শিক্ষার্থীদের শাস্তি দিয়ে নয়, আদর দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করাই উত্তম, মানবজমিন ২১ অক্টোবর ২০২১

পত্রিকার লিংক

শিক্ষার্থীদের শাস্তি দিয়ে নয়, আদর দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করাই উত্তম 

দৈনিক মানবজমিন > ২১ অক্টোবর ২০২১


মো. রহমত উল্লাহ্

কোন দেশেই শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করার আইনগত অধিকার নেই শিক্ষকের। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে ২০১১ সালে। 'শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি রহিত করা সংক্রান্ত নীতিমালা-২০১১ শিরোনামে জারিকৃত সেই আদেশের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে- শারীরিক শাস্তি বলতে বুঝাবে যে কোন ধরনের দৈহিক আঘাত করা। যেমন: শিক্ষার্থীকে হাত-পা বা কোন কিছু দিয়ে আঘাত বা বেত্রাঘাত, চক বা ডাস্টার জাতীয় বস্তু ছুঁড়ে মারা, আছাড় দেয়া ও চিমটি কাটা, কামর দেয়া, চুল টানা বা চুল কেটে দেয়া, হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে পেন্সিল চাপা দিয়ে মোচড় দেয়া, ঘাড় ধাক্কা দেয়া, কান টানা বা ওঠা-বসা করানো, চেয়ার টেবিল বা কোনকিছুর নিচে মাথা দিয়ে দাঁড় করানো বা হাঁটু গেড়ে দাঁড় করে রাখা, রোদে দাঁড় করিয়ে বা শুইয়ে রাখা, কিংবা সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড় করানো এবং ছাত্র-ছাত্রীদের দিয়ে এমন কোন কাজ করানো। আর মানসিক শাস্তি বলতে বুঝাবে- শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে এমন কোন মন্তব্য করা যেমন: মা-বাবা, বংশ পরিচয়, গোত্র বর্ণ ও ধর্ম সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য করা, অশোভন অঙ্গভঙ্গি করা যা শিক্ষার্থীদের মনে বিরোপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।' শাস্তিযোগ্য এই রাষ্ট্রীয় আইন/নীতিমালা মেনেই করা উচিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকতা। কোন ধর্মেও অনুমোদন দেয় না শিক্ষার্থীদের শাস্তি প্রদান। তথাপি কেউ যদি শিক্ষার্থীকে ভালবাসার অধিকার দেখিয়ে শাসনের নামে নির্যাতন করতে চান তো তাকে অবশ্যই অর্জন করতে হবে তেমন শ্রদ্ধা এবং নিশ্চিত থাকতে হবে যে, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক মাথা পেতে নিবে সেই শাসন বা নির্যাতন এবং কখনো করবে না এর প্রতিবাদ।


উল্লিখিত নীতিমালা পড়ে কোন কোন শিক্ষক মন্তব্য করছেন যে, এ আইন মানতে গেলে কঠিন হয়ে পড়বে দুষ্টু শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণ এবং অমনোযোগীদের পাঠদান। তাদের প্রশ্ন হচ্ছে, শাসন না থাকলে নিয়ন্ত্রণ থাকবে কী ভাবে? শাস্তি ব্যতীত শাসন করার উপায় কী? তারা মনে করেন, বিভিন্ন রকম জ্ঞান-বুদ্ধি খাটিয়ে হাজার কথা বলে ও কৌশল করে আত্মনিয়ন্ত্রণ শিখানো/করানোর চেয়ে শত সহজ হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পিটিয়ে বাধ্য করা! তারা বুঝতে চাচ্ছেন না যে, শাসন মানেই শাস্তি প্রদান নয়। শাসন মানে প্রভাব দ্বারা নিয়ন্ত্রণ। আধুনিক শিক্ষা মনোবিজ্ঞান সম্পর্কিত জ্ঞানের প্রচন্ড অভাব থেকেই উৎপত্তি তাদের এ ধরনের প্রশ্ন ও মনোভাব। তাই তারা মনে করেন শাস্তি প্রদানই শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণের ও নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার। তারা এটিও মনে করেন যে, শিক্ষা প্রদানের দায়িত্ব পাওয়া মানেই শাস্তি প্রদানের অধিকার পাওয়া। এই ভ্রান্ত ধারনার কারণেই শিক্ষার্থীদের উপর নেমে আসে অধিকাংশ অমানবিক ও নিষ্ঠুর নির্যাতন। যার মাত্র দু’চারটি ব্যতীত প্রায় সবই থেকে যায় আমাদের জানার/ দেখার বাইরে। বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশে এমন শিক্ষক/ শিক্ষিকা/ প্রশিক্ষক/ হুজুরের সংখ্যা অনেক বেশি। কেননা, আমরা শিশু মনোবিজ্ঞান ও শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের উপর উচ্চতর ডিগ্রি না নিয়েই প্রায় সকল স্তরে শিক্ষক হতে পারি এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকতা করতে পারি। আমি নিজেও তেমন একজন। অথচ উন্নত বিশ্বে তা মোটেও সম্ভব নয়। আমাদের এই দুর্বলতা স্বীকার করার মানসিকতাও নেই অনেকেরই।


