মেলায় যাই রে
মো. রহমত উল্লাহ্
>কচি কলাপাতায় চিকচিক করছে বিকেলের রোদ। কিছু আগেই হয়ে গেল ঝড় বাদল। মেলায় যাচ্ছে শিমুল ও বকুল। হাঁটছে বাবার হাত ধরে। মাত্র ১০ মিনিটের পথ। মাইকে ভেসে আসছে ঘোষণা। মেলা! মেলা! মেলা! এক বিরাট বৈশাখী মেলা! গত কয়েক দিন ধরেই চলছে এই মাইকং। আর সেইসাথে চলেছে শিমুল ও বকুলের আয়োজন। কে কোন জামা পড়ে যাবে মেলায়। কে কী কিনবে মেলা থেকে। এসব আলাপেই কেটেছে বেশিটা সময়।
তাড়াতাড়ি পা চালায় দু’জনেই। যেন বাবার দু’হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ওরা। ওদের সাথে যাচ্ছে আরো শত শত মানুষ। হাসি-খুশি সবার মুখ। সবার মুখের দিকে তাকায় শিমুল। দেখে, ওর বন্ধুরা কেউ চলে যাচ্ছে কিনা আগে। কোন কাজেই পিছনে পড়তে চায়না সে। লেখাপড়া, খেলাধুলা, নাওয়া-খাওয়া সব কিছুতেই আগে থাকা চাই। এমনকি পাকামোতেও। তার সাথে হার মানে ছোট বোন বকুল। মেতে থাকে বকুলকে খেপানোর তালে। ক্লাস ফোরের ফার্স্টবয় সে। গায়ের রং তামাটে। বন্ধুদের তুলনায় বেশ বড়সড়।
মেলার কাছাকাছি চলে এসেছে ওরা। বাড়ি ফিরে যাচ্ছে অনেকেই। নিয়ে যাচ্ছে পছন্দের জিনিস। শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন খেলনা ও বাঁশির শব্দ। এসব দেখে কিছুটা ভাবনায় পড়ে বকুল। জানতে চায় বাবার কছে। বাবা, আমরা যেয়ে কি পাবোনা এমন সুন্দর বেলুন? কথা বলে শাওন। রাসেল স্যারের মতো। হুম, নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। বিরাট বড় বৈশাখী মেলা। তুমি যা চাও তাই পাবে সেখানে। ভাইয়ার কথা শুনে খুশি হয় বকুল। ভাবে এর চেয়ে সুন্দর বেলুন কিনবে সে।
২
মেলার শুরুতেই অনেক রকম বেলুন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন বেলুন ওয়ালা। বল, লাউ, কুমড়া, বেগুন, মাছ, হাঁস, বিড়াল, পুতুল, শাপলা…। আরো কত কী যে তৈরি করেছে ফুলানো বেলুনে। সবই কিনতে মন চায় বকুলের। শিমুল কিনে বাঁশিবেলুন ও রকেটবেলুন। ভাইয়ার দেখাদেখি বকুলও নেয় একটি বাঁশিবেলুন। বাবা পছন্দ করেন একটি শাপলাবেলুন। সেটি কিনে দেন বকুলকে। আরো খুশি হয় বকুল। শাওনকে দেখায় বার বার। শাওন হাতের তালু ঘষে দেয় বকুলের বেলুনে। শব্দ হয় প্যাক করে। যেন রাজহাসের ডাক। ভ্যা করে কেঁদে উঠে বকুল। শিমুল বলে, না, কিছু হয়নি। ঠিক আছে কিনা দেখলাম তোমার বেলুন। বলতে বলতে হাত বুলিয়ে দেয় বকুলের গায়ে।
চুড়ি ওয়ালির সামনে যায় বকুল। বাড়িয়ে দেয় দুইহাত। বকুলকে কোলে বসিয়ে নেয় চুড়িওয়ালি। রঙ বেরঙের চুড়িতে ভরিয়ে দেয় বকুলের হাত। বকুল দেখে, অনেক রকম সাজনি জিনিস। রাখা আছে, চুড়ি ওয়ালির তিন পাশে। বেছে বেছে বেশকিছু জিনিস তুলে নেয় বকুল। আলতা, ফিতা, ক্লিপ, লিপস্টিক, নেইলপলিশ ও পুতিরমালা। রাখে নিজের ফ্রকের কুচায়। বলে, বাবা, আমি এসব নেবো। শিমুল বলে, এসবতো বাসায়ই আছে। আবার নেওয়ার...। শিমুলকে থামিয়ে দেয় বকুল। জোরে