পত্রিকার লিংক
শক্তিশালী করতে হবে শুদ্ধতার সংগ্রাম
দৈনিক বাংলা, ২২ জুন ২০২৪
মো. রহমত উল্লাহ্
বাংলাদেশ বেতারের একজন সহকারী প্রকৌশলী আদনান ফেরদৌস চাকরি ছেড়ে সাব-রেজিস্ট্রার পদে যোগদান করেছেন বলে অনেক আলোচনা ও সমালোচনা হচ্ছে। ক্যাডার পদ ছেড়ে নন-ক্যাডার পদে যাওয়াটাকে অনেকেই ভালো চোখে দেখছেন না, দেখার কথাও নয়। কেউ কেউ বলছেন তথ্য বিভাগে পদোন্নতি অত্যন্ত সীমিত, তাই এখানে কর্মকর্তারা থাকতে চান না। এটি যৌক্তিক বলে মনে হয় না। কেননা, আমার জানা-দেখা অনেক সাব-রেজিস্ট্রার সারাজীবন একই পদে চাকরি করে অবসরে গিয়েছেন। অবশ্য তারা প্রায় সবাই অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন তা সবাই জানেন। হয়তো এ কারণেই আদনান ফেরদৌসের চাকরি পরিবর্তনের উদ্দেশ্য অসৎ বলে অগণিত মন্তব্য দেখা যায় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। প্রায় সবাই তার চিন্তা-চেতনাকে বিভিন্নভাবে অসৎ আখ্যায়িত করেছেন। এটি অযৌক্তিক নয়। সবাই জানেন সাব-রেজিস্ট্রারের অবৈধ আয় লাগামহীন। (গত ৯ জুন ২০২৪ তারিখে প্রকাশিত দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে, ‘কুমিল্লার আদর্শ সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিস: দুই বছরে ২৫ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন সাব-রেজিস্ট্রার।’) কেউ কেউ বলেছেন, যেহেতু আদনান ফেরদৌসের অসৎ উদ্দেশের বিষয়টি প্রায় প্রমাণিত, সেহেতু তাকে সাব-রেজিস্ট্রার পদে যোগদান করতে দেওয়া উচিত হয়নি। বাস্তবে আইনগতভাবে তা সম্ভব নয়। এসব সমালোচনা শুনে সম্পদের পাহাড়ে বসা অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত সাব-রেজিস্ট্রাররা হয়তো একটুও লজ্জা পাচ্ছেন না, বরং আমাদের বোকা ভেবে মুচকি হাসছেন!
আদনান ফেরদৌস যদি সাব-রেজিস্ট্রার পদ ছেড়ে বাংলাদেশ বেতারের সহকারী প্রকৌশলী পদে যেতেন তো নিশ্চয়ই এমন সমালোচনা হতো না। তাহলে এখন তাকে নিয়ে এত সমালোচনা কেন? তার সঙ্গে অন্যান্য যারা সাব-রেজিস্ট্রার পদে যোগদান করেছেন, তাদের নিয়ে কিন্তু কোনো সমালোচনা আমরা শুনছি না। যদিও তাই হওয়া উচিত ছিল। তাদের উদ্দেশ্যও কিন্তু আদনান ফেরদৌস থেকে ভিন্ন হওয়ার কথা নয়। তারাও তো অন্য চাকরি থেকে সাব-রেজিস্ট্রার পদকে লোভনীয় মনে করে অগ্রাধিকার দিয়ে অনেক চেষ্টা করে নিয়োগপত্র হাত করে যোগদান করেছেন। কেউ তাদের ঘৃণা করে বয়কট করবেন বা আত্মীয়তা করতে চাইবেন না, এমনটি হবে বলে মনে হয় না। বরং আগে যারা পাত্তা দিতেন না, এখন তারা প্রায় সবাই অধিক গুরুত্ব দেবেন। দেখতে যেমনই হোক উত্তম পাত্র-পাত্রী পাওয়ার ও সফল স্বামী-স্ত্রী হওয়ার প্রতিযোগিতায় তারা অন্য অনেক চাকরির তুলনায় বহুগুণ এগিয়ে গেছেন। খোঁজ নিলে জানা যাবে তারা এলাকায় ও আত্মীয়স্বজনের মধ