[দৈনিক যায়যায়দিন > ০৮ ডিসেম্বর ২০১৬ এবং সাপ্তাহিক প্রতিচিত্র > ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬]
পুরুষ নির্যাতন: কয়েকটি খন্ডচিত্র
মো. রহমত উল্লাহ্
আমাদের সমাজে বর্তমানে নারী নির্যাতনের চেয়ে পুরুষ নির্যাতনের মাত্রা, ভয়াবহতা ও বিচিত্রতা কোন অংশেই কম নয়। অথচ পুরুষ নির্যাতন রোধে আমাদের কোন আইন নেই, প্রতিবাদ নেই, সংগঠন নেই, প্রকাশ্য তৎপরতা নেই, সামাজিক প্রতিরোধ নেই; যেমনটি আছে নারী নির্যাতন রোধের ক্ষেত্রে। তাই নারীর তুলনায় পুরুষেরা এখন ভিতরে ভিতরে অনেক বেশি অসহায়, অনেক বেশি নির্যাতিত। অথচ এসব বিষয়ে পুরুষেরা মুখ খুলেনা তথাকথিত লোকলজ্জার ভয়ে। কেউ যদি মুখ খুলে তো মনে করা হয় তিনি নিজেই ব্যর্থ, নির্যাতিত, কাপুরুষ। তাই পুরুষ নির্যাতন রোধে এগিয়ে আসেনা পুরুষেরাই। যদিও পুরুষ নির্যাতন রোধ এখন সময়ের দাবি।
চলুন দেখাযাক আমাদের বর্তমান সমাজে বিদ্যমান পুরুষ নির্যাতনের কয়েকটি খন্ডচিত্র। নারী পুরুষ উভয়ের সম্মান রক্ষার্থে ঘটনাসমুহের সংগে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গের আসল নাম-পরিচয় গোপন রাখা হলো।
এক। মায়ের কাছে যাবার জন্য ভোরেই তৈরি হচ্ছে সালেম। গ্রামের বাড়িতে একা থাকেন সালেমের মা। তিনি মিথ্যা করে বলেন, ‘বাসায় আমার ভালো লাগেনা’। আসলে ছেলের বউয়ের কারনেই একমাত্র ছেলের সাথে থাকা হয়না তাঁর। তাই মাসে দু’একদিন গ্রামে যেতে হয় সালেমের। সকালে ঘুম থেকে উঠে বাগড়া দিল তার বউ সালেয়া। ‘ফ্রিজ পরিস্কার করে দিয়ে যাও’। কোন কথা বলেনা সালেম। বিবাদ করা তার মায়ের নিষেধ। সে জানে, কথা বললেই বেড়ে যাবে অনেক কথা, লেগে যাবে বিবাদ। যাওয়া হবেনা মায়ের কাছে। সাত সকালে ঘুম ভাঙবে এই ফ্ল্যাট বাড়ির সবার। তাই মায়ের জন্য কেনা শীতের জামাটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে যেতে চায় চুপচাপ। পথ আগলে দাঁড়ায় সালেয়া। গলা ফাটিয়ে বলে, ‘যাও কই, কথা কানে যায় নাই? বলছিযে পরিস্কার করতে হবে’। কোন জবাব দেয়না সালেম। কৌশল করে চাইল্ড বেড রোমে ঢুকে বন্ধ করে দেয় দরজা। আটকে দেয় ইনার লক। বাইরে থেকে দরজা পিটায় সালেয়া। চুপকরে শুয়ে থাকে সালেম। বাবা বলেছিলেন, শুয়ে গেলে কমে যায় রাগ। বাইরে চিৎকার চেচামেচি করে নানান কথা বলতে থাকে সালেয়া। উদ্দার করতে থাকে সালেমের চৌদ্দ গোষ্ঠী। একসময় চাবি এনে ইনার লক খুলে সালেয়া ঢুকে যায় সেই রুমে। জোরে ধাক্কা মারে পাশফিরে শোয়ে থাকা সালেমের গায়ে। হাত ছিটকে মারে সালেম। সালেমের গায়ে লাথি মারে সালেমের বউ। