অপসংস্কৃতি বিস্তার রোধে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। ভোরের কাগজ


পত্রিকার লিংক

অপসংস্কৃতি বিস্তার রোধে কয়েকটি পদক্ষেপ নেয়া জরুরি



মো. রহমত উল্লাহ্ 

ভোরের কাগজ, বৃহস্পতিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬


বাংলা ভাষার ওপর ভিত্তি করেই আমরা বাঙালি। এর মাধ্যমেই আমরা পেয়েছি আমাদের আত্মপরিচয়, নিজস্ব সাহিত্য, মরমী সুর, চালচলন, পোশাক আশাক, প্রতিবাদের ভাষা, প্রতিরোধের শক্তি-সাহস আর আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশ। আমাদের বাংলা ভাষা রক্ষার জন্য যারা অন্দোলন করেছেন, সংগ্রাম করেছেন, আত্মত্যাগ করেছেন তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।


দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমরা আজ ভুলতে বসেছি আমাদের ভাষার সঠিক ব্যবহার। তাই হারাতে বসেছি আমাদের অতীত ঐতিহ্য। ইচ্ছে করে, ন্যাকামি করে, আধুনিকতা করে বিকৃত করছি মায়ের ভাষার উচ্চারণ। পরিধান করছি ভিন দেশিদের পোশাক। চুল কাটছি উদ্ভট করে। বিদেশি গান গাইছি ও শুনছি আঁকাবাঁকা হয়ে। বাংলা গানের কথায় জুড়ে চিচ্ছি ইংরেজি গানের সুর। এসব বিকৃত আধুনিকতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন একশ্রেণির ন্যায়নীতিহীন অভিভাবক এবং এসব প্রচার করছে কিছু ন্যায়নীতিহীন রেডিও-টেলিভিশন আর ওপেন কনসার্ট।


মহান ভাষা দিবসসহ সব জাতীয় দিবসের আগের রাতে রাজধানীসহ বড়-ছোট অনেক শহরে, কিছু কিছু উপশহরে, এমনকি কোনো কোনো মফস্বল এলাকায় ওপেন বাজানো হচ্ছে বিকট শব্দে বিদেশি বাদ্যযন্ত্র, আর সেই সঙ্গে মাদকদ্রব্য খেয়ে-খায়িয়ে, উলঙ্গ নেচে-নাচিয়ে, গাওয়া হচ্ছে যৌন উদ্দীপক ইংরেজি ও হিন্দি গান। হারাম করে দেয়া হচ্ছে এলাকাবাসীর সারারাতের ঘুম। এরচেয়ে বেশি করা হচ্ছে গায়ে হলুদে, বিয়েতে, জন্মদিনে, মুসলমানিতে, ঈদে, পূজায়, বড়দিনে, ইংরেজি নববর্ষে, এমনকি বাংলা নববর্ষেও। অথচ এসবের প্রতিবাদ করার শক্তি সাহস, মনমানসিকতা যেন আজ আর অবশিষ্ট নেই কারোর মাঝেই। মনে হচ্ছে, যেখানে সেখানে, যখন তখন তাদের এসব অশান্তি করার অধিকার আছে কিন্তু আমাদের নিজের ঘরে শান্তিতে ইবাদত করার, লেখাপড়া করার, ঘুমিয়ে থাকার কোনো অধিকার নেই। (বর্তমান পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশেই অন্যের অসুবিধা হয় এমন স্থানে ও সময়ে বিশেষ করে রাত ১০টার পরে লাউড স্পিকার চালানো যায় না।) অথচ নিজের দল ভারী করার আশায় এসবে সমর্থন ও অর্থ দিচ্ছে তথাকথিত নেতারা আর প্রত্যক্ষ অংশ নিচ্ছে তাদের কর্মীরা। দেখেও না দেখার ভান করছে পুলিশ এবং সিভিল প্রশাসন। কিন্তু কেন?


অন্যদিকে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন উপলক্ষে করা হচ্ছে চরম অশালীন বিদেশি নাচ-গানের আয়োজন। ব্যয় করা হচ্ছে অভিভাবকদের কাছ থেকে আদায় করা অর্থ। আর শিক্ষার্থীদের দেয়া হচ্ছে অপসংস্কৃতি অনুশীলন ও বাঙালি সংস্কৃতি পরিহারের কুশিক্ষা। অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও শিক্ষকরা বাধ্য হচ্ছেন এমন আয়োজন করতে। এসব যেন খেয়ালই করছে না আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অথচ দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিদেশি নাচ-গান বাদ্য-বাজনা নিষিদ্ধ করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি আদেশই যথেষ্ট। কিন্তু এতদিনেও তা হচ্ছে না কেন?


