প্রবন্ধ- শিক্ষকের আত্মতৃপ্তি কোথায় -দৈনিক ইত্তেফাক ২০২০

 

শিক্ষকের আত্মতৃপ্তি কোথায়?

দৈনিক ইত্তেফাক > আলোকপাত 

প্রিন্ট সংস্করণ, ২৬ আগস্ট ২০২০

মো. রহমত উল্লাহ্

>আমাদের দেশে শিক্ষকদের, বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকদের প্রাপ্য ও প্রত্যাশার তুলনায় প্রাপ্তির পরিমাণ অত্যন্ত কম বিধায় অনেক অসন্তোষ বিরাজ করছে তাদের মনে। সন্তোষজনক বেতন-ভাতা দিয়ে এই অসন্তোষ মেটানো জাতীয় স্বার্থেই জরুরি এবং তা করা সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি সব কর্তৃপক্ষেরই দায়িত্ব। তবে শিক্ষক হিসেবে আমাদেরও মনে রাখা প্রয়োজন যে, অগণিত চাকরিজীবীর জীবনেই এমন অনেক রকম অপ্রাপ্তির অসন্তোষ বিরাজমান। তার পরও তারা নানা কারণে সেই চাকরিটাই করেন ও সেই চাকরির নির্ধারিত দায়দায়িত্বও পালন করেন। তাই আমরা যারা যে কোনো কারণেই হোক, শিক্ষকতায় এসেছি এবং রয়েছি তাদের দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলা বা অনীহা দেখানো অনুচিত বলেই মনে করি। বিভিন্ন দিবস উদ্যাপন এবং রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক দায়িত্ব পালনকালে কোনো কোনো শিক্ষক বলে থাকেন, ‘শিক্ষকদের বুঝি আর কাজ নাই?’ তাদের কাছে যদি জানতে চাই শিক্ষকদের কাজ কী? তারা কী বলবেন আমরা জানি না। তবে এটাও জানি ও মানি সত্যিকারের শিক্ষকদের অনেক কাজ, অনেক দায়িত্ব, অনেক কর্তব্য—যা আর্থিক মানদণ্ডে পরিমাপ করা অসম্ভব। একজন শিক্ষক যদি আসলেই শিক্ষক হয়ে ওঠেন তো তিনি সমাজের, রাষ্ট্রের, বিশ্বের শিক্ষক হয়ে যান এবং সবার ছাত্র হয়ে যান। তার দায়িত্ব-কর্তব্যের পরিধি সীমাহীন হয়ে যায়। তার নিয়োগপত্র ও কর্তৃপক্ষ দ্বারা নির্ধারিত কর্ম ও সিলেবাস সঠিকভাবে সম্পন্ন করার পরেও তিনি প্রতিনিয়ত পালন করেন অনেক অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য। মানুষের অধিক কল্যাণ চিন্তা করেই সেসব তিনি করেন স্বেচ্ছায় ও বিনা পারিশ্রমিকে। তখনই তিনি হয়ে ওঠেন উত্তম। তখনই তিনি হয়ে ওঠেন সর্বজনশ্রদ্ধেয়। তখই তিনি হয়ে ওঠেন প্রকৃত শিক্ষক। যিনি যত শুদ্ধ চিন্তা করবেন, তিনি তত শুদ্ধ মানুষ হবেন এবং যিনি যত উত্তম কর্ম করবেন তিনি তত উত্তম হয়ে উঠবেন। এই শুদ্ধ ও উত্তম তিনি হবেন নিজের বিবেকের কাছে। সমাজ ও রাষ্ট্র তাকে কী দিল, আর কী দিল না, সেই হিসাব এখানে মিলবে না। একজন শিক্ষার্থীকে ধূমপান না করার উপদেশ দিয়ে, বড়কে মান্য ও ছোটকে স্নেহ করার পরামর্শ দিয়ে, কাউকে আঘাত না করার শিক্ষা দিয়ে, আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার নিয়ম শিখিয়ে দিয়ে, মিথ্যা না বলা ও দুর্নীতি না করার প্রতিজ্ঞা করিয়ে, মানবকল্যাণে নিবেদিত হওয়ার ব্রত দিয়ে, সঠিক ধর্মীয় জ্ঞান দিয়ে, কুসংস্কারমুক্ত আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক হওয়ার পথ দেখিয়ে, মনের গভীরে যে পরিতৃপ্তি লাভ করবেন প্রকৃত শিক্ষক, কীভাবে নির্ধারিত হবে তার আর্থিক মূল্য? একজন শিক্ষকের উপদেশে যদি একজন মানুষও শুদ্ধ হয়, তো সেই শিক্ষকের শিক্ষকতা জীবন সার্থক। আর কেউ দেখুক বা না দেখুক, তিনি নিজেই দেখবেন তার সার্থকতা। একান্তে নিজেই মূল্যায়ন করবেন নিজেকে। সবার অজান্তে লাভ করবেন আত্মপরিতৃপ্তি। অঢেল অর্থ দিয়ে কেনা সম্ভব নয় এই পরিতৃপ্তি। অন্য চাকুরেদের পক্ষেও অর্জন সহজ নয় এই সফলতা। একদল শিক্ষকের সহায়ক ভূমিকায় যদি সমাজ থেকে একটা কুসংস্কার দূরীভূত হয়, একটা বাল্যবিবাহ বন্ধ হয়, একটা মানুষের জীবন রক্ষা পায় তো পুরো শিক্ষক সমাজ সার্থক। প্রিয় শিক্ষক, আমরা অধিক ভাগ্যবান যে আমাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অনেক শিক্ষার্থী আছে। আসুন, তাদের মধ্যে শুভ চিন্তা প্রোথিত করে, মানবসন্তানকে মানুষ করে, সুস্থ সমাজ রচনা করে, আমরা হয়ে উঠি সত্যিকারের মানুষ গড়ার কারিগর। মনে রাখুন, নিয়োগপত্র পেলেই শিক্ষক হওয়া যায় না, শিক্ষক হয়ে উঠতে হয় চিন্তায় ও কর্মে।<


n লেখক :অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা


https://www.ittefaq.com.bd/print-edition/opinion/177635/%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%86%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A6%A4%E0%A7%83%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BF-%E0%A6%95%E0%A7%8B%E0%A6%A5%E0%A6%BE%E0%A7%9F


Previous Post
Next Post

About Author

0 মন্তব্য(গুলি):