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায় সালেমের। শোয়ে থেকেই তার পাশে দাঁড়ানো মারমুখো সালেয়ার গায়ে লাথি মারে সালেম। খাটে শোয়ে থাকা সালেমের পাশে দাঁড়িয়ে সালেমের গায়ে-পায়ে বার বার লাথি মারতে থাকে সালেয়া। এই মারামারির একপর্যায়ে খেটের কোনায় লাগে সালেয়ার জোরালো লাথি। ভেঙ্গে যায় তার পায়ের আঙ্গুল। রক্ত জমেযায় পায়ের গোছায়। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে সালেয়া। পাশের রুমেই ঘুমিয়েছিলো ঈদের ছুটিতে আসা ভার্সিটি পড়োয়া ছেলে। মায়ের কান্না শুনে দৌড়ে আসে সে। বিস্তারিত না জেনে, না বুঝেই তুইতোকারি করেতে করতে মারতে যায় সালেমকে। হতবম্ব হয়েযায় সালেম। আরো জোরে হাউমাউ কান্নাকাটি করতে করতে এবং সালেমের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্দার করতে করতে বাসার বাইরে বেরিয়ে যায় সালেয়া। পুলিশ নিয়ে এসে ধরিয়ে দেয় সালেমকে।
দুই। চাকরিজীবী ভাইয়ের বাসায় থেকে লেখাপড়া করতে গিয়েছিলো মামছু। ভাইও তাকে নিয়েছিলেন অনেক আশাকরে। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে তারা। খুবই ভালো ছাত্র ছিলো মামছু। কিন্তু মামছুকে বাসায় থাকতে দিবেন না ভাবী। এই নিয়ে শুরু হলো বিবাদ আর অশান্তি। পরিস্কার বক্তব্য তার ভাবীর- ‘আমার বাসায় থাকতে পারবেনা তোমার কোন আত্মীয়-স্বজন’। কিছুদিন পর ভাবীর ভাই এলেন বাসায়। পাখি শিকার করতে গেলেন হাওড়ে। সাথে নিয়ে গেলেন মামছুকে। সেখানে গিয়ে বন্দুক তাক করলেন মামছুর বুকে। ভয়ে চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়লো মামছু। পরে তার জ্ঞান ফিরলেও আর ফিরলোনা মানসিক ভারসাম্য। সে বাসা ছাড়লো, বাড়ি ছাড়লো, দুনিয়া ছাড়লো। এই শোকে যার পর নাই মর্মাহত হলো মামছুর ভাই সাবেদ। সাবেদের কাছে আর সুন্দর লাগেনা তার আলোচিত সুন্দুরি বউ। বাসায় রাজত্ব কায়েম করে তার বউ। সাবেদের পক্ষের সকল আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্দব থেকে বিচ্ছিন্ন করে সাবেদকে। নানান কথা বলে সাবেদের সন্তানকে বিষিয়ে তোলে সাবেদের মা-বাবা ভাই-বোন আত্মীয়-স্বজন সকলের প্রতি। আরো বিষন্নতায় পড়ে সাবেদ। বাসায় ও চাকরিতে বাড়তে থাকে সমস্যা। একসময় সাবেদ হারিয়ে ফেলে সকল কাজের আগ্রহ। চরম অনাগ্রহ তৈরি হয় এই বউয়ের সাথে যৌনতায়। কাজ হয়না কোন ঔষধেও। সাবেদের এই দুর্বলতাকে কাজে লাগায় তার বউ। হাত করে নেয় সাবেদের মাসিক বেতনের টাকাসহ সকল সহায় সম্পদ। এমনকি স্বমীকে দিয়ে একজন খুনের আসামি জামিন করিয়ে দিবেন বলে মোটা অংকের টাকা নেয় কাজের বুয়ার মাধ্যমে। সে কাজে রাজি হয়না সাবেদ। গভীর রাতে নিজের মাথা দেওয়ালে ঠুঁকে, পরদিন সাবেদের নামে নারী নির্যাতন মামলা করে সাবেদের বউ। সাবেদ আটক হয় পুলিশের হাতে। সাময়ীক বরখাস্ত হয় চাকরি থেকে। এই বউ তালাক দিতে চায় সাবেদ। আগেও তালাক দিতে চেয়েছে অনেক বার। কিন্তু উকিল বলেন- ‘আপোস করো। তালাক দিতে গেলে তোমার বিপদ আরো বাড়বে। আইন এখন মেয়েদের পক্ষে। তাছাড়া দশলাখ টাকার কাবিন। তোমারতো আর নাই কিছুই।’ ছয়মাস পর জেলখানা থেকে জামিনে বেরিয়ে এসে অতিরিক্ত ঔষধ খেয়ে আত্মহত্য করে এলাকার সবচেয়ে বড় সরকারি কর্মকর্তা সাবেদ।