মনে রাখতে হবে, বর্তমান শিক্ষার্থীরা আগের মত নয়। এখন তারা অনেক তথ্য সমৃদ্ধ, আবেগপ্রবণ, অধিকার সচেতন ও আত্মমর্যাদা বোধ সম্পন্ন। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্বময় বিস্তৃত তাদের দৃষ্টি। অভিভাবকগণও সন্তানদের লেখাপড়ার বিষয়ে অনেক আগ্রহী এবং আধুনিক আগের তুলনায়। অনেক বদলে গেছে তাদের পারিবারিক আচার-আচরণ। তারা এখন অনেক বেশি প্রশ্রয় দেয় ছেলেমেয়েদের। এমনও অভিভাবক আছেন যিনি নিজেই অবাধ্য ছিলেন মা-বাবা ও শিক্ষকের। আগের পন্ডিত বা শিক্ষকদের তুলনায় অনেক পাল্টেছে বর্তমান স্যার-ম্যাডামদের সাজপোশাক, চালচলন, আচার-আচরণ ও জীবনযাপন। পাল্টেছে চুলের ছাঁট, নখের কাট ও পোশাকের ধরণ। আগের দিনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতো না সবাই। হাতেগোনা যারা ভর্তি হতো তারাও টিকে থাকতো না লেখাপড়ায়। শিক্ষকদের মার খেয়ে প্রত্যক্ষ প্রতিবাদ না করলেও অধিকাংশরাই নিরব প্রতিবাদ করে, নিজেকে অযোগ্য মনে করে, পালিয়ে যেত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। তাদের আর কোনদিন ফিরে আসা হতো না শিক্ষায়! চিহ্নিত হতোনা মেধার ক্ষেত্র। লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত থেকে যেতো বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে। যারা টিকে থাকতো তারা জন্মগতভাবে অত্যন্ত মেধাবী ও ব্যক্তিগত বা পারিবারিকভাবে নম্র-ভদ্র এবং শিক্ষা লাভে বদ্ধপরিকর হাতেগোনা কয়েকজন। তখনকার প্রায় শতভাগ অভিভাবক ও শিক্ষক মনে করতেন যে, কঠিন শাস্তি দিয়েই শিক্ষা দিতে হয়। অভিভাবক শিক্ষককে বলেই দিতেন তার সন্তানকে বকাবকি ও মারধর করে মানুষ করার জন্য। তখন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ের সংখ্যাই ছিল কম। সেভাবে ভাবলে আর চলবে না এখন। পাল্টাতে হবে নিয়ন্ত্রণ কৌশল। শক্তি খাটিয়ে নয়, বুদ্ধি খাটিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে বর্তমান ছেলেমেয়েদের। শতভাগে উন্নীত করতে হবে শিক্ষার হার। সবাইকেই ধরে রাখতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।  করে তুলতে হবে যুগের উপযোগী কর্মক্ষম নাগরিক। সেই অসাধ্য সাধন করার মতো হতে হবে শিক্ষকদের।   

 

আমাদের দেশে প্রচলিত প্রশ্নোত্তর পদ্ধতির পরীক্ষায় এ+ গ্রেড এবং কর্ম জীবনে অধিক আর্থিক সুবিধা হাত করা মানেই যে এ+ মানুষ হওয়া নয়; তা আমরা অনেকেই বুঝিনা, বুঝতে চাইনা বলেই নিষ্ঠুরভাবে চালাই 'মানব সন্তান'দের পিটিয়ে মানুষ(?) করার প্রতিযোগিতা। ফলে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য মানবিক গুণাবলি জাগ্রত করার পরিবর্তে আমরা প্রতিনিয়ত শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন করে করে চিরতরে হটিয়ে দিই অনেকের ভিতরের অধিকাংশ জন্মগত মানবিক গুণাবলী। সাধিত হয় না তাদের আচরণের স্থায়ী অনুকূল পরিবর্তন।  ফলে লেখাপড়া শিখেও তারা হয়ে উঠে আরো বেশি লোভি, নিষ্ঠুর ও আত্মকেন্দ্রিক। স্বপ্রনোদিত হয়ে এগিয়ে আসে না অপরের কল্যাণে। পরিবার, রাষ্ট্র ও সমাজে বৃদ্ধি পায় অনাচার এবং অস্থিতিশীলতা। বিশ্বের যেসকল দেশে শিক্ষার হার বেশি ও দুর্নীতির মাত্রা কম সেসকল দেশে শিক্ষার্থী নির্যাতন নেই বললেই চলে। 


শাস্তি দেওয়া যত সহজ শিক্ষা দেওয়া তত সহজ নয়! শাস্তি দেওয়ার জন্য তেমন সময়, শ্রম, মেধা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু সঠিক শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজনীয় পরিচর্যার জন্য অনেক সময়, শ্রম, মেধা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রয়োগ করতে হয়। যিনি শিক্ষার্থীদের শাস্তি না দিয়ে সঠিক শিক্ষা প্রদানে তথা আচরণের অনুকূল স্থায়ী পরিবর্তন সাধনে সক্ষম তিনি অবশ্যই উত্তম শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের শাস্তি দিয়ে বা ভয় দেখিয়ে নয়; বরং অনুকরণীয় অনুসরণীয় আদর্শ ব্যক্তিত্ব দিয়ে, সত্যিকারের আদর দিয়ে, উৎসাহ-উদ্দীপনা দিয়ে, বিবেক জাগ্রত করে, মানব ও দেশ প্রেমে উদ্ভূদ্ধ করে, বাস্তবতাপূর্ণ উচ্চাশা দিয়ে, সোনালি ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনতে দিয়ে, আর সবার মত সেও পারে এমন সৎসাহস দিয়ে, ভয়ভীতি হীন আনন্দঘন পরিবেশ দিয়েই সুনিশ্চিত করা যায় মেধানুযায়ী সুশিক্ষা। যার জন্য আমূল অনুকুল পরিবর্তন আনতে হবে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায়। সর্বোচ্চ বেতন-ভাতা দিয়ে নিশ্চিত করতে হবে সর্বোচ্চ মেধাবী, প্রশিক্ষিত ও যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক। 


মো. রহমত উল্লাহ্

প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ এবং অধ্যক্ষ -কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা। 

