আরও উন্নত হোক বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের বাছাই প্রক্রিয়া


পত্রিকার লিংক

আরও উন্নত হোক শিক্ষক নিয়োগের বাছাই প্রক্রিয়া 

মো. রহমত উল্লাহ্

দৈনিক বাংলা, ০১ জুন ২০২৫

>অত্যন্ত জটিল কর্ম সাধন হচ্ছে শিক্ষকতা। এর সফলতা শিক্ষার্থী নির্ভর। একজন শিক্ষকের জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সফলভাবে সঞ্চারিত করার জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি অন্যান্য অনেক যোগ্যতার প্রয়োজন হয়। সেসব যোগ্যতা একই সাথে জন্মগত ও অর্জনীয়। এমন কিছু যোগ্যতা ও দক্ষতা আছে যা প্রশিক্ষণ দিয়ে পূর্ণ করা যায় না, সামান্য উন্নয়ন করা যায়। অথচ শিক্ষকতায় সে সকল যোগ্যতা ও দক্ষতার আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। বিভিন্ন স্তরে (স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে) শিক্ষক নিয়োগের বাছাই প্রক্রিয়ায় অন্যান্য আবশ্যকীয় যোগ্যতাগুলো কোন্ কর্তৃপক্ষ কীভাবে কতটুকু মূল্যায়ন করেন তা আমার বিস্তারিত জানা নেই। তবে মাঠের বাস্তবতায় এই মূল্যায়নের ফলাফল সন্তোষজনক বলে মনে হয় না। নিজের যোগ্যতা দিয়ে শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করার, দীক্ষা দিয়ে শিষ্যে পরিণত করার, গুণের পরশে গুণান্বিত করার, পদ্ধতি দিয়ে পাঠদান করার, প্রেষণা দিয়ে উজ্জীবিত করার, সুশিক্ষা দিয়ে সুযোগ্য করার ও আদর দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার মতো শিক্ষকের সংখ্যা আনুপাতিক হারে খুবই কম! 


উত্তম শিক্ষক বাছাই করার জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি অন্যান্য যোগ্যতাগুলো যাচাই করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, উত্তম শিক্ষক হবার জন্য উত্তম মেধাবী হওয়ার পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতায়, আইসিটিতে, সহশিক্ষায় যোগ্য-দক্ষ হওয়াসহ আরো অনেক উত্তম গুণের অধিকারী হতে হয়। যার অধিকাংশই যাচাই করা যায় প্রার্থীর শিক্ষাজীবনের কর্মকান্ড মূল্যায়ন এবং লিখিত পরীক্ষা, সাক্ষাৎকার ও ডেমো ক্লাসের মাধ্যমে; যদি কর্তৃপক্ষের তেমন সদিচ্ছা ও দক্ষতা থাকে। যেনতেন পরীক্ষার মাধ্যমে অতিরিক্ত প্রার্থী বাদ দেওয়ার কৌশল না নিয়ে উন্নত/আধুনিক পদ্ধতিতে সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমে অধিক যোগ্যদের খুঁজে নেওয়াই নিয়োগ কর্তৃপক্ষের পবিত্র দায়িত্ব। অর্থাৎ নিয়োগ পরীক্ষাগুলো হতে হবে- কাউকে বাদ দেওয়ার জন্য নয়, উত্তমকে খুঁজে নেওয়ার জন্য। শিক্ষক নিয়োগের বাছাই প্রক্রিয়া যত দুর্বল হবে শিক্ষকগণ তত দুর্বল ও অবমূল্যায়িত হবে এবং শিক্ষার মান ততই নিম্নগামী হবে!


যিনি অভ্যাসগত ও স্বভাবগত ভাবেই হাসিমাখা মুখে, প্রমিত বাংলায়, স্পষ্ট উচ্চারণে, মধুর কন্ঠে, শুদ্ধ বাক্যে, সরল ভাষায়, উঁচু-নিচু স্বরে, গভীর আন্তরিকতায় সবার সাথে কথা বলেন তাঁকে শিক্ষার্থীরা অধিক পছন্দ করবে এটাই স্বাভাবিক। কোন শিক্ষকের ভাষা অসুন্দর হলে, উচ্চারণ অস্পষ্ট হলে, বাক্য গঠন ভুল হলে, এ্যা অ্যা ও করে কথা বললে, বলার গতি খুব কম/বেশি হলে ও কণ্ঠস্বর অতি নিচু বা বিরক্তিকর হলে শিক্ষার্থীরা সে শিক্ষকের ক্লাসে আগ্রহী থাকে না, মনোযোগী থাকে না। তাই সে শিক্ষকের পাঠদান সফল হয় না। যিনি অত্যন্ত ধৈর্য ধরে কোন বিষয়বস্তুকে গভীর ভাবে আত্মস্থ করে, আকর্ষণীয় ভাবে উপস্থাপন করে, সহজ ভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিতে পারেন তিনি শিক্ষার্থীদের অধিক প্রিয় হবেন, পাঠদানে সর্বাধিক সফল হবেন এটাই বাস্তব। শিক্ষা মনোবিজ্ঞানীরাও তাই বলে থাকেন। শিক্ষার্থীরা যাকে বেশি পছন্দ করে, ব্যক্তিত্ববান মনে করে, আইডল মনে করে, তার নিকট থেকেই বেশি শিখে। সে শিক্ষাই স্থায়ী হয়।


সরাসরি পাঠদানে মুখের ভাষার প্রভাব সর্বাধিক। তাই শিক্ষকের আঞ্চলিক ভাষা পরিহার ও প্রমিত বাংলা ভাষা ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোন কিছু সহজে শিশুদের বুঝিয়ে দেয়ার জন্য দু'একটি স্থানীয় শব্দের প্রয়োগ হতে পারে। তবে এনসিটিবি'র বই অনুসারে শিক্ষার্থীদের প্রমিত বাংলা ব্যবহারে অভ্যস্ত বা পাকা করে তোলা শিক্ষকের দায়িত্ব। সে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার জন্যই শিক্ষককে প্রমিত বাংলা শুদ্ধভাবে লেখার পাশাপাশি সঠিকভাবে অনর্গল বলায় পারদর্শী হতে হয়। একাধিক শিক্ষাসনদ অর্জন করেও যিনি কথা বলার সময় আঞ্চলিক ভাষা পরিহার করতে পারেন না তিনি শ্রেণি পাঠদানে প্রমিত বাংলায় কথা বলবেন কীভাবে? আবার যিনি সামান্য অসচেতন হলে ও দ্রুত কথা বলতে গেলে স্থানীয় ভাষা প্রয়োগ করেন তিনিও শ্রেণি পাঠদানে সর্বাবস্থায় প্রমিত বাংলায় কথা বলতে ব্যর্থ হবেন! সেই সাথে ব্যর্থ হবে শিক্ষার্থীরা। কেননা, শিক্ষক হচ্ছেন শিক্ষার্থীদের কাছে অনুকরণীয় অনুসরণীয় রোল মডেল। 


একজন মানুষ যতই মেধাবী হোক, জ্ঞানী হোক, শিক্ষক হিসেবে তাঁর সবচেয়ে বড় যোগ্যতা হচ্ছে সেই জ্ঞান শিক্ষার্থীদের নিকট সঠিকভাবে উপস্থাপন, বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণ করা। শিখন-শিখানো কার্যক্রম সফল করার জন্য আবশ্যকীয় ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য উপাদান হচ্ছে শিক্ষকের সুন্দর ভাষা, উত্তম ব্যবহার, উচ্চ প্রকাশ-ক্ষমতা। শিক্ষকের প্রকাশ-ক্ষমতার উপরই অধিকাংশ নির্ভর করে তাঁর বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান শিক্ষার্থীদের মধ্যে কতটা সঞ্চারিত হবে। সরাসরি পাঠদানের ক্ষেত্রে যার প্রকাশ-ক্ষমতা যত বেশি সে তত বেশি সফল শিক্ষক। বিশেষ করে মৌখিকভাবে কোন কিছু সহজে প্রকাশ করার সর্বাধিক ক্ষমতা থাকা চাই শিক্ষকের। সেইসাথে অবশ্যই থাকতে হয় সর্বাধিক মেধা ও বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান। থাকতে হয় আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) ব্যবহারের দক্ষতা। হতে হয় ব্যাপক তথ্যসমৃদ্ধ এবং চিন্তা-চেতনায় কর্মে-কথায় অত্যন্ত স্মার্ট। তাই শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করতে হবে সার্বিক বিবেচনায় সর্বাধিক যোগ্যদের। 


শিক্ষকতা অন্যান্য পেশার মতো নয়। এটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সৃজনশীল কর্ম। সকল পেশার মানুষ তৈরি করেন শিক্ষক। এজন্যই তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয়। শিক্ষকের যোগ্যতা ও দক্ষতার উপরই নির্ভর করে অন্যান্য পেশার মানুষ কতটা যোগ্য ও দক্ষ হবেন। একজন অযোগ্য শিক্ষক সারা জীবনে তৈরি করেন অগণিত অযোগ্য নাগরিক। অর্জন করতে ব্যর্থ হন শ্রদ্ধা। ভালো শিক্ষক হবার জন্য যেমন ভালো ছাত্র হতে হয় তেমনি অন্যান্য যোগ্যতাও থাকতে হয়। বিশেষ কিছু যোগ্যতার দ্বারাই শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঞ্চারিত করেন শিক্ষা ও সহশিক্ষার সকল বিষয়বস্তু। তাই শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীর শিক্ষাজীবনের কর্মকাণ্ড মূল্যায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেইসাথে শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং লিখিত পরীক্ষার পাশাপাশি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার ও ডেমো ক্লাসের উপর আরো বেশি গুরুত্ব দিয়ে সার্বিক যোগ্যতার মূল্যায়ন অত্যাবশ্যক। সেক্ষেত্রে ট্রান্সপারেন্সি নিশ্চিত করার জন্য অবশ্যই সংরক্ষণ করতে হবে লিখিত পরীক্ষার উত্তরপত্র এবং ধারণ-রক্ষণ করতে হবে সাক্ষাৎকার ও ডেমো ক্লাসের ভিডিও। বর্তমান বাংলাদেশে তা সহজেই সম্ভব। মনে রাখতে হবে, শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা যতই কম হোক শিক্ষক পদে আবেদনকারীর সংখ্যা কিন্তু এখনো কম নয়। উত্তম বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এদের মধ্য থেকে তুলনামূলক উত্তমদের শিক্ষকতায় নিয়ে আসা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। তদুপরি শিক্ষকতা পেশার মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে সর্বাধিক যোগ্যদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করা দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে অত্যাবশ্যক। কিন্তু বাছাই প্রক্রিয়া দুর্বল, অস্বচ্ছ ও ত্রুটিযুক্ত হলে কখনোই অধিক যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ সম্ভব নয়! <