তিন। হৃদরোগ হাসপালের ক্যাবিনে চলছে মিটিং। খুব খারাপ অবস্থা রমিজের মা’র। ডাক্তারেরা বলেদিয়েছেন, আর চিকিৎসা চলবেনা, নিয়ে যান। সবারই মন খারাপ। রমিজের মা, মামা, ভাই, বোন, ভাগনা, ভাগনি, ভাগনি-জামাই সবাই উপস্থিত। সবাই শিক্ষিত, কর্মজীবী ও সচ্ছল। আলোচনা একটাই, কী করাযায় এখন? শেষে সিদ্ধান্ত হলো, বিদেশে নেওয়া হবে রমিজের মাকে। কে কত টাকা দিবেন, কে পাসপোর্ট ভিসা করবেন, কে তিনার সাথে যাবেন ইত্যাদি আলোচনার মাঝে সিদান্ত দিলেন রমিজের মা। আমার সাথে যাবে রমিজ আর সমান হারে টাকা দিবে আমার ছেলেরা এবং দোয়া করবে সবাই। আর্জেন্ট পাসপোর্ট-ভিসার দায়িত্ব দেওয়া হলো রমিজের এক ভাগনি-জামাইকে। সে তার মোবাইল ফোন সেটে তোলে নিয়ে গেলো রমিজের ও রমিজের মায়ের ছবি। বলে গেলো আজকে নাহয় কালকেই হয়েযাবে ভিসা। মাকে নিয়ে বিদেশ যাওয়ার জন্য অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় গেলো রমিজ। এই খবর শুনেই ক্ষেপে গেলো রমিজের বউ। শুরু করলো উচ্চবাচ্য- ‘তোমার যাইতে হবে কেনো বিদেশ? হেই বেটির কি আর পোনাপান নাই? তুমি রাজি হইলা কেন? আমারে জিজ্ঞেস করছিলা? তোমার মা’র লাগি এত দরদ, তো মারে লইয়াই থাকতা, বিয়া করছিলা কেন? আর কত বাঁচতে চায় হেই বেটি? দেশের ডাক্তার খাওয়া হইছে, এখন বিদেশের গুলান খাইবো। এই সংসার মজায়া মরবো। কতদিন ধইরা কইতাছি- আমার আরেক জোড়া চুরি বানানোর কথা। তা হয়না, এখন টাকার অভাব হইতোনা। যাও, যেখানে খুশি সেখানে যাও। আমার চুরির টাকা দিয়া যাও। তা নাহলে তুমি কেমনে যাও আমি দেইখা দিমু। ...।
চার। বিয়ের পরে অনেক কষ্ট করে স্ত্রীকে লেখাপড়া করিয়েছেন হবিউলের বেতনের টাকায়। সংসারের সচ্ছলতা বাড়ানোর আশায় স্ত্রীকে জোগাড় করে দিয়েছেন ভালো চাকরি। এখন চাকরি করেন দু’জনেই। কিন্তু পালটে গেছে হবিউলের স্ত্রীর বক্তব্য। পরিস্কার বলেদিয়েছে তার স্ত্রী- ‘তোমার সংসার তুমি চালাবা। সংসারের কোনকিছু আমি কিনবোনা। ছেলেমেয়ে তোমার। তোমার ছেলেমেয়ের যা লাগে তুমি দিবা। আমার যখন যা লাগে তুমি দিবা। আমি একটাকাও দিবনা। আমি কত বেতন পাই তা জানতে চাও কেন? লজ্জা করেনা বউয়ের টাকা চাইতে? আমার টাকার উপর তোমার কোন হক নাই। তোমার বেতনের টাকাও আমার কাছে দিবা। সব খরচ চালানো তোমার দায়িত্ব। তুমি চুরি করবা না ডাকাতি করবা তা আমি জানিনা। ফকিন্নি মার্কা চলা চলতে পারোমনা। ভালোভাবে সংসার চালাইতে না পারলে বিয়া করছিলা কেন? …।’ এমন অনেক বিষয়ে বনিবনা না হওয়ায় হবিউলের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়েযায় হবিউলের বউয়ের। বউ চাকরিজীবী হবার পরেও হবিউলকে পরিশোধ করতে হয় তার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়া বউয়ের ভরন-পোষণের টাকা। তদুপরি তিনলাখ টাকার বকেয়া দেনমোহর এখন পরিশোধ করতে হয় ছয়লাখ টাকায়।