১২/১০/২০২১

https://m.mzamin.com/article.php?mzamin=298306


সুশিক্ষায় প্রেষণা বনাম শাসন-বারণ

সুশিক্ষায় প্রেষণা বনাম শাসন-বারণ 

দৈনিক ইত্তেফাক > ১৭ আগস্ট ২০১২


মো. রহমত উল্লাহ্  

সন্তানের ভালো-মন্দ নিয়ে মায়েদের দুশ্চিন্তা যেন চিরন্তন। মানব সন্তানের মানুষ হয়ে উঠার ক্ষেত্রে প্রথমত মা-বাবার এবং দ্বিতীয়ত শিক্ষকগণের ভূমিকাই মুখ্য। বিশেষ করে মায়েরা হচ্ছেন সন্তানের সর্বপ্রথম সার্বক্ষণিক শিক্ষক। নেপোলিয়ন যথার্থই বলেছেন- আমাকে শ্রেষ্ঠ মা দাও আমি শ্রেষ্ঠ জাতি দিবো। কেননা মায়ের অজান্তেও সন্তান আত্মস্থ করে মায়ের অনেক গুণাগুণ (দোষ-গুণ)। 

‘মায়ের আদর বাবার শাসন’ এর মধ্যদিয়ে আমাদের বেড়ে উঠা। কিন্তু আমাদের সন্তানরা কি পাচ্ছে তেমনটি? যদিও আগের তুলনায় এখনকার মায়েরা লেখাপড়া বেশি জানেন। সন্তানের লেখাপড়ার ব্যাপারে মায়েরা ইদানিং এতই আগ্রহী যেন নিজেরাই প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছেন। দিন-রাত লেগে থাকেন সন্তানের পিছনে। কথা ফোটার আগেই শিখাতে থাকেন ইংরেজি। আর গর্ব করে বলেন- আমার বাবু এ বি সি ডি বলতে পারে। তারপর শুরু করেন ছুটাছুটি। ভালো-মন্দ যা-ই হোক, নামকরা স্কুলে ভর্তি করা চাই তার সন্তান। অহঙ্কার করে বলতে হবে- আমার ছেলে-ময়ে অমুক স্কুলে পড়ে। মাসে বেতন পাঁচ হাজার টাকা। দশটা বই পড়ায়। প্রতিদিন অনেক বাড়ির কাজ দেয়। বাসায় তিনজন মাস্টার রেখেছি। এই মায়ের কথা শুনে নেমে পড়েন অন্যরাও। যে বাবার আর্থিক সঙ্গতি কম তার বারোটা বাজিয়ে ছাড়েন মায়েরা। ‘সবাই পারে, তুমি পারবে না কেন?’ বিশেষ করে শহরেই বেশি হচ্ছে এমনটি । সকাল-বিকাল দেখা যায় বাসে/টেম্পোতে ছোট্ট ছোট্ট ছেলে-মেয়েদের নিয়ে অনেক দূরের কোন ভালো(?) স্কুলে যাচ্ছেন বা বাসায় ফিরছেন মায়েরা। সকালে শিশুদের ঘুমঘুম চোখ আর বিকালে একরাশ ক্লান্তিতে নেতিয়ে পড়া মলিন চেহারাগুলো দেখলে খুব কষ্ট হয়। বাসায় ফিরে আবার তাকে নিয়ে যাওয়া হয় দূরের কোন ভালো(?) কোচিং সেন্টারে। সেখান থেকে এনে আবার তুলে দেয়া হয় একেএকে দুই/তিনজন গৃহশিক্ষকের হাতে। এরই ফাঁকে ফাঁকে সময়ে অসময়ে গিলিয়ে দেয়া হয় মায়ের পছন্দের সব খাবার। তদুপরি বিধি-নিষেধের অন্ত নেই। ক্লাসের এই এই ছেলে-মেয়ের সাথে কথা বলা যাবে না, বিকালে মাঠে খেলতে যাওয়া যাবে না, সাইকেল চালানো যাবে না, রাস্তায় হাঁটা যাবে না, ছাদে ঘুরতে যাওয়া যাবে না, মায়ের পছন্দের সিরিয়াল ছাড়া টিভি দেখা যাবে না, আউট বই ও পত্র-পত্রিকা পড়ে সময় নষ্ট করা যাবে না, পাশের বাসার কারো সাথে মিশা যাবে না, লেখাপড়ার ক্ষতি করে ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে যাওয়া যাবে না, ফোনে কারো সাথে কথা বলা যাবে না, বাসায় ছুটাছুটি করা যাবে না, মেহমানদের সাথে বেশি সময় দেয়া যাবে না, বড়দের কথায় কান দেয়া যাবে না, দু’ভাই-বোনে গল্প করা যাবে না, হাসির বিষয়েও হাসাহাসি করা যাবে না, মার দিলেও জোরে কান্না করা যাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। সবাই ক্লাসে ফার্স্ট হতে হবে। কেউ সেকেন্ড/থার্ড হতে পারবে না। 

আনন্দহীন শিক্ষা ক্ষণস্থায়ী আর আনন্দঘন শিক্ষা চিরস্থায়ী। শিশু শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রেষণা হচ্ছে সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার। তিরস্কার না করে ধন্যবাদ দিন, সামান্য কৃতিত্বে অসামান্য পুরস্কার দিন, ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় বুঝতে দিন, দেখবেন তেমন প্রয়োজন নেই শিশুদের শাসন-বারণ। আমরা শিশুদের যতটা অবুঝ মনেকরি শিশুরা ততটা অবুঝ নয়। তারা আমাদের চেয়েও অনেক বেশি সবুজ। তাদের কল্পনার জগত্ আমাদের ধারণার চেয়েও অনেক বেশি বিস্তৃত। তারা মিথ্যা জানে না; আমরা জানাই। তারা ফাঁকি বুঝে না; আমরা বুঝাই। তারা নিষ্ঠুর নয়; আমাদের কারণেই নিষ্ঠুর হয়। তারা স্বনির্ভরভাবে দাঁড়াতে চায়; আমরাই পরনির্ভর করে তুলি। শিশুরা দুষ্টুমি জানে না; আমরা জানাই। আমরা যাকে দুষ্টুমি বলি, তা শিশুদের অত্যন্ত জরুরি কাজ বা অতি আনন্দের খেলা। এটি সে আজীবন করবে না। তাকে অন্য কাজ দিন, খেলা দিন। এজন্য শাস্তি দিলে নিরানন্দময় হয় শিশুর জীবন। প্রতিবাদে ফুঁসে উঠে তার কোমল মন। হারায় তারুণ্য। আক্রান্ত হয় বিষণ্নতায়। শিশুরা দেখে-শুনে-ঠেকে-জেনে, যা বোঝে, যা শিখে তা-ই করে। তাদের অনুকরণ ও অনুসরণ ক্ষমতা অনেক বেশি। আমরা সবাই যদি সঠিক পথে চলি তো আমাদের শিশুরা অবশ্যই সঠিক পথে চলবে। থাকবে না এত বেশি শাসন-বারণ-শাস্তির প্রয়োজন। //  