বলে, বাবা, আমি এসব নেবো। বাবা হ্যাঁ না কিছুই বলেন না। হাসিমুখে বলেন, এতকিছু নেবে কিসে? ফ্রকে করেতো আর নেওয়া যাবেনা। বকুল ঝপ করে এসব ঢেলে দেয় বাঁশের তৈরি পুরায়। তার পায়ের কাছেই ছিল এটি। চুড়ি ওয়ালির পান শুপারি রাখার পুরা। এত টুকুন বকুলের বুদ্ধি দেখে অবাক হয় সবাই। চুড়ি ওয়ালি খুশি হয়ে তার পুরাটি দিয়ে দেয় বকুলকে। গোলাপ পাঁপড়ির মতো হাসি ফুটে বকুলের মুখে। যেন সমগ্র পৃথিবী এখন তার। বাবাও কিনে নেন, মায়ের জন্য বেশ কিছু লালচুড়ি।
শিমুলের দিকে তাকান বাবা। বলেন, তুমি কী কিনবে? লজ্জায় লাল হয়ে উঠে শিমুলের মুখ। মাথা নিচু করে বলে, আমি কি মেয়ে নাকি? অন্য দোকানে চল।
সবচেয়ে বড় দোকানটিতে গিয়ে দাঁড়ায় শিমুল। মানুষের ভীড় ঠেলে এগিয়ে যায় সামনে। এতো এতো খেলনা। কী কিনবে ঠিক করে উঠতে পারেনা সে। ভালো করে তাকায়। একেক সময় একেকটি খেলনার দিকে। মনেমনে কল্পনা করে এটির আনন্দ। হিসেব করে সুবিধা আর অসুবিধা। পিস্তলের দিকে চোখ যায় বার বার। চটপট কিনে নেয় অনেকেই। চলে যায় ফুটাতে ফুটাতে। শাওনও হাতে নেয় একটি। রোভোকপের মত তাক করে বকুলের দিকে। এ্যা, করে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বকুল। মনে পড়ে শিমুলের, পিস্তল কিনতে নিষেধ করেছেন মা। পিস্তল রেখে আবার দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। বানর নাচানো ঢোল, বাঁশের বাঁশি, বেলুনবাঁশি ও বিভিন্ন খেলনার শব্দ। সেইসাথে ছোটদের হৈহুল্লোড়। সামান্য বিরক্ত হন বাবা। বলেন, শাওন, দাঁড়িয়ে আছো কেন? তাড়াতাড়ি নাও, কী নেবে। আর কিছুই ভাবেনা শিমুল। নিয়ে নেয় বাঁশের বাঁশি, বাতাই, পাখিরাজ ঘোড়া আর লাটিম। মনে পড়ে মাঠের খেলার কথা। নেয় একটা রেফরি বাঁশি। পু-র-র-র, করে বাজায় বকুলের কানের কাছে। যা, বলে অন্য দিকে মাথা সরিয়ে নেয় বকুল। চোখ যায় মাটির তৈরি জিনিসের দোকানে। বাবাকে টেনে নিয়ে যায় সেখানে।
মাটির তৈরি নানান রকম জিনিস। পশু, পাখি, ফল, নৌকা, পুতুল…। দেখে দেখে অবাক হয় বকুল! ভাবে, কেমন করে তৈরি করে এসব। অনেক সুন্দর। পুরা ভর্তি সাজনির চেয়ে ভালো এসব। হাতের পুড়াটি ধরিয়ে দেয় বাবার হাতে। খপ করে কোলে তুলে নেয় ছোট্ট একটা কবুতর। পুতুলও নেয় এক জোড়া। সিংহ দেখে চিড়িয়াখানার কথা মনে পড়ে শিমুলের। ভয়ে টুক করে উঠে বুকের ভিতর। ধরতে গিয়ে কেঁপে উঠে হাত। আসল সিংহের মতই হা করে আছে মাটির সিংহ। মিথ্যে ভয় পেয়েছে ভেবে হাসে মনে মনে। বীরের মত ঘাড়ে ধরে তুলে নেয় বড় সিংহটি। আঙুল ঢুকিয়ে দেয় সিংহের হা করা মুখের ভিতর। মেলায় এসে বাবাও যেন ফিরে যান ছেলেবেলায়। খুব দেখে, বেছে কিনে নেন একটা পাল তোলা নৌকা।
