প্রাইভেট কোচিং বন্ধের উপায় কী? দৈনিক শিক্ষা, ২৮ জানুয়ারি ২০১৯

        মূল পত্রিকার লিংক

প্রাইভেট কোচিং বন্ধের উপায় কী?
মো. রহমত উল্লাহ্ |
দৈনিক শিক্ষা, ২৮ জানুয়ারি, ২০১৯

আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তনের অপরিহার্যতা সবাই স্বীকার করলেও অতীতে এর জন্য বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বর্তমান সরকার তা নিয়েছে এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে বেশ কিছু অনুকূল পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। এই যে সারা দেশে অনলাইনে সব ভর্তি, রেজিস্ট্রেশন, ফরম পূরণ, একই দিনে বই বিতরণ, একই দিনে ক্লাস শুরু, একই রুটিনে অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা গ্রহণ, অতি স্বল্পতম সময়ে কাগজবিহীন ফলাফল প্রকাশ, এসএমএসের মাধ্যমে ফলাফল জানা ও উত্তরপত্র পুনঃমূল্যায়ন, মোটের ওপর একটা উদ্যম-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে-  এ সবকিছুই  বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকায় রয়েছেন শিক্ষক সমাজ।







শিক্ষকরা তাদের অভাব-অনটন থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় বুক বেঁধে কাজ করেছেন ও করছেন সরকারের গৃহীত অনুকূল পদক্ষেপ বাস্তবায়নে। অন্যথায় এই সফলতাটুকু অর্জন সম্ভব ছিল না মোটেও। আর এই শিক্ষকদের ৯৭ ভাগ হচ্ছেন বেসরকারি। তাদের প্রাপ্ত বেতন-ভাতায় সংসার চলে না- এটি এখন সবাই জানেন ও বোঝেন। শিক্ষকদের বাধ্য হয়েই বিকল্প উপার্জনের রাস্তা খুঁজতে হচ্ছে সংসারের ন্যূনতম ব্যয় মেটানোর জন্য।



তাই তাদের যোগ্যতানুসারে বেছে নিয়েছেন ওভারটাইম আয়ের রাস্তা। কেউ প্রাইভেট পড়াচ্ছেন, কেউ নোট-গাইড লিখছেন, কেউ ঠিকাদারি, কেউ জমির ব্যবসা, কেউ রাজনীতি ব্যবসা, কেউ আবার দোকানদারি করছেন, কেউ বাবার/স্বামীর ধন খাচ্ছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। সেসব খাতের আয়ের ওপর যেহেতু তাদের জীবনধারণ করতে হচ্ছে সেহেতু তারা এডিশনাল কাজকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। সে কাজেই বেশি সময়, শ্রম ও মেধা খাটাচ্ছেন। ফলে শিক্ষকতায় তাদের মনোযোগ না থাকা বা কম থাকাই স্বাভাবিক। শিক্ষার্থীরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়াই বাস্তব। এই বাস্তবতায় প্রাইভেট বা কোচিং না করে শিক্ষার্থীরা পারবে কীভাবে? তবে এ কথা স্বীকার করতে হবে, যারা শিক্ষকতার পাশাপাশি অন্যান্য কাজ করছেন বা করতে বাধ্য হচ্ছেন; তাদের চেয়ে যারা প্রাইভেট-কোচিং দিচ্ছেন তারা তো ব্যক্তিগতভাবে হলেও শিক্ষকতাই করছেন। নিজের পাঠদানের বিষয়টি নিয়মিত চর্চা করছেন কমবেশি। অন্যরা তো তা-ও করছেন না।