মো. রহমত উল্লাহ্ : লেখক, শিক্ষাবিদ এবং অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা। ফোন- ০১৭১১১৪৭৫৭০, Email- rahamot21@gmail.com

বিশ্ব শিক্ষক দিবসে বিক্ষিপ্ত ভাবনা > দৈনিক শিক্ষা, ০৫ অক্টোবর ২০২১

পত্রিকার লিংক

বিশ্ব শিক্ষক দিবসে বিক্ষিপ্ত ভাবনা 

দৈনিক শিক্ষা > ০৫ অক্টোবর ২০২১



মো. রহমত উল্লাহ্

১. শিক্ষক হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর। এই মানুষ গড়ার কারিগর যত বেশি যোগ্য হবেন, সুদক্ষ হবেন ততবেশি যোগ্য নাগরিক পাবো আমরা। তাইতো জীবনের সকল পরীক্ষায় অতি উত্তম ফলাফল অর্জনের পাশাপাশি একজন শিক্ষককে চলায়, বলায়, সাজে, পোশাকে, চিন্তায়, চেতনায়, জ্ঞানে, দক্ষতায়, মেধায়, নীতিতে, আদর্শে, দেশপ্রেমে, জাতীয়তাবোধে, আধুনিকতায়, হতে হয় উত্তম। এসব বিবেচনায় যার উত্তম হবার ইচ্ছা আছে, যোগ্যতা আছে, শিক্ষকতাকে ব্রত হিসেবে নেওয়ার মানসিকতা আছে তাকে বাছাই করার কাজটি আসলেই কঠিন। আমাদের দেশে শিক্ষক বাছাইয়ের প্রচলিত প্রক্রিয়া কতটা মানসম্মত তা ভেবে দেখা উচিত। বর্তমানে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের জন্য বাছাই ক্ষমতা এনটিআরসিএ এর হাতে নেওয়ার ফলে আগের তুলনায় কিছুটা অধিক যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ পাচ্ছেন সারাদেশে। তথাপি সেই মান প্রত্যাশিত পর্যায়ে পৌঁছেনি। এখনো কিছু কিছু বিষয়ে এমন অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ পাওয়া যাচ্ছে যাদের সাধারণ জ্ঞান ও বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের গভীরতা ও প্রায়োগিক ক্ষমতা অত্যন্ত কম এবং তারা জানেন না ও পারেন না অনেক অনেক শব্দের সঠিক বানান ও উচ্চারণ! শ্রেণিকক্ষেও পরিহার করতে পারেন না আঞ্চলিক ভাষা! সঠিক পাঠদান তো অনেক দূরের কথা! প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিটি স্তরে শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য অবশ্যই আরো উন্নত করতে হবে শিক্ষক বাছাই প্রক্রিয়া। সকল স্তরেই বৃদ্ধি করতে হবে শিক্ষক হওয়ার নূন্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং বাছাইয়ে মূল্যায়ন করতে হবে আরো অনেক বিষয়। তদুপরি শিক্ষক বাছাইকালে অবশ্যই প্রার্থীদের অংশগ্রহণ করাতে হবে দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে ও প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে। যেন মূল্যায়ন করা যায় তাদের লেখার, বলার ও পাঠদানের দক্ষতা। চিহ্নিত করা যায় অযোগ্যতা বা দুর্বলতা।


২. আধুনিক বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানে শিক্ষককে থাকতে হয় সমৃদ্ধ। জানতে হয় আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার, সুফল-কুফল এবং সে আলোকে শিক্ষার্থীকে দিতে হয় সঠিক দিকনির্দেশনা। শিক্ষা লাভে শিক্ষককে সদা সর্বদা থাকতে হয় সক্রিয়। হতে হয় বই ও প্রকৃতির একনিষ্ঠ পাঠক এবং সেভাবেই গড়ে তুলতে হয় শিক্ষার্থীদের। শিক্ষক নিজে হতে হয় সবচেয়ে বড় শিক্ষার্থী। যিনি নিজে শিক্ষার্থী নন, তিনি অন্যের শিক্ষক হবেন কী করে? শিক্ষাদান শিক্ষকের একান্ত কর্তব্য। আর শিক্ষাগ্রহণ শিক্ষকের গুরুদায়িত্ব। শিক্ষাদানের পূর্বশর্তই শিক্ষা গ্রহণ। প্রতিনিয়ত শিক্ষাদান কার্যের পূর্বপ্রস্তুতি হচ্ছে প্রতিনিয়ত শিক্ষা গ্রহণ। অবশ্যই থাকতে হবে বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ। যে শিক্ষক ভাববেন, আমি কেবল পড়াব, পড়ব না; সে শিক্ষক কখনো ভালো শিক্ষক হবেন না। শিক্ষক নিজের মধ্যে শিক্ষার সঠিক চর্চা করেই সঠিক পরিচর্যা করবেন শিক্ষার্থীর। ভালো শিক্ষক নিজের মধ্যে জ্ঞানের চর্চা করবেন প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ, আজীবন। নিরলসভাবে অর্জন ও বিতরণ করবেন নতুন নতুন জ্ঞান। শিক্ষার্থী ও সমাজের সব মানুষকে করবেন জ্ঞানে-গুণে সমৃদ্ধ। আলোকিত করবেন দেশ ও জাতি।