কিছুদিন পর, লোকাল বাসের ভিতরে মানুষের ঠেলাঠেলিতে পাশাপাশি হয়েযায় হবিউল আর হবিউলের সাবেক বউ। হঠাত হবিউলের দিকে হাত তুলে বকাবকি শুরুকরে তার সাবেক বউ। ‘ওই বদমায়িশ, তুই আমার গায়ে হাত দিলে কেন? তোর কি মা-বোন নাই?’ এইসব কথা শুনেই ক্ষেপে গেলো বাসের সকল যাত্রী। এই পাপলিক বাসের কেউতো আর জানেনা তাদের ইতিহাস। কিছুই বলার সুযোগ দিলোনা হবিউলকে। নারীর মর্যাদা রক্ষার্থে সবাই ঝাপিয়ে পড়লো হবিউলার উপর। ফাটিয়ে দিলো হবিউলের নাখ-মুখ-চোখ। বাস থামিয়ে পথেই মানিয়ে দিলো হবিউলকে। ততক্ষণে আর জ্ঞান নেই হবিউলের।
পাঁচ। বেতনের সব টাকা স্ত্রীর হাতে তোলে দেন কিসমত। শুরুতে ভালই চলছিলো তাদের সংসার। ইদানীং কিসমতের স্ত্রী নিজের ও তার বাপ-মা-ভাই-বোনের প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে দেদারছে খরচ করছে কিসমতের টাকা। বাসা থেকে কিসমতের ছোটভাইকে তাড়িয়ে দিয়ে, নিয়ে এসেছে নিজের ছোটবোন। এখন কড়ায় গন্ডায় হিসাব করে কিসমতকে দেয় এবং ফেরত নেয় সংসারের খরচ। কিসমতের বাবা-মা-ভাই-বোনকে দেওয়াতো দূরের কথা নিজের ঔষধ কেনার টাকাও পায়না ঠিকমত। কিসমতের বউয়ের বক্তব্য- ‘এটা আমার সংসার। আমি যেভাবে বলবো সেভাবে চলবে। এখানে আসতে পারবেনা তোমার আনকালচার্ড ফেমিলির লোকজন। কী দেয় তারা তোমারে? তোমার যাওয়া লাগে কেন সবার দরকারে? টেলিফোনে এতো কী কথা তাদের সাথে? টাকা লাগেনা টেলিফোন করতে? ইহ্, তাইন উপকারি, উপদেষ্টা! সবার উপকার করে। কী করছো, সবার উপকার কইরা? যারা তোমার সাথে চাকরি করে সবারই বাড়ি-গাড়ি আছে। তারা কি বেতন বেশি পায়? তারা টাকা পায় কই? তুমি পাওনা কেন? তুমি শকুন। তোমার খেয়াল নিচেই থাকবে। তোমার চৌদ্দ গোষ্ঠী ফকিন্নি। আস্তে কথা বলবো কেন? লজ্জা লাগে? আমি চুপ করবো কেন? তুমি চুপ করো। আমি আরো জোরে বলবো। কী করবা? করো দেখি। দুই আনার মোরদ নাই আবার কথা বলে। আবার কথা বললে চৌদ্দ শিকের ভিতরে ঢুকায়া …।’