এই প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করতে পারেনি বলেই হয়তো শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাইভেট-কোচিং বন্ধের ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত নমনীয় নীতি নির্ধারণ করতে বাধ্য হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। প্রাইভেট-কোচিং বন্ধের কথা বলে বলে শেষমেশ যে নীতিমালা জারি করেছেন তাকে পরোক্ষ অনুমোদনই বলছেন কেউ কেউ। [যেমন : শিক্ষকরা নিজের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদেরকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না। অন্য প্রতিষ্ঠানের ১০ জনের বেশি পড়াতে পারবেন না। নিজের শিক্ষার্থীদেরকে প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনায় প্রতি বিষয় শহরে ৩০০, উপশহরে ২০০, গ্রামে ১৫০ টাকা হারে; তবে সর্বমোট অনধিক ১২০০ টাকায় সব বিষয় পড়াতে পারবেন অভিভাবকদের সম্মতিসাপেক্ষে। এর ব্যত্যয় ঘটলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক শাস্তি পাবেন। একটি বিশেষ কমিটি তা মনিটরিং করবে।

এসব পদক্ষেপের ফলে যা দাঁড়াল তা হচ্ছে, আগে তো কেবল কঠিন বিষয়ে কোচিং হতো এখন হবে সব বিষয়ে। কারণ দুয়েক জন শিক্ষক কোচিং ফি পাবেন আর অন্যরা পাবেন না তা তো হবে না। তাই পরীক্ষায় ফেল করিয়ে কোচিংয়ে বাধ্য করাতে পারেন অতি সহজ বিষয়ের জটিল স্যাররাও।

অপরদিকে নিজের বাসায় বসে বা শিক্ষার্থীর বাসায় গিয়ে কোন শিক্ষক কখন কতজন কোন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াচ্ছেন তা মনিটর করা আমাদের জন্য দুরূহ কাজ। আমরা তো এখনও আমাদের নিত্যদিনের ওপেন ও প্যাকেট খাবারগুলোই ভেজাল এবং ফরমালিনমুক্ত করতে পারছি না। প্রকাশ্যে সদর রাস্তায় চলা মিটারবিহীন অটোরিকশা ও ট্যাক্সিক্যাব বন্ধ করতে পারছি না। সরকারি ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ করতে চেষ্টাও করছি না।

অথচ কোথায় কোন গ্রামেগঞ্জে, শহরে কোন ঘরে বসে বা অন্যের ঘরে গিয়ে কবে কখন সকাল-বিকেল রাতে কোন প্রতিষ্ঠানের কতজন শিক্ষার্থীকে কোন প্রতিষ্ঠানের কোন শিক্ষক প্রাইভেট-কোচিং দিচ্ছেন তা খুঁজে বের করে শাস্তি দেবেন আর প্রাইভেট-কোচিং বন্ধ হবে এমনটি অবাস্তব নয় কী? আসলে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা সঠিকভাবে পড়াচ্ছেন কি না, তদারকি করা প্রয়োজন সেটি। তা না করে কমিটি বাসাবাড়িতে যেয়ে তদারক করবে শিক্ষকরা সরকারি নিয়ম মেনে প্রাইভেট-কোচিং দিচ্ছেন কি না। এ যেন ‘চোখের অপারেশন পায়ে’।

একটু গভীরভাবে তাকালে দেখা যাবে অনেক মন্ত্রী, এমপি, আমলা, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতির ছেলেমেয়ে বা নাতি-নাতনিকে প্রাইভেট পড়ানোর জন্য হয়তো বাসায়ই নিয়োগ দেওয়া আছে একাধিক টিচার। বিশেষ করে নামকরা টিচার ও কোচিং-সেন্টারের আশেপাশের রাস্তায় যেসব দামি দামি গাড়ির ভিড় লেগে থাকে সেগুলোর অধিকাংশই সমাজ ও রাষ্ট্রের বিশেষ ব্যক্তিদের ছেলেমেয়ে বা নাতি-নাতনিদের। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, যাদের দিয়ে এই প্রাইভেট-কোচিং বাণিজ্য বন্ধের তদারকি করানো হবে তাদের কারও সন্তানও যে প্রাইভেট পড়েনি, পড়ছে না এবং পড়বে না, তা নিশ্চিত করবে কে? বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষকরা প্রাইভেট-কোচিং করানো বন্ধ করতে বাধ্য হলেও শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট-কোচিং না করে পারবে না। কারণ শ্রেণিকক্ষে পর্যাপ্ত শিক্ষা থেকে তারা বঞ্চিত। ফলে অশিক্ষকের কাছ থেকে প্রাইভেট-কোচিং নিতে বাধ্য হবে শিক্ষার্থীরা। অশিক্ষকদের তো আর শাস্তি নেই। সে হবে আরও বেশি ক্ষতির কারণ।

