বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও সদস্যদের শিক্ষাগত যোগ্যতা। ভোরের কাগজ, 9 ডিসেম্বর 2020

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটি

সভাপতি ও সদস্যদের শিক্ষাগত যোগ্যতা

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৮, ২০২০ , ১০:১০ অপরাহ্ণ আপডেট: ডিসেম্বর ৮, ২০২০ , ১০:১০ অপরাহ্ণ, ভোরের কাগজ

দলের সক্রিয় নেতাকর্মীকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও সদস্য করতে হবে তারও কোনো যুক্তি নেই। এলাকার আদর্শবান বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও সদস্য করাই অধিক মঙ্গলজনক। তারা হতে পারেন নিরপেক্ষ বা দলের সমর্থক। তবে অবশ্যই হতে হবে ন্যূনতম ডিগ্রি পাস এবং চল্লিশোর্ধ্ব বয়স।

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির ওপর শিক্ষকদের অসন্তোষের অন্ত নেই। অধিকাংশ কমিটির সদস্যদের দৌরাত্ম্য, ক্ষমতার অপব্যবহার, অযাচিত হস্তক্ষেপ ইত্যাদি এর প্রধান কারণ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সভাপতির অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক আচরণে অতিষ্ঠ সবাই। প্রতিটি বিষয়ে সভাপতি এত বেশি হস্তক্ষেপ করেন যেন তিনিই প্রতিষ্ঠান প্রধান। অধ্যক্ষ, সুপার বা প্রধান শিক্ষক যেন তার আদেশের গোলাম। অনেকেই জানেন না, মানেন না কোনো নিয়মকানুন। যা ইচ্ছা তাই করতে বলেন। এসব করলেও বিপদ, না করলেও বিপদ! চাকরি যায় অধ্যক্ষ, সুপার বা প্রধান শিক্ষকের। মান তো যায়ই, জানও যেতে পারে কোনো কোনো সময়। যারা দুর্নীতিবাজ তাদের কথা আলাদা। এমন অনেক সভাপতি ও সদস্য আছেন যারা নিজেদের মনে করেন প্রতিষ্ঠানের মালিক এবং শিক্ষকরা তাদের কেনা কাজের লোক। মন চাইলে বেতন দেবেন, মন না চাইলে দেবেন না। যা খুশি বলবেন, করবেন। ইচ্ছা হলে রাখবেন, ইচ্ছা না হলে রাখবেন না। শুধু তারা নয়, তাদের অধিকাংশ ভাইবোন, বিবি-বাচ্চা, সাঙ্গোপাঙ্গরাও দেখান ক্ষমতা, করেন খারাপ আচরণ। এমনকি তাদের যে সন্তান এখনো স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় পড়ে সেও ভাব দেখায় শিক্ষকদের সঙ্গে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অমান্য করে শিক্ষকদের আদেশ-নির্দেশ।
এমন অনেক উদাহরণ হয়তো আছে সারাদেশে, পরীক্ষায় ফেল করা সাবেক ছাত্র এখন কমিটির সদস্য বা সভাপতি। সেই ছাত্ররাই এখন পরিচালনা করে প্রতিষ্ঠান, শাসন করে শিক্ষকদের। অনেক ফেল করা, বেয়াদবি করা, মস্তানি করা ছাত্ররা এখন বসে প্রতিষ্ঠানের বড় বড় চেয়ারে। অর্থাৎ স্যারদের ফেল করা ছাত্রই এখন স্যারদের স্যার! কী অবাক ব্যাপার! কী অসহ্য ব্যাপার! এসব মেনে নিয়েই চাকরগিরি করতে হয় উচ্চশিক্ষিত শিক্ষকদের। প্রতিবাদ করতে গেলে, প্রতিকার চাইতে গেলে, পিটিয়ে তাড়িয়ে দেবেন। তাই হাসি মুখ করে বলতে হয়, না না কোনো সমস্যা নেই, খুব ভালো আছি! এই হলো আমাদের দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের প্রায় সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দীর্ঘদিনের বাস্তবতা। আমি যদি সত্যি সত্যিই বলি, আমাদের প্রতিষ্ঠানে তেমন খারাপ কিছুই হচ্ছে না, আমরা আসলেই ভালো আছি, তো এই কথা বিশ্বাস করার মতো শিক্ষক সারাদেশে খুব কমই পাওয়া যাবে। শিক্ষকদের মনের অবস্থা যদি এমন থাকে তো শিক্ষা কেমন হবে তা ভাবনার বিষয়!