লেখক:

শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও কলামিস্ট 

Email - rahamot21@gmail.com


(লেখাটি যুক্তিযুক্ত মনে করলে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য শেয়ার করতে পারেন।)


https://epaper.dainikbangla.com.bd/home/displaypage/news_2025-06-01_5_16_b

শিক্ষায় যোগাযোগ দক্ষতা

পত্রিকার লিংক

শিক্ষায় যোগাযোগ দক্ষতা 

মো. রহমত উল্লাহ্

ইত্তেফাক > ০৪ মে ২০২৫

>যোগাযোগ ব্যতীত অনেক কিছুই অচল। শুধু প্রাণীকুলের মধ্যেই নয়, প্রাণীকুল ও সৃষ্টিকর্তার মধ্যেও যোগাযোগের প্রয়োজন হয়। তাই যোগাযোগ দক্ষতা সবার জন্যই আবশ্যক। বিভিন্ন ক্ষেত্রের সফলতা অনেকাংশেই যোগাযোগ দক্ষতার উপর নির্ভরশীল। নেতা, কর্তা, কর্মী, শিল্পী, শিক্ষক, সাহিত্যিক সবার সফলতাই কমবেশি নির্ভর করে যোগাযোগ দক্ষতার উপর।


প্রত্যক্ষভাবে বা প্রযুক্তির মাধ্যমে তথ্য ও মনোভাবের সফল আদান-প্রদানের যোগ্যতাই যোগাযোগ দক্ষতা। সংক্ষেপে বলা যায়, বুঝতে পারা এবং বুঝাতে পারার যোগ্যতাই যোগাযোগ দক্ষতা। বলা, শোনা, লেখা, পড়া, আঁকা, ইঙ্গিত করা যোগাযোগের উল্লেখযোগ্য উপায়। যার জন্য ভাষাগত ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং এর প্রয়োগ দক্ষতা অত্যাবশ্যক। স্থান, কাল, পাত্র, ক্ষেত্র, পরিবেশ, পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে যথাযথ ভাষা, যুক্তি, প্রযুক্তি প্রয়োগ করে তথ্য ও মনোভাব আদান-প্রদান সফল যোগাযোগের পূর্বশর্ত। উত্তম সম্ভাষণ উত্তম যোগাযোগের অলংকার। 


শ্রেণিনেতা হিসেবে শিক্ষকের যোগাযোগ দক্ষতা উত্তম শিক্ষক হবার ক্ষেত্রে সর্বাধিক ভূমিকা রাখে। শিক্ষনীয় বিষয়ে তথ্যসমৃদ্ধ হয়ে শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করার দক্ষতা শিক্ষকের অন্যতম প্রধান গুণ। আবশ্যকীয় এ গুণ আত্মস্থ করা, প্রয়োগ করা শিক্ষকের নৈতিক ও পেশাগত অপরিহার্য দায়িত্ব। যোগাযোগ দক্ষতায় সুদক্ষ শিক্ষকের নিকট থেকেই শিক্ষার্থীরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আয়ত্ত করে বিভিন্ন শিক্ষনীয় শিক্ষনীয় বিষয়।  


শিক্ষার্থীর কাঙ্খিত যোগাযোগ যোগ্যতা অর্জনের প্রধান অবলম্বন হচ্ছেন শিক্ষক। শিক্ষকের নিকট থেকেই শিক্ষার্থী আয়ত্ত করে যৌক্তিক প্রশ্ন করার এবং উত্তর দেওয়ার অধিকাংশ কৌশল, শিষ্টাচার, নমনীয়তা ও সহিষ্ণুতা। যা তার উত্তম জীবনের অফুরন্ত সম্পদ। নিজের মনে উঁকি দেওয়া প্রশ্নগুলো সঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারা শিক্ষার্থীর আবশ্যকীয় যোগাযোগ দক্ষতা। যে শিক্ষার্থীর প্রশ্ন করার আগ্রহ ও দক্ষতা বেশি সে শিক্ষার্থীর শিক্ষা লাভের সম্ভাবনা বেশি। উত্তরদাতার বোধগম্য করে প্রশ্ন করা এবং প্রশ্নকর্তার বোধগম্য করে উত্তর দেওয়ার দক্ষতা ঘরে-বাইরে প্রতিটি ক্ষেত্রেই কাঙ্খিত। আবার সম্পর্ক বজায় রেখে ‘না’ বলতে পারাও যোগাযোগ দক্ষতার বিশেষ দিক। 


যোগাযোগ সফলতার মানদণ্ডেই নির্ধারিত হয় পারস্পরিক ও সামগ্রিক সম্পর্কের স্তর।

ছাত্র ও শিক্ষক উভয়ের উত্তম যোগাযোগ দক্ষতার উপর ভিত্তি করেই রচিত হয় উত্তম ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক। যা সফল শিক্ষার অপরিহার্য মানবীয় উপাদান।< 


মো. রহমত উল্লাহ্

শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক



https://epaper.ittefaq.com.bd/m/433618/6816237b5e35a

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি

 পত্রিকার লিংক

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি:

ক্লাশ অফিস সহশিক্ষা কার্যক্রম খোলা-বন্ধের বিষয় স্পষ্ট করা উচিত

মো. রহমত উল্লাহ্

জাগোনিউজ২৪ডটকম, ১০ এপ্রিল ২০২৫

>আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আরো গভীরভাবে ভাবা উচিত। সাধারণত দেখা যায় স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় বিভিন্ন উপলক্ষে বছরে ছুটি থাকে কমবেশি ৭৫ দিন। এর বাইরে খুলার দিনগুলোতে সপ্তাহে দু’দিন করে থাকে সাপ্তাহিক ছুটি। এভাবে বছরে ৩৬৫ দিনের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মোট ছুটি থাকে ১৫০ দিনেরও বেশি! এক্ষেত্রে মেনে চলা উচিত আন্তর্জাতিক মান ও সমতা। জানা উচিত কোন দেশে কী কারণে কতদিন ছুটি থাকে কোন ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান? বাস্তবতার ভিত্তিতে তুলনামূলক পর্যালোচনা করা উচিত আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি নিয়ে। যেমন, পূজায় মাদ্রাসা এবং রোজায় উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা উচিত কিনা? প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এক ধরনের ছুটির তালিকা, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আরেক ধরনের ছুটির তালিকা এবং উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আরেক ধরনের ছুটির তালিকা কতটা যৌক্তিক?


শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাপ্তাহিক ছুটি শুক্র ও শনিবারের পরিবর্তে বৃহস্পতি ও শুক্রবার নির্ধারণ করা অধিক যুক্তিযুক্ত হতে পারে। এতে করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে অভিভাবকদের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পাবে; যা শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। বিশেষ করে কর্মজীবী অভিভাবকগণ তাদের সন্তানদের শুক্রবারে নিজেদের মত সময় দিতে পারবেন এবং শনিবারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে সন্তানদের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে শিক্ষকগণের পরামর্শ নিতে পারবেন ও প্রয়োজনীয় মতামত দিতে পারবেন। অর্থাৎ অভিভাবক-শিক্ষক সমিতি (পিটিএ) এর কার্যক্রম আরো জোরদার করা যাবে। পরিচালনা কমিটিতে (জিবি, এসএমসি, এমএমসি) অধিক শিক্ষিত কর্মজীবীদের অন্তর্ভুক্ত করে শনিবারে সভা করে উপস্থিতি বৃদ্ধি করে অধিক সহযোগিতা নেওয়া যাবে। তাছাড়া শিক্ষক-কর্মচারীরা বৃহস্পতিবারে ছুটি না নিয়ে নিজেদের ব্যাংক একাউন্ট অপারেট করাসহ অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট কাজ সম্পাদন করতে পারবেন। তদুপরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসন চাইলে বৃহস্পতিবারে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের অফিসিয়াল কাজও জরুরি ভিত্তিতে সম্পাদন করতে পারবেন। অপরদিকে যানজট নিয়ন্ত্রণ ও পানি-বিদ্যুৎ বন্টনের ক্ষেত্রেও তা সামান্য সহায়ক হবে।


একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয় যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটির তালিকায় জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দিবস ছুটি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যেমন: ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২৬শে মার্চ, বাংলা নববর্ষ, ১৬ই ডিসেম্বর। কিন্তু সেসকল দিবস উদযাপনের জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে বলা হয়। দিবস উদযাপনের জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন বিধায় কর্মচারীদেরও প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে হয়। অর্থাৎ অন্যান্য দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর মত শিক্ষক-কর্মচারীরা ঐ সকল জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবসে বাস্তবে ছুটি ভোগ করতে পারেন না। এক্ষেত্রে অনেকের মনে অসন্তোষ বিরাজ করে। এসকল দিবস শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য ছুটির দিন নাকি খোলার দিন তা পরিষ্কার নয়! তাই প্রতিষ্ঠান প্রধানরাও শিক্ষকদের ম্যানেজ করতে গিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জটিল সমস্যার সম্মুখীন হন। প্রতিষ্ঠান প্রধানের সঙ্গে শিক্ষকদের মতপার্থক্য হয়, দূরত্ব বৃদ্ধি পায় ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছুটির দিনে এক বা একাধিক শিক্ষক-কর্মচারী অনুপস্থিত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে কী ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে তা পরিষ্কারভাবে বলা না থাকায় প্রতিষ্ঠান প্রধানগণ চরম বেকায়দায় পড়েন। 