আবারও বলছি, দীর্ঘ অতীত ও বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের প্রয়োজনেই চলছে এই প্রাইভেট-কোচিং। কিন্তু এভাবে তো আর চলতে পারে না। শিক্ষার্থীরা নিজের প্রতিষ্ঠানে মোটা অঙ্কের টাকায় ভর্তি হবে, বেতন-ফি পরিশোধ করবে, আবার নিজের প্রতিষ্ঠানেই অতিরিক্ত টাকা দিয়ে কোচিং ক্লাস করে রিকভার করতে বাধ্য হবে নির্ধারিত ক্লাসের ঘাটতি পড়া! সব শিক্ষার্থীকে সব বিষয়ে পরিপূর্ণ পাঠদান করাই তো শিক্ষকদের চাকরি। কিন্তু শিক্ষকরা এ কাজ সঠিকভাবে সম্পাদন করছেন কি না তা তদারক করার জন্য কমিটি না করে, করা হল প্রাইভেট-কোচিং তদারকি কমিটি।

একজন শিক্ষক দৈনিক কত ঘণ্টা প্রতিষ্ঠানে থাকবেন, কত ঘণ্টা থাকছেন তার কি কোনো হিসাব নেওয়া হয়? আমার জানা মতে, এমনও শিক্ষক আছেন যারা ঢাকা শহরে বাসাবাড়িতে থেকে চাকরি করছেন অন্য জেলার সরকারি-বেসরকারি কলেজে। সপ্তাহে যাচ্ছেন ৩-৪ দিন। চল্লিশ মিনিটের ক্লাস নিচ্ছেন দিনে দুয়েকটি মাত্র। তাদের মাসিক কর্মঘণ্টা  ৮/১০/১৬/২০ ঘণ্টার। শুধু উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণি আছে এমন কলেজের একজন শিক্ষক যদি প্রতিদিন চল্লিশ মিনিটের দুটি করে ক্লাস সপ্তাহে ছয় দিনই নেন তবুও তার মাসিক কর্মঘণ্টা হবে সর্বোচ্চ ৩২ ঘণ্টা। এর বাইরে হয়তো কিছু পরীক্ষা নেওয়া আর খাতা দেখা। দৌড়ে এসে ক্লাস আবার ক্লাস শেষ হলেই দৌড়। এক কাজ থেকে এসে আবার ছুটছেন অন্য কাজে। পত্রপত্রিকা পড়ার সময় এবং ধৈর্য্যও নেই অনেকেরই। গবেষণা তো দূরের কথা। শিক্ষকরা এমন হলে শিক্ষার্থীরা যাবে কোথায়? কমবেশি একাদশ শ্রেণির ১২০ এবং দ্বাদশ শ্রেণির ১২০ জনসহ মোট ২৪০ শিক্ষার্থীর জন্য মাত্র  একজন করে  বাংলা  ও  ইংরেজি শিক্ষক যথেষ্ট কি না তা-ও ভেবে দেখা প্রয়োজন। দীর্ঘদিনের এই দুরবস্থা থেকে বের হতে হলে অবশ্যই বাড়াতে হবে শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা এবং সেই সঙ্গে বাড়াতে হবে কর্মঘণ্টা। শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠানে অবস্থান নিশ্চিত করে শিক্ষার্থীদের জন্য নিশ্চিত করতে হবে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা। যেন আর না থাকে ক্লাসের বাইরে ক্লাসের বিষয় পড়ার কোনো প্রয়োজনীয়তা। তা না হলে বন্ধ করা সম্ভব হবে না এই প্রাইভেট-কোচিং।