একজন ভালো শিক্ষক হবেন নিবেদিতপ্রাণ মানুষ। তার থাকবে নিজেকে উজাড় করে দেয়ার মতো মন-মানসিকতা। ভোগের চেয়ে ত্যাগের ইচ্ছাই থাকবে বেশি। তিনি কী পেলেন, তার চেয়ে বেশি ভাববেন কী দিলেন এবং কী দিতে পারলেন না। ভোগের চেয়ে ত্যাগেই বেশি আনন্দিত হবেন তিনি। বস্তু প্রাপ্তির নয়, জ্ঞান প্রাপ্তি ও প্রদানের সংগ্রামে অবতীর্ণ থাকবেন শিক্ষক। কেবল বস্তুগত প্রপ্তির আশায় যিনি শিক্ষক হবেন ও শিক্ষকতা করবেন তিনি কখনো প্রকৃত শিক্ষক হয়ে উঠবেন না। কেননা, প্রকৃত শিক্ষাদানের অন্তর্নিহিত অনাবিল আনন্দ ও শিক্ষাদানের অফুরান পুণ্য থেকে তিনি বঞ্চিতই থেকে যাবেন। শিক্ষকতার প্রকৃত পরিতৃপ্তি লাভের অতল সাগরে কোনোদিন যাওয়া হবে না তার। শিক্ষার্থীর জন্য যিনি নিবেদিতপ্রাণ তিনিই পরম শ্রদ্ধেয়। তাকেই শ্রদ্ধাভরে আজীবন মনে রাখে শিক্ষার্থী।


একজন ভালো শিক্ষক আজীবন লালন করবেন জানার এবং জানানোর ঐকান্তিক ইচ্ছা। শিক্ষককে জ্ঞানার্জনে হতে হবে নিরলস। অত্যন্ত সমৃদ্ধ হতে হবে নির্ধারিত বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানে। শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি অত্যন্ত ভালোভাবে জানা থাকতে হবে শিক্ষার সংজ্ঞা, শিক্ষার উদ্দেশ্য ও শিক্ষাদানের আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি।


অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হবেন শিক্ষক। তিনি হবেন সৃষ্টিশীল, সৃজনশীল ও বাস্তববাদী। তার আয়ত্তে থাকবে শিক্ষাদানের মনস্তাত্ত্বিক জ্ঞান ও আধুনিক কলাকৌশল। একজন ভালো শিক্ষক হবেন শিক্ষার্থীর মন-মানসিকতা, যোগ্যতা-অযোগ্যতা, আগ্রহ-অনাগ্রহ বোঝার অপরিসীম ক্ষমতার অধিকারী। নিজের প্রতিটি শিক্ষার্থীকে সবদিক থেকে প্রতিনিয়ত মূল্যায়ন করবেন শিক্ষক। সেই মূল্যায়নের আলোকেই দেখাবেন শিক্ষার্থীর সামনে এগিয়ে যাওয়ার সঠিক পথ। 


দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধে পরিপূর্ণ হবেন শিক্ষক। ভালোভাবে জানবেন দেশ-জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্য। নিজের মধ্যে গভীরভাবে লালন ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সচেতনভাবে সঞ্চালন করবেন দেশপ্রেম ও জাতীয় চেতনা। দেশপ্রেমে ও জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত করবেন শিক্ষার্থীদের। 


প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের পাশাপাশি শিক্ষকের থাকতে হবে প্রাকৃতিক শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা। প্রকৃতির একনিষ্ঠ ছাত্র হবেন শিক্ষক। থাকতে হবে প্রতিনিয়ত প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের ঐকান্তিক ইচ্ছা। নিজে শিখবেন এবং নিজের শিক্ষার্থীদের শিখাবেন প্রকৃতির পাঠ। সেই সঙ্গে শিখিয়ে দেবেন প্রকৃতির পাঠ রপ্ত করার কৌশল। শিক্ষার্থী যেন প্রকৃতিকে বানাতে পারে তার জীবনের নিত্য শিক্ষক। 


