বেসরকারি শিক্ষকদের প্রতি সরকারিদের মনোভাব।

 


বেসরকারি শিক্ষকদের প্রতি সরকারিদের মনোভাব 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে প্রায়ই বলে থাকেন, ‘মানুষকে অবহেলার চোখে দেখবেন না বা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবেন না। মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান দিবেন। রিকশাওয়ালাকেও আপনি করে বলবেন। মনে রাখবেন, আমরা জনগণের শাসক নয়, সেবক।’ তার পিতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও বলতেন, ‘মানুষকে সম্মান করে কথা বলুন, ইজ্জত করে কথা বলুন। তারাই দেশের মালিক।’

সরকারপ্রধানের এমন বক্তব্যে আমরা আসলেই খুব সম্মানিত বোধ করি এবং সরকারিদের নিকট থেকে সদ্ব্যবহার প্রত্যাশা করি। কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন তেমনভাবে দেখিনা, পাইনা, ভোগ করি না।

কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত অধিকাংশ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই এমন ভাব দেখান যেন তারাই দেশের মালিক। চরম তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন সেবাগ্রহীতা জনসাধারণকে। বিনামূল্যে কিংবা সরকারের নির্ধারিত চার্জে তারা করতে চান না জনগণের কোনো কাজ। ভালো ব্যবহার তো আরো অনেক দূরের কথা। সরকারের খাজনা দিতে গেলেও করে থাকেন হয়রানি। সরকারি হাসপাতলে গিয়েও বিনামূল্যে পাওয়া যায় না সঠিক চিকিৎসা ও ভালো ব্যবহার। নিজের টাকা জমা রাখতে গেলেও সম্মান পাওয়া যায়না সরকারি ব্যাংকে।

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে শুধু সাধারণ মানুষদের অসম্মান করেন, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন, তা নয়; বেসরকারি বা প্রাইভেট চাকরিজীবীদের প্রতিও দেখান না তেমন সম্মান। আজকের এই আলোচনায় শুধুমাত্র বেসরকারি শিক্ষকদের প্রতি সরকারিদের মনোভাব তুলে ধরার চেষ্টা করছি। দু'একটি উদাহরণ দিই: বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্থাপিত পাবলিক পরীক্ষার কেন্দ্রে যখন ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে আসেন কোন সরকারি কর্মকর্তা, তখন কী যে ভয়াবহ থাকে তিনার হামবড়া ভাব! শ্রদ্ধেয় পিতৃতুল্য শিক্ষকগণের প্রতিও দেখান না ন্যূনতম সম্মান। মাননীয় অধ্যক্ষ বা প্রধান শিক্ষককে সম্বোধন করেন ‘সাহেব’ বলে। অথচ প্রত্যাশা করেন, সবাই তাঁকে স্যার বলুক, দাঁড়িয়ে সম্মান করুক, দৌড়ে গিয়ে এগিয়ে আনুক, সাথে সাথে হাঁটতে থাকুক, বিশেষভাবে আপ্যায়ন করুক, যাবার সময় এগিয়ে দিয়ে আসুক। কী অবাক ব্যাপার, তিনি নিজে কাউকে সম্মান করবেন না, অথচ সম্মান প্রত্যাশা করবেন সবার কাছ থেকে!

বেসরকারি শিক্ষকগণ যখন নিজের বেতন তুলতে যান সরকারি ব্যাংকে তখন কি যে অসহনীয় হয় ব্যাংকারদের আচরণ তা বলে বোঝানোর মত নয়! তাঁরা একজন সাধারণ গ্রাহকের চেয়েও অবমূল্যায়ন ও হয়রানি করেন বেসরকারি শিক্ষকদের। এমন ভাব করেন যেন তাঁদের পকেটের টাকা নিয়ে নিচ্ছেন শিক্ষক। কথা বলেন ধমকের সুরে। অধিক বয়স্ক শিক্ষকগণের প্রতিও দেখান না ন্যূনতম সম্মান! কেননা, তারা জানেন, বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন, ক্ষমতা ও ব্যাংক ব্যালেন্স সবার চেয়ে কম! বাধ্য না হলে কোনোদিনও সরকারি ব্যাংকে যেতেন না বেসরকারি শিক্ষকগণ।

একদিন তিনজন নবীন সরকারি কর্মকর্তা এসেছিলেন আমার দপ্তরে। একজন সরকারি কলেজের প্রভাষক, একজন সরকারি ব্যাংকের অফিসার, একজন উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা। তারা আমাদের পার্শ্ববর্তী একটি কেজি স্কুলের পরিচালক। তাদের স্কুলের একটি অনুষ্ঠান আমাদের বেসরকারি স্কুল ও কলেজের মাঠে করার অনুমতি নিতে এসেছিলেন তারা। আমার সন্তানও তাদের মতই সরকারি কর্মকর্তা। সন্তানতুল্য নবীন অফিসারদের আগমনে আনন্দে ভরে উঠল আমার মন। দেখালাম সর্বোচ্চ সৌজন্যতা, করলাম সাধ্যমত আপ্যায়ন। অথচ, আলাপকালে অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম, তারা তিনজনই আমাকে সম্বোধন করছে ‘প্রিন্সিপাল সাহেব’ বলে! আরো বেশি অবাক হলাম, তাদের তিনজনের একজন কলেজ শিক্ষক! সে তার সিনিয়র কলিগের ফোন পেয়ে স্যার স্যার বলতে বলতে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এই কি শিক্ষা দেয়া হয় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বুনিয়াদি ও অন্যান্য প্রশিক্ষণে? ম্যানার্স এন্ড এটিকেটস কি শুধু সরকারিদের সাথে সরকারিদের?

