ছাত্র শিক্ষক সম্পর্কের বাস্তবতা, দৈনিক বাংলা, ১৭ নভেম্বর ২০২৩

 পত্রিকার লিংক


ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের বাস্তবতা 

মো. রহমত উল্লাহ্

দৈনিক বাংলা, ১৭ নভেম্বর ২০২৩

ওস্তাদজী ওযু করছেন। পায়ে পানি ঢেলে দিচ্ছে বাদশা আলমগীরের পুত্র তথা ওস্তাদজীর ছাত্র। এই দৃশ্য দেখে বাদশা আলমগীর ভীষণ মন ক্ষুন্ন হয়ে ওস্তাদজীকে ডেকে পাঠালেন। সবাই ভাবল, বাদশা ওই ওস্তাদজীকে কঠিন শাস্তি দিবেন! অবশেষে বাদশা আলমগীর জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কেমন শিক্ষা দিয়েছেন যে, ছাত্র শুধু পানি ঢেলে দেয়, নিজের হাতে আপনার পা ধুয়ে দেয় না? আমরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ওস্তাদের কদর শিরোনামে এই সত্য বিষয়টি পড়েছিলাম। বর্তমান বইয়ে এটি নেই। তাই নতুনদের উদ্দেশ্যে সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করলাম। এমন দৃশ্য এখন প্রায় অবাস্তব। ছাত্র শিক্ষক সম্পর্কও এখন অন্যরকম। তাই অনেকেই আফসোস করে বলে থাকেন, আগের শিক্ষক ছিলেন পরম শ্রদ্ধেয় মাননীয় পূজনীয়। ছাত্র ছিল বিশ্বস্ত আদুরে স্নেহশীল। সর্বোৎকৃষ্ট সম্পর্ক ছিল ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক। শিক্ষকের আদেশ-নির্দেশ উপদেশ পাওয়ার প্রত্যাশায় সর্বদা ব্যাকুল থাকত শিক্ষার্থী। শিক্ষকের দেয়া কঠিন শাস্তিকেও মনে করত আশীর্বাদ। শুধু পুস্তকবদ্ধ জ্ঞান নয়, শিক্ষকের আচার-আচরণ জীবনযাপন নীতি-নৈতিকতা দেশপ্রেম জাতীয়তা বোধ সবকিছুই আত্মস্থ করার আপ্রাণ চেষ্টায় মগ্ন থাকতো ছাত্ররা। ‘আব্দুস সালাম পন্ডিত কিংবা মোহাম্মদ আলী মাস্টারের প্রিয় ছাত্র’- এই স্বীকৃতিটুকুই যথেষ্ট ছিল সবুজ পাহাড় এলাকার একজন যুবকের লজিং পাওয়া, কাজ পাওয়া, এমনকি পুলিশের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য। ছাত্রকে সর্বময় ভালো শিক্ষায় শিক্ষিত করার অদম্য প্রচেষ্টায় মগ্ন থাকতেন শিক্ষক। খুব ভোরে ও গভীর রাতে দু’এক মাইল হেঁটে বাড়ি যেয়ে দেখে আসতেন অধ্যয়ন করছে কিনা ছাত্র! এক দু’দিন পাঠশালায় অনুপস্থিত থাকলেই উদ্বিগ্ন চিত্তে ছুটে যেতেন পরস্পরের ভালো-মন্দ জানার জন্য। সামান্য অসুস্থ হলেই সেবার হাত বাড়িয়ে দিনরাত বসে থাকতেন শিয়রে। সবচেয়ে ভালো কথা ও কর্ম শত কষ্টে শিক্ষক আয়ত্ত করে রাখতেন ছাত্রের জন্য। সুশিক্ষা গ্রহণ ও দানই ছিল শিক্ষকের ধর্ম। ছাত্রের গাছের প্রথম সুস্বাদু ফল, নতুন ধানের মুড়ি খই পিঠা গাভীর দুধ এমন অনেক কিছুই শিক্ষকের জন্য আনন্দচিত্তে বরাদ্দ করতেন অভিভাবকগণ। 


