জাতীযকরণ: শিক্ষাব্যবস্থা বনাম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সমকাল, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১

জাতীয়করণ: শিক্ষাব্যবস্থা বনাম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

মো. রহমত উল্লাহ্‌

অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।

প্রকাশ: দৈনিক সমকাল, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১


বেশ কিছুদিন ধরে আমাদের দেশের বেসরকারি শিক্ষক সমাজে সর্বাধিক উচ্চারিত দাবি হচ্ছে 'শিক্ষাব্যবস্থা' জাতীয়করণ। বিশেষ করে ২০২০ সাল ছিল এই দাবি উচ্চারণের উল্লেখযোগ্য বছর। তখন মনে হয়েছে, এই দাবিতে প্রতিযোগী মনোভাব নিয়ে সোচ্চার ও সক্রিয় আমাদের বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন। কেউ মাঠে সক্রিয়, কেউ ফেসবুকে। দাবি একটাই, 'শিক্ষাব্যবস্থা' জাতীয়করণ।


বেশিরভাগ শিক্ষক সংগঠনের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের মনোভাব এমন যেন এখনই 'শিক্ষাব্যবস্থা' জাতীয়করণ হয়ে যাবে আর এর কৃতিত্ব নিজের ঘরে তুলতে হবে যে করেই হোক। সুতরাং চুপ করে থাকলে চলবে না। মুখ খুলতে হবে, স্ট্যাটাস দিতে হবে, কর্মসূচি দিতে হবে। যে করেই হোক, এই স্রোতের পক্ষেই থাকতে হবে। তা না হলে শিক্ষকপ্রিয়তা হারাতে হবে। এই যখন অবস্থা তখন আমাদের জাতীয় সংসদেও উত্থাপিত হয়েছে এ ইস্যুটি।


শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ ইস্যুতে জাতীয় সংসদে খুব পরিস্কার বক্তব্য দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সব এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানকে সরকারীকরণ না করার কারণ জানিয়ে তিনি বলেছেন, 'স্কুল করার একটা নিয়ম আছে। অনেকে সেই নিয়ম মানেননি। যেখানে-সেখানে যখন-তখন একটা স্কুল খুলে ফেলেছেন। হয়তো ছাত্রছাত্রীই নেই সেখানে। এ রকমও আছে, ছাত্রছাত্রীদের থেকে শিক্ষকের সংখ্যাও বেশি। নিয়মটা স্কুল এবং মাদ্রাসা সবার জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য।' এর আগেও জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারীকরণ করা হবে।


শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিও বলেছেন, 'শিক্ষাব্যবস্থা' পুরোটাই সরকারি হতে হবে- এমন কোনো কথা নেই। আমরা প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করেছি। আমাদের মাধ্যমিকে প্রায় ৩২ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, যার বেশিরভাগই বেসরকারি। সবগুলোকে সরকারি করা খুবই বড় ব্যাপার। তা ছাড়া পুরোটা সরকারি হতে হবে- এমন কোনো কথা নেই। যারা বেসরকারি আছে, সেখানেও পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ আছে। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন দেওয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন করে দেওয়া, শিক্ষার্থীদের বই দেওয়া, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, ল্যাব করে দেওয়া এসব দায়িত্ব কিন্তু সরকারেরই।


'শিক্ষাব্যবস্থা' জাতীয়করণ স্লোগানটির অর্থ খুবই অস্পষ্ট। এটি স্পষ্ট করার কথা আমি বিভিন্ন সময়ে সভা-সেমিনার ও টকশোতে বলেছি। শিক্ষাব্যবস্থাকে ইংরেজিতে বলা হয় এডুকেশন সিস্টেম। যেমন সমাজব্যবস্থা হচ্ছে সোশ্যাল সিস্টেম। একটা সিস্টেম বা ব্যবস্থাকে কীভাবে জাতীয়করণ করা সম্ভব তা আমার বোধগম্য নয়। শিক্ষার অগণিত ক্ষেত্র ও উন্মুক্ত পরিধির মতোই শিক্ষাব্যবস্থা ব্যাপক বিস্তৃত ও সম্প্রসারণশীল।


যদি অন্যদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আমিও বলি, 'শিক্ষাব্যবস্থা' জাতীয়করণ মানে হচ্ছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ সরকারীকরণ; তাহলেও কয়েকটা প্রশ্ন এসে দাঁয়ায় : কোন কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারীকরণের জন্য আমরা দাবি করছি? কোন স্তর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারীকরণের জন্য আমরা দাবি করছি? অগণিত কেজি স্কুল ও কওমি মাদ্রাসা থেকে শুরু করে হাইস্কুল, কলেজ, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সবই কি সরকারি করার দাবি আমাদের? নাকি কোনো বিশেষ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি করার দাবি করছি আমরা?


প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করা হয়েছে (যদিও প্রাথমিক স্তরের অগণিত কেজি স্কুল ও বিভিন্ন মাদ্রাসা এখনও প্রাইভেট রয়ে গেছে এবং আরও নতুন নতুন তৈরি হচ্ছে)। এখন কি আমরা মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করতে চাই? নাকি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত জাতীয়করণ করতে চাই? নাকি উচ্চশিক্ষাসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করতে চাই? এ বিষয়টি পরিস্কার বলা হয়নি আগে কখনোই। প্রায় সবাই শুধু একই স্লোগান দিয়েছেন ও দিচ্ছেন, একযোগে 'শিক্ষাব্যবস্থা' জাতীয়করণ চাই।


শিক্ষামন্ত্রী বলছেন, শুধু মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি করাই খুব বড় ব্যাপার। অন্যদিকে পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম বলেছেন, 'এমন একটা সময় আসবে যখন দেশে কোনো বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকবে না। সব সরকারি করা হবে। ধাপে ধাপে আমরা এগুচ্ছি।'


শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যে একটা ইঙ্গিত লক্ষণীয় যে, তিনি মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সরকারীকরণ তথা মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক ও সার্বজনীন করার সক্ষমতা-সম্ভাব্যতা বিবেচনা করছেন। অথচ প্রতি উপজেলায় একটি করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি করার ক্ষেত্রে তার এই মনোভাবের বাস্তবায়ন লক্ষ্য করা যায়নি। বরং সে ক্ষেত্রে পানিসম্পদ উপমন্ত্রীর বক্তব্যের কিছুটা বাস্তবায়ন লক্ষ্য করা গেছে। অর্থাৎ শিক্ষা অবৈতনিক ও সার্বজনীন করার ক্ষেত্রে সরকার কোন দিকে এগুচ্ছে, তা আমাদের কাছে অস্পষ্ট।


শিক্ষানীতি অনুসারে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার স্তর যদি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত হতো; তাহলে হয়তো সে পর্যন্ত শিক্ষা বাধ্যতামূলক, অবৈতনিক ও সার্বজনীন হয়ে যেত অনেক আগেই। এখন আরও কিছুটা খাটো হতো আমাদের দাবির পরিধি। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। অবৈতনিক শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে আমাদের উপবৃত্তিবহির্ভূত শিক্ষার্থীরা এবং অসচ্ছল জীবনযাপন করছেন বেসরকারি শিক্ষকরা। তাই অত্যন্ত যৌক্তিকভাবেই উত্থাপিত হচ্ছে শিক্ষা অবৈতনিক তথা জাতীয়করণের দাবি।


ইদানীং অবশ্য কেউ কেউ শুধু এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সরকারীকরণকেই 'শিক্ষাব্যবস্থা' জাতীয়করণ বোঝাতে চাচ্ছেন। তাতে নাখোশ হচ্ছেন অন্যরা। আবার কেউ কেউ বলছেন, প্রাথমিকের মতো মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি করা হোক। তাতে আবার নাখোশ হচ্ছেন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। পরস্পর বিরোধী এমন মনোভাব অবশ্যই দাবি আদায়ের অন্তরায়।


আরও গণমুখী করা উচিত আমাদের দাবি উত্থাপনের ভাষা ও কৌশল। শিক্ষা অবৈতনিক ও সার্বজনীন করার দাবির কথা শুনলেই শিক্ষকদের সঙ্গে যোগ দিতে আসবেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবক। শুধু শিক্ষক চাইলে হবে না। অভিভাবকদের চাইতে হবে, ছাত্রদের চাইতে হবে, নেতাদের চাইতে হবে। সে লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে। নির্ধারিত করা প্রয়োজন যোগ্য নেতৃত্ব, দাবি আদায়ের উত্তম কৌশল ও সঠিক আন্দোলনের রূপরেখা।


যতটুকু চাই, ততটুকু চাওয়া উচিত যৌক্তিকভাবে, সমস্বরে, একই স্লোগানে, একতাবদ্ধ হয়ে। মনে রাখা জরুরি, সব স্তরের শিক্ষা অবৈতনিক ও সার্বজনীন করার বৃহত্তর দীর্ঘমেয়াদি দাবির পাশাপাশি অবশ্যই সোচ্চার থাকতে হবে আমাদের এখনই প্রাপ্য বাড়ি ভাড়া ভাতা, চিকিৎসা ভাতা, উৎসব ভাতা, অন্যান্য ভাতা ও পেনশন সুবিধার ব্যাপারে। তা ছাড়া বদলি ব্যবস্থা চালু করা, কমিটি প্রথা বাতিল করা বা উচ্চশিক্ষিতদের কমিটিতে যুক্ত করা, অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করা ইত্যাদি দাবিতেও থাকা উচিত সক্রিয়। শুধু সভা, সেমিনার, ফেসবুকে নয়; যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবেও উপস্থাপন করা আবশ্যক আমাদের সব দাবি-দাওয়া। সেইসঙ্গে প্রয়োজন প্রত্যেকের পেশাগত উৎকর্ষ সাধন।


দায়িত্বশীলদের বক্তব্য অনুসারে এটি পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে যে, আমাদের দেশের সব স্তরের সম্পূর্ণ শিক্ষা জাতীয়করণ প্রায় অসম্ভব। কোনোভাবে সম্ভব হলেও এটি হবে একটি দীর্ঘমেয়াদি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই দূর ভবিষ্যতে সরকারীকরণের আশায় এখন এসব পাওনা ছেড়ে দিয়ে বসে থাকলে চলবে না। কোনোভাবেই যেন হালকা হয়ে না যায়, আড়ালে পড়ে না যায়, আমাদের সব স্তরের এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের এসব দাবির স্লোগান এবং নতুন করে আরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার দাবি। একেকটি দাবি আদায় করা মানেই জাতীয়করণে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া।


[আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে অবশ্যই সব যৌক্তিক দাবি আদায় করা সম্ভব। যেখানে ঐক্য নেই, সেখানে বিজয় নেই। দল, মত, পথ, যাই থাকুক, এক দাবিতে একাট্টা থাকা উচিত সবাই। তাহলেই আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নীতিমালা প্রণয়ন করে শিক্ষা অবৈতনিক ও সর্বজনীন করার জন্য দ্রুত এগিয়ে আসবে সরকার।]


https://samakal.com/chaturango/article/210252873/%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%80%E0%A7%9F%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A6%A3--%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%AC%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A6%BE-%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%AE-%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%BE%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%A0%E0%A6%BE%E0%A6%A8

Previous Post
Next Post

About Author

0 মন্তব্য(গুলি):