— হ্যালো স্যার। আসসালামু আলাইকুম স্যার। এটি কি স্যার ... সরকারি কলেজের নম্বর স্যার?
— ওয়ালাইকুম সালাম। না, এটি ... সরকারি কলেজের নম্বর নয়। আমি ... কলেজের অধ্যক্ষ বলছি। কে বলছিলেন প্লিজ।
— ও আচ্ছা, আমি ডিজি অফিস থেকে বলছি। শোনেন, আমরা কিছু তথ্য চেয়ে সব কলেজে মেইল পাঠিয়েছি। মেইল চেক করেন। কালকের মধ্যেই জবাব দিতে হবে।
— ঠিক আছে, দেখছি। কে বলছিলেন প্লিজ?
— আমি ডিজি অফিস থেকে বলছি।
— তাতো বুঝলাম। ডিজি অফিস থেকে কে বলছেন?
— ... শাখা থেকে বলছি। (ফোন কেটে দিলেন)
টেলিফোনের এই কথোপকথন গুলো একটি বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয়ের সঙ্গে সরকারি দপ্তরের কর্মচারীর। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, সরকারি দপ্তরের কর্মচারী যখন সরকারি কলেজের অফিসে ফোন করেছেন তখন বারবার স্যার স্যার বলেছেন। কিন্তু যখন তিনি জানতে পেরেছেন যে, এটি আসলে সরকারি কলেজের ফোন নম্বর নয় এবং একজন বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয়ের সাথে তাঁর কথা হচ্ছে, তখন আর আগের মত স্যার স্যার বলছেন না। আদেশের সুরে কথা বলছেন। এমনকি তার নিজের সঠিক পরিচয়টিও অধ্যক্ষ মহোদয়ের নিকট দিচ্ছেন না। ন্যূনতম সৌজন্যতা না দেখেই ফোন কেটে দিয়েছেন। শুধু যে টেলিফোনেই তাঁরা এমন খারাপ আচরণ করেন তা নয়, অফিসে গেলে এর চেয়েও বেশি খারাপ আচরণ করে থাকেন। এ সকল কর্মচারীরা তাদের বসদের কাছ থেকেই শিখেছেন এমন আচরণ। তারা প্রতিদিন দেখেন যে সরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকগণ ডেপুটেশনে ডিজি/বোর্ড অফিসে এসে হঠাৎ বস হয়ে কেমন খারাপ আচরণ করেন বেসরকারি শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান প্রদানগণের সঙ্গে!

সরকারি স্কুল-কলেজে কর্মরত শিক্ষকগণও চরম অবমূল্যায়ন করে থাকেন বেসরকারি শিক্ষকদের। সরকারি স্কুলের একজন সাধারণ শিক্ষক বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষ স্যারকেও স্যার বলতে অনীহা দেখান। আর যারা সরকারি স্কুল-কলেজের হেডস্যার, প্রিন্সিপাল স্যার, তারা তো আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে। কেউ যদি শিক্ষা কর্মকর্তা হতে পারেন তো তিনার ভাবসাবই হয়ে যায় অন্যরকম! যেন সাক্ষাৎ ব্রাহ্মণ বনে গেছেন তিনি! কী বলবেন, কী করবেন, নিজেই ঠিক করতে পারেন না! বেসরকারিদের উপর ছড়ি ঘোরানোর জন্যই যেন তিনি নাযিল হয়েছেন।

কিছু ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। আমার নিজের দেখা অতি উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা আছেন যিনি শিক্ষকদের অত্যন্ত সম্মান করেন। সকল শিক্ষককেই সমীহ করেন, সরকারি-বেসরকারি আলাদা করেন না। এমনকি তিনার সন্তানকে প্রাইভেট পড়াতে বাসায় আসা হাউস টিউটরকেও স্যার বলে সম্বোধন করেন। শুধু শিক্ষকগণকেই নয়, সবাইকেই সম্মান করেন তিনি। তিনাকেও সম্মান করেন সবাই। সেই সম্মান ভয়ে নয়, শ্রদ্ধায় পরিপূর্ণ। তিনি যেমন মন থেকে সম্মান করেন সবাইকে, সবাই তেমনি মন থেকেই শ্রদ্ধা করেন তিনাকে। এটি-ই প্রকৃত শ্রদ্ধা, প্রকৃত সম্মান। ভয়ে স্যার বলায়, সালাম দেয়ায়, কুর্নিশ করায় প্রকৃত শ্রদ্ধা নেই, আন্তরিকতা নেই, পূণ্য নেই। প্রকৃত সম্মানেই আনে প্রকৃত সম্মান। এমনই তো হওয়া উচিত সকলের। তিনি ব্যতিক্রম হবেন কেন?

যিনি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী হয়েছেন বলে অহংকার করেন, দেমাগ দেখান, ভাব ধরেন তিনিইতো ব্যতিক্রম হবার কথা। যে সকল সরকারিরা নিজেকে উত্তম ভাবেন, অন্যকে অধম ভাবেন, অসম্মান করেন, হয়রানি করেন, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন, খারাপ আচরণ করেন, তারাই তো নগণ্য হবার কথা। মানুষের সংজ্ঞায় প্রকৃতপক্ষে তারাই তো অধম! অবশ্যই প্রয়োজন তাদের এই মানসিকতার পরিবর্তন এবং সেইসাথে প্রয়োজন বেসরকারি শিক্ষকগণের জীবনমান ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদার উন্নয়ন।

মো. রহমত উল্লাহ: কলাম লেখক, সাহিত্যিক এবং অধ্যক্ষ -কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।


পত্রিকার লিংক

Previous Post
Next Post

About Author

0 মন্তব্য(গুলি):