শিক্ষার্থীদের বিশেষ দিবসে প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থাকা ও বিভিন্ন ইভেন্টে অংশগ্রহণ করাকে ধারাবাহিক মূল্যায়নের বা প্রতিযোগিতার অন্তর্ভুক্ত করে কিছুটা বাধ্যবাধকতা আরোপ করা গেলেও শিক্ষকদের ক্ষেত্রে উপস্থিত থাকার বাধ্যবাধকতা আরোপ করার তেমন কোন নির্ধারিত উপায় ঘোষণাকৃত নেই। কোন শিক্ষক-কর্মচারী জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ দিবসে স্বপ্রণোদিত হয়ে স্বেচ্ছায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে না চাইলে অর্থাৎ বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে অনুপস্থিত থাকতে চাইলে বা বিনা অনুমতিতে অনুপস্থিত থাকলে প্রতিষ্ঠান প্রধান কী করবেন বা কী ধরনের ব্যবস্থা নিবেন তা পরিষ্কার করে উল্লেখ থাকা উচিত। একজনকে বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ঐদিন অনুপস্থিত থাকার অনুমতি দেওয়া হলে ১০ জন ১০ রকমের সমস্যা উত্থাপন করে অনুপস্থিত থাকার আবদার করেন! সবার আবদার রাখতে গেলে দিবস উদযাপন করা সম্ভব হয় না। আবার অনুপস্থিতির সংখ্যা হ্রাস করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠান প্রধানের ক্ষমতা বলে ওই দিনের অনুপস্থিতির কারণে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-কর্মচারীর একদিনের নৈমিত্তিক ছুটি কমিয়ে দেওয়া হলে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন; যদিও ছুটিবিধি অনুসারে কর্মী বৎসরে পূর্ণ বিশ দিন নৈমিত্তিক ছুটি অধিকার হিসেবে প্রাপ্য নন এবং প্রতিষ্ঠান প্রধান তা দিতে বাধ্য নন। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, সরকারি আদেশ অনুসারে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবস উদযাপনের এবং তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপনের দায়িত্ব কেবল প্রতিষ্ঠান প্রধানের ও আগ্রহী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করে। ফলে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই দায়সারা ভাবে জাতীয় দিবস উদযাপিত হয়ে থাকে। এমতাবস্থায় বিশেষ জাতীয় দিবসগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি তালিকার বাইরে রাখা অথবা অন্য কোন কার্যকর নির্দেশনা থাকা আবশ্যক। 


অপরদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন কিছু ছুটি বিদ্যমান যে সকল ছুটির দিনে বা ভ্যাকেশনে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও সরকারি অফিস খোলা থাকে। অর্থাৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটি, সরকারি অফিস খোলা। তাই সংশ্লিষ্ট সরকারি অফিস থেকে বিভিন্ন আদেশ-নির্দেশ এসে থাকে; যা জরুরি ভিত্তিতে সমাধান করতে হয় বিধায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অফিস খোলা রাখতে হয়। প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা এবং বিভিন্ন অফিসিয়াল বা হিসাব সংক্রান্ত কাজেও ভ্যাকেশনের সময় অফিস খোলা রাখার প্রয়োজন পড়ে। শিক্ষার্থীদের ভর্তি, টিসি, রেজিস্ট্রেশন, ফরম ফিলাপ, সনদ প্রদান, প্রবেশপত্র প্রদান, বইয়ের চাহিদা প্রদান, শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-বিল তৈরি ইত্যাদি কাজে প্রতিষ্ঠানের অফিস নিয়মিত খোলা না রেখে কোন উপায় থাকে না। তখন প্রতিষ্ঠান প্রধান, সহপ্রধান ও কর্মচারীদের উপস্থিত থাকতে হয়। অর্থাৎ তারা ওই ভ্যাকেশন উপভোগ করতে পারেন না। আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের ভ্যাকেশন ডিপার্টমেন্টের কর্মী হিসেবে ট্রিট করার কারণে বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরা ছুটি অর্জন ও বিক্রির সুবিধা থেকে বঞ্চিত এবং তারা পিআরএল ভোগের সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান প্রধান, সহপ্রধান ও কর্মচারী প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে না চাইলে কী রকম ব্যবস্থা নেওয়া হবে তাও পরিষ্কার ভাবে ব্যাখ্যা থাকা উচিত। তবে যে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী অবকাশ বিভাগের সুবিধা ভোগ করতে পারেন না তাদেরকে অবকাশ বিভাগের কর্মী হিসেবে বিবেচনা করা কতটা যুক্তিযুক্ত তাও ভাবতে হবে।

 

তাছাড়া বিশেষ দিবসে ও অন্যান্য ভ্যাকেশনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান “ছুটি/বন্ধ থাকবে” এমন কমন কথা ছুটির তালিকায় বা সরকারি আদেশে মোটেও লেখা উচিত নয়। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন অফিসের গেট বা দরজা ছুটির দিনে বন্ধ থাকে। সে হিসেবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও ছুটির দিনে সম্পূর্ণ বন্ধ থাকারই কথা এবং সেদিন শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মচারীরা প্রতিষ্ঠানে আসতে না চাওয়ারই কথা। তাই নির্ধারিত ছুটির/বন্ধের দিনে কেউ আসতে না চাইলে তাকে বাধ্য করা খুবই কঠিন। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটির তালিকায় এটি পরিষ্কার করে লেখা উচিত যে, কোন দিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ ছুটি থাকবে, কোন দিন শুধু শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ থাকবে, কোন দিন অফিস খোলা থাকবে, কোন দিন বিশেষ দিবস উদযাপনের জন্য কিংবা সহশিক্ষা কার্যক্রমের জন্য সবাই প্রতিষ্ঠানে আসতে বাধ্য থাকবে। যখন অফিস বন্ধ রাখা হবে তখন কোন সরকারি কাজ করার আদেশ সাধারণত দেওয়া উচিত নয়। কেননা, বাড়তি সুবিধা দেওয়া না গেলে ছুটির দিনে কাজ করার আদেশ অমান্য হবার সম্ভাবনাই বেশি থাকে।<


সর্বোপরি শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অফিসের জন্য পৃথকভাবে যৌক্তিক বার্ষিক মোট কর্মদিবস তথা মোট কর্মঘন্টা নির্ধারণ করে ছুটির তালিকা প্রণয়ন করা এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবসসহ বিভিন্ন দিবসে ও অন্যান্য ভ্যাকেশনে প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থেকে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রধান, সহপ্রধান, শিক্ষক ও কর্মচারীদের জন্য পুরস্কার-তিরস্কার নির্দিষ্ট করা আবশ্যক। সেইসাথে অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় রাখা উচিত শিক্ষক-কর্মচারীদের আর্থিক স্বচ্ছলতা ও কাঙ্খিত জীবনমান।


লেখক: অধ্যক্ষ ও প্রাবন্ধিক

শক্তিশালী করতে হবে শুদ্ধতার সংগ্রাম, দৈনিক বাংলা, ২২ জুন ২০২৪


পত্রিকার লিংক

শক্তিশালী করতে হবে শুদ্ধতার সংগ্রাম

দৈনিক বাংলা, ২২ জুন ২০২৪ 

মো. রহমত উল্লাহ্

বাংলাদেশ বেতারের একজন সহকারী প্রকৌশলী আদনান ফেরদৌস চাকরি ছেড়ে সাব-রেজিস্ট্রার পদে যোগদান করেছেন বলে অনেক আলোচনা ও সমালোচনা হচ্ছে। ক্যাডার পদ ছেড়ে নন-ক্যাডার পদে যাওয়াটাকে অনেকেই ভালো চোখে দেখছেন না, দেখার কথাও নয়। কেউ কেউ বলছেন তথ্য বিভাগে পদোন্নতি অত্যন্ত সীমিত, তাই এখানে কর্মকর্তারা থাকতে চান না। এটি যৌক্তিক বলে মনে হয় না। কেননা, আমার জানা-দেখা অনেক সাব-রেজিস্ট্রার সারাজীবন একই পদে চাকরি করে অবসরে গিয়েছেন। অবশ্য তারা প্রায় সবাই অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন তা সবাই জানেন। হয়তো এ কারণেই আদনান ফেরদৌসের চাকরি পরিবর্তনের উদ্দেশ্য অসৎ বলে অগণিত মন্তব্য দেখা যায় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। প্রায় সবাই তার চিন্তা-চেতনাকে বিভিন্নভাবে অসৎ আখ্যায়িত করেছেন। এটি অযৌক্তিক নয়। সবাই জানেন সাব-রেজিস্ট্রারের অবৈধ আয় লাগামহীন। (গত ৯ জুন ২০২৪ তারিখে প্রকাশিত দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে, ‘কুমিল্লার আদর্শ সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিস: দুই বছরে ২৫ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন সাব-রেজিস্ট্রার।’) কেউ কেউ বলেছেন, যেহেতু আদনান ফেরদৌসের অসৎ উদ্দেশের বিষয়টি প্রায় প্রমাণিত, সেহেতু তাকে সাব-রেজিস্ট্রার পদে যোগদান করতে দেওয়া উচিত হয়নি। বাস্তবে আইনগতভাবে তা সম্ভব নয়। এসব সমালোচনা শুনে সম্পদের পাহাড়ে বসা অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত সাব-রেজিস্ট্রাররা হয়তো একটুও লজ্জা পাচ্ছেন না, বরং আমাদের বোকা ভেবে মুচকি হাসছেন!


আদনান ফেরদৌস যদি সাব-রেজিস্ট্রার পদ ছেড়ে বাংলাদেশ বেতারের সহকারী প্রকৌশলী পদে যেতেন তো নিশ্চয়ই এমন সমালোচনা হতো না। তাহলে এখন তাকে নিয়ে এত সমালোচনা কেন? তার সঙ্গে অন্যান্য যারা সাব-রেজিস্ট্রার পদে যোগদান করেছেন, তাদের নিয়ে কিন্তু কোনো সমালোচনা আমরা শুনছি না। যদিও তাই হওয়া উচিত ছিল। তাদের উদ্দেশ্যও কিন্তু আদনান ফেরদৌস থেকে ভিন্ন হওয়ার কথা নয়। তারাও তো অন্য চাকরি থেকে সাব-রেজিস্ট্রার পদকে লোভনীয় মনে করে অগ্রাধিকার দিয়ে অনেক চেষ্টা করে নিয়োগপত্র হাত করে যোগদান করেছেন। কেউ তাদের ঘৃণা করে বয়কট করবেন বা আত্মীয়তা করতে চাইবেন না, এমনটি হবে বলে মনে হয় না। বরং আগে যারা পাত্তা দিতেন না, এখন তারা প্রায় সবাই অধিক গুরুত্ব দেবেন। দেখতে যেমনই হোক উত্তম পাত্র-পাত্রী পাওয়ার ও সফল স্বামী-স্ত্রী হওয়ার প্রতিযোগিতায় তারা অন্য অনেক চাকরির তুলনায় বহুগুণ এগিয়ে গেছেন। খোঁজ নিলে জানা যাবে তারা এলাকায় ও আত্মীয়স্বজনের মধ্যে আদৃত হচ্ছেন, বাহবা পাচ্ছেন!


