বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি
আমাদের বার্তা, ২৩ আগস্ট ২০২২
মো. রহমত উল্লাহ্
'দুই ভাগে হোক বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ' শিরোনামে গত বছরের ১৪ আগস্টে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে আমি লিখেছিলাম, 'বেসরকারি শিক্ষকদের বদলির দাবিটি তাদের প্রয়োজনের দিক থেকে খুবই মানবিক ও যৌক্তিক। দীর্ঘদিন ধরে এই দাবিতে সোচ্চার বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষকরা। এ কারণেই একাধিক এমপিও নীতিমালায় বদলির প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে একটি সুষ্ঠু নীতিমালা তৈরির মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি বাস্তবায়ন করার জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু, কেন জানি- দীর্ঘ দিনেও তা সম্ভব হচ্ছে না বা করা হচ্ছে না! যতক্ষণ পর্যন্ত বদলির নীতিমালা প্রনয়ণ ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না - ততক্ষণ পর্যন্ত অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ দেওয়া উচিত। কেননা, তারা আগে নিয়োগ পেয়েছেন এবং অনেকদিন ধরে কষ্ট করে দূরে চাকরি করছেন। কোন ভাবেই নতুন নিয়োগ প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামানো উচিত নয় বদলিপ্রত্যাশী বিদ্যমান এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের।
বর্তমান নিয়োগ প্রক্রিয়াকে বিভক্ত করতে হবে দুইভাগে। প্রতিবছর বা প্রতিবার পৃথক ভাবে সম্পন্ন করতে হবে দু'টি নিয়োগ প্রক্রিয়া। প্রথমে প্রদান করতে হবে শুধুমাত্র এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের জন্য বিশেষ বিজ্ঞপ্তি। এক্ষেত্রে কোন নতুন প্রার্থী আবেদন করতে পারবেন না। কেবলমাত্র বিদ্যমান এমপিওভুক্ত নিবন্ধিত শিক্ষকরা আবেদন করতে পারবেন। এদের পুনঃনিয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন সম্পন্ন করার পরবর্তীতে চিহ্নিত করতে হবে শূন্য পদ। সেই শূন্য পদে নতুনদের নিয়োগের জন্য প্রকাশ করতে হবে গণবিজ্ঞপ্তি। সেক্ষেত্রে কোন এমপিওভুক্ত শিক্ষক আবেদন করতে পারবেন না। শুধুমাত্র নিবন্ধিত প্রার্থীরা আবেদন করবেন। তাদের নিয়োগের মাধ্যমে বিদ্যমান শূন্যপদসমূহ পূর্ণ করা সম্ভব হবে। এভাবে প্রতিবছর বা প্রতিবার বিদ্যমান এমপিওভুক্ত নিবন্ধিত শিক্ষকদের পুনঃনিয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের জন্য একটি এবং শুধু নিবন্ধিত প্রার্থীদের নতুন নিয়োগের জন্য একটি অর্থাৎ মোট দু'টি নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হলে অবশ্যই অনেকাংশে পূর্ণ হবে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বদলিপ্রত্যাশী লাখ লাখ শিক্ষকের দাবি। সেই সাথে নিয়োগ পাবেন অধিক সংখ্যক নতুন প্রার্থী এবং পূর্ণ হবে অধিক শূন্য পদ।'
যেহেতু বিদ্যমান বিধিবিধানের আওতায় বেসরকারি শিক্ষকদের সরাসরি বদলি করা সম্ভব নয় এবং যেহেতু বদলির জন্য নতুন নীতিমালা প্রণয়নের লক্ষ্যে এখনো সরকারি কোন কমিটি গঠন করা হয়নি, সেহেতু তাদের সরাসরি বদলির সুযোগ সৃষ্টির সম্ভাবনা অনিশ্চিত। তাই মন্দের ভালো হিসেবে উল্লেখিত লেখায় উত্থাপিত প্রস্তাবের সমর্থনেই ঐক্যবদ্ধ বদলিপ্রত্যাশী বেসরকারি শিক্ষকরা। সরাসরি বদলির বিকল্প পন্থাসমূহের মধ্যে এটিকেই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মনে করেন তারা। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অন্যান্য বিবেকবান মানুষও অধিক যুক্তিযুক্ত মনে করেন এই প্রস্তাব। উল্লেখিত প্রক্রিয়ায় দু'টি পৃথক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে প্রথমে এমপিওভুক্ত নিবন্ধনধারী শিক্ষকদের এবং পরবর্তীতে শুধুমাত্র নিবন্ধনধারী প্রার্থীদের নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি এনটিআরসিএ কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে বলে 'ইনডেক্সধারীদের নিয়োগ আলাদা প্রক্রিয়ায়' শিরোনামে একটি সংবাদ গত ২২ আগস্ট ২০২২ তারিখের দৈনিক শিক্ষায় প্রকাশিত হলে বদলি