মেলার পাশেই বিস্তর ফাঁকা জায়গা। কত রকম ঘুড়ি যে সেখানে! তেলেঙা, ডাহুক, লেন্ঠেন, চিলঘুড়ি আরো কত নাম! একেক করে উড়িয়ে দেখছে ক্রেতারা। সবই যেন ভাল উড়ে বিক্রেতাদের হাতে। বাবাও উড়িয়ে দেখলেন দু’একটা। চিলঘুড়িটি উড়ালেন কয়েক বার। হাসলেন মিটিমিটি। শিমুল বুঝতে পারলো চিলঘুড়িটি সবচেয়ে ভা্লো। তাই দেরি হয়নি এটি কিনতে। এবার শিমুল প্রশ্ন করল বাবাকে। বাবা, তুমিও কি ঘুড়ি উড়াতে ছোটবেলায়? দীর্ঘ হাসি দিয়ে মুখ খুললেন বাবা। বললেন, হ্যাঁ, অনেক উড়িয়েছি। সবচেয়ে বেশি উড়াতে পারতো তোমার বড়চাচু। নিজেরা বানিয়েই উড়াতাম আমরা। তোমার বড়চাচু দেখলে এখনো উড়াতে চাইবে এই ঘুড়িটি।
এবার খাবার জিনিসের দোকানে এলেন বাবা। অনেক রকমের খাবার। বেশির ভাগই মিষ্টান্ন খাবার। এটাকী? সেটাকী? ঐটাকী? বাবাকে প্রশ্ন করতে লাগলো দু’জনে। মুড়ি, জিলাপি, খাজা, গজা, কটকটি…। এসব কিনতে কিনতে পরিচয় করিয়ে দিলেন বাবা। বললেন, বুঝেছো, এসব হচ্ছে বাঙালিদের ফাস্টফুড। দোকানি একটা তিলের খাজা তুলে দেয় বকুলের হাতে। বকুল হাত বাড়িয়ে এটি দেখায় শিমুলকে। ছোঁ মেরে এটি নিয়ে যায় শিমুল। ভ্যা করার আগেই বকুলকে আরো দু'টি খাজা দোকানি।
৩
ফেরার পথে বাবাকে প্রশ্ন করে শিমুল বকুল। আচ্ছা বাবা, এত ফাস্টফুডের নাম তুমি মনে রাখো কীভাবে? বাবা বলেন, আমরাতো ছোট বেলায় খেয়ে খেয়ে মুখস্ত করেছি। তাই আর ভুলিনা। বাসায় গিয়ে খেতে খেতে জেনে নিও। তোমারও মনে থাকবে।
বাবার কথা শেষ না হতেই মুখ খুলে শিমুল। বলে, তুমিতো সব খাবার কিনইনি। সেগুলো মনে থাকবে কীভাবে? অপরাধী কণ্ঠে কথা বলেন বাবা। ঠিক আছে, আরেক দিন কিনবো। এখন একটা ছড়া শুন।
চিড়া মুড়ি মুড়কি মোয়া
বাতাসা মুড়ালি
খাজা গজা কদমা নাড়ু
খেজুরের পাটালি।
ফুলপিঠা পাতাপিঠা
ঝিকিমিকি জিলাপি
ভাঁপাপিঠা চিতইপিঠা
তিলে ভরা তিলাপি।
কলার পিঠা তালের পিঠা
লাড্ডু বড়া খই সন্দেশ
কাঁঠালপিঠা পাকনপিঠা
শত পিঠার বাংলাদেশ।
এসব খেয়ে যুগেযুগে
আমারা আছি ভেরিগুড।
তাইতো বলি বিশ্বসেরা
বাঙালিদের ফাস্টফুড।
এবার মুখ খুলে বকুল। হ্যাঁ, খুব সুন্দর ছড়া। এটি আমি স্কুলের মাইকে বলবো। বকুলের পেটে একটা খোঁচা দেয় শিমুল। বলে, ইহ্, সাহস কত! শিমুলের হাতে খামচি দেয় বকুল। বাবা বলেন, এ ছড়াটি মুখস্ত করলেই তোমাদের মনে থাকবে এসব খাবারের নাম।
৪
বাসায় পৌঁছেই ভাইবোনে শুরু করে বেলুনবাঁশি বাজানোর প্রতিযোগিতা। ছোট বাঁশের বাঁশি। বেলুন যত বড় হয় বাঁশির সুর তত দীর্ঘ হয়। ফুলাতে ফুলাতে ফট করে ফেটে যায় শিমুলের বেলুন। একা একা মজা করে বাজায় বকুল। খুব খারাপ লাগে শিমুলের। বলপেন দিয়ে খোঁচা মেরে ফুটিয়ে দেয় বকুলের বেলুন। ভ্যা করে বকুল।
মেলার ফাস্টফুডেই হয় রাতের খাবার। শুয়েশুয়ে বাবাকে প্রশ্ন করে শিমুল।
বাবা, ঘুড়ি কিনলে কি পাপ হয়?
বাবা উত্তর দেন, না।
-মুড়ি, জিলেপি কিনলে?
-না।
-নৌকাকিনলে?
-না।
-সাজনি কিনলেও কি পাপ হয়না?
-জানিনা।
-তাহলে, অনেকেই বলেন কেন, মেলায় গেলে পায় হয়?<
------------
[মো. রহমত উল্লাহ্ : অধক্ষ – কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।]