আমাদের দেশে কর্ম পছন্দ-সংক্রান্ত সমালোচনার বিষয় কিন্তু আরও অনেক আছে। যখন প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদ ইত্যাদি বিশেষ ডিগ্রিধারীরা এসে কাস্টম অফিসার, পুলিশ অফিসার, অ্যাডমিন ক্যাডার ইত্যাদি পদে নিয়োগ নিচ্ছেন ও যোগদান করছেন তখন কিন্তু এত সমালোচনা শোনা যাচ্ছে না। তাদের উদ্দেশ্য কি প্রশ্নবিদ্ধ নয়? যখন শিক্ষকতার মতো সম্মানজনক কাজ তথা শিক্ষা ক্যাডার বাদ দিয়ে অনেকেই অন্য ক্যাডারে বা চেয়ারে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করছেন ও যাচ্ছেন তখন কিন্তু এত সমালোচনা হচ্ছে না। অ্যাডমিন ক্যাডারে কেউ সুযোগ পেলে তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়, তাকে নিয়ে অনেক লেখালেখি করা হয়, তাকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার জন্য অনেক কিছুই করা হয়! তার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা হয় না! অথচ শিক্ষার্থীদের ক্যাডারের যোগ্য করে তোলার জন্য যারা নিয়োজিত থাকেন, বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি করেন, উত্তরপত্র মূল্যায়ন করেন, সেই শিক্ষা ক্যাডারে কেউ সুযোগ পেলে তাকে কিন্তু সংবর্ধনা দেওয়া হয় না! বিসিএস পরীক্ষার ফরম পূরণের সময় প্রায় সব প্রার্থীর সর্বশেষ পছন্দ থাকে শিক্ষা ক্যাডার! সর্বশেষ সুযোগ কাজে লাগিয়েও অন্য পেশায় চলে যেতে চান, চলে যান শিক্ষক। এসব কি দুঃখজনক নয়? সর্বাধিক যোগ্যরা শিক্ষক হবেন, অন্য পেশা ছেড়ে শিক্ষকতায় আসবেন, শিক্ষকরা সর্বাধিক সচ্ছল ও সম্মানিত হবেন, তবেই তো শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে জাতি। অথচ এ জন্য আমরা কিন্তু তেমন কিছুই করছি না! যখন উচ্চশিক্ষিতরা অনেক চেষ্টা-তদবির করে অবৈধ আয়ে ভরপুর বিভিন্ন বিভাগের ছোট ছোট পদ হাত করছেন ও যোগদান করছেন তখন কিন্তু আমরা তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে খুব বেশি সমালোচনা করছি না। বরং প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে গেলে, পরিশ্রম করে বৈধ উপার্জন করতে গেলে, সৎভাবে সাধারণ জীবনযাপন করতে গেলে, আমরা অনেকেই বলছি- সে লেখাপড়া করে কী করেছে? একটা সরকারি চাকরি ম্যানেজ করতে পারে নাই! আবার সরকারি চাকরি সৎভাবে করে, সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে, দেশকে বা মানুষকে সেবা দিয়ে সাধারণ জীবনযাপন করে, কেউ অবসরে এলে আমরাই কেউ কেউ বলছি- সে সারাজীবন সরকারি চাকরি করে কিছুই করতে পারল না! অথচ সব চাকরির ক্ষেত্র যদি সম্পূর্ণ দুর্নীতিমুক্ত হতো, সব চাকরির বৈধ সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে যদি ন্যায্যতা নিশ্চিত হতো, পদ-পদবি-পরিচিতি নির্বিশেষে সব অপরাধীর যথাযথ শাস্তি যদি নিশ্চিত হতো, সর্বক্ষেত্রে সবার ন্যায্য অধিকার ও প্রাপ্য মর্যাদা যদি নিশ্চিত থাকত, তাহলে নিশ্চয়ই আলোচিত পরিস্থিতির চিত্রটি অন্যরকম হতো।


দুর্নীতিবাজদের মোটা অঙ্কের অনুদান নিয়ে অনেক মসজিদ-মাদ্রাসায় কমিটির নেতা-কর্মী বানানো হচ্ছে! সেসব দুর্নীতিবাজদের তোয়াজ করে বেড়াচ্ছেন কতিপয় হুজুর ও তাদের অনুসারীরা! অধিক চতুর দুর্নীতিবাজরা সুদ খেয়ে, ঘুষ খেয়ে, চাঁদাবাজি করে, দখলদারি করে এসে স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসা বানিয়ে সেখানকার নেতা বনে যাচ্ছেন। এসব করে অবৈধ ও কালো টাকা ধর্মীয়ভাবে সাদা হয় ও অবৈধ উপার্জনের পাপ মাফ হয় বলে আমার জানা নেই! পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, টাকা হলে সবই হয়! যার টাকা নেই তার কিছুই নেই! এই অশুভ পরিস্থিতি কিন্তু অনেক মানুষের দুর্নীতির আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে!


বেশির ভাগ ভোটারের মানসিকতা এমন হয়েছে যে, টাকা না দিলে, খাবার না দিলে, সুযোগ-সুবিধা না দিলে, ভোট দিবে না; প্রার্থী যতই সৎ ও যোগ্য হোক! অবৈধ সুযোগ-সুবিধা না দিলে সঙ্গে বা পাশে থাকবে না কর্মী, দায়িত্ব পালন করবে না কর্মচারী। রোদ-বৃষ্টি-ঈদ-পূজা ইত্যাদি উসিলা পেলেই জিনিসের দাম বাড়িয়ে দিবে ব্যবসায়ীরা, ভাড়া বাড়িয়ে দিবে রিকশাওয়ালা ও গাড়িওয়ালা! সুযোগ পেলেই সামান্য পানি মিশিয়ে দিবে দুধে। অর্থাৎ যার যতটুকু সুযোগ বা ক্ষমতা আছে, সে ততটুকুই দুর্নীতি করতে উদগ্রীব! এতে মনে হচ্ছে মনস্তাত্ত্বিকভাবে আমরা অনেকেই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছি! মনস্তাত্ত্বিকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের চিন্তা-চেতনা সর্বত্রই দুর্নীতির পক্ষে যুক্তি খুঁজে! তাদের কেউ এক টাকার দুর্নীতিবাজ, কেউ লাখ টাকার দুর্নীতিবাজ, কেউ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতিবাজ। নীতিকথা আজ মূল্যহীন, নীতিবানরা আজ অবহেলিত, বিজ্ঞরা মূর্খের অধীন, সততা মানেই দরিদ্রতা। সবকিছুই যেন গ্রাস করেছে দুর্নীতির দুষ্টচক্র! দুর্নীতি করা, দুর্নীতিকে সমর্থন করা, দুর্নীতিবাজকে সম্মানিত করা, যখন সামাজিকভাবে স্বাভাবিক হয়ে যায় তখন সমাজের মানুষের মানসিকতা কতটা অস্বাভাবিক হয়ে গেছে, তা কিঞ্চিৎ অনুমান করা যায়! এমন অস্বাভাবিক মানসিকতার ধারকই আদনান ফেরদৌস ও অন্যরা। এমন অস্বাভাবিক দুর্নীতিপরায়ণ মানসিকতা একদিনে কিংবা এক যুগে তৈরি হয় না, আমাদেরও হয়নি। এটি কত যে ভয়াবহ, তা আমরা অনেকেই অনুমান করতে পারছি না এখনো। মনে পচন ধরে গেলে মানুষের আর অবশিষ্ট থাকে না কিছুই!



আমাদের সবারই যে দুর্নীতিপরায়ণ মানসিকতা তৈরি হয়ে গেছে তা কিন্তু নয়। নিজের অস্তিত্ব জানান দেয় না, দিতে পারে না, এমন অগণিত ভালো মানুষ এখনো আমাদের সমাজের আনাচে-কানাচে বিদ্যমান। তবে সামাজিকভাবে স্বেচ্ছায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার মতো সক্রিয় মানুষের সংখ্যা লক্ষণীয়ভাবে কমে গেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা, তেমনটি করতে গেলে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব। কেউ ন্যায়ের পক্ষে ও অন্যায়ের বিপক্ষে সামান্য এগিয়ে এলেই আঘাত করা হয়, ফেলে দেওয়া হয়! এর বিচার চাইতে গেলেও বিপদ হয়! আমরা স্বীকার করি বা না করি বাস্তবতা হচ্ছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভালোরা ঐক্যহীন, শক্তিহীন ও দুর্বল আর মন্দরা ঐক্যবদ্ধ, শক্তিধর ও সবল! এমতাবস্থায় আমাদের নতুন প্রজন্মের ভালোরা, যোগ্যরা ও দক্ষরা বাধ্য হয়েই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে দেশ থেকে, পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে। এতে মাঠ খালি পেয়ে খুশি হয়ে তবল বাজাচ্ছে অযোগ্য আর দুষ্টুরা! আমাদের অনেকেই বিশ্বসেরা হচ্ছে বিদেশে গিয়ে অনুকূল পরিবেশ পেয়ে। অথচ তারা দেশে থাকলে দেশটাই বিশ্বসেরা হতে পারত তাদের দ্বারা। যারা বিদেশ যেতে পারছে না বা চাচ্ছে না; অথচ সৎভাবে পরিশ্রম করে সচ্ছল জীবনযাপন করতে চাচ্ছে, তারা চাকরি নিচ্ছে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে। একটু লক্ষ করলেই দেখা যায়, ব্যাংক ও আইটি সেক্টরসহ বিভিন্ন প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে আমাদের অনেক যোগ্য সন্তান। দুর্নীতিকে ঘৃণা করার মতো, দুর্নীতিমুক্ত থাকার মতো, সৎ জীবনযাপন করার মতো, পরিশ্রম করে অধিক অর্থ উপার্জন করার মতো, দেশ-জাতিকে ভালোবাসার মতো অনেক মানুষ এখনো অবশিষ্ট আছে এবং আরও অনেক মানুষ তৈরি হচ্ছে। এটি অবশ্যই আমাদের শুদ্ধ সমাজ ফিরে পাওয়ার সম্ভাব্য আশার বিষয়। তাই যেকোনো মূল্যে ওদের জন্য নিশ্চিত করতে হবে অনুকূল পরিবেশ। শক্তিশালী ও বাস্তবমুখী করতে হবে শুদ্ধতার সংগ্রাম। পরাস্ত করতে হবে দুর্নীতির দুষ্টচক্র। যার জন্য প্রয়োজন আইনের শাসন ও নৈতিক শিক্ষা। নৈতিক শিক্ষার পাশাপাশি অপরাধের শাস্তি নিশ্চিতকরণ ব্যতীত কোনো দেশের মানুষই দুর্নীতিমুক্ত হয়নি, হবে না। মহান সৃষ্টিকর্তাও তাই মানুষের জন্য উপদেশ দেওয়ার পাশাপাশি শাস্তির বিধান দিয়েছেন। যেখানে শাসন থাকে না, শাস্তির ভয় থাকে না, বিবেকের দংশন থাকে না সেখানেই মানুষ অবাধ্য হয় বেশি। এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক বিষয়। ক্যান্টনমেন্টের ভিতর ঢুকলেই সব ট্রাফিক আইন মেনে চলে সব ড্রাইভার। যে দেশে নৈতিক শিক্ষা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা যত বেশি সে দেশে দুর্নীতি তত কম। সে সব দেশের কৌশল আমাদের জন্য হতে পারে অনুসরণীয়। একটি দেশ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হতে যেমন দীর্ঘ সময় লাগে তেমনি দুর্নীতি থেকে উত্তরণের জন্য আরও বেশি সময় প্রয়োজন হয় এবং সেটি ধরে রাখার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। দেশ ও জাতির অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই শুদ্ধতার সে সংগ্রাম আরও শুদ্ধ করা, সুসংগঠিত করা ও শক্তিশালী করা অত্যাবশ্যক।