লেখক : শিক্ষাবিদ এবং অধ্যক্ষ,  কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ,  ঢাকা।


ক... করে ওঠে কাক

ক... করে ওঠে কাক


মো. রহমত উল্লাহ্‌


আলো ঝলমল বিকাল বেলা। গ্রামের পথে হাঁটছে তিনজন। রাকিব, সাকিব ও লুহাম। খেলতে যাবে সবুজ পাহাড় মাঠে। গুড়ুম করে আওয়াজ হয় বিদ্যুতের তারে। চোখে লাগে আগুনের ঝিলিক। ঝপ করে নিচে পড়ে একটি কাক। কা কা, কা কা! ডেকে উঠে কয়েকটি কাক। কা কা করে আসতে থাকে আরও। ডাকতে থাকে কর্কষ গলায়। বাড়তে থাকে কা কা, কা কা! আসতে থাকে আরো কাক। কা, কা, কা! বাড়তে থাকে ডাকাডাকি। বাড়তে থাকে ছুটাছুটি। যেনো কাকদের প্রতিবাদী মিছিল। ভয়ে দৌড়ে পালায় রাকিব ও সাকিব। তবে পালায় না লুহাম। সে ছুটে যায় সেই কাকের কাছে। দেখে, মাটিতে পড়ে আছে কাক। অপলক তাকিয়ে থাকে কাকের দিকে। ভাবে, কী করা যায়?


কাকের কাছে বসে লুহাম। হাতে তুলে নেয় কাকটিকে। কঠিন হয়ে আছে কাকের শরীর। নড়াচড়া করে না মোটেও। কালো চোখ যেন পাথর। কুঁকড়ে আছে পায়ের আঙুল। বাঁকা হয়ে আছে ছাই রং ঘাঁড়। হা হয়ে আছে দুটি ঠোঁট। লাল দেখা যায় মুখের ভিতর। পাখা ও লেজ হয়ে আছে এলোমেলো । যেনো, ছেঁড়া ছাতার কালো কাপড়। মনেহয়, আর বেঁচে নেই কাক! কারণ বুঝতে পারে লুহাম। বিদ্যুৎ শকেই এমন হয়েছে কাকের। ভাবে, কী করা যায়? কী করা যায় এখন?


একটা দৃশ্য মনে পড়ে লুহামের। একদিন সে খেলা দেখছিল টিভিতে। চলছিল তার প্রিয় ফুটবল খেলা। আহত হয়েছিল এক খেলোয়াড়। মাঠে পড়েছিল এই কাকের মতই। একজন এসে চাপল তাঁর বুক। বাঁকা ও সোজা করল হাত-পা। বার বার করল এপাশ ওপাশ। শেষে বেঁচে গেল সেই খেলোয়াড়। মনে মনে কথা বলে লুহাম। হ্যাঁ, এখন তাই করব আমি।


কাকের বুকে হালকা চাপ দেয় লুহাম। চাপ দেয় সারা শরীরে । বাঁকা, সোজা করে পা। টানে ঠোঁট ও পাখা। হালকা চাপড় দেয় কাকের পীঠে। এসব করতে থাকে বার বার। একসময় ক… করে ওঠে কাক। নড়ে ওঠে কাকের চোখ। কিছুটা টান করে পা। সামান্য নাড়ায় পাখা। খুশিতে মন ভরে ওঠে লুহামের।  মুখে ফুটে ওঠে হাঁসির রেখা। বুকে জাগে আশার আলো।