৩. যতই আধুনিক শিক্ষা উপকরণ যুক্ত করা হোক, উন্নত সুযোগসুবিধা সম্বলিত বহুতল ভবন নির্মাণ করা হোক; শিক্ষকের মান বৃদ্ধি করা সম্ভব না হলে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। শিক্ষকের মান বৃদ্ধি করা খুবই কঠিন কাজ বিশেষ করে আমাদের দেশে যেখানে সর্বোচ্চ মেধাবীরা শিক্ষকতায় আসেননি, আসছেন না যুগ যুগ ধরে। টাকা হলে রাতারাতি শিক্ষা উপকরণ বদল করা যায়, পুরনো ভবন ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ করা যায়; কিন্তু শিক্ষকদের বদল বা মান বৃদ্ধি করা যায় না। শিক্ষকের মান বৃদ্ধি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। শিক্ষকের বেতন সর্বোচ্চ নির্ধারণ করে দেওয়ার সাথে সাথেই আমাদের সকল শিক্ষকের মান সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়ে যাবে এমনটি অবাস্তব। কেননা, এই আমি যতদিন আছি ততদিন দিয়েই যাবো ফাঁকি, রেখেই যাব কম দক্ষতার স্বাক্ষর। তথাপি বৃদ্ধি করতে হবে আমার তথা শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা। প্রশিক্ষিতদের দিতে হবে আরো বর্ধিত বেতন। শিক্ষকতায় আনতে হবে সর্বোচ্চ মেধাবী ও যোগ্যদের। কোনরকম কোটা সংরক্ষণ করে তুলনামূলক কম যোগ্যদের শিক্ষক হবার সুযোগ দেওয়া মোটেও উচিত নয়। কেননা, শিক্ষক অযোগ্য হলে জাতি অযোগ্য হয়। আমাদের সর্বাধিক মেধাবী ও যোগ্য সন্তানেরা যেদিন সাগ্রহে এসে দখল করবে আমাদের স্থান সেদিনই উন্নীত হবে আমাদের শিক্ষকদের কাঙ্খিত মান। সেটি যতই সময়সাপেক্ষ হোক এখন হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না কোন অজুহাতেই। ব্যাপক প্রশিক্ষণ দিয়ে যথাসম্ভব বৃদ্ধি করার চেষ্টা করতে হবে আমার মত বিদ্যমান শিক্ষকদের মান। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে শিক্ষক হবার জন্য মাস্টার অফ টিচিং ডিগ্রি বাধ্যতামূলক। তিনি যে পর্যায়ের, যে বিষয়ের শিক্ষকই হতে চান না কেন তার নিজস্ব বিষয়ে ডিগ্রির পাশাপাশি মাস্টার অফ টিচিং ডিগ্রি থাকতেই হবে। অর্থাৎ পাঠদানের বৈজ্ঞানিক কৌশল না জেনে কেউ শিক্ষক হতে পারেন না। অথচ আমাদের দেশে যে কেউ যে কোনো সময় শিক্ষক বা হুজুর হয়ে যাচ্ছেন! শিক্ষক হবার জন্য শিক্ষকতা শিক্ষা করার অর্থাৎ শিক্ষা মনোবিজ্ঞান ও পাঠদানের আধুনিক কলাকৌশল আয়ত্ত করার কোন বাধ্যবাধকতা নেই! তাই আমাদের বিদ্যমান শিক্ষক বা ওস্তাদদের যতটুকু সম্ভব প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর পাঠদানে। এর কোনো বিকল্প নেই বর্তমান বাস্তবতায়।


৪. আমাদের তুলনায় উন্নত বিশ্বে শিক্ষকগণের আর্থিক সুবিধা অনেক অনেক বেশি। হ্যা, একথা অবশ্যই সঠিক, আমাদের দেশের শিক্ষকগণের আর্থিক সুবিধা অত্যন্ত কম; যা বৃদ্ধি করা জরুরি। আসন্ন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপযোগী যোগ্য ও দক্ষ নাগরিক-কর্মী তৈরি করার জন্য অবশ্যই বৃদ্ধি করতে হবে আমাদের শিক্ষার মান। শিক্ষার মান বাড়ানোর জন্যই নিয়োগ করতে হবে সর্বাধিক যোগ্য শিক্ষক, বাড়াতে হবে শিক্ষকগণের আর্থিক সুবিধা। সেই সাথে করতে হবে বিদ্যমান সুবিধার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার। পর্যাপ্ত প্রার্থী থাকায় বর্তমান স্বল্প সুবিধার মধ্যেও শুরু করা সম্ভব আরও অধিক যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া। সেজন্য পুনঃনির্ধারণ করতে হবে সর্বস্তরে শিক্ষক নিয়োগের নূন্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অগ্রাধিকার। শিক্ষকতার জন্য মূল বিষয়াদির পাশাপাশি শিক্ষায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিকে অগ্রাধিকার দেওয়া শুরু করা হলে কয়েক বছর পরেই আর অভাব হবে না এই ডিগ্রিধারী প্রার্থীর। যারা শিক্ষক হতে চান তারা অনেক আগে থেকেই মনেপ্রাণে লালন করবেন শিক্ষকতা পেশাকে এবং যে বিষয়ের শিক্ষক হতে চান সে বিষয়ে প্রয়োজীয় ডিগ্রি অর্জনের পাশাপাশি অর্জন করবেন শিক্ষায় ব্যাচেলর ডিগ্রি। সবাই সব কাজের যোগ্য হবেন না এটাই স্বাভাবিক। মনে রাখতে হবে অতি দুর্বলকে বারবার প্রশিক্ষণ দিয়েও কাঙ্খিত মানে উন্নীত করা সম্ভব হয় না। একজন অযোগ্য শিক্ষক সারাজীবনে তৈরি করেন অসংখ্য অযোগ্য নাগরিক-কর্মী। হয়তো সঠিক যোগ্যতার অভাবে নিজের অজান্তে, অনিচ্ছায় আমিও করছি তাই। শিক্ষক অযোগ্য হলে, সাধারণের অজান্তে সমাজের সর্বত্র তৈরি হয় গভীর ক্ষত, জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায় দেশ ও জাতির দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি! তাই অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে শিক্ষকগণের সর্বোচ্চ আর্থিক সুবিধা। কেননা, অধিক যোগ্য নাগরিক-কর্মী তৈরির জন্যই শিক্ষককে হতে হবে সর্বোচ্চ যোগ্য।