লেখক: সাহিত্যিক, শিক্ষক ও কলামিস্ট



https://www.dainikbangla.com.bd/opinion/45638/1718984851



বেসরকারি শিক্ষক হওয়ার পূর্বে কতিপয় বিবেচ্য বিষয়, দৈনিক বাংলা

বেসরকারি শিক্ষক হওয়ার পূর্বে কতিপয় বিবেচ্য বিষয়, দৈনিক বাংলা

 

পত্রিকার লিংক

বেসরকারি শিক্ষক হওয়ার পূর্বে কতিপয় বিবেচ্য বিষয়

মো. রহমত উল্লাহ
প্রকাশিত : ২৭ মে, ২০২৪ ১৪:১৫

আমাদের দেশে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে যারা এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হতে আগ্রহী তাদের উচিত বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য জেনে বুঝে বাস্তবতার আলোকে এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা। কেননা অতি আবেগ-তাড়িত হয়ে বা অন্য চাকরি না পেয়ে অথবা ভিন্ন কোনো কারণে সবকিছু না জেনে, না বুঝে বেসরকারি শিক্ষক হয়ে নিজের কর্মের ওপর সন্তুষ্ট থাকতে না পারলে ব্যক্তিগত সফলতা অর্জন এবং দেশ ও জাতির কল্যাণসাধন মোটেই সম্ভব নয়। সফল শিক্ষক ব্যতীত যোগ্য ও দক্ষ নাগরিককর্মী তৈরি হয় না। একজন স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ও আত্মনিবেদিত সুযোগ্য সফল শিক্ষক সারাজীবনে তৈরি করেন অগণিত সফল মানুষ। বিপরীতক্রমে একজন অনাগ্রহী ও অসন্তুষ্ট শিক্ষক নিজের জান্তে বা অজান্তে সারাজীবনে তৈরি করেন অগণিত অযোগ্য নাগরিক। উত্তম শিক্ষকতার জন্য সন্তুষ্টচিত্তে আত্মমনোযোগী হওয়া অত্যাবশ্যক। তাই বলছি, ভালোভাবে সবকিছু জেনে বুঝে ভেবেচিন্তেই হওয়া উচিত শিক্ষক, বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষক। এ জন্য প্রার্থীদের সুবিধার্থে সংক্ষিপ্তভাবে নিচে উপস্থাপন করছি কিছু বিবেচ্য বিষয়।

মনে রাখতে হবে, ভিন্ন ভিন্ন ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডি দ্বারা পরিচালিত প্রতিটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পৃথক, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি পদ সম্পূর্ণ পৃথক, চাকরির আবেদনের চয়েজ লিস্টের প্রতিটি চয়েজ পৃথক। পদ শূন্য থাকলে নিজের যোগ্যতা ও ইচ্ছা অনুসারে বাড়ির পাশে, দূরে বা বহুদূরে, শহরে কিংবা গ্রামে অবস্থিত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায়, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবেদন করা যাবে। এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে সরাসরি বদলি হওয়ার কোনো সুযোগ বিদ্যমান নেই। কেন নেই সে ব্যাখ্যা অনেক বিস্তৃত ও অনেক বিতর্কিত। প্রতিষ্ঠান বদলের ন্যূনতম সুযোগটুকুও এখন আর নেই! সেটি পুনরায় আদৌ তৈরি হবে কি না, হলেও কতদিনে হবে তা অনিশ্চিত। বদলির কিংবা প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ যখনই হোক, যে নীতিমালা তৈরি করা হবে সে নীতিমালায় কে কতটুকু সুযোগ পাবে তাও অজানা।

কেউ কোনো দিন সুযোগ পেলেও তাকে অন্য একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই যেতে হবে এবং সেটির ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডির অধীনস্থ হয়েই চাকরি করতে হবে।

মোট শূন্যপদের বিপরীতে মোট প্রার্থীর সংখ্যা যাই থাকুক না কেন ভালো, সচ্ছল ও সুবিধাজনক প্রতিষ্ঠানে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংখ্যা বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। নিবন্ধন পরীক্ষায় বেশি নম্বর প্রাপ্ত হয়ে থাকলেও ভালো প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পেতে চাইলে একাধিক প্রতিষ্ঠানে আবেদন করার প্রয়োজন হবে। যাদের নিবন্ধন পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর তুলনামূলক কম তাদের আরও বেশিসংখ্যক প্রতিষ্ঠানে আবেদন করার প্রয়োজন হবে। সেক্ষেত্রে নিজের বাড়ির আশপাশে অবস্থিত একাধিক প্রতিষ্ঠানে এবং অনেক দূরদূরান্তে অবস্থিত একাধিক প্রতিষ্ঠানে আবেদন করার তাগিদ অনুভব করতে পারেন।

যে প্রতিষ্ঠানেই আবেদন করুন না কেন; ধরে নিতে হবে ওই প্রতিষ্ঠানেই আপনার চাকরি হবে এবং আপনি অবশ্যই সেখানে চাকরি করতে যাবেন। তাই একজন প্রার্থীর নিম্নলিখিত বিষয়গুলো ভালোভাবে বিবেচনায় রেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চয়েজ করে সিলেকশন করা বা আবেদন করা উচিত।

১। নিবন্ধন পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর বেশি বা মেরিট পজিশন আগে না থাকলে বেশি ভালো বা সুবিধাজনক প্রতিষ্ঠানে সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকবে। সেক্ষেত্রে অধিক সংখ্যক আবেদন করার প্রয়োজন হতে পারে।

২। নিজের এলাকায় ও কম দূরে অবস্থিত যাতায়াত সুবিধা-সংবলিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে পছন্দের ক্ষেত্রে যথাসম্ভব অগ্রাধিকার দেওয়া। বিশেষ করে যাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সমস্যা আছে এবং যারা মহিলা প্রার্থী তাদের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিজের বাড়িতে থেকে কম বেতন পেলেও টিকে থাকা যায় এবং অন্যান্য সুবিধা পাওয়া যায়।

৩। প্রতিষ্ঠানের সুনাম, অবস্থা, অবস্থান, কর্মপরিবেশ, শিক্ষার্থীর সংখ্যা, আর্থিক সচ্ছলতা ও শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি সন্তোষজনক কি না তা জেনে নেওয়া। শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম থাকলে প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ-সুবিধার পরিমাণও সাধারণত কম থাকে। এমনকি বৈধভাবে প্রাইভেট পড়ানোর সুযোগও কম থাকে।

৪। আবেদনের জন্য প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত পদটি এমপিওভুক্ত শূন্যপদ কি না, এ পদের বিপরীতে কাম্য শিক্ষার্থী আছে কি না, কোনো মামলা-মোকদ্দমা আছে কি না, এমপিওভুক্ত হবে কি না, হলে কতদিন লাগতে পারে তা নিশ্চিত হওয়া।

৫। কোনো কারণে নন-এমপিও পদে আবেদন করতে চাইলে তা জেনে বুঝেই করা। প্রতিষ্ঠানের সচ্ছলতা নিশ্চিত হওয়া এবং প্রতিষ্ঠান থেকে সব সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় কি না, তা নিশ্চিত হওয়া। কারণ সরকারি আদেশ থাকার পরও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান থেকেই নন-এমপিও শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সমপরিমাণ আর্থিক সুবিধা প্রদান করা হয় না!

৬। দূরবর্তী কোনো প্রতিষ্ঠানে আবেদন করতে হলে সেই প্রতিষ্ঠান ও এলাকা সম্পর্কে ভালোভাবে জেনেশুনে দেখে নেওয়া। তদুপরি সেখানে যাতায়াত সুবিধা কেমন, থাকা-খাওয়ার সুবিধা আছে কি না, নিরাপত্তাব্যবস্থা কেমন, ছুটিতে বা প্রয়োজনে নিজের আপনজনের কাছে যাওয়া-আসা করা যাবে কি না, যেসব অসুবিধা আছে সেগুলো সহজে মেনে নেওয়া যাবে কি না, তাও বিবেচনা করা। প্রার্থী মহিলা হলে এসব বিষয় অধিক গুরুত্ব দিয়ে দেখা।

৭। গ্রামে কিংবা শহরে যেখানে বসবাস করতে আপনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন সেখানকার প্রতিষ্ঠানকে অগ্রাধিকার দেওয়া। শহরে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানে আবেদন করার ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, শহরেও সচ্ছল এবং অসচ্ছল উভয় ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। শহরের কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে বেতন-ভাতা কিছুটা বেশি থাকলেও জীবনযাপনের ব্যয় অনেক বেশি।

৮। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি ও ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কোনো ধরনের প্রতিষ্ঠানে বা সহকর্মীদের সঙ্গে কর্ম করে আপনি অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন তা ভেবে নেওয়া।

৯। যে পদে আবেদন করবেন সেই পদের মর্যাদা কতটুকু, সরকারি বেতন স্কেল কী, বর্তমান মূল বেতন কত, অন্যান্য ভাতাদি পরিমাণ কত, মাসিক কর্তনের পরিমাণ কত, বিভিন্ন বোনাসের পরিমাণ কত, বার্ষিক ইনক্রিমেন্টের পরিমাণ কত, পদোন্নতির সুযোগ আছে কি না, অবসরের সময় কী পরিমাণ আর্থিক সুবিধা পাওয়া যেতে পারে এবং অন্যান্য পেশার তুলনায় সুযোগ-সুবিধা কতটুকু কম-বেশি ইত্যাদি জেনে নেওয়া।