ছয়। ভালোবাসা পাওয়ার আশায় সকল সঞ্চয় দিয়ে বউয়ের নামে ফ্ল্যাট কিনেছে কমল। এখন আরো বেশি নিঠুর হয়েছে কমলের বউয়ের বক্তব্য ও আচরন- ‘তোমার জামাকাপড়ে এমন গন্ধ কেন? তোমাকে না নিষেধ করেছি, আমার বাথরুমে যাবানা। খালি গায়ে বিছানায় শোও কেন? তোমার গায়ের চুল সারা বিছায়। ঠিকমত বসতে না পারলে ছোফায় বসবানা। সারাঘরে তোমার পায়ের ময়লা। আমার চিরুনি ধরবানা বলেদিলাম। আমার গেলাসে পানি খাও কেন? সুন্দর করে গোছায়া রাখতে পারোনা নিজের জামাকাপড়? বন্ধ করে রাখতে পারোনা বইটা? এমন হাবাজাবা কেন, ভালোমত গোছাইতে পারোনা বিছানা? কেমনে টানাও মশারি, ফাঁক থাকে কে? তোমার নাক ডাকার জ্বালায় আমি ঘুমাতে পারিনা। যত্তসব গাঁইয়া সভাব।…।’ ভালোবাসার ঠেলায় বারান্দায় রাখা ছোট্ট চৌকিতেই এখন কমলের বসবাস।
সাত। কথায় কথায় ‘গোলামের ঘরের গোলাম, বদমায়িশের বাচ্ছা, মজুরের ঘরের মজুর, ফকিরের বাচ্চা ফকির, নিমচার ঘরের নিমচা, বেলাজার ঘরের বেলাজা’ ইত্যাদি গালাগালি বউয়ের মুখ থেকে শুনতে শুনতে ধর্য্য হারা হয়ে একদিন বউয়ের গায়ে হাত তুলেছিলো লেহাজ। তারপর বউ তার মাস্তান ভাইদের দিয়ে লেহাসকে পিটিয়ে লিখে নিয়েছে লেহাজের পৈত্রিক সুত্রে প্রাপ্ত জমিজমা। এখন সেই জমিতে এবং অন্যের জমিতে কাজ করে জীবন ধারন করে লেহাস। বউয়ের সাথে আর শোতে ইচ্ছে করেনা লেহাজের। তিন সন্তানের বাবা লেহাজ, তার বউয়ের ভাষায় এখন আর পুরুষ না, মরদ না, মাগি।
আট। অফিস থেকে ফিরার পথে বাজার করে নিয়ে আসে ফায়াদ। রাগারাগি শুরু করে তার বউ। বলে, ‘এতক্ষণ তুমি অফিসে কী করো? তোমারে কি বেতন বেশি দেয়? প্রতিদিন বিকালেই চলে আসে পাশের বাসার ভাই। আর তোমার পাঁচটা ছয়টা পর্যন্ত থাকতে হয় অফিসে। দুই টাকার চাকরি, আবার সারাদিন অফিস। নীতিবান চাকরিজীবী। রাতে যায় বাজার করতে। নিয়ে আসে পঁচা জিনিস। কখন রান্না করবে, আর কখন ফিরবে বুয়া?’ এবার মুখ খুলে ফায়াদ, ‘বুয়াকে ছুটি দিয়ে দিলেই পারতা।’ ফায়াদের কথা শেষ না হতেই আরো ক্ষেপে যায় ফায়াদের বউ। চড়া গলায় বলে, ‘হ্যা ভালই। বুয়াকে ছুটি দিয়ে আমি রান্না করবো। বুয়ার জন্যতো খুব দরদ তোমার। বুয়াকে খুব ভালো লাগে, তাই না? নিয়ে যাও, সোফায় বসিয়ে রাখো। আমি রান্না করি। বুয়াকে নিয়ে খেয়ো মজা করে।’ আবার মুখ খুলে ফায়াদ- ‘সকাল বিকাল তাজা শাক-সবজি নিয়ে আসে ফেরিওয়ালা। নিচে নামলেইতো আনা যায় পছন্দ মতো। রান্নাও হয়ে যায় সন্ধার আগে।’ আরো চড়া গলায় কথা বলে ফায়াদের বউ- ‘অ, ভালো কথা। আমাকে দিয়ে বাজার করাতে চাও? আমি কি তোমার কাজের লোক? নিজের কাপড়চোপড় কিনতে যাই বলে কি শাকসবজি কিনতেও যাবো? পাইছো কি? রাখো, দেখাচ্ছি মজা। এই বুয়া, তুমি চলে যাও। যাও, এখনই চলে যাও।’ বুয়াকে বিদায় করে দিয়ে আরো জোরে চিল্লাতে থাকে ফায়াদের বউ- ‘তোমার ভালোবাসার বুয়াকে রিলিফ দিলাম। যাও রান্না ঘরে। এখন থেকে তুমি রান্না করবে।’