এবার অন্যদিক খেয়াল করে লুহাম। দেখে, সাথে নেই রাকিব ও সাকিব। উড়াউড়ি করছে কাকের দল। কর্কষ গলায় করছে কা কা। ছুটছে মাথার সামান্য উপর দিয়ে। উড়ছে গায়ের খুব কাছ দিয়ে। যেনো এখনই ঠোঁকর দিবে মাথায়! খামছি দিবে গায়ে! তবুও ভয় পায় না লুহাম। রাগ করে না কাকদের উপর। ভাবে, কাকেরা অনেক ভাল। একের বিপদে এগিয়ে এসেছে সবাই।<


[শিশুদের উপযোগী এই গল্পটিতে ৪ বর্ণের অধিক কোন শব্দ নেই, ৬ শব্দের অধিক কোন বাক্য নেই, কোন শব্দে যুক্ত বর্ণ নেই।]


মো. রহমত উল্লাহ্

অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকাবিদ্যালয়ওকলেজ

তাজমহল রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা


+8801711147570

[১৪ জানুয়ারি ২০১৯, মোহাম্মদপুর, ঢাকা]

বই উৎসবের বাস্তবতা ও আমাদের করণীয়- ভোরের কাগজ- ১৫ জানুয়ারি ২০১৯

বই উৎসবের বাস্তবতা ও আমাদের করণীয়

মো. রহমত উল্লাহ্

দেশের প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সব শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে পাঠ্যবই তুলে দেয়া শেখ হাসিনা সরকারের এক বিরাট সাফল্য। অনেক সফলতার অন্যতম এটি। সরকারি, বেসরকারি, প্রাইভেট, সাধারণ স্কুল, কেজি স্কুল, এনজিও স্কুল, মাদ্রাসা, বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম, গ্রাম, শহর, উপশহর, ধনী, দরিদ্র, ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই বিনামূল্যে পাচ্ছে সরকারি বই। এটিই কল্যাণ রাষ্ট্রে ধারণা। সমালোচকরা যাই বলুক, সারা বিশ্বে এটি একটি গণকল্যাণমুখী অনন্য উদাহরণ। যা গত দশ বছর ধরে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে চলমান।

বিনামূল্যের বই বিতরণের জন্য প্রতি শিক্ষাবর্ষের শুরুতে জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে সারাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে করা হয় বই উৎসব। সত্যিই এটি খুব আনন্দের বিষয়। কেননা এই বই উৎসব আমাদের পহেলা বৈশাখের চেয়েও অধিক সর্বজনীন উৎসব। কিন্তু এর বাস্তবতায়ও রয়েছে দুয়েকটি কষ্টের বিষয়। পর্যাপ্ত বই থাকার পরও জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে সবার হাতে হাতে বই তুলে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এর কয়েকটি কারণ বিদ্যমান।

প্রথমত, যেসব শিক্ষার্থী প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক পরীক্ষায় পাস করে না, সঙ্গত কারণেই তাদের উপরের ক্লাসের বই দেয়া হয় না এবং তারা পরবর্তী সময় বিশেষ বিবেচনায় বা তদবিরে প্রমোশন পাবে এই আশায় নিচের ক্লাসের বই নিজেরাই নেয় না। প্রথম দিন বই পায় না বিধায় তারা বই উৎসবের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়। এ কষ্ট নিয়ে তারা প্রতিষ্ঠানেই আসে না প্রথম দিন। কেউ এলেও প্রমোশন না পাওয়ায় তাকে উপরের ক্লাসের বই দেয়া সম্ভব হয় না। এদের সংখ্যা কিন্তু কম নয়।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের মোট শিক্ষার্থীর শতকরা প্রায় ১০ ভাগ শিক্ষার্থী বার্ষিক পরীক্ষায় ফেল করে থাকে। বর্তমানে দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় সোয়া চার কোটি। কম করে হলেও এই চার কোটি শিক্ষার্থীর ১০ ভাগ ৪০ লাখ। এই ৪০ লাখ শিক্ষার্থী প্রথম দিনে বই না পেলেও নতুন বই প্রাপ্তির আনন্দ থেকে শেষমেশ তারা বঞ্চিত হয় না। কিছুদিন পরই তারা তাদের নির্ধারিত শ্রেণির বই পেয়ে যায়।

