শব্দঘর- জানুয়ারি ২০১৪ বিসর্গের দুঃখ
মো. রহমত উল্লাহ্
আমরা বাংলাদেশের বাঙালিরাই জীবন দিয়ে শহিদ হয়ে রক্ষা করেছি আমাদের মাতৃভাষা। আমাদের শহিদদিবসেই আজ বিশ্ব-ব্যাপী পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষাদিবস। অথচ সঠিক চর্চা ও পরিচর্যার মাধ্যমে মাতৃভাষার উৎকর্ষ সাধনে আমরা অনকেই এখনো অনেক বেশি উদাসীন। এমনকি অক্ষরের প্রয়োগ, শব্দের বানান, শব্দ গঠন, শব্দ সংক্ষেপন, শব্দের প্রয়োগ, বাক্য গঠন, যতি-চিহ্নের ব্যবহার ইত্যাদি সাধারণ বিষয়েও আমরা প্রায় সবাই এত বশি ভুল লিখি যা স্বল্প পরিসরে আলাচনা সম্ভব নয়। তাই এই নিবন্ধে কেবল বিসর্গের (ঃ) ব্যাপক অপব্যবহারের আংশিক তুলে ধরা হলো।
ভাষার গতি বৃদ্ধির জন্য শব্দ সংক্ষেপ অপরিহার্য্য। তাই শব্দ সংক্ষেপ করার জন্যও প্রত্যেক ভাষারই থাকা চাই সর্বজনবিধিত একটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম। আমাদেরও আছে। কিন্তু সে নিয়ম অনুসরণ করছিনা আমরা সবাই।
যেমন: ‘ডাঃ মাঃ সাঃ জাঃ ফয়েজ, এমঃ বিঃ বিঃ এসঃ’। এক্ষেত্রে বিসর্গ (ঃ) গুলোর অপব্যবহার করা হয়েছে যতিচিহ্ন (শব্দ সংক্ষেপন চিহ্ন) হিসেবে। অর্থাৎ ‘ডাক্তার মোহাম্মদ সারোয়ার জাহান ফয়েজ’, ‘ব্যচলর অফ মডিকেল সাইন্স’ কথা গুলোকে সংক্ষিপ্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়েছে বিসর্গ দিয়ে।
আবার ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্বারক নম্বর’ কথা গুলোকে সংক্ষেপে লখা হচ্ছে- ‘শিঃ মঃ স্বাঃ নং’ এই ভাবে। গভঃ দিয়ে গভর্নমেন্ট, প্রাঃ দিয়ে প্রাইভেট, লিঃ দিয়ে লিমিটেড, হঃ দিয়ে হযরত, ছঃ দিয়ে 'ছল্লাল্লা হু আলাইহি ওয়া ছাল্লাম', রাঃ দিয়ে 'রাদিয়াল্লা হু আন হু' ইত্যাদি লেখা হয়ে থাকে। এভাবে বিসর্গ (ঃ) দিয়ে শব্দ সংক্ষেপ করা সঠিক নয়।
বিসর্গ (ঃ) কে যতিচিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করা যায়না। যতিচিহ্নের কোন উচ্চারণ ধবণি নেই। কেননা, কোন যতিচিহ্নই বর্ণ নয়। বিসর্গ (ঃ) একটি বর্ণ। বিসর্গের (ঃ) আছে উচ্চারণ ধবণি। আছে সঠিক ব্যবহারের নিয়মকানুন। অথচ আমরা অনেকেই না জেনে, না বুঝে এই বিসর্গ (ঃ) ধবণিকে ব্যবহার করছি যতিচিহ্ন হিসেবে। এতে বিলুপ্ত হচ্ছে বিসর্গ (ঃ) এর উচ্চারণ ধবণি ও অস্তিত্ব। আবার এইরূপ অপব্যবহৃত বিসর্গ (ঃ) এর উচ্চারণ করতে গেলেও অর্থ দাঁড়াচ্ছে অন্য রকম। যমন- ‘হাইমচর হামদর্দ হাসপাতাল’কে বিসর্গযোগে সংক্ষিপ্ত করতে গেলে হবে ‘হাঃ হাঃ হাঃ’। উচ্চারণ হবে ‘হাহ্ হাহ্ হাহ্’। অর্থ দাঁড়াবে উচ্চ স্বরে হাসির শব্দ।