১০। একাধিক স্তরবিশিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত পদে যোগদান করলে কোন কোন স্তরে ক্লাস নিতে হবে, তা জেনে নেওয়া এবং সেই স্তরে ক্লাস নেওয়ার জন্য নিজের ইচ্ছা ও যোগ্যতা আছে কি না বা থাকবে কি না তা ভেবে নেওয়া।

১১। আধুনিক শিক্ষকতায় কাজের ধরন-পরিধি কেমন, লেখাপড়ায় লেগে থাকতে ভালো লাগে কি না, শিক্ষকের দায়িত্ব-কর্তব্য কতটুকু ও কর্মকালে ছুটি ভোগের বিধান কেমন, অন্যান্য পেশার তুলনায় সুযোগ-সুবিধা কতটুকু কম-বেশি, নিজের যোগ্যতা ও মন-মানসিকতার সঙ্গে এই পেশা খাপ খায় কি না ইত্যাদি বুঝে নেওয়া।

১২। প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের ক্ষেত্রে (পুনরায় সুযোগ দেওয়া হলে) কাঙ্ক্ষিত প্রতিষ্ঠানের অবস্থা ও অবস্থান বর্তমান প্রতিষ্ঠানের অবস্থা ও অবস্থানের তুলনায় অধিক ভালো কি না এবং সেখানে গেলে পরিবর্তনের উদ্দেশ্য পূর্ণ হবে কি না, তা জেনে বুঝে নেওয়া।

উল্লিখিত বিষয়গুলোর সঙ্গে নিজের বিশেষ বিষয়গুলো সার্বিক বিবেচনায় যথাযথ ও মনোপুত হলেই পছন্দ তালিকা তৈরি করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক পদে আবেদন করা উচিত; যেন নিয়োগ পেলে যোগদান করার ব্যাপারে কোনোরূপ অনিহা না থাকে। কেননা নিয়োগ পেয়ে কেউ যোগদান না করলে একদিকে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা শিক্ষক প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয় এবং অন্যদিকে একজন প্রার্থী নিয়োগ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন! যেখানে চাকরি হলে আপনি যাবেন না সেখানে অহেতুক আবেদন করে অন্য প্রার্থীকে বঞ্চিত করা ও পদটি শূন্য রেখে শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত করা মোটেও উচিত নয়। তাই সংশ্লিষ্ট নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান, থানা/উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস, এলাকার মানুষ ও অন্যান্য সোর্স থেকে কাঙ্ক্ষিত তথ্য সংগ্রহ করে সবদিক বিবেচনা করে এমন পদে বা প্রতিষ্ঠানে আবেদন করা উচিত যেখানে নিয়োগ পেলে যোগদান ও কর্ম সম্পাদনে নিজের আগ্রহ থাকবে।

হাজার বছর ধরেই এদেশের শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা অত্যন্ত কম ছিল। তখনকার শিক্ষকদের প্রায় সবাই স্বেচ্ছায় স্বপ্রণোদিত হয়ে, আত্মনিবেদিত হয়ে শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন। তাদের কাছে শিক্ষকতা প্রায় শতভাগ ব্রত ছিল। তখনকার জীবনযাপনের প্রেক্ষাপটে শিক্ষকতার মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্য মুখ্য ছিল না। তবে বর্তমান বাস্তবতায় শিক্ষকদের ন্যূনতম জীবন ধারণের প্রয়োজনেই শিক্ষকতার মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের বিষয়টি অনেকাংশে মুখ্য হয়ে উঠেছে। তথাপি আমাদের দেশের শিক্ষকদের বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা অন্যান্য দেশের তুলনায় খুবই নগণ্য! বর্তমানে এমপিও-এর মাধ্যমে সরকার মাধ্যমিক স্তরের একজন প্রশিক্ষণবিহীন সহকারী শিক্ষককে মূল বেতন দিয়ে থাকে মাত্র ১২ হাজার ৫০০ টাকা! উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ের একজন প্রভাষককে প্রাথমিক মূল বেতন দেওয়া হয় ২২ হাজার টাকা। এ ছাড়া সব স্তরের শিক্ষকদের বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট অনধিক ৫ শতাংশ, বাড়ি ভাড়া ভাতা ১ হাজার টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা, উৎসব ভাতা ২৫ শতাংশ, বাংলা নববর্ষ ভাতা ২০ শতাংশ দেওয়া হয়ে থাকে। অন্যদিকে এই মূল বেতন থেকে অবসর + কল্যাণ তহবিলের জন্য ১০ শতাংশ টাকা জমা রাখা হয়। নিয়মিত ২৫ বা ততোধিক বৎসর চাকরি করে অবসরে গেলে কল্যাণ + অবসর তহবিল থেকে সর্বশেষ মূল বেতনের প্রায় ১০০ গুণ টাকা পাওয়ার বিধান বিদ্যমান। উল্লিখিত সরকারি সুবিধার অতিরিক্ত কোনো সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব সচ্ছলতা ও বিধি-বিধানের ওপর নির্ভরশীল। প্রতিষ্ঠান সচ্ছল হলে আরও কিছু সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। কিন্তু প্রতিষ্ঠান অসচ্ছল হলে সরকারি টাকার বাইরে উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই পাওয়া যায় না! এই ডিজিটাল যুগে নিজেকে তৈরি করতে জানলে এর চেয়ে অধিক উপার্জনের বহুমুখী সুযোগ দেশে-বিদেশে অবারিত। বেসরকারি শিক্ষকদের বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা কতদিনে কতটুকু বৃদ্ধি পাবে তা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। কতকালে কতটি প্রতিষ্ঠান সরকারি হবে তা আরও বেশি অনিশ্চিত। আমার দীর্ঘ অতীত অভিজ্ঞতা তাই বলে বারবার।

কেউ যদি ধারণা করেন, অন্যান্য চাকরির তুলনায় শিক্ষকতায় সময়, শ্রম ও মেধা কম দিতে হয় তো সেটি ভুল। শিক্ষকতায় কাজের পরিধি এখন অনেক বিস্তৃত। নিত্যনতুন বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সঠিক জ্ঞান দেওয়ার জন্য শিক্ষককে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হয় প্রতিনিয়ত। আয়ত্ত করতে হয় অত্যাধুনিক পাঠদান ও মূল্যায়ন কৌশল। আত্মনিবেদিত থাকতে হয় সর্বক্ষণ। বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদ্‌যাপনের জন্য ছুটির দিনেও আসতে হয় প্রতিষ্ঠানে। শিক্ষার্থীর কল্যাণার্থে চিন্তা-চেতনার দিক থেকে প্রকৃত শিক্ষকের কোনো ছুটি নেই। এসবই করা চাই অত্যন্ত আগ্রহ ও আনন্দের সঙ্গে। শিক্ষকতা শিক্ষকের জন্য আনন্দদায়ক না হলে শিক্ষালাভ শিক্ষার্থীদের জন্য আনন্দদায়ক হয় না, সফল হয় না। শিক্ষক হওয়ার আগে অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে এসব।

মোট কথা হচ্ছে, না জেনে না বুঝে শিক্ষকতায় এসে কেউ যদি হতাশায় ভোগেন তো তিনি নিজে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হন তেমনি শিক্ষার্থীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই সবকিছু জেনে বুঝে, মেনে নিয়ে, মনে নিয়ে, তবেই আসা উচিত শিক্ষকতায় বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকতায়। আমি বলতে চাচ্ছি, সবার শিক্ষক হওয়া উচিত নয়। যারা সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত, ভোগের চেয়ে ত্যাগে আনন্দিত, শিক্ষা অর্জনে ঐকান্তিক, শিক্ষাদানে উজ্জীবিত, মননশীল ও সৃষ্টিশীল, মহৎ চিন্তায় ও কাজে নিবেদিত, শিক্ষার্থীদের কল্যাণে নিরলস, শিক্ষার্থীদের মধ্যে অমর হতে ইচ্ছুক তাদেরই হওয়া উচিত শিক্ষক। তা না হলে এ মহৎ কাজে এসে সারাক্ষণ মন খারাপ করে, দাবি-দাওয়া করে, আন্দোলন করে, দলাদলি করে, অন্যকে দোষারোপ করে, অন্যের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করে, বিক্ষুব্ধ বা হতাশাগ্রস্ত হয়ে নিজের পেশাকে মন্দ বলে বলে মন্দ সময় পার করে; না হওয়া যায় শিক্ষক, না পাওয়া যায় আনন্দ, না পাওয়া যায় শান্তি!

লেখক: অধ্যক্ষ, শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক

যে করেই হোক বন্ধ করতে হবে সনদ জালিয়াতি

যে করেই হোক বন্ধ করতে হবে সনদ জালিয়াতি

পত্রিকার লিংক 


যে করেই হোক বন্ধ করতে হবে সনদ জালিয়াতি 

মো. রহমত উল্লাহ্

দৈনিক বাংলা, o৩ মে ২০২৪

>সম্প্রতি কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের কম্পিউটার সেলের সিস্টেম এনালিস্ট এ কে এম শামসুজ্জামান সনদ জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছে। সনদ জালিয়াতির ব্যাপারে তার স্বীকারোক্তি ও জবানবন্দীর পরিপ্রেক্ষিতে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সদ্যসাবেক চেয়ারম্যান আলী আকবর খান এর স্ত্রী সেহেলা পারভীনকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রয়োজনে আলী আকবর খানকেও গ্রেফতার করা হতে পারে। সেহেলা পারভীন সিস্টেম অ্যানালিস্ট এর সঙ্গে অবৈধ অর্থ লেনদেনের কথা স্বীকার করেছে। জানা গেছে আসামি একে এম শামসুজ্জামান বিপুলসংখ্যক জাল সার্টিফিকেট তৈরি করে দেশব্যাপী বিভিন্ন সার্টিফিকেট প্রত্যাশীদের কাছে বিক্রি করে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইটে আপলোড করেছে। অর্থাৎ সার্টিফিকেট জালিয়াতির কাজটি এমনভাবেই করা হয়েছে যে বোর্ডের ওয়েবসাইটে যাচাই করেও জাল সনদ চিহ্নিত করার কোন উপায় নেই! এমতাবস্থায় কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সকল সনদ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক নয় কি? যারা কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে প্রকৃতপক্ষে শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে বৈধ সনদের অধিকারী হয়েছেন তারাও এখন লজ্জিত, অপমানিত ও বিক্ষুব্ধ। বৈধ সনদের অধিকারীরাই অপরাধীদের বিরুদ্ধে সর্বাধিক সোচ্চার হওয়া উচিত এবং এটি তাদের নৈতিক দায়িত্ব। 