তবে পয়লা দিনে তাদের মনে থেকে যায় নতুন ক্লাসে প্রমোশন না পাওয়ার ও নতুন বই হাতে না পাওয়ার দুটি কষ্ট। সেদিন এই বিজিতদের হাতে হাতে নতুন বই তুলে দিয়ে উৎসবের আনন্দে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কোনো উপায় এখনো বিদ্যমান নেই।

দ্বিতীয়ত, নতুন বছরের সেশন চার্জ দিয়ে ভর্তি নিশ্চিত না করলে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বই দিতে চায় না। কেননা বার্ষিক পরীক্ষায় যারা অতি উত্তম রেজাল্ট করে এবং যারা ফেল করে তারা উভয়েই অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং অনেকেই যায়। অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই এই বাস্তবতা বিদ্যমান। বই নিয়ে শিক্ষার্থীরা অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে গেলে এবং সেই প্রতিষ্ঠান থেকে আরেক সেট বই নিলে সে বইয়ের হিসাব মিলাতে বেকায়দায় পড়তে হয় প্রতিষ্ঠান প্রধানদের।

কেননা কিছুদিন পর যখন শ্রেণিভিত্তিক ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের নামের তালিকাসহ বইয়ের হিসাব চায় সরকার তখন আর উপায় থাকে না। এ ছাড়া যে শিক্ষার্থী পিইসি বা জেএসসি পাস করে সরকারি সনদ লাভ করে, সে সেই সনদ দিয়ে যে কোনো যথাযোগ্য প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ভর্তি হতে পারে।

এমতাবস্থায় প্রতি বছর প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পিইসি ও জেএসসি পাস করে আসা লাখ লাখ শিক্ষার্থী যদি মাধ্যমিক স্তরের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে জানুয়ারি মাসের ১ তারিখের আগে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি না হয় এবং যারা পাস করে না তারাও যদি জানুয়ারি মাসের ১ তারিখের আগে কোনো প্রতিষ্ঠানের ৫ম শ্রেণিতে পুনরায় ভর্তি না হয়; তো ১ তারিখের বই উৎসবে তাদের হাতে হাতে নতুন বই তুলে দেয়ার উপায় কী? ২০১৮ সালে যাদের সংখ্যা ছিল ২৯ লাখ ৩৪ হাজার ৯৫৫ জন।

অনুরূপভাবে যে লাখ লাখ শিক্ষার্থী প্রতি বছর জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা পাস করে শিক্ষা বোর্ডের সনদ লাভ করে এসএসসি পাসের মতোই স্বাধীন হয়ে যায় তারা যদি জানুয়ারি মাসের ১ তারিখের আগে কোনো প্রতিষ্ঠানের ৯ম শ্রেণিতে ভর্তি না হয় এবং যারা পাস করে না তারাও যদি জানুয়ারি মাসের ১ তারিখের আগে কোনো প্রতিষ্ঠানের ৮ম শ্রেণিতে পুনরায় ভর্তি না হয়; তো তারা ১ তারিখের বই উৎসবে বই পাবে কীভাবে? ২০১৮ সালে যাদের সংখ্যা ছিল ২৩ লাখ ২৯ হাজার ২৪১ জন।

তৃতীয়ত, অনেক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে যারা আর্থিক অনটনের কারণে শিক্ষক-কর্মচারীদের মাসিক বেতন-ভাতা নিয়মিত পরিশোধ করতে পারে না। তারা সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন যে, জানুয়ারি মাসে ভর্তি ও সেশন ফি বাবদ কিছু টাকা আয় হলে সামান্য বেতন-ভাতা পাবেন। তাই তারা নির্ধারিত সেশন ফি জানুয়ারি মাসের আগেই দিয়ে দিতে বলেন এবং নতুনদের ভর্তি হতে বলেন।