শব্দ সংক্ষেপ করার জন্য ব্যবহার করতে হবে যতিচিহ্ন। একমাত্র দাঁড়ি (। ) ব্যতীত সকল যতিচিহ্নই আমরা পেয়েছি / নিয়েছি ইংরেজি ভাষা থেকে। তাই ব্যবহারও হচ্ছে ইংরেজি ভাষার রীতি অনুসারেই। সেমতে শব্দ সংক্ষেপ করার জন্য ব্যবহৃত হবে ডট (.)। বাংলায় আমরা এর নাম দিয়েছি এক বিদু (.) বা শব্দ সংক্ষেপন চিহ্ন। যেমন: ডা. মো. সা. জা. ফয়েজ, এম. বি. বি. এস. । শি. ম. স্বা. , এস. এস. সি. , এমএস. সি. , বি. এড. , বিডি. আর. ইত্যাদি। খেয়াল রাখতে হবে, বাক্যের প্রথম ও মধ্যবর্তী শব্দ সংক্ষেপ করার জন্য যে নিয়মে নির্ধারিত বর্ণের পরে এক বিন্দু (.) বসে, সে নিয়মেই শেষ শব্দ সংক্ষেপ করার জন্যও নির্ধারিত বর্ণের পরে এক বিন্দু (.) বসবে।
শুধুমাত্র শব্দ সংক্ষিপ্ত করার জন্যই যে বিসর্গের (ঃ) অপব্যবহার হচ্ছে তা নয়, বিশ্লেষণ করার জন্যও অহরহ অপব্যবহৃত হচ্ছে বির্সগ (ঃ) নামক ধবণি। ‘যেমন: / যমন-’ কে বিসর্গ দিয়ে লেখা হচ্ছে ‘যেমন ঃ ’। ‘নাম- / নাম:’ কে লেখা হচ্ছে ‘নাম ঃ’ । ‘গ্রাম- / গ্রাম:’ কে লেখা হচ্ছে ‘গ্রাম ঃ ’। ‘পোস্ট.- / পোস্ট. : ’ কে লেখা হচ্ছে ‘পোস্ট ঃ ’ । এই রকম অপব্যবহার বা দুর্ব্যবহারের করণে অনেক ক্ষেত্রে বিসর্গ (ঃ) ধবণি হীন, নিরব। বিসর্গের মত এমন অনেক ধবণি, বর্ণ এবং যতিচিহ্ণ প্রয়োগ আমাদের খামখেয়ালির জন্যই বাঙলা ভাষা আজ ক্ষত-বিক্ষত ও দুখঃভারাক্রান্ত।
অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও বাস্তব যে, বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নাম ফলক, চিঠি-পত্র, টলিভিশন এমনকি অনেক প্রকাশিত বই-পত্র-পত্রিকায় এমনি ভুল ভাবে বিসর্গের অহরহ অপপ্রয়োগ দীর্ঘ দিন দেখতে দেখতে এখন নতুন প্রজন্মসহ আমরা অনেকেই মনেকরি তা-ই সঠিক। এমনকি আমাদের অধিকাংশ শিক্ষিত মানুষের নামের সংক্ষিপ্ত রূপ আমাদের শিক্ষা সনদে লেখা হয়েছে ও হচ্ছে (ঃ) বিসর্গ দিয়ে। যেমন: মো. , মোসা. , মি. এসবকে লেখা হচ্ছে মোঃ , মোসাঃ , মিঃ , ইত্যাদি। আজীবন এই ভুল বয়ে বেড়াচ্ছি সবাই।
অথচ শিক্ষা বোর্ড এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ একটু সচেতন হলেই বন্ধ করা যায় এই চলমান/প্রচলিত ভুল। তা করা হলে নিজের সনদ দেখেই আমাদের সন্তানেরা শিখতে পারবে শব্দ সংক্ষেপন চিহ্নের ব্যবহার এবং পরিহার করতে পারবে (ঃ) বিসর্গের অপব্যবহার। এব্যাপারে যথা শীঘ্র সম্ভব বাঙলা একাডেমিসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন সকল প্রতিষ্ঠান ও প্রিট মিডিয়াসমূহ ঐকমত্যে এসে একই নিয়ম অনুসরণ অত্যাবশ্যক। মনে রাখতে হবে সামান্য অবহেলায় ভাষার ভিতরে কোন ভুল বিস্তৃত হয়ে পড়লে মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভাষা; যা কাটিয়ে উঠা হয়ে পড়ে অত্যন্ত কঠিন ও সময় সাপেক্ষ। //
অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলজ, ঢাকা।
Email: rahamot21@gmail.চম
0 মন্তব্য(গুলি):