নয়। গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরতে রাত হয় তাকিরের। বাসার দরজা খুলেনা তার বউ। বলে- ‘এতোক্ষণে তোমার আসার খবর হয়েছে? বাড়িতে এতো মজা তো আসছো কেনো? থাকতা কয়েকদিন। দেখতা তোমার মায় কী মজা খাওয়ায়। দরজা পিটাবানা, বাইরেই থাকো।’ কিছুক্ষণ খটখট করে ব্যর্থ হয়ে দরজায় হেলান দিয়ে বাইরে বসেই রাত কাটায় সে। ক্লান্ত হলেও মসা আর শীতের যন্ত্রণায় ঘুমাতে পারেনা একফোঁটাও। ভাবে, কোন দিকে যাবে সে? একদিকে মা আর একদিকে বউ। এই অশান্তির চেয়ে ভালোছিলো বিয়ে না করে থাকাই।
পরদিন সকালে বাইরে হাঁটতে বেরোয় তাকিরের বউ। এই সুযোগে ঘরে ঢুকে জামা বদল করে অফিসে চলে যায় তাকির। অফিস থেকে ফিরে চুপচাপ শুয়ে থাকে সে। ঘরে ঢুকেই খটাস করে দরজা বন্ধ করে দেয় তার বউ। বুঝতে পারে তাকির, এখনই শুরু হবে প্যাঁচাল। চলবে সারারাত। কৌশল করে এটাস বাথরুমে ঢুকে যায় সে। আটকে দেয় দরজা। হাই কোমডের ঢাকনা লাগিয়ে বসে থাকে তার উপর। ভেবে পায়না কী করবে? তার বউ এখন দুই সন্তানের মা। প্রচন্ড চাপ অনুভব করে বুকের মাঝখানে!
দশ। ছোটবেলা থেকেই আবৃত্তি, উপস্থাপনা ও লেখালেখি করে নাদাফ। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করতো বেতারে, বিতর্ক করতো টিভিতে, লেখালেখি করতো পেপারে। এইসব কারণেই ক্যাম্পাসে খুব জনপ্রিয় ছিলো সে। শিক্ষকতায় এসেও ধরে রেখেছিলো তার এসব ভালো লাগা কাজ। হয়েছিলো তুমুল জনপ্রিয় ও উদ্যমী শিক্ষক। প্রকাশিত হয়েছিলো তার কবিতার বই। কিন্তু বিয়ের পরেই পালটে গেলো নাদাফের জীবনের গতি। তার বউ এসেই বলেদিলো সাফ সাফ- ‘আমাকে শুনাতে এসোনা এই লেখালেখি। বাদ দাও এসব কাজ। কোন লাভ নেই। টাকা ছাড়া জীবন চলেনা। আমার যখন যা লাগে দিতে হবে। কীভাবে জোগাড় করবে তা আমি জানিনা।’ নাদাফ বাড়িয়ে দেয় টিউশি। ঘরে ফিরে রাতে। লিখতে খুব মন চায় তার। অনেক লেখার বিষয় কিলবিল করে তার মাথার ভিতর। কিন্তু লিখতে পারেনা। টেবিলে বসলেই ক্ষেপে যায় তার বউ। শুরু করে অকথ্য ভাষায় গালাগালি। পাশ ফিরে শোয়ে কাটিয়ে দেয় রাত। কিছুদিন পর ডিপ্রেশনে পড়েযায় নাদাফ। ঔষধ দিয়ে, লেখালেখি চালিয়ে যেতে বলে ডাক্তার। আবার লেখার টেবিলে বসে নাদাফ। কিছুটা ভালো হয় তার মন। এরই মাঝে প্রকাশিত হয় নাদাফের আগের লেখা বেশ কয়েকটি বই। আরো উতসাহ নিয়ে লিখতে বসে নাদাফ। এবার কৌশল পালটায় নাদাফের বউ। ঘরের বিভিন্ন কাজ করতে বাধ্য করে নাদাফকে। তা না হলে মাথায় তোলে সারা বাড়ি। আবার বন্ধ হয় নাদাফের লেখালেখি। আরো বেশি ডিপ্রেশনে পড়ে নাদাফ। এভাবে চলে বছরের পর বছর। নাদাফ এখন আর ভালো শিক্ষক নয়, ভালো লেখক নয়, ভালো আবৃত্তিকার নয়। তেমন বয়স না হতেই সেই অতি উদ্যমী নাদাফ এখন ঝিমিয়ে পড়া ধীর গতির মানুষ। তার বউয়ের ভাষায়- মোরদ নেই, ণপুংশক, কাপুরুষ!
---------------
মো. রহমত উল্লাহ্ :
অধ্যক্ষ- কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা।
www.creativeclan.net
0 মন্তব্য(গুলি):