প্রত্যাশীরা আশায় বুক বেঁধেছিলেন। কিন্তু গত ১২ অক্টোবর ২০২২ তারিখের দৈনিক শিক্ষায় প্রকাশিত অপর একটি প্রতিবেদনে চরমভাবে আশাহত হয়েছেন বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষকরা। যার শিরোনাম- 'প্রস্তাবেই আটকা ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের আলাদা নিয়োগ'। জানা যায়, কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সহজ ও প্রাপ্য সুযোগটিও পাচ্ছেন না বদলিপ্রত্যাশীরা। এদিকে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের জন্য চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আয়োজন চলছে। তাতে প্রতীয়মান হচ্ছে, এই গণবিজ্ঞপ্তির পূর্বে শুধুমাত্র ইনডেক্সধারী নিবন্ধিত শিক্ষকদের জন্য পৃথকভাবে বিশেষ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সম্ভাবনা নেই। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষকগণের জন্য এটি অবশ্যই অত্যন্ত দুঃসংবাদ ও পরিতাপের বিষয়! আরো বৃদ্ধি পেল তাদের বুকে জমে থাকা দীর্ঘদিনের পাথরচাপা কষ্ট!
সর্বশেষ তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তির নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দেখা গেছে যে, নতুন নিয়োগ প্রত্যাশী নিবন্ধনধারীদের সাথে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পুনঃনিয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ দেওয়ার কারণে নিয়োগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন নতুন প্রার্থীরা। অপরদিকে বিদ্যমান এমপিওভুক্ত নিবন্ধনধারী শিক্ষকদের সাথে নতুনদের আবেদন করার সুযোগ দেওয়ার কারণে তারা অনেকেই পুনঃনিয়োগ পাননি বিধায় যেতে পারেননি কাঙ্ক্ষিত প্রতিষ্ঠানে। তারা বঞ্চিত হয়েছেন পরোক্ষ বদলির এই ন্যূনতম সুযোগ থেকে। ক্ষতির শিকার হয়েছেন উভয়পক্ষই। অপরদিকে বেশ কিছু ইনডেক্সধারী শিক্ষক এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যাওয়ার কারণে শূন্য পদের অবস্থান পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। ফলে প্রায় ৮৯ লাখ আবেদন নিয়ে বিশাল নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পরেও শূন্য পদ রয়েছে প্রায় ৫০ হাজার। যা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়! ক্ষতির শিকার হয়েছে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ সংঘটিত হয়েছে ত্রিমুখী ক্ষতি! এরূপ অযৌক্তিক প্রক্রিয়া চলতে থাকলে বারবার তৈরি হবে এমন চিত্র! বারবার প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন থেকে বঞ্চিত হবেন অনেক শিক্ষক, বারবার নিয়োগ থেকে বঞ্চিত হবেন অনেক নতুন প্রার্থী, বারবার শূন্য থেকে যাবে অনেক অনেক পদ, প্রতিবারই অসন্তোষ বাড়তে থাকবে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের উপর; যা কারও কাম্য নয়।
অপরদিকে এটিও মনে রাখতে হবে, আগামী ২০২৩ সাল থেকে আমরা যে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছি শিক্ষকগণ সেই মননশীল কর্মযজ্ঞের অগ্রবর্তী সৈনিক। শিক্ষকদের মনে আনন্দ না থাকলে শিক্ষার্থীদের জন্য আনন্দঘন শিক্ষার পরিবেশ মোটেও তৈরি করা সম্ভব হবে না। নিশ্চয়ই বিপুল অর্থ ব্যয় হবে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের জন্য। তার কতটা বেসরকারি শিক্ষকদের ভাগ্যে নতুন করে আসবে তা আমরা জানি না, যদিও তা অত্যাবশ্য। অথচ কোনরূপ সরকারি অর্থ ব্যয় ব্যতীত তাদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ তথা বদলির সুযোগ দিয়ে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কষ্ট থেকে কিছুটা মুক্তি দেয়া এবং শিক্ষাক্ষেত্রে কিছুটা আনন্দঘন পরিবেশ যুক্ত করা সম্ভব। যারা এ বিষয়টিকে গুরুত্বহীন ভাবছেন তারা নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে তথা শিক্ষার মানোন্নয়নে কতটা আন্তরিক সে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
লেখক: শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক
আমাদের বার্তা, ২৩ আগস্ট ২০২২
0 মন্তব্য(গুলি):