কিন্তু অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবক তা করেন না বিধায় শিক্ষকরা জানুয়ারির ১ তারিখে সবাইকে বই না দিয়ে ভর্তি/সেশন ফি আদায় করে দুয়েকদিন পর বই দিতে চান। কেননা শিক্ষার্থীরা নতুন বই হাতে পেয়ে গেলে দেনা পরিশোধে অভিভাবকরা চরম অনীহা দেখান। সব অভিভাবক যে অভাবের কারণে এমনটি করে থাকেন তা নয়।

একেকজন একেক রকম ক্ষমতা খাটিয়েও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের টাকা না দেয়ার সুযোগ নিয়ে থাকেন এবং একাধিক সেট বইও নিয়ে থাকেন কেউ কেউ। ফলে প্রাপ্য পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত হন শিক্ষক-কর্মচারী। বইয়ের সঠিক হিসাব দিতে পারেন না শিক্ষকরা। হাতেগোনা কিছু নামিদামি প্রতিষ্ঠান ব্যতীত অধিকাংশ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাস্তব অবস্থাই এমন।

সরকারি বই আটকে রাখার কোনো অধিকার শিক্ষকদের নেই এবং শেষমেশ তারা তা আটকে রাখেন না। উল্লিখিত তিনটি বাস্তব পরিস্থিতির কারণেই জানুয়ারি মাসের ১ তারিখের বই উৎসবে কম-বেশি ৯০ লাখ শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই তুলে দিতে পারেন না শিক্ষকরা। ফলে তারা বঞ্চিত হয় বই উৎসবের আনন্দ থেকে। তবে কয়েকদিন পরই ভর্তিকৃত সবাইকে দিয়ে দেন তাদের প্রাপ্য বই। এতে যথাযথ হয় সরকারি বইয়ের বণ্টন ও রোধ হয় সরকারি সম্পত্তির অপচয়।

তা না হলে বিনামূল্যে সরকারি বই নিয়ে সের দরে বিক্রি করবে লাখ লাখ ঝরে পড়া শিক্ষার্থী। যার হার প্রাথমিক স্তরে প্রায় ২০% এবং মাধ্যমিক স্তরে প্রায় ৪০%। আর এ কারণেই নির্ধারিত শ্রেণিতে ভর্তি নিশ্চিত না করে কাউকেই বই দেয়া উচিত নয়। ‘জানুয়ারি মাসের ১ তারিখের বই উৎসবেই সবাই বই পাবে। তা না হলে শিক্ষকদের শাস্তি হবে।’ এমন অবাস্তব বক্তব্য দেয়া ও কঠোর অবস্থান নেয়ার আগে উল্লিখিত বাস্তবতাগুলো অনুধাবন করা সবারই দায়িত্ব।

শিক্ষকরাও এই সমাজেরই মানুষ। সবদিক বিবেচনায় জানুয়ারি মাসের ৫ তারিখে করা যেতে পারে এই বই উৎসব। অথবা ১ জানুয়ারি উদ্বোধন করে ১ সপ্তাহ হতে পারে শিক্ষার্থীদের বই বিতরণ উৎসব। তা না হলে নেয়া যেতে পারে আরো অধিক যুক্তিযুক্ত কোনো পদক্ষেপ। এককথায় সরকারি বই বতরণের ক্ষেত্রে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে আলোচিত সমস্যাগুলোর স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে একটা সুষ্ঠু নীতিমালা থাকা এবং তা শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সবার জানা থাকা একান্ত আবশ্যক।

মো. রহমত উল্লাহ্ : লেখক এবং অধ্যক্ষ কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা।