আমাদের ভাষাপ্রেম ও 'বিসর্গ' বর্ণের অপব্যবহার
দৈনিক ইত্তেফাক, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১
মো. রহমত উল্লাহ্
পৃথিবীতে একমাত্র আমরাই জীবন দিয়ে রক্ষা করেছি আমাদের রাষ্ট্রভাষা, বাংলা ভাষা। আমাদের 'শহিদদিবস' তথা একুশে ফেব্রুয়ারি আজ ১৯৩টি দেশে পালিত হয় ইউনেস্কো স্বীকৃত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। অথচ ভাষার আন্দোলনে আজও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় অর্জিত হয়নি আমাদের সফলতা।
সঠিক চর্চা ও পরিচর্যার মাধ্যমে মাতৃভাষার উৎকর্ষ সাধনে আমরা অনেকেই এখনো অনেক বেশি উদাসীন। এমনকি অক্ষরের প্রয়োগ, শব্দের বানান, শব্দ গঠন, শব্দ সংক্ষেপণ, শব্দের প্রয়োগ, বাক্য গঠন, যতিচিহ্নের ব্যবহার ইত্যাদি সাধারণ বিষয়েও আমরা প্রায় সবাই এত বেশি ভুল লিখি যা স্বল্প পরিসরে আলোচনা সম্ভব নয়।
এই নিবন্ধে আমাদের বাংলা ভাষার একটি বর্ণ 'বিসর্গ' (ঃ) এর ব্যাপক অপব্যবহারের আংশিক চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি। ভাষার গতিবৃদ্ধির জন্য শব্দসংক্ষেপ অপরিহার্য। তাই শব্দ সংক্ষেপ করার জন্যও প্রত্যেক ভাষারই থাকা চাই সর্বজনবিদিত সুনির্দিষ্ট নিয়ম। আমাদের বাংলা ভাষায়ও আছে তেমন কিছু নিয়মকানুন। কিন্তু সে নিয়ম অনুসরণ করছি না, প্রয়োগ করছি না আমরা অনেকেই।
কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক। ‘ডাঃ মোঃ মোঃ হোসেন, এমঃ বিঃ বিঃ এসঃ’। এক্ষেত্রে বিসর্গ (ঃ) গুলোর অপব্যবহার করা হয়েছে যতিচিহ্ন (শব্দ সংক্ষেপণ চিহ্ন) হিসেবে। অর্থাৎ ‘ডাক্তার মোহাম্মদ মোক্তার’, ‘ব্যাচেলর অফ মেডিক্যাল সাইন্স’ কথাগুলোকে সংক্ষিপ্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়েছে বিসর্গ দিয়ে।
আবার ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্মারক নম্বর’ কথাগুলোকে অনেক সময় সংক্ষেপে লেখা হয় ‘শিঃ মঃ স্মাঃ নং’ এভাবে। গভঃ দিয়ে গভর্নমেন্ট, প্রাঃ দিয়ে প্রাইভেট, লিঃ দিয়ে লিমিটেড, হঃ দিয়ে হযরত, ছঃ দিয়ে ‘ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া ছাল্লাম’, রাঃ দিয়ে ‘রাদিয়াল্লা হু আন হু’ ইত্যাদি লেখা হয়ে থাকে প্রায়শই। এভাবে বিসর্গ (ঃ) দিয়ে শব্দ সংক্ষেপ করা সঠিক নয়।
বিসর্গ (ঃ) কে যতিচিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করা যায় না। যতিচিহ্নের কোনো উচ্চারণ ধ্বনি নেই। বিসর্গ যতিচিহ্ন নয়। বিসর্গ একটি ব্যঞ্জনবর্ণ। বিসর্গের (ঃ) আছে উচ্চারণ ধ্বনি। আছে সঠিক ব্যবহারের নিয়মকানুন। অথচ আমরা অনেকেই না জেনে, না বুঝে এই বিসর্গ (ঃ) ধ্বনিকে ব্যবহার করছি যতিচিহ্ন হিসেবে। এতে চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে বাংলা ভাষার শুদ্ধতা এবং বিলুপ্ত হচ্ছে বিসর্গ (ঃ) বর্ণের উচ্চারণ ধ্বনি ও অস্তিত্ব।
এইরূপ অপব্যবহূত বিসর্গ (ঃ) এর উচ্চারণ করতে গেলেও অর্থ দাঁড়াচ্ছে অন্যরকম। যেমন, ‘হাইমচর হামদর্দ হাসপাতাল’কে বিসর্গযোগে সংক্ষিপ্ত করতে গেলে হবে ‘হাঃ হাঃ হাঃ’। উচ্চারণ হবে ‘হাহ্ হাহ্ হাহ্’। অর্থ দাঁড়াবে উচ্চৈঃস্বরে হাসির শব্দ।
শব্দ সংক্ষেপ করার জন্য ব্যবহার করতে হবে যতিচিহ্ন। একমাত্র দাঁড়ি (। ) ব্যতীত সকল যতিচিহ্নই আমরা পেয়েছি বা নিয়েছি ইংরেজি ভাষা থেকে। তাই ব্যবহারও হচ্ছে ইংরেজি ভাষার রীতি অনুসারেই। সেমতে শব্দ সংক্ষেপ করার জন্য ব্যবহৃত হবে ডট (.)। বাংলায় আমরা এর নাম দিয়েছি এক বিন্দু (.) বা শব্দ সংক্ষেপণ চিহ্ন। যেমন: ডা. মো. সা. জা. ফয়েজ, এম. বি. বি. এস.। শি. ম. স্মা., এস. এস. সি., এম. এসসি., বি. এড., বি. জি. বি. ইত্যাদি।
শুধু শব্দ সংক্ষিপ্ত করার জন্যই যে বিসর্গ (ঃ) বর্ণের অপব্যবহার হচ্ছে তা নয়, বিশ্লেষণ করার জন্যও অহরহ অপব্যবহূত হচ্ছে বিসর্গ (ঃ) নামক বর্ণ ও ধ্বনি। ‘যেমন- / যেমন:’ কে বিসর্গ দিয়ে লেখা হচ্ছে ‘যেমনঃ’। ‘নাম- / নাম:’ কে লেখা হচ্ছে ‘নামঃ’। ‘গ্রাম- / গ্রাম:’ কে লেখা হচ্ছে ‘গ্রামঃ’। ‘পোস্ট- / পোস্ট:’ কে লেখা হচ্ছে ‘পোস্টঃ’। বিসর্গের মতো এমন অনেক ধ্বনি, বর্ণ এবং যতিচিহ্ন প্রয়োগ আমাদের খামখেয়ালির জন্য বাংলা ভাষা আজ ক্ষত-বিক্ষত ও দুঃখভারাক্রান্ত।
অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও বাস্তব যে, বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নামফলক, চিঠিপত্র, টেলিভিশন এমনকি অনেক প্রকাশিত বই এবং পত্রপত্রিকায় এমনি ভুলভাবে বিসর্গের অহরহ অপপ্রয়োগ দীর্ঘদিন দেখতে দেখতে এখন নতুন প্রজন্মসহ আমরা অনেকেই মনে করি তা-ই সঠিক। এমনকি আমাদের অধিকাংশ শিক্ষিত মানুষের নামের সংক্ষিপ্তরূপ আমাদের শিক্ষা সনদে লেখা হয়েছে ও হচ্ছে (ঃ) বিসর্গ দিয়ে। যেমন: মো., মোসা., মি. এসবকে লেখা হচ্ছে মোঃ, মোসাঃ, মিঃ, ইত্যাদি। আজীবন এই ভুল বয়ে বেড়াচ্ছি আমরা!
অথচ জন্মনিবন্ধন কর্তৃপক্ষ, জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান কর্তৃপক্ষ, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বোর্ড এবং সকল স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ সনদ লেখার সময় একটু সচেতন হলেই অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব এই চলমান/ প্রচলিত ভুল। নিজের শুদ্ধ সনদ দেখেই আমাদের সন্তানেরা শিখতে পারবে শব্দ সংক্ষেপণ চিহ্নের সঠিক ব্যবহার এবং পরিহার করতে পারবে (ঃ) বিসর্গের অপব্যবহার।
তদুপরি যথাশীঘ্র সম্ভব বাংলা একাডেমিসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন সকল প্রতিষ্ঠান এবং প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াসমূহ ঐকমত্যে এসে একই নিয়ম অনুসরণ অত্যাবশ্যক। এক্ষেত্রে শিক্ষকদেরও নিতে হবে অগ্রণী ভূমিকা। প্রমাণ করতে হবে, আমাদের ভাষাপ্রেম কতটা গভীর। মনে রাখতে হবে, সামান্য অবহেলায় ভাষার ভেতরে কোনো ভুল বিস্তৃত হয়ে পড়লে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভাষা; যা কাটিয়ে ওঠা হয়ে পড়ে অত্যন্ত কঠিন ও সময়সাপেক্ষ।
মো. রহমত উল্লাহ্ : সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ এবং অধ্যক্ষ- কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।
Email- rahamot21@gmail.com