্দ গুলোর অবস্থান পরিবর্তন করে বাক্যগুলো আরো সঠিক করা যেতে পারতো। যেমন:
"সে এদিক ওদিক তাকাল পানির খোঁজে।" এই বাক্যটি হতে পারতো- সে পানির খোঁজে এদিক ওদিক তাকাল। "তখন একটা কলসি পড়ল তার চোখে।" এই বাক্যটি হতে পারতো- তখন সে একটা কলসি দেখতে পেল। / তখন একটা কলসি তার চোখে পড়ল। "এভাবে কাকটি অনেক নুড়ি কলসিতে ফেলল।" "তখন কাকটি প্রাণ ভরে পানি খেল।" এই বাক্য দু'টিতে এসে কাককে টি বলা হলো কেন? সে কি এখানে এসে বস্তু হয়ে গেল? এই বাক্য দু'টিতো এভাবে লেখা যেতো- এভাবে কাক অনেক নুড়ি কলসিতে ফেলল। তখন কাক প্রাণ ভরে পানি পান করল। ইত্যাদি।
এমন দুর্বলতা যে কেবল প্রথম শ্রেণির বাংলা বইয়েই আছে তা কিন্তু নয়। স্কুল ও মাদ্রাসার সকল শ্রেণির সকল বইয়েই রয়েছে এমন ছোট বড় সমস্যা। দেখা গেছে একই শব্দের বানান বাংলা বইয়ে একরকম আর তারই অংক বইয়ে আরেক রকম। একই ক্লাসের বাংলা, অংক, ইংরেজি, সমাজ ইত্যাদি বইয়ের স্টেন্ডার্ড একই রকম নেই। একই শ্রেণির বাংলা বইয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভাষা শিক্ষার যে স্তর লাভ করেছে, তারচেয়ে অনেক কঠিন শব্দে ও জটিল বাক্যে লেখা তারই অন্যান্য বই। ফলে একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষার মাধ্যম বাংলা (ইংলিশ ভার্সনের ক্ষেত্রে ইংরেজি) ভালভাবে না জানার কারণেই অর্থ উদ্ধারে ব্যর্থ হয়ে ভালভাবে পারছেনা গণিত, সমাজ ও নৈতিক শিক্ষা। আর আমরা অন্ধের মতই বলছি, এই শ্রেণির এই শিক্ষার্থী এই বিষয়ে দুর্বল!
এভাবে অযত্নে অবহেলায় শিখানোতো ভুল শিখানোরই সামিল। শিশুকালের এই ভুল শিক্ষাই দখল করে রাখে আমাদের মস্তিষ্কের একটা বিরাট অংশ। যা থেকে বেড়িয়ে এসে পরবর্তী জীবনে সঠিক চিন্তা ও কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে অনেকের পক্ষেই। বিশেষ করে যারা পরবর্তীতে বিভিন্ন ভাবে বঞ্চিত হয় সঠিক ও আধুনিক শিক্ষা থেকে। তাই দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এখনই আমাদের শিশুদেরকে এইরূপ "আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম" জাতীয় ভুল শিক্ষার মায়া জাল থেকে বেড় করে নিয়ে আসা জরুরি।
আমাদের পাঠ্যবইসমূহে যেসব গল্প, কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ, নিবন্ধ দেওয়া হচ্ছে সেগুলো সবই যে মন্দ তা কিন্তু নয়। তবে এরচেয়েও ভালো দু'চারটি লেখা যে আমাদের নবীন-প্রবীণ লেখকদের নেই তা বলা যাবেনা। আমার জানামতে শিশু সাহিত্য নিয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা করে গল্প, কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ, নিবন্ধ লিখছেন দেশের বেশকিছু লেখক। তাই বিভিন্ন ক্লাসের বইয়ের জন্য পৃথক বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে লেখা আহ্বান করে দেখা উচিৎ এরচেয়ে ভাল লেখা পাওয়া যায় কি না। তবে লেখক নয়, বাছাই করতে হবে লেখা। একজন নামীদামী লেখকের লেখা সকল শ্রেণিতে পাঠ্য করার উপযোগী নাও থাকতে পারে। অমুক লেখকের একটা লেখা অমুক শ্রেণিতে দিতেই হবে এমন রিজিট থাকা অনুচিত। আর সেই লেখা যাচাই বাছাই করার জন্য গঠিত টিমে বিশেষজ্ঞদেরসাথে অবশ্যই যুক্ত রাখা উচিৎ কিছু নবীন-প্রবীণ শিশু সাহিত্যিক এবং সংশ্লিষ্ট প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বিভিন্ন সময়ের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের। বই করার এই টিমে যারা যুক্ত থাকবেন তাদের লেখা গল্প-কবিতা বইগুলোতে না রাখাই কৌশলগত দিক থেকে সঠিক। বইয়ের পান্ডুলিপি চূড়ান্ত করার আগে বাছাইকৃত বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিকট পাঠিয়ে দিয়ে করে নেওয়া উচিৎ বিজ্ঞান ভিত্তিক ফিল্ড টেস্ট। অনলাইনে দিয়ে নিয়ে নিয়ে নেওয়া যেতে পারে সকলের মতামত। যাতে সবাই জানতে পারে আগামীতে কেমন বই যাচ্ছে আমাদের স্কুল ও মাদ্রাসায় পড়োয়া সন্তানদের হাতে হাতে। আর এই সবকিছুর জন্যই থাকা চাই সংশ্লিষ্টদের আন্তরিক সদিচ্ছা। <
[মো. রহমত উল্লাহ: শিশু সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ এবং অধ্যক্ষ - কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা। Website: creativeclan.net.bd ]
0 মন্তব্য(গুলি):