যোগ্যতার সনদ জালিয়াতি বাস্তবে একটিমাত্র অপরাধ নয়; অনেক অনেক অপরাধের সূত্রপাত। জাল সনদ প্রদানকারী ও গ্রহণকারী উভয়ই অপরাধী। জাল সনদ গ্রহণকারী জাল সনদ ব্যবহার করে সারা জীবনে যাই করুক সবই অপরাধ। সে নিজেকে এ সনদ অর্জনকারী বলা অপরাধ, এই সনদ কোথাও দাখিল করা অপরাধ, এ সনদ দ্বারা চাকরির আবেদন করা অপরাধ, এ সনদ দ্বারা একজন যোগ্য লোককে বঞ্চিত করা অপরাধ, এ সনদ দ্বারা চাকরি করা অপরাধ, এ সনদে প্রাপ্ত কর্মের/ চাকরির আয় অবৈধ, এ আয় দ্বারা জীবনযাপন অপরাধ, এ আয় খেয়ে ইবাদত নিষ্ফল, এ সনদের যোগ্যতা ও কর্ম দেখিয়ে বৈবাহিক সম্পর্ক করা অপরাধ! এমন আরো অনেক অনেক অপরাধের অংশীদার কিন্তু সেই অবৈধ সনদ প্রদানকারীও। একজন অবৈধ সনদ প্রদানকারী কিন্তু বহু জনকে বহু অবৈধ কাজের সুযোগ সৃষ্টিকারী! সে হাজারো অপরাধের সূত্রপাত ঘটায়! সে অনেক মানুষের সারা জীবনের জন্য নৈতিক স্খলন ঘটায়! কেননা তার দেওয়া অবৈধ সনদ দ্বারা কেউ কোন কাজে নিয়োজিত হলে আজীবন ওই অপকর্মেই থেকে যায়। ভুয়া সনদ প্রদানকারী বহু অপরাধের হুতা, সর্বাধিক শাস্তিযোগ্য অপরাধী! 


বিভিন্ন সময় দফায় দফায় হাজার হাজার জাল সনদধারী শিক্ষকের খোঁজ পাওয়া গেছে! এটি আমাদের শিক্ষক সমাজের জন্য, দেশের জন্য, জাতির জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক, লজ্জাজনক ও কলঙ্কজনক! সম্পূর্ণ অযোগ্য, জাল সনদধারী, চরম অনৈতিক হাজারো দুষ্ট লোক যে দেশে শিক্ষক হতে পারে, শিক্ষকতায় নিয়োজিত থাকতে পারে, সে দেশের শিক্ষার মান কেমন হবে তা তো যে কেউ অনুমান করতে পারবেন। এমন দুষ্ট লোকদের কাছে শিক্ষার্থীরা কেমন শিক্ষা লাভ করবে তা তো অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ! ভুয়া/ জাল/ অবৈধ সনদধারী কেউ যাতে শিক্ষাক্ষেত্রে থাকতে না পারে এবং শিক্ষকতায় আসতে না পারে সেজন্য সর্তকতা অবলম্বন করা ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। তদুপরি কোন অজুহাতে যাতে অযোগ্যরা আবারো শিক্ষক হতে না পারে সে ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখা আবশ্যক এবং শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে অধিক যোগ্য ও আদর্শ মানুষদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করা দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে অত্যন্ত প্রয়োজন। তড়িঘড়ি করে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করার চেয়ে বিলম্ব করে অধিক যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করা দীর্ঘমেয়াদে অধিক কল্যাণকর। তাই কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন এক বছর মেয়াদী এ্যাডভান্স সার্টিফিকেট ইন ফাইন আর্টস (চারু-কারুকলা) এবং কম্পিউটার টেকনোলজি (ICT) কোর্সের সনদ তড়িঘড়ি নিয়ে যারা সহজেই বেসরকারি শিক্ষক হবার ব্যাপক সুযোগ পাচ্ছেন তাদের এ সনদ ও যোগ্যতা নিয়ে পরে যেন কোন প্রশ্ন দেখা দিতে না পারে সে ব্যাপারে এখনই সতর্ক ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সম্প্রতি এ দুটি বিষয়ে অতি সংক্ষিপ্ত সময়ে বিপুলসংখ্যক সনদ অর্জনকারীদের সনদের সত্যতা, কোর্স সম্পন্ন করানো প্রতিষ্ঠান গুলোর বৈধতা ও উপযুক্ততা এবং অনুমোদন প্রদানের যথার্থতা, প্রশিক্ষণ প্রদানকারী প্রশিক্ষকদের প্রকৃত যোগ্যতা ও পর্যাপ্ততা, প্রশিক্ষণার্থী ভর্তির তারিখ থেকে কোর্স সমাপ্তির বাস্তব ডিউরেশন (অর্থাৎ ১২ মাসের কোর্সের ৮-৯ মাস কিংবা তারও বেশি সময় চলে যাওয়ার পর শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে কিনা!), প্রকৃতপক্ষে যথাযথ প্রশিক্ষণ গ্রহণের সত্যতা, প্রশিক্ষণে সফলতা অর্জনের সত্যতা ইত্যাদি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে বিশেষ কমিটি গঠন করে পিছন থেকে যাচাই-বাছাই করা আবশ্যক।


শুধুমাত্র শিক্ষকতায়ই নয় অন্যান্য চাকরিতেও অবৈধ সনদধারী থাকার সম্ভাবনা আছে। বিশেষ করে যে সকল কর্মে/ চাকরিতে অষ্টম শ্রেণি পাশের সনদ দিয়ে নিয়োজিত হওয়া যায় সে সকল ক্ষেত্রে সর্বাধিক ভুয়া সনদধারী পাওয়ার সম্ভাবনা বিদ্যমান। শুধুমাত্র নাম দস্তখত করতে জানেন, আর কিছুই লিখতে পড়তে পারেন না, এমন অনেকেই অষ্টম শ্রেণি পাস সনদ দিয়ে বিভিন্ন সেক্টরে নিয়োজিত ছিলেন, আছেন। জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা বাতিল হওয়ায় আবারও তেমনটি ঘটবে বলে পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। অপরদিকে টেকনিক্যাল ট্রেনিং ও প্র্যাকটিক্যাল এডুকেশন রিলেটেড সার্টিফিকেট দিয়ে যে সকল কর্মে নিয়োজিত হওয়া যায় সে সকল ক্ষেত্রেও ভুয়া সনদধারী থাকার সম্ভাবনা বেশি। এমন অনেক চাকরিজীবী আছেন যারা তাদের সনদে লিখিত যোগ্যতা ও দক্ষতা ন্যূনতম প্রমাণে সক্ষম নন। লোভে বা চাপে এমন অনেক ভুয়া বা অবৈধ সনদ দিয়ে থাকেন বা দিতে বাধ্য হন অনেক প্রতিষ্ঠান প্রধান। এ সকল বাস্তবতায় জাল বা অবৈধ কিংবা ভুয়া বা আংশিক ভুয়া সনদ কিন্তু অনেক রকম হতে পারে। এক. কোন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়নি, নির্ধারিত কোর্স সম্পন্ন করেনি, পরীক্ষায় বা কাজে অংশগ্রহণ করেনি এমন কাউকে কোন পরীক্ষা পাশের বা কাজের দক্ষতা লাভের সনদ তৈরি করে দেওয়া। দুই. প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছে কিন্তু কোর্স সম্পন্ন করেনি ও পরীক্ষায় বা কাজে অংশগ্রহণ করেনি এমন কাউকে কোন পরীক্ষা পাশের বা কাজের দক্ষতা লাভের সনদ দেওয়া। তিন. প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছে কিন্তু নির্ধারিত কোর্স সম্পন্ন করেনি ও পরীক্ষায় বা কাজে অংশগ্রহণ করে কৃতকার্য হয়নি এমন কাউকে সনদ দেওয়া। চার. প্রতিষ্ঠানে বিলম্বে ভর্তি হয়েছে বিধায় বা অন্য কোন কারণে নির্ধারিত কোর্স সম্পন্ন করেনি বা করতে পারেনি তাকে অনৈতিকভাবে পাস দেখিয়ে/করিয়ে সনদ দেওয়া। পাঁচ. পরীক্ষায় বা মূল্যায়নে নকল করার অবাধ/উন্মুক্ত সুযোগ দিয়ে পাস করিয়ে সনদ দেওয়া। ছয়. প্রকৃত প্রাপ্ত গ্রেডকে অবৈধ ভাবে আপগ্রেড করে সনদ দেওয়া। অর্থাৎ জাল বা অবৈধ সনদ কিংবা ভুয়া বা আংশিক ভুয়া সনদ যথাযথ কর্তৃপক্ষের প্রকৃত কাগজে প্রকৃত সিল-স্বাক্ষর যুক্ত হয়েও তৈরি হতে পারে, আবার সবকিছুই নকল হতে পারে। যখন সবকিছুই নকল হয় তখন শুধুমাত্র সনদ যাচাই করে সত্যতা/ অসত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। কিন্তু যখন যথাযথ কর্তৃপক্ষের আসল কাগজে আসল সিল-স্বাক্ষর যুক্ত হয়ে অবৈধ বা ভুয়া কিংবা আংশিক ভুয়া সার্টিফিকেট তৈরি হয় তখন সেটির যাচাই কাজ অনেক পিছন থেকে শুরু করতে হয়। তাই সে প্রক্রিয়াটি অনেক গভীর ও দীর্ঘ হয়। তেমন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সনদের সত্যতা যাচাই করা হয় না বললেই চলে। তাই অনেক ভুয়া বা অবৈধ সনদধারীরা আলোচনার ও ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। তারা টেকনিক্যাল এডুকেশন এবং সাধারণ শিক্ষা উভয় ধরনের বা একেক জন একেক ধরনের সনদধারী হতে পারে। বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে সার্বিকভাবে বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত রাখা অত্যাবশ্যক। তা না হলে একসময় জাল সনদের জালে আটকে যেতে পারে আমাদের অনেক ক্ষেত্র। যে করেই হোক ভুয়া শিক্ষকের শিক্ষকতা ও ভুয়া চিকিৎসকের চিকিৎসা থেকে মুক্ত হওয়াসহ ভুয়া বা অবৈধ সনদধারীমুক্ত করতে হবে আমাদের দেশের প্রতিটি ব্যক্তি, প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ও সবকটি ক্ষেত্র।<