এত গেল বাইরের কথা। কী হচ্ছে ঘরে ঘরে? কী দেখা হচ্ছে টিভিতে? সারা বছর চলছে হিন্দি সিরিয়াল। অধিকাংশ বাসা-বাড়ির টিভির রিমোট বড়দের হাতে বিশেষ করে গৃহকর্ত্রীর হাতে থাকে বিধায় ছোটরাও দেখতে বাধ্য হচ্ছে বড়দের ক‚টচালে ভরা হিন্দি সিরিয়াল। তাই তারা বেড়ে উঠতে বাধ্য হচ্ছে বিকৃত রুচি ও মানসিকতা নিয়ে। এই সিরিয়াল পাগলরা এমনই পাগল যে, শহীদ দিবসে, স্বাধীনতা দিবসে, বিজয় দিবসে, ঈদের দিনে, পূজার দিনে, পহেলা বৈশাখে, এমনকি শোকের দিনেও দেখেন না বাংলাদেশের অনুষ্ঠান। ফলে ছোটরাও দেখতে পারে না আমাদের বাংলা অনুষ্ঠান। শুনতে পারে না আমাদের গুণীজনদের কথা। জানতে পারে না আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। সেদিনও তাদের মাথায় ঠেলে দেয়া হচ্ছে ভিনদেশি সংস্কৃতি।


আশির দশকে এমন একটা সময় ছিল, যখন এসব হিন্দি চ্যানেল আমাদের টিভিতে দেখা যেত না। আমাদের এত টিভি চ্যানেলও ছিল না। তখন সবাই বিটিভির অনুষ্ঠানই দেখতে বাধ্য ছিল। আর তখন ছিল আমাদের ইতিহাস বিকৃত ও ঐতিহ্য ধ্বংস করার যুগ। চির বিজয়ী বীর বাঙালি জাতিকে বিভক্ত করে ভীতু বাংলাদেশি বানানোর যুগ। তখন সঠিক ইতিহাস প্রচার করা হতো না আমাদের টিভিতে। তাই বাধ্য হয়ে আমরা ভুলটাই দেখতাম ও শিখতাম। বিভ্রান্ত হতাম। বিভক্ত হতাম। সেই সময়ের বিভ্রান্ত যুবক-যুবতী ও ছেলেমেয়েরাই এখনকার বেশির ভাগ দাদা-দাদি, নানা-নানি, মা-বাবা, চাচা-মামা, ফুফু-খালা, শিক্ষক-শিক্ষিকা। তাদের হাতেই এখন টিভির রিমোট। তারাই পছন্দ করে না বাংলাদেশের অনুষ্ঠান। তারাই পাগল হিন্দি সিরিয়াল দেখার জন্য।


অথচ এখন যখন আমাদের অনেক টিভি চ্যানেল। এখন যখন আমাদের অধিকাংশ টিভিতে আমাদের সঠিক ইতিহাস ও ঐতিহ্য কম-বেশি প্রচারিত হচ্ছে; তখন আমাদের ওপর জেঁকে বসেছে বিদেশি চ্যানেল। অর্থাৎ আমাদের ছেলেমেয়েরা আগে শিখেছে ভুল ইতিহাস আর এখন শিখছে ভিন্ন কালচার।


এমতাবস্থায় দাবি উঠেছে, কয়েকটি বিদেশি চ্যানেল বন্ধ করার। মতামত রয়েছে এই দাবির পক্ষে বিপক্ষে। সেটি হলে ভালো। না হলে, কমপক্ষে আমাদের শহীদ দিবসে, স্বাধীনতা দিবসে, বিজয় দিবসে, শোক দিবসে, পহেলা বৈশাখে বন্ধ রাখা হোক সব বিদেশি চ্যানেল এবং বিদেশি নাচ-গান ও বাদ্য-বাজনার ওপেন কনসার্ট। যাতে অন্তত এই একটা দিন আমাদের সন্তানরা দেখতে পারে আমাদের চেহারা, শুনতে পারে আমাদের কথা, জানতে পারে আমাদের অতীত, জাগ্রত করতে পারে জাতীয় চেতনা, বর্ধিত করতে পারে দেশপ্রেম, তৈরি করতে পারে সুরুচি, রচনা করতে পারে সঠিক ভবিষ্যৎ।


মো. রহমত উল্লাহ : অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।

http://www.bhorerkagoj.net/print-edition/2016/02/25/77216.php 

Previous Post
Next Post

About Author

0 মন্তব্য(গুলি):