৫. আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে যতটুকু অগ্রগতি তথা অনুকূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে ও হচ্ছে তা মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন ও আছেন শিক্ষক সমাজ। অন্যথায় এই সফলতাটুকু অর্জন সম্ভব ছিল না মোটেও। আর এই শিক্ষকদের প্রায় ৯৭ ভাগ হচ্ছেন বেসরকারি। তাদের প্রাপ্ত বেতন-ভাতায় সংসার চলে না, এটি এখন সবাই জানেন ও বোঝেন। শিক্ষকদের বাধ্য হয়েই বিকল্প উপার্জনের রাস্তা খুঁজতে হচ্ছে সংসারের ন্যূনতম ব্যয় মেটানোর জন্য। তাই তারা যোগ্যতানুসারে বেছে নিয়েছেন অতিরিক্ত কাজ করে সামান্য আয়ের পথ। কেউ কেউ প্রাইভেট পড়ানো, নোট-গাইড লেখা, বিভিন্ন ব্যবসা, ঠিকাদারি, রাজনীতি ইত্যাদি করছেন। আবার কেউ বাবার/স্বামীর ধন খাচ্ছেন। সেসব খাতের আয়ের ওপর যেহেতু তাদের জীবনধারণ অনেকাংশে নির্ভর করছে; সেহেতু তারা ঐ কাজকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। ঐ কাজেই বেশি সময়, শ্রম ও মেধা খাটাচ্ছেন। ফলে শিক্ষকতায় তাদের মনোযোগ না থাকা বা কম থাকাই স্বাভাবিক। শিক্ষার্থীরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়াই বাস্তব। এই বাস্তবতায় প্রাইভেট না পড়ে বা কোচিং না করে শিক্ষার্থীরা পারবে কী ভাবে? তবে এ কথা স্বীকার করতে হবে, যারা শিক্ষকতার পাশাপাশি অন্যান্য কাজ করছেন বা করতে বাধ্য হচ্ছেন; তাদের চেয়ে যারা প্রাইভেট পড়াচ্ছেন বা কোচিং করাচ্ছেন তারা তো ব্যক্তিগতভাবে হলেও শিক্ষকতাই করছেন। নিজের পাঠদানের বিষয়টি নিয়মিত চর্চা করছেন কমবেশি। অন্যরা তো তা-ও করছেন না।  এই প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করতে পারেনি এবং শিক্ষকদের কাম্য বেতন-ভাতা নিশ্চিত করতে পারেনি বলেই হয়তো যুগ যুগ ধরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাইভেট-কোচিং বন্ধের ব্যাপারে নমনীয় নীতি অনুসরণ ও নির্ধারণ করতে বাধ্য হয়েছে বার বার।


দীর্ঘদিনের এই দুরবস্থা থেকে শিক্ষার উত্তরণ ঘটাতে চাইলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদেরও বাড়াতে হবে শিক্ষকদের প্রকৃত আর্থিক সুবিধা এবং সেই সঙ্গে বাড়াতে হবে তাদের বাস্তবিক কর্মঘণ্টা। আর সেটি আন্তরিক ভাবে মেনে নিতে হবে শিক্ষকদের। উন্নত বিশ্বের শিক্ষকগণ তাদের শিক্ষার্থীদের নির্ধারিত ক্লাসেই দিয়ে থাকেন পরিপূর্ণ শিক্ষা। স্কুলের বাইরে গিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়তে হয় না ক্লাসের পড়া। 


মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে প্রথমত নিশ্চিত করতে হবে মানসম্মত শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দ্বিতীয়ত শিক্ষকদের পর্যাপ্ত বেতন-ভাতা প্রদানের মাধ্যমে আরো বেশি সময় প্রতিষ্ঠানে অবস্থান করিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য নিশ্চিত করতে হবে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা। যেন শিক্ষকদের না থাকে বেতন-ভাতার অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের ধান্দা এবং শিক্ষার্থীদের না থাকে ক্লাসরুমের বাইরে ক্লাসের বিষয় পড়ার কোনো প্রয়োজনীয়তা। 


মো. রহমত উল্লাহ্

প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ এবং অধ্যক্ষ -কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা। 


০১ অক্টোবর ২০২১


https://lm.facebook.com/l.php?u=https%3A%2F%2Fwww.dainikshiksha.com%2F%25E0%25A6%25AC%25E0%25A6%25BF%25E0%25A6%25B6%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25AC-%25E0%25A6%25B6%25E0%25A6%25BF%25E0%25A6%2595%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25B7%25E0%25A6%2595-%25E0%25A6%25A6%25E0%25A6%25BF%25E0%25A6%25AC%25E0%25A6%25B8%25E0%25A7%2587-%25E0%25A6%25AC%25E0%25A6%25BF%25E0%25A6%2595%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25B7%25E0%25A6%25BF%25E0%25A6%25AA%25E0%25A7%258D%25E0%25A6%25A4-%25E0%25A6%25AD%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25AC%25E0%25A6%25A8%25E0%25A6%25BE%2F216999%2F&h=AT0rnl2I_kKG-qVllaubGJePcrliiJVHALb_QrGwirt1crKVqikKTHXzemRBYET9Rr4VRoScsGdjOH5HsI86W8Rl4Md2yG_GQ38mJI0inyDnTm7Cmpe49IxVDKAzGSGJCG0

চারু ও কারুকলা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির যোগ্য শিক্ষক চাই > দৈনিক শিক্ষা, ০৩ অক্টোবর ২০২১

পত্রিকার লিংক

চারু-কারুকলা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির যোগ্য শিক্ষক চাই

দৈনিক শিক্ষা > ০৩ অক্টোবর ২০২১



মো. রহমত উল্লাহ্

বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০২১ প্রকাশের পর থেকেই  বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও ব্যানার-পোস্টারে খুব বেশি চোখে পড়ছে নিম্নরূপ ভর্তির বিজ্ঞপ্তি। 

"… টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে এক বছর মেয়াদী এ্যাডভান্স সার্টিফিকেট ইন ফাইন আর্টস (চারু-কারুকলা) এবং কম্পিউটার টেকনোলজি (ICT) কোর্সে ভর্তি চলছে। এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে চারু ও কারুকলা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ের সহকারী শিক্ষক পদে চাকরি প্রত্যাশী, যে কোন বিষয়ে স্নাতক-ফাজিল-অনার্স বা সমমান পাস শিক্ষার্থী বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এক বছর মেয়াদী এ দুই কোর্সে জানুয়ারি-ডিসেম্বর, ২০২১ এবং জুলাই-জুন ২০২১-২০২২ সেশনে ভর্তি হতে পারবেন।" 


গত ০৮ সেপ্টেম্বর তারিখে দৈনিক শিক্ষা ডটকমে প্রকাশিত উল্লিখিত বিজ্ঞপ্তিটিতে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, প্রায় নয় মাস আগে থেকে শুরু হওয়া এবং প্রায় তিন মাস আগে থেকে শুরু হওয়া দুটি কোর্সে নিয়মিত শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে। এক বছর মেয়াদী কোর্স এর প্রায় নয় মাস চলে যাওয়ার পর নিয়মিত শিক্ষার্থী ভর্তি করা কীভাবে সম্ভব তা বোধগম্য নয়! এখন কোন শিক্ষার্থী ভর্তি হলে পরবর্তী তিন মাসে তাকে কীভাবে এক বছরের কোর্স করানো সম্ভব তাও বোধগম্য নয়। অবশ্য নয় মাস বিলম্বে ভর্তি করে যদি নয় মাস পরে কোর্স সমাপ্ত করা হয় তো সেটি যুক্তিযুক্ত হতে পারে।  চারু ও কারুকলা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয় দুটি সম্পূর্ণই ব্যবহারিক। এসকল বিষয়ে ক্লাস না করে বা অনলাইনে ক্লাস করে সঠিকভাবে কোর্স সম্পন্ন করা মোটেও সম্ভব নয়। 


অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, যথাযথ লেখাপড়া ও হাতে কলমে শিক্ষা ব্যতীতই সনদ প্রদানের একটি প্রক্রিয়া চলমান! তাই এর বাস্তবিক সত্যতা নিশ্চিত হওয়া জরুরি। কেননা, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ নিয়ে শিক্ষক হবার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে এই সনদ। তাই চাকরি প্রত্যাশীরা যে করেই হোক এই সনদ সংগ্রহে এখন ব্যতিব্যস্ত। এ দুটি কোর্সে ভর্তির বিজ্ঞপ্তি সম্বলিত বিপুল সংখ্যক ব্যানার-পোস্টার, বিজ্ঞাপন ও ফোনে আসা এসএমএস দেখে মনে হচ্ছে দ্রুত গজিয়ে উঠছে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান এবং বিদ্যমান অনেক প্রতিষ্ঠানে তড়িঘড়ি খোলা হচ্ছে এ দুটি কোর্স। এ দুটি কোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তি করা, পাঠদান করা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করার জন্য নিশ্চয়ই কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অনুমোদন প্রয়োজন হচ্ছে। তাই কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের দেখা উচিত প্রায় নয় মাস ও প্রায় তিন মাস চলে যাওয়ার পর কোর্স দু'টিতে কীভাবে নিয়মিত শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়! ভর্তির পর বাস্তবে কত মাস শিক্ষা দিয়ে এই শিক্ষার্থীদের এক বছর মেয়াদি কোর্স সমাপ্ত করা হয়। 


আলোচিত এ সকল প্রতিষ্ঠানের যোগ্যতা কেমন তাও যাচাই করা প্রয়োজন। উল্লিখিত কোর্স দু'টি পড়ানোর মতো পর্যাপ্ত যোগ্য শিক্ষক তাদের আছে কিনা, পাঠদানের উপযোগী অবকাঠামো আছে কিনা, ব্যবহারিক ক্লাস করার উপযোগী যন্ত্রপাতি ও ল্যাব আছে কিনা, যত সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে তত সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি করার অনুমতি আছে কিনা, যে পরিমাণ কোর্স ফি নেওয়া হচ্ছে তা যথাযথ হচ্ছে কিনা, নিয়মিত থিউরিটিক্যাল ও প্রেকটিকেল ক্লাস হচ্ছে কিনা, শিক্ষার্থীরা সে সকল ক্লাসে যথাযথভাবে অংশগ্রহণ করে কাঙ্খিত যোগ্যতা ও দক্ষতা অর্জন করছে কিনা ইত্যাদি বিষয় নিশ্চিত হয়ে যথাযথ মূল্যায়নের মাধ্যমে সনদ প্রদান করা উচিত। 


একবছর মেয়াদী এডভান্স সার্টিফিকেট কোর্স  (থিউরিটিক্যাল ও প্রাকটিক্যাল) যদি তিন মাসে সম্পন্ন করে সনদ দেওয়া হয় তো তারা কেমন শিক্ষিত হবেন? এরপর এইরূপ সনদধারীরা যদি সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পান তো তারা কেমন যোগ্য  শিক্ষক হবেন? শিক্ষকতায় যদি আসতে পারেন তো তারা কেমন শিক্ষার্থী তৈরি করবেন? একজন শিক্ষক অযোগ্য হলে তো তিনি সারাজীবনে তৈরি করেন অসংখ্য অযোগ্য নাগরিক-কর্মী! বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০২১ অনুসারে চারু ও কারুকলা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয় দুটিতে সারাদেশে নিয়োগ হবে বিপুলসংখ্যক শিক্ষক। সম্ভাব্য এই শিক্ষকগণ যোগ্য না হলে ব্যাহত হবে সরকারের উদ্দেশ্য। সঠিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। 


যথাযথ যোগ্যতা না দিয়ে সনদ দেওয়া হলে, প্রায় শতভাগ আবেদনকারী অযোগ্য হলে এবং তাদের মধ্য থেকেই বিপুল সংখ্যক লোক নিয়োগ দিতে হলে যতই বাছাই করা হোক কাঙ্ক্ষিত যোগ্য শিক্ষক পাওয়া যাবে কীভাবে? শিক্ষক যোগ্য না হলে কাঙ্খিত শিক্ষা নিশ্চিত হবে কীভাবে? তাই এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সজাগ দৃষ্টি ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ প্রত্যাশা করছি।  


মো. রহমত উল্লাহ্

শিক্ষক ও কলাম লেখক