উপ-সম্পাদকীয়- 'কওমি মাদ্রাসার সিলেবাসে যুক্ত হোক কর্মমুখী শিক্ষা'- সমকাল ও দৈনিক শিক্ষা- ২২ এপ্রিল ২০১৭

কওমি মদ্রাসার সিলেবাসে যুক্ত হোক কর্মমুখী শিক্ষা -সমকালসমকাল ও দৈনিক শিক্ষা > ২২ এপ্রিল ২০১৭।
কওমি মাদ্রাসার সিলেবাসে যুক্ত হোক কর্মমুখী শিক্ষা
মো. রহমত উল্লাহ্
বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা প্রসারে দানশীল মানুষের অবদান সবচেয়ে বেশি। কোনো সরকারকেই কওমি মাদ্রাসার ভবন তৈরি এবং এর শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য উল্লেখযোগ্য আর্থিক অনুদান দিতে হয়নি; যেমনটি দেওয়া হয়েছে আলিয়া মাদ্রাসার ক্ষেত্রে। হয়তো সব সরকারই এমন ধারণা পোষণ করেছে ও করছে যে, কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষিতরা যেহেতু জাতীয় উৎপাদনে ভূমিকা রাখার কোনো যোগ্যতা লাভ করে না এবং দেশের জিডিপিতে যেহেতু তাদের তেমন ভূমিকা নেই, সেহেতু কর্মমুখী জনগণের ট্যাক্সের টাকায় গঠিত সরকারি কোষাগার থেকে তাদের পেছনে অর্থ ব্যয় করা অনুচিত।
এ কথা মিথ্যা নয় যে, কওমি মাদ্রাসায় প্রচলিত শিক্ষায় শিখানো হয় না কোনো আধুনিক কর্মকৌশল। মুখস্থ করানো হয় কোরআন-হাদিস। এর পাশাপাশি সেখানে শিখানো হয় না আধুনিক কৃষিকাজ, হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল লালন-পালন, মাছ চাষের নিয়ম-কানুন, জামা-কাপড় সেলাই কৌশল, ছোট-বড় কোনো ফ্যাক্টরির কাজ, দালানকোঠা নির্মাণ, কম্পিউটার পরিচালনা, মানুষের প্রয়োজনীয় কোনো পণ্যের উৎপাদন ও উদ্ভাবন, আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজি; এমনকি সঠিকভাবে শিখানো হয় না মাতৃভাষা বাংলা। তদুপরি বড় বড় কিতাব উর্দুতে পড়ানো এবং বাংলা ভালো না জানার কারণে কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষিতরা পারেন না আরবি থেকে উত্তম অনুবাদ, যা সাধারণের বোধগম্য হবে। সেই শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে তারা অর্জন করতে পারেন না বর্তমান বিশ্বসমাজে টিকে থাকায় অপরিহার্য রাজনীতি, অর্থনীতি, খনি, তড়িৎ, তরঙ্গ, চিকিৎসা, কম্পিউটার, পরিবেশ, পুষ্টি, জীববিজ্ঞান ও হিসাববিজ্ঞানের ধারণা। তাই তারা অনেক ক্ষেত্রে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় পবিত্র কোরআন ও আধুনিক বিজ্ঞানকে। মহান সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীর বাইরে ও ভেতরে যে অফুরন্ত সম্পদ রেখে দিয়েছেন মানুষের কল্যাণে এবং সেসবের তথ্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বলে দিয়েছেন পবিত্র কোরআনে; তা তারা আমাদের ব্যবহারোপযোগী করতে পারেন না। ব্যবহার করাও অনুচিত মনে করেন অনেক সময়। তারা দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়ে উপলব্ধি করতে অক্ষম যে পবিত্র কোরআন জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎস। তদুপরি তারা কওমি মাদ্রাসার হুজুর ব্যতীত অন্য কারও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ মেনে নিতে চান না।
এখন সরকার কওমি মাদ্রাসাকে মান দিচ্ছে; অতএব তার সিলেবাস নিয়ে ভাবা জরুরি। আমরা মনে করি, কওমি মাদ্রাসায় যুক্ত করতে হবে কর্মমুখী ও বিজ্ঞানমনস্ক হওয়ার শিক্ষা।
ধর্মের সঙ্গে তো কর্মের কোনো বিরোধ নেই। কর্মে আছে সম্মান, ভিক্ষায় আছে অপমান। দান, সাহায্য, ভিক্ষার মাধ্যমে অর্থ আয় করা গেলেও এসব কোনো কর্ম নয়। যিনি একই সঙ্গে ধর্ম এবং কর্ম দুটিই সম্পাদন করেন তিনিই তো উত্তম। যার ধর্মীয় মূল্যবোধ আছে তার কর্মে কল্যাণ আছে। যার বিবেক নেই, ধর্মীয় মূল্যবোধ নেই, তার কর্মে কল্যাণ নেই। সে ফসলে বিষ দেয়, খাবারে ভেজাল দেয়, কাজে ফাঁকি দেয়, অন্যকে ঠকায়, মানুষকে ধোঁকা দেয়, অত্যাচার করে, দুঃশাসন করে। যে সত্যিকার ধর্মপ্রাণ সে এসব অপকর্ম করতে পারে না। পরিবার, রাষ্ট্র ও সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা যেমন প্রয়োজন; তেমনি সুস্থ-সবল, সচ্ছল ও আত্মনির্ভরশীল মুসলমান হয়ে মর্যাদা নিয়ে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন কর্মমুখী ও বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষা। নৈতিক ও ধর্মীয় এবং কর্মমুখী ও বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষার সমন্বয় সাধনের মাধ্যমেই গুটানো সম্ভব মুসমানদের দান গ্রহণের হাত। নিরসন করা সম্ভব দাতাদের কূটকৌশলে সৃষ্ট আমাদের ঐক্যের ফাটল। আত্মনির্ভশীলতার অভাবই আমাদের অনৈক্য ও অশান্তির প্রধান কারণ। তাই আমাদের দেশের কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থাকে নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি কর্মমুখী ও বিজ্ঞানমনস্ক করা জরুরি।
উর্দু শব্দ 'মাদ্রাসা'র অর্থ শিক্ষালয়। মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণ সাধনের উপযোগী সব শিক্ষাই তো দিতে হবে আদর্শ শিক্ষালয়ে। কর্মমুখী ও বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষা সব মানুষকেই ধর্মবিমুখ করে না- তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে বিশ্বব্যাপী তাবলিগ জামাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত লাখ লাখ মুসলমান শ্রমিক-কর্মচারী, কর্মকর্তা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনবিদ, কৃষিবিদ, বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ী বিভিন্ন কর্মে নিয়োজিত সচ্ছল ও আত্মনির্ভরশীল মানুষ। সে ক্ষেত্রে মানও যথার্থ হবে।
অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও
কলেজ, ঢাকা
rahamot21@gmail.com
Previous Post
Next Post

0 মন্তব্য(গুলি):