লেখক: অধ্যক্ষ, শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট 


https://epaper.dainikbangla.com.bd/home/displaypage/news_2024-05-03_5_15_b

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি প্রসঙ্গ

পত্রিকার লিংক

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি প্রসঙ্গ

মো. রহমত উল্লাহ্

দৈনিক বাংলা, ৩১ মার্চ ২০২৪

“বিতর্ক এড়িয়ে রমজান মাসে ছুটি কার্যকর রাখতে আগামীতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শনিবারের সাপ্তাহিক ছুটি বাতিল হতে পারে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। মঙ্গলবার (২৬ মার্চ ২০২৪) আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে আয়োজিত স্বাধীনতা দিবসের আলোচনা সভায় এ কথা জানান তিনি।” শিক্ষার্থীদের বৃহত্তর স্বার্থে যে কোন গঠনমূলক সিদ্ধান্ত বিবেকবান শিক্ষক সমাজ আন্তরিকভাবে মেনে নিবেন এবং সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। তথাপি কোন সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার পূর্বে সকল ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সকল স্তরের শিক্ষক, অভিভাবক ও বিশেষজ্ঞের সঙ্গে মতবিনিময় করে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের জন্য পৃথকভাবে বার্ষিক মোট কর্মদিবস তথা মোট কর্মঘন্টা যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করে নেওয়া উত্তম। এক্ষেত্রে ডাবল শিফট ও সংযুক্ত বিদ্যালয়ের কথাও বিবেচনায় রাখতে হবে। রমজান মাসের ছুটি নিশ্চিত করার জন্য শনিবারের সাপ্তাহিক ছুটি কাটছাঁট করা এখন আর সহজ হবে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাপ্তাহিক ছুটি দুইদিন ঘোষণা করার আগেই এমন আরো অনেক বিষয় বিবেচনা করা উচিত ছিল। রমজান মাসের ছুটি ছাড়াও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি সংক্রান্ত আরো অনেক বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে, আলোচনা করতে হবে, ঐক্যমতে পৌঁছতে হবে। সকল ক্ষেত্রেই অর্জন করার চেষ্টা করতে হবে আন্তর্জাতিক মান। সেই সাথে অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে শিক্ষকদের জীবনমান।


শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাপ্তাহিক ছুটি শুক্র ও শনিবারের পরিবর্তে বৃহস্পতি ও শুক্রবার নির্ধারণ করা অধিক যুক্তিযুক্ত হতে পারে। এতে করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে অভিভাবকদের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পাবে; যা শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। বিশেষ করে কর্মজীবী অভিভাবকগণ তাদের সন্তানদের শুক্রবারে নিজেদের মত সময় দিতে পারবেন এবং শনিবারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে সন্তানদের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে শিক্ষকগণের পরামর্শ নিতে পারবেন ও প্রয়োজনীয় মতামত দিতে পারবেন। অর্থাৎ অভিভাবক-শিক্ষক সমিতি (পিটিএ) এর কার্যক্রম আরো জোরদার করা যাবে। পরিচালনা পরষদ (জিবি, এসএমসি, এমএমসি) এ অধিক শিক্ষিত কর্মজীবীদের অন্তর্ভুক্ত করে শনিবারে সভা করে উপস্থিতি বৃদ্ধি করে অধিক সহযোগিতা নেওয়া যাবে। তাছাড়া শিক্ষক-কর্মচারীরা বৃহস্পতিবারে ছুটি না নিয়ে নিজেদের ব্যাংক একাউন্ট অপারেট করাসহ অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট কাজ সম্পাদন করতে পারবেন। তদুপরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসন চাইলে বৃহস্পতিবারে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের অফিসিয়াল কাজও সম্পাদন করতে পারবেন। অপরদিকে যানজট নিয়ন্ত্রণ ও পানি-বিদ্যুৎ বন্টনের ক্ষেত্রেও তা সামান্য সহায়ক হবে। 


প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এক ধরনের ছুটির তালিকা, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আরেক ধরনের ছুটির তালিকা এবং উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আরেক ধরনের ছুটির তালিকা কাঙ্খিত নয়। সকল ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একই রকম ছুটির তালিকা থাকা উচিত। একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয় যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটির তালিকায় জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দিবস ছুটি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যেমন: ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৭ মার্চ, ২৬ মার্চ, বাংলা নববর্ষ, ১৫ আগস্ট ও ১৬ ডিসেম্বর। কিন্তু সে সকল দিবস উদযাপনের জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে বলা হয়। দিবস উদযাপনের জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন বিধায় কর্মচারীদেরও প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে হয়। অর্থাৎ অন্যান্য দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর মত শিক্ষক-কর্মচারীরা ঐ সকল জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবসে বাস্তবে ছুটি ভোগ করতে পারেন না। এক্ষেত্রে অনেকের মনে অসন্তোষ বিরাজ করে। এসকল দিবস শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য ছুটির দিন নাকি খোলার দিন তা পরিষ্কার নয়! তাই প্রতিষ্ঠান প্রধানরাও শিক্ষকদের ম্যানেজ করতে গিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জটিল সমস্যার সম্মুখীন হন। প্রতিষ্ঠান প্রধানের সঙ্গে শিক্ষকদের মতপার্থক্য হয়, দূরত্ব বৃদ্ধি পায় ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছুটির দিনে এক বা একাধিক শিক্ষক-কর্মচারী অনুপস্থিত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে কী ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে তা পরিষ্কারভাবে বলা না থাকায় প্রতিষ্ঠান প্রধানগণ চরম বেকায়দায় পড়েন। 


শিক্ষার্থীদের বিশেষ দিবসে প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থাকা ও বিভিন্ন ইভেন্টে অংশগ্রহণ করাকে ধারাবাহিক মূল্যায়নে অন্তর্ভুক্ত করে কিছুটা বাধ্যবাধকতা আরোপ করা গেলেও শিক্ষকদের ক্ষেত্রে উপস্থিত থাকার বাধ্যবাধকতা আরোপ করার তেমন কোন নির্ধারিত উপায় ঘোষণাকৃত নেই। কোন শিক্ষক-কর্মচারী জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ দিবসে স্বপ্রণোদিত হয়ে স্বেচ্ছায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে না চাইলে অর্থাৎ বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে অনুপস্থিত থাকতে চাইলে বা বিনা অনুমতিতে অনুপস্থিত থাকলে প্রতিষ্ঠান প্রধান কী করবেন বা কী ধরনের ব্যবস্থা নিবেন তা পরিষ্কার করে উল্লেখ থাকা উচিত। একজনকে বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ঐদিন অনুপস্থিত থাকার অনুমতি দেওয়া হলে ১০ জন ১০ রকমের সমস্যা উত্থাপন করে অনুপস্থিত থাকার আবদার করেন! সবার আবদার রাখতে গেলে দিবস উদযাপন করা সম্ভব হয় না। আবার অনুপস্থিতির সংখ্যা হ্রাস করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠান প্রধানের ক্ষমতা বলে ওই দিনের অনুপস্থিতির কারণে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-কর্মচারীর একদিনের নৈমিত্তিক ছুটি কমিয়ে দেওয়া হলে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন; যদিও ছুটিবিধি অনুসারে কর্মী বৎসরে পূর্ণ বিশ দিন নৈমিত্তিক ছুটি অধিকার হিসেবে প্রাপ্য নন এবং প্রতিষ্ঠান প্রধান তা দিতে বাধ্য নন। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবস উদযাপনের দায়িত্ব কেবল প্রতিষ্ঠান প্রধানের ও আগ্রহী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করে। এমতাবস্থায় এ ব্যাপারে একটা পরিষ্কার দিকনির্দেশনা থাকা আবশ্যক। 


অপরদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন কিছু ছুটি বিদ্যমান যে সকল ছুটির দিনে বা ভ্যাকেশনে সরকারি অফিস খোলা থাকে। তাই সংশ্লিষ্ট সরকারি অফিস থেকে বিভিন্ন আদেশ-নির্দেশ এসে থাকে; যা জরুরি ভিত্তিতে সমাধান করতে হয় বিধায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অফিস খোলা রাখতে হয়। প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অফিসিয়াল কাজ বা হিসাব সংক্রান্ত কাজেও ভ্যাকেশনের সময় অফিস খোলা রাখার প্রয়োজন পড়ে। ভর্তি, রেজিস্ট্রেশন, ফরম ফিলাপ, বেতন-বিল তৈরি ইত্যাদি কাজে প্রতিষ্ঠান নিয়মিত খোলা না রেখে উপায় থাকে না। তখন প্রতিষ্ঠান প্রধান, সহপ্রধান ও কর্মচারীদের উপস্থিত থাকতে হয়। অর্থাৎ তারা ওই ভ্যাকেশন উপভোগ করতে পারেন না। আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের ভ্যাকেশন ডিপার্টমেন্টর কর্মী হিসেবে ট্রিট করার কারণে বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরা ছুটি অর্জন ও বিক্রির সুবিধা থেকে বঞ্চিত এবং তারা পিআরএল ভোগের সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান প্রধান, সহপ্রধান ও কর্মচারী প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে না চাইলে কী রকম ব্যবস্থা নেওয়া হবে তাও পরিষ্কার ভাবে ব্যাখ্যা থাকা উচিত। তবে যে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী অবকাশ বিভাগের সুবিধা ভোগ করতে পারেন না তাদেরকে অবকাশ বিভাগের কর্মী হিসেবে বিবেচনা করা কতটা যুক্তিযুক্ত তাও ভাবতে হবে।

 

সর্বোপরি শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অফিসের জন্য পৃথকভাবে যৌক্তিক বার্ষিক মোট কর্মদিবস তথা মোট কর্মঘন্টা নির্ধারণ করে ছুটির তালিকা প্রণয়ন করা এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবসসহ বিভিন্ন দিবসে ও অন্যান্য ভ্যাকেশনে প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থেকে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রধান, সহপ্রধান, শিক্ষক ও কর্মচারীদের জন্য পুরস্কার-তিরস্কার নির্দিষ্ট করা আবশ্যক। 


লেখক: অধ্যক্ষ, শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক 


২৯.০৩.২০২৪ 

ঢাকা


https://epaper.dainikbangla.com.bd/