গভীর মনোযোগে অধ্যয়ন করত ছাত্ররা। ‘ছাত্রনং অধ্যয়নং তপ’ শিক্ষকের এই উক্তি মনে প্রানে বিশ্বাস করত, কার্যকর করত।  জবাবদিহিতার প্রশ্নই ছিল না শিক্ষকের। তথাপি মানুষের ভিতরের মানুষটিকে আসল মানুষ করার গুরু দায়িত্ব পালনে কোন ছাত্রের অক্ষমতার কারণে সামান্য ব্যর্থ হলেও নিজের ব্যর্থতা মনে করে শিক্ষক ছটফট করতেন অনুতাপ যন্ত্রণায়! ছাত্রের মধ্যে এমনি প্রথিত হতো শিক্ষকের গুণ যেন শিক্ষক উপস্থিত থাকতেন জীবনের সর্বক্ষেত্রে। মনে কষ্ট পেতে পারেন শিক্ষক এমন কথা ও কাজ শুধু ছাত্র নয় ছাত্রের অভিভাবকগণও বলতেন না, করতেন না। ছাত্র-শিক্ষকের সেই সম্পর্কটি ছিল সহমর্মিতায় পরিপূর্ণ আদর্শগত সম্পর্ক। শুধুই কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্য ছিল উভয়ের। অর্থ মূল্যে বা ভোগে নয়, মনের টানে ও ত্যাগে মূল্যায়িত হত সেই সম্পর্ক। পারস্পরিক স্নেহ-শ্রদ্ধার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা গুরু-শিষ্য সম্পর্কটি ইদানিং খুবই কম দেখা যায়। ‘ছাত্ররা এখন শিক্ষককে মান্য করে না, এমনকি শিক্ষকের গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করে না’, এর প্রকৃত কারণ ও সত্যতা গভীরভাবে পর্যালোচনা করে প্রয়োজনে সম্পর্কের আরো উন্নয়ন অত্যাবশ্য।


আসলে আগের মত কিছুই নেই। জীবনযাত্রার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে শিক্ষার পরিবেশ। বহু গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে ছাত্র-শিক্ষক সংখ্যা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অনিবার্য প্রবর্তনের ফলে সামান্য হলেও বৃদ্ধি পেয়েছে ছাত্র-শিক্ষকের অবস্থানগত দূরত্ব। পাল্টে গেছে শিক্ষা দানের আদি ধারণা। শিক্ষাদানকে বলা হচ্ছে পাঠদান, দক্ষতা দান, অভিজ্ঞতা দান। এক সময় ধর্ম, দর্শন, ভাষা ও গণিত শিক্ষাকেই মনে করা হতো শিক্ষা। অথচ এখন শিক্ষার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়েছে সর্বদিকে। কৃষি থেকে মহাশূন্য পর্যন্ত এখন শিক্ষা বিস্তৃত। মানুষের নৈতিক চরিত্র গঠনের চেয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি ও অর্থ উপার্জন ক্ষমতা অর্জনকে বিবেচনা করা হচ্ছে শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য। ফলে শিক্ষা এখন অনেকটা পণ্য এবং শিক্ষা উপার্জন ব্যয় বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচিত। আগে শিক্ষককে মনে করা হতো বিদ্যাদাতা। আর এখন শিক্ষক অনেকটা বেতনভোগী সহযোগীর মতো। আমাদের শিক্ষার স্তরও উন্নীত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে। যেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর বয়সের ব্যবধান আগের তুলনায় অনেক কম। তারা এখানে ভাই-বন্ধুর মত। প্রেম, প্রজনন, পরিবার পরিকল্পনা, যৌন রোগের বিস্তার ইত্যাদি গোপনীয় বিষয়েও ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আলোচনা করতে হয় খোলামেলাভাবে। যিনি জুতা তৈরীর বা পশুপাখি পালনের কৌশল শেখাচ্ছেন তিনিও শিক্ষক। যে গাড়ি, মেশিন, বিমান বা কম্পিউটার চালনা শিখছে সেও শিক্ষার্থী। যার বয়স তার শিক্ষকের চেয়ে বেশিও হতে পারে। অন্যান্য যোগ্যতার কারণে এই ছাত্র হতে পারেন শ্রদ্ধার পাত্র। যেমনটি অতীতে ছিল না বললেই চলে। শুধু শিক্ষক বা প্রকৃতি নয়; পত্র-পত্রিকা, বেতার-টেলিভিশন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ইত্যাদি বর্তমানে পালন করছে বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষকের ভূমিকা। যেখানে শিক্ষকের অবদান পরোক্ষ। অর্থাৎ অতীতের মতো ছাত্র-শিক্ষক ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ এখন নেই। এক্ষেত্রে কোন শিক্ষকের নিকট থেকে কোন বিষয় শিখবার আগ্রহ মানেই ঐ শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা। ছাত্র-শিক্ষকের এই সম্পর্কটি সফল। অর্থাৎ সুসম্পর্ক। এখানে শিক্ষকের পায়ে পানি ঢালবার সুযোগ ও পরিবেশ কোথায়? তাছাড়া শিক্ষক যথাযোগ্য না হলে, আন্তরিক ও নিবেদিত না হলে, সৎ ও নিরপেক্ষ না হলে ছাত্রদের শ্রদ্ধা পাওয়ার আশা করাও অনুচিত। 