দূর অতীতে এমন এক সময় ছিল যখন এলাকার ধনাঢ্য ব্যক্তিরা নিজেদের উদ্যোগে, নিজেদের অর্থে, নিজেদের সম্পদে, নিজেদের জমিতে, নিজেদের চেষ্টায় সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ মনোভাব নিয়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে কোনো লাভ পাওয়া, পদ পাওয়া, ক্ষমতা পাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল না তাদের। নিজের এলাকার, সমাজের, দেশের মানুষের শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করাই ছিল তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। জাতিকে শিক্ষিত করা, কর্মক্ষম করা, সমৃদ্ধ করা, উন্নত করা, আধুনিক করার মনোভাব ছিল তাদের। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তারা দিতে আসতেন, নিতে আসতেন না। খাওয়াতে আসতেন, খেতে আসতেন না। শুধু শিক্ষক-কর্মচারীদের নয় শিক্ষার্থীদেরও খাওয়াতেন চিড়া, মুড়ি, বাতাসা ও বিস্কুট। প্রয়োজনে নিজের পকেট থেকে দিতেন শিক্ষকদের সম্মানী। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নিতেন না কোনো ফি। সেসব ত্যাগী মানুষরাই তখন পরিচালনা করতেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষকদের প্রতি তাদের যেমন ছিল সর্বোচ্চ সম্মান, তেমনি শিক্ষার্থীদের প্রতিও ছিল অফুরন্ত দরদ। বর্তমানে তেমন নিঃস্বার্থ ক’জন আছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায়? অতীতের মতো কি দায়িত্ব পালন করে বর্তমান কমিটি? শিক্ষক-শিক্ষার্থী তথা শিক্ষার কি কল্যাণ সাধন করেছেন তারা?

বাস্তবতা হচ্ছে, কমিটির প্রয়োজন থাকুক বা না থাকুক, বিদ্যমান বিধিমালায় সরাসরি কমিটির অধীনেই চাকরি করতে হচ্ছে বেসরকারি শিক্ষকদের। আরো একটি বাস্তবতা হচ্ছে, যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে সে দলের নেতাকর্মীরাই থাকেন পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও সদস্য। অনেকেই মনে করেন, তারা উচ্চশিক্ষিত হলে, শিক্ষাবান্ধব হলে, কিছুটা সহায়ক ভ‚মিকা পালন করতে পারতেন শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে। তাদের দ্বারা এত বেশি অপমানিত হতেন না শিক্ষকরা। তারা কিছুটা হলেও বুঝতেন, রাখতেন শিক্ষকদের মর্যাদা। কমবেশি মানসম্পন্ন হতো তাদের কথা ও কাজ। কিছুটা হলেও জানতেন, মানতেন, সরকারি ও প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মকানুন। শিক্ষার সংজ্ঞা ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে থাকত ন্যূনতম ধারণা। কম বেশি বুঝতেন, শিক্ষকতা একটি উঁচু মাপের মননশীল কাজ। এর জন্য অবশ্যই প্রয়োজন শিক্ষকদের মানসিক প্রশান্তি, সার্বিক নিরাপত্তা, ব্যক্তিগত সম্মান ও আর্থিক সচ্ছলতা।

এসব বিষয় তথা শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করেই শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে প্রাথমিক ও স্নাতক/স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির সদস্যদের। উভয় ক্ষেত্রেই সভাপতির শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে ন্যূনতম ডিগ্রি পাস। অথচ গত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আইনি নোটিস দেয়ার পরও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়নি এখনো। যা অত্যন্ত অযৌক্তিক ও দুঃখজনক! এ পর্যায়ের স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় সভাপতি ও সদস্য হওয়ার জন্য এখনো কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রয়োজন নেই। এমনকি নেই কোনো বয়সের বার। ফলে সরকারি দলের অধিকাংশ অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত অল্পবয়স্ক নেতাকর্মীরা এখন জেঁকে বসেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। দলের প্রভাব খাটিয়ে বারবার হচ্ছে কমিটির সভাপতি ও সদস্য। দুর্দান্ত প্রতাপে তারা দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে প্রতিষ্ঠান প্রধান ও সম্মানিত শিক্ষকদের। অসহায় শিক্ষকরা মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলতে বাধ্য হচ্ছেন ‘খুব ভালো আছি’। আর তাদের অন্তরে অবস্থিত অদেখা ক্ষোভ গিয়ে পড়ছে বর্তমান সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর ওপর। এটি মোটেও শুভ লক্ষণ নয়! শিক্ষকদের মনে ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়া এই ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাঝে। মনের কষ্টে পাঠদানে আগ্রহ হারাচ্ছেন শিক্ষকরা। সঠিকভাবে গঠিত হচ্ছে না শিক্ষার্থীদের সুস্থ মন। পূর্ণতা পাচ্ছে না শিক্ষার সংজ্ঞা। অথচ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী বড় দলে তো সুশিক্ষিত লোকের কোনো অভাব নেই। তাছাড়া দলের সক্রিয় নেতাকর্মীকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও সদস্য করতে হবে তারও কোনো যুক্তি নেই। এলাকার আদর্শবান বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও সদস্য করাই অধিক মঙ্গলজনক। তারা হতে পারেন নিরপেক্ষ বা দলের সমর্থক। তবে অবশ্যই হতে হবে ন্যূনতম ডিগ্রি পাস এবং চল্লিশোর্ধ্ব বয়স। যেন কিছুটা হলেও রক্ষা পায় শিক্ষকের সম্মান, কিঞ্চিৎ হলেও উন্নত হয় শিক্ষার পরিবেশ। আশা করি বিষয়টি শিগগিরই বিবেচনা করবে বর্তমান সরকারের শিক্ষা প্রশাসন।

মো. রহমত উল্লাহ : লেখক ও শিক্ষক।
rahamot21@gmail.com


মূল পত্রিকার লিংক

Previous Post
Next Post

About Author

0 মন্তব্য(গুলি):