- মো. রহমত উল্লাহ্
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন প্রয়োজন
সম্প্রতি অসংখ্য ধর্ষণ ও বলাৎকার সংবাদে বিব্রত, লজ্জিত, মর্মাহত ও বিক্ষুব্ধ সমগ্র জাতি। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে দলমত নির্বিশেষে যখন সোচ্চার দেশের নারী-পুরুষ উভয়ই, তখন গত ১৩ অক্টোবর ২০২০ তারিখে এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের স্থলে ‘মৃত্যুদণ্ড’ বা ‘যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’ নির্ধারণ করেছে বর্তমান সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগ্রহেই দ্রুত জারি হয়েছে এই অধ্যাদেশ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, এ্যাসিড নিক্ষেপকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। কারণ, সেখানে আমরা আইন সংশোধন করেছিলাম। পার্লামেন্টে অনুমোদনের পর এটি আইনে পরিণত হয়েছে ইতোমধ্যে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ধর্ষণ একটা পাশবিকতা, মানুষ পশু হয়ে যায়। যার কারণে আমাদের মেয়েরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সে জন্য আমরা ধর্ষণ করলে যাবজ্জীবনের সঙ্গে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইনটি সংশোধন করে পাস করেছি। এ বিষয়ে অল্প কথায় প্রায় সব কথাই বলে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁকে সাধুবাদ জানিয়েছেন সর্বস্তরের মানুষ।
এদিকে এই অধ্যাদেশ জারির পর পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক কথা ও একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে বার বার। তা হলো-ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হলে বলাৎকারের শান্তি কি? বলাৎকারও তো ধর্ষণের মতোই জঘন্যতম অপরাধ। সকল ধর্মেই বলা আছে তা। বাস্তবে ধর্ষণের চেয়েও বেশি মাত্রায় এটি সংঘটিত হচ্ছে আমাদের দেশে। বিশেষ করে কিছু আবাসিক মাদ্রাসা ও আবাসিক কর্মস্থলে প্রতিনিয়ত বলাৎকারের শিকার হচ্ছে অনেক নিষ্পাপ ছেলেশিশু! যার প্রায় শতভাগই থেকে যাচ্ছে গোপন। দারিদ্র্য, লোকলজ্জা, সামাজিক মর্যাদা হানি, কর্ম/ছাত্রত্ব হারানোর ভয় ইত্যাদি কারণে মুখ খুলে না নির্যাতিত শিশু ও তার পরিবার। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এসব অবুঝ শিশু ও তাদের অধিকাংশ অভিভাবক জানেই না এই অপরাধের শাস্তি কি বা আদৌ কোন শাস্তি আছে কি না? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই কেউ কেউ উত্তর দিয়েছেন এই প্রশ্নের। বলেছেন- ধর্ষণ ও বলাৎকারের শাস্তি একই। কেননা, যা ধর্ষণ তা-ই বলাৎকার। এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন অনেকেই। আর এ কারণেই এই লেখার সূত্রপাত।
আভিধানিক বা আইনগত অর্থ যা-ই থাকুক, সমাজের প্রায় সর্বস্তরের মানুষ ধর্ষণ ও বলাৎকার এই দুটি শব্দের প্রায়োগিক অর্থ এক মনে করে না, বলাৎকার বলতে শিশুর বা নারীর বা পুরুষের বা হিজড়ার পায়ুপথে পুরুষাঙ্গ দ্বারা নির্যাতন করা বুঝে থাকে। আর ধর্ষণ বলতে মেয়ে শিশুর বা নারীর গোপনাঙ্গে নির্যাতন করা বুঝে থাকে। আমাদের সাহিত্যে, পত্রপত্রিকায় এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতেও এ দুটি অপকর্মকে এরূপ পৃথকভাবে ধর্ষণ ও বলাৎকার বোঝানো হয়ে থাকে। গুগল এবং ইউটিউবেও তাই দেখা যায়। সবার ধারণায় এবং মুখেমুখেও তাই প্রচলিত আছে। এটি একটি ভাল দিক যে, এ দুটি শব্দের প্রায়োগিক অর্থকে আমরা সর্বজনীনভাবে আলাদা করতে পেরেছি। এতে আমাদের বাংলা ভাষার সুনির্দিষ্টকরণ শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। যে আইনটিতে এখন ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড সংযুক্ত করা হয়েছে, সেই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ৯ ধারাতেও সরাসরি মেয়েদের বা নারীদের কথাই বলা হয়েছে। যেমন, ‘যদি কোন পুরুষ কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন তা হইলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হইবেন।’ সেখানে এর ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে এভাবে-‘যদি কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত [ষোলো বছরের] অধিক বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে ও ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তাহার সম্মতি আদায় করিয়া, অথবা [ষোলো বছরের] কম বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন।’ এই আইনে ‘নারী’ অর্থ যে কোন বয়সের নারী এবং ‘শিশু’ অর্থ অনধিক ষোলো বছর বয়সের কোন ব্যক্তি। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, এই আইনের ব্যাখ্যার শুরুতেই বলা হয়েছে ‘যদি কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত অর্থাৎ, এখানে পরিষ্কার মেয়ে বা নারীকেই বোঝানো হয়েছে। কেননা, ছেলে বা পুরুষের সঙ্গে পুরুষের বিবাহ বন্ধন সম্ভব নয়। যদিও শিশু বলে ছেলেমেয়ে উভয়কেই বোঝানো সম্ভব ছিল। এখানে তাও করা হয়নি। বার বার বলা হয়েছে, নারীর সহিত, নারীর সহিত, নারীকে। এখানে ধর্ষণ বলতে ছেলে বা পুরুষকে বলাৎকার বোঝার কোন সুযোগ নেই। জানা মতে, আমাদের দেশের আদালতেও ধর্ষণ এবং বলাৎকার এ দুটিকে পৃথকভাবেই উপস্থাপন করা হয়। এমনকি এসব মামলার রায়েও ধর্ষণকে বলাৎকার এবং বলাৎকারকে ধর্ষণ বলে অভিহিত করা হয়েছে এমন কোন সংবাদ দেখিনি। প্রায় সবাই মনে করে বলাৎকার ধর্ষণের মতো বড় অপরাধ নয়। সাধারণ মানুষের ধারণাও এমনই। ধর্ষণের প্রতিবাদে মিছিল, মিটিং, পোস্টার, লিফলেট, লেখালেখি ইত্যাদি হলেও বলাৎকারের প্রতিবাদে কিন্তু এসব হয়নি, হচ্ছে না। তাই তারা ধরেই নিচ্ছে যে, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হলেও বলাৎকারের শাস্তি তা নয়। এ বিষয়ে প্রকাশিত কোন সংবাদেও তা স্পষ্ট করা হয়েছে বলে জানা নেই। ফলে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের কথা জানাজানি হলেও বলাৎকারের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কি না, সেটি আমাদের অনেকেরই অজানা। দুটি শব্দের প্রায়োগিক অর্থের ভিন্নতায় আইনের এই অস্পষ্টতা হেতু বলাৎকারের শাস্তি কি, তা পরিষ্কারভাবে না জানার কারণে অনেক নির্যাতিত চাইতেই যাচ্ছে না, যাবে না এর বিচার। এই সুযোগে বলাৎকারকারীরাও চালিয়ে যাচ্ছে, চালিয়ে যাবেই তাদের অপকর্ম! এটি অনুধাবন করেই বলাৎকারকে পরিষ্কারভাবে ধর্ষণ গণ্য করে মৃত্যুদণ্ড চেয়ে সরকারকে আইনী নোটিস দিয়েছে ‘ল এ্যান্ড লাইফ ফাউন্ডেশন’ নামক একটি মানবাধিকার সংগঠন। গত ২৯ অক্টোবর ২০২০ তারিখে দেয়া ওই নোটিসে বাংলাদেশ দণ্ড বিধির ৩৭৫ ধারা এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ নম্বর ধারা সংশোধন করে বলাৎকারের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান যুক্ত করতে বলা হয়েছে।
সর্বাধিক জনসম্পৃক্ত একটি ফৌজদারি আইনে ব্যবহৃত শব্দ, সংজ্ঞা ও এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সাধারণ মানুষের মাঝে যতটা পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা যাবে, তত বেশি মানুষ এই আইন সম্পর্কে সচেতন হয়ে তা মেনে চলতে চেষ্টা করবে। অপরদিকে এই আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষ সোচ্চার হয়ে পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। মুখ খোলার সাহস ও পরিবেশ পাবে নির্যাতিতরা। ফলে সমাজ থেকে হ্রাস পাবে অপরাধ প্রবণতা এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে বৃদ্ধি পাবে আইনের সফলতা। তাই আলোচিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণ ও বলাৎকারের প্রায়োগিক সংজ্ঞা নির্ধারণ করা উচিত এবং এর ধারায় ও ব্যাখ্যায় ‘ধর্ষণ’ শব্দটির স্থলে ‘ধর্ষণ বা বলাৎকার’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপন করে আরও পরিষ্কার বিশ্লেষণ দিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালানো উচিত। অথবা, ‘বলাৎকার দমন আইন’ নামে স্বতন্ত্র একটি আইন প্রণয়ন করা উচিত। সেইসঙ্গে এই অপকর্ম সংঘটিত হওয়ার সম্ভাব্য ক্ষেত্রসমূহে চালু করা উচিত আধুনিক ও কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থা, যাতে সুনিশ্চিত হয় এই আইনের অধিক সুফল।
লেখক : সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ এবং অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ
rahamot21@gmail.চম
0 মন্তব্য(গুলি):