ছাত্র শিক্ষক সু-সম্পর্কের বড় একটি পূর্ব শর্ত হচ্ছে অসংখ্য শিক্ষা ক্ষেত্র থেকে সুনির্দিষ্ট শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীর আগ্রহ নির্ধারণ। অর্থাৎ কী শিখতে সে সর্বাধিক আগ্রহী এবং তার পক্ষে কী শিক্ষা করা সম্ভব তা স্থির করা। অতীতে শিক্ষার এতগুলো ক্ষেত্র চিহ্নিত ছিল না বলেই শিক্ষার্থীর আগ্রহ নির্ধারণের সুযোগও কম ছিল, শিক্ষার্থীও কম ছিল। যে কৃষি শিক্ষায় আগ্রহী তাকে পারিবারিক সিদ্ধান্তে ডাক্তারি বিদ্যা শিক্ষা দিতে গেলে অমনোযোগী থাকবেই। ওই শিক্ষার প্রতি আগ্রহের কারণেই শিক্ষকের প্রতিও থাকবে অনাগ্রহী। যে কম্পিউটার বিজ্ঞানে আগ্রহী তাকে কম্পিউটার বিজ্ঞান শিখতে দিলে ওই বিদ্যার প্রতি আগ্রহের কারণেই সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের প্রতিও সে আগ্রহী হবে, শ্রদ্ধাশীল হবে। এ বিষয়ে শিক্ষকের জ্ঞানের গভীরতায় ডুব দেওয়ার জন্যই শিক্ষার্থী তার সান্নিধ্য চাইবে, সন্তুষ্টি চাইবে। শিক্ষক সুযোগ্য হলে অবশ্যই তৈরি হবে সুসম্পর্ক। যে গান শিখতে আগ্রহী সে শুধু তার শিক্ষকের প্রতিই নয় ভালো শিল্পীর প্রতিও শ্রদ্ধাশীল, যদিও ওই শিল্পীর সঙ্গে তার পরিচয় নেই। এ সম্পর্কের বন্ধন আত্মিক। সুযোগ্য শিক্ষক ও যথাযথ পরিবেশ পেলে ওই সম্পর্কের সেতু বেয়ে আগ্রহী ছাত্রের কাছে প্রবাহিত হবে শিক্ষকের সকল সুশিক্ষা ও গুণাবলী। 


শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও মেধা অনুযায়ী শিক্ষার সুযোগ দিতে পারছিনা বলেও আমাদের ছাত্ররা যা শিখতে বাধ্য হচ্ছে ওই বিষয়ের প্রতি ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের প্রতি তুলনামূলক কম আন্তরিক, কম শ্রদ্ধাশীল। অন্ধভক্তি সুসম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ নয়। যে ছাত্র বাহ্যিকভাবে শিক্ষককে শ্রদ্ধা দেখায় কিন্তু যে বিষয়/কর্মদক্ষতা শেখার জন্য শিক্ষকের নিকট যায় তা সঠিকভাবে আয়ত্ত করে না সে ছাত্রের সঙ্গে শিক্ষকের সম্পর্ক ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক হিসেবে কতটা সফল তা প্রশ্নবিদ্ধ! বরং যে শিক্ষার্থী নির্ধারিত শিক্ষা লাভে আগ্রহী, সচেষ্ট ও সফল তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের সম্পর্ক ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক হিসেবে অধিক সফল। শুধুমাত্র সালাম/ নমস্কারের পরিমাণ নয়, সুশিক্ষা লাভের পরিমাণই এই সম্পর্কের মানদন্ড। শ্রমবিভাজনের ফলে বর্তমানে একজন শিক্ষার্থীর অনেক শিক্ষক। বাংলা ইংরেজি অংক বিজ্ঞান ধর্ম সংগীত চিত্রকলা ক্রীড়া কম্পিউটার ইত্যাদি প্রতি বিষয়ের এক বা একাধিক শিক্ষক থাকেন প্রাথমিক স্তরেই। একেকজনের বৈশিষ্ট্য একেক রকম। তাদের নির্ধারিত পাঠ আয়ত্ত করতেই হিমশিম খাচ্ছে শিক্ষার্থী, ঘনিষ্ঠ হবার যোগ্যতা, ক্ষমতা ও সুযোগ আছে কি? বিভিন্ন মিডিয়াসহ নানা বিষয়ের শিক্ষকদের প্রতি ছাত্রদের যে শ্রদ্ধা তার সমষ্টি অতীতের চেয়ে কম নয়।


একসঙ্গে ছাত্র-শিক্ষকের উঠা-বসার সময় তুলনামূলক কমে যাওয়ায় পারস্পরিক স্নেহ-শ্রদ্ধা প্রদর্শনের সুযোগও এখন কম। বিভিন্ন কারণে যে শিক্ষার প্রতি অমনোযোগী, অশ্রদ্ধাশীল ও অনাগ্রহী সে শিক্ষকের প্রতিও অশ্রদ্ধাশীল। পন্ডিত মশাই এর টিকিট কেটে পকেটে দিয়ে দেওয়ার মত দুষ্টু আগেও ছিল পাঠশালায়। কতিপয় ছাত্র-শিক্ষকের অশুভ আচরণের ভিত্তিতে পুরো ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মান নির্ধারণ অযৌক্তিক, অনুচিত। তথাপি এদের সংখ্যা হ্রাস করা জরুরি। প্রকৃত ছত্রের পক্ষে তার শিক্ষকের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা কোনদিনই সম্ভব নয়। অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে আদর্শ ছাত্রদের সঙ্গে আদর্শ শিক্ষকদের সুসম্পর্ক আগের তুলনায় মোটেই কমেনি। বিভিন্ন পরিবর্তনের প্রভাবে এই সম্পর্কের ধরন পরিবর্তিত হয়েছে মাত্র। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ঝর্ণাধারার মতো প্রবাহমান ছিল, আছে, থাকবে। আসলে যার শিখবার আগ্রহ আছে, শেখাবার আগ্রহ আছে, সেই ছাত্র, সেই শিক্ষক। এতো দুই নয়, একই সত্তা। সম্পর্ক অবনতির সুযোগ কই? 


মো. রহমত উল্লাহ্

শিশুসাহিত্যিক, শিক্ষাগবেষক এবং অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।

১৪ নভেম্বর ২০২৩



Previous Post
Next Post

About Author

0 মন্তব্য(গুলি):