উপসম্পাদকীয় >মুক্তচিন্তা >দৈনিক ভোরের কাগজ >০৮ সেপ্টেম্বর ২০২০
কীভাবে দ্রুত অর্জন সম্ভব শতভাগ সাক্ষরতার হার
অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ্
দেশ নিরক্ষরমুক্ত হয়ে গেলে এ খাতে আর বিদেশি ‘ভিক্ষা’ পাওয়া যাবে না, ভাগ-বণ্টনও করা যাবে না; অতএব এমনি চলুক! যারা এই অশুভ মনোভাব পোষণ করে তারা অবশ্য আমার এই উচিত কথায় মনোক্ষুণ্ন হয়ে বিভিন্ন সমালোচনা করবে। বাস্তবতা হচ্ছে, আইনের বাধ্যবাধকতা দ্বারা নিরক্ষরদের শিখার আগ্রহ নিশ্চিত করা যাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
গত ২০১০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রকাশিত আমাদের দেশের প্রথম সারির একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সংবাদ শিরোনাম ছিল ‘মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ২০১৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ নিরক্ষরমুক্ত করা হবে’। সেটি বাঙালি জাতির জন্য অব্যশ্যই একটি সুখবর ছিল। কিন্তু তা অর্জিত হয়নি আজো! অথচ আমাদের সবাইকে ন্যূনতম অক্ষর জ্ঞান দান করে, নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে সমগ্র জাতিকে মুক্ত করার নামে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ বা কর্মসূচি বাস্তবায়নের পিছনে এ যাবত ব্যয় হয়েছে সরকারি, বেসরকারি ও দাতা সংস্থাগুলোর বিপুল অর্থ, শ্রম এবং সময়। আজো আমরা মুক্ত নই সেই অভিশাপ থেকে।
যদিও অনেকের মতে এসব পদক্ষেপের কারণেই বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে সাক্ষরতার হার বেড়ে বর্তমানে হয়েছে ৭৪.৭ শতাংশ। এসব কর্মসূচির মাধ্যমে কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পেয়েছে শিক্ষা সচেতনতা। প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বর্তমানে ড্রপ আউটের পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ২০ শতাংশের নিচে। সময়, শ্রম ও অর্থব্যয়ের তুলনায় এই অগ্রগতি মোটেও সন্তোষজনক নয়। সবচেয়ে বড় কথা, ব্যালট পেপারের মুড়িতে ভোটারদের টিপসহির পরিমাণ দেখে এই হিসাবের সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায় না। এখনো দেশের এক-চতুর্থাংশ মানুষ নিরক্ষর! বছরে সাক্ষরতার হার বাড়ছে ১ শতাংশেরও কম। এসডিজি অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যেই অর্জন করার কথা শতভাগ সাক্ষরতা। অথচ এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৩০ বছরেও অর্জন করা যাবে না শতভাগ সফলতা। তাই হয়তো নিন্দুকেরা বলে থাকেন, আমাদের নিরক্ষরতা জাতির জন্য অভিশাপ হলেও কারো কারো বিদেশি অর্থ পাওয়ার ও খাওয়ার জন্য হয়তো এটি বড় আশীর্বাদ!
আসলে শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের বিশেষ করে বয়স্কদের অনাগ্রহ বা অলসতাই অশিক্ষার অন্যতম কারণ। অসচেতনতা ও অসচ্ছলতা তো আছেই। তদুপরি নেই কোনো বাধ্যবাদকতা। ন্যূনতম লেখাপড়া না জানার দায়ে বড় কোনো সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন বলে মনে করছেন না নিরক্ষররা। কেননা, তারা ব্যক্তিগত জৈবিক ও বৈষয়িক সমস্যাকেই বড় করে দেখেন অশিক্ষার অন্ধকার চোখে। তাই তাদের প্রত্যেককে কোনো না কোনোভাবে বাধ্য করতে হবে শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী করতে। বুঝিয়ে দিতে হবে, শিক্ষা গ্রহণ ব্যতীত অচল হয়ে যাবে তার জীবনযাপন। কেননা, কাউকে কোনো কিছু শিক্ষা দেয়া যায় না, যদি সে শিক্ষা গ্রহণের জন্য এগিয়ে না আসে। একটি সরকারি পদক্ষেপই এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ: শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ ১৯৮১-৮২ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ ৫০ নম্বর পুরস্কার দিয়ে পাঠিয়ে ছিলেন নিরক্ষরদের অক্ষর জ্ঞান দেয়ার জন্য। পরীক্ষার্থীরা প্রথমে মনের আনন্দে এবং পরে বাধ্য হয়ে বারবার গিয়েছে নিরক্ষরদের বাড়ি বাড়ি। তখন আমি নিজেই শুনেছি নিরক্ষরদের মন্তব্য ‘আমি লেখাপড়া শিখলে তুমি নম্বর পাইবা আমি কী পামু?’ এ প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছে কিশোর পরীক্ষার্থীরা। নম্বর পাওয়ার তাগিদে (দুই/এক রোজের পারিশ্রমিক দিয়ে বা অন্য কোনোভাবে) সামান্য লেখাপড়া জানে এমন লোকদের হাজির করেছে স্যারদের সামনে। মিথ্যে করে বলেছে- উনাকে আমি লেখাপড়া শিখিয়েছি। নম্বর পেয়ে গেছে পরীক্ষায়। আসলে যে নিরক্ষর সে পায়নি বা নেয়নি অক্ষর জ্ঞান। চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে অত্যন্ত মিতব্যয়ী একটি পদক্ষেপ। এছাড়াও সম্ভব হয়নি দাতাদের অর্থায়নে পরিচালিত ‘সবার জন্য শিক্ষা’ কর্মসূচি ও নিজেদের অর্থায়নে পরিচালিত ‘সার্বিক সাক্ষরতা আন্দোলন’ প্রকল্পের প্রকৃত সফলতা অর্জন। সেখানেও ছিল নিরক্ষরদের আগ্রহ তৈরির ব্যর্থতা। শিক্ষা লাভের জন্য বয়স্কদের আমরা নিতে পারিনি সেই নাইট স্কুল বা বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্রে। সব শিশুকে নিতে পারিনি বা ধরে রাখতে পারিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। আমরা হয়তো মনে রাখিনি যে, শিখন একটি দ্বিমুখী প্রক্রিয়া। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী উভয়ের আন্তরিকতার ওপরই নির্ভর করে এর সফলতা।
আলোচিত বাস্তবতার আলোকে দেখা যায় সার্বিক সাক্ষরতা অর্জন দ্রুত ও নিশ্চিত করতে চাইলে অন্যান্য পদক্ষেপের পাশাপাশি নিম্নরূপ দুয়েকটি আইন বা আদেশ জারি করা জরুরি। যেমন বিয়ের বর, কনে ও সাক্ষী হতে হলে; যে কোনো দলিলের দাতা, গ্রহীতা ও সাক্ষী হতে হলে; কোনো মামলার বাদী, বিবাদী বা সাক্ষী হিসেবে আদালতে জবানবন্দী দিতে গেলে; ব্যাংক বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতে গেলে; যে কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হতে ও ভোট দিতে চাইলে; যে কোনো প্রতিষ্ঠানে যে কোনো পদে চাকরি প্রার্থী হলে; নিজের বা অন্যের পেনশনের বা ভাতার টাকা পেতে হলে; কোনোরূপ সরকারি সাহায্য গ্রহণ করতে চাইলে; বিদেশ যেতে চাইলে অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের এমন শিক্ষা থাকতে হবে যাতে তারা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পড়ে ও বুঝে নিজের ‘নাম স্বাক্ষর’ দিতে পারেন, টিপসহির পাশাপাশি। শুনতে ও মানতে একটু কঠিন মনে হলেও সত্যিকারার্থে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ নিরক্ষরমুক্ত করতে হলে এখনই জারি করতে হবে উল্লিখিত আদেশ, যা কার্যকর করতে হবে ২০৩১ সালের শুরুতে। তবে শিশু, প্রতিবন্ধী ও অতি বৃদ্ধদের মানবিক কারণেই রাখতে হবে এই আইনের বাইরে।
দেশ নিরক্ষরমুক্ত হয়ে গেলে এ খাতে আর বিদেশি ‘ভিক্ষা’ পাওয়া যাবে না, ভাগ-বণ্টনও করা যাবে না; অতএব এমনি চলুক! যারা এই অশুভ মনোভাব পোষণ করে তারা অবশ্য আমার এই উচিত কথায় মনোক্ষুণ্ন হয়ে বিভিন্ন সমালোচনা করবে। বাস্তবতা হচ্ছে, আইনের বাধ্যবাধকতা দ্বারা নিরক্ষরদের শিখার আগ্রহ নিশ্চিত করা যাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ আমরা উপদেশের চেয়ে কড়া নির্দেশই মান্য করি বেশি। তবে আমার বক্তব্যের অর্থ এই নয় যে, শুধু আইন করে দিলেই নিরক্ষরদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে। বরং সরকারি পদক্ষেপের অংশ হিসেবেই হোক আর ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই হোক ধনী-দরিদ্র, ছোট-বড়, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দেশপ্রেমিক ছাত্র, শিক্ষক, ডাক্তার, চাকুরে, গৃহিণী, ইমাম, সমাজকর্মী, খেলোয়াড়, সাংস্কৃতিক কর্মী, রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ সব শিক্ষিত ব্যক্তিকেই এগিয়ে আসতে হবে উদার মন নিয়ে। একজনকে নিতে হবে কমপক্ষে একজনের দায়িত্ব। কাজের লোক বলে, দরিদ্র বলে, ভিক্ষুক বলে নিরক্ষরদের প্রতি কোনো তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য বা অবহেলা নয়; বরং শ্রদ্ধাভরে টেনে নিতে হবে কাছে। অত্যন্ত ধৈর্য ধরে দিতে হবে শিক্ষা। আবারো প্রমাণ করতে হবেÑ ‘আমরাও পারি’। তবেই সম্পাদিত হবে পুণ্যকর্ম। তৈরি হবে সত্যিকার নিরক্ষরমুক্ত বাঙালি জাতি। বিশ্বদরবারে বৃদ্ধি পাবে আমাদের প্রকৃত গৌরব।
মো. রহমত উল্লাহ্ : শিক্ষাবিদ এবং অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা।
rahamot21@gmail.চম
0 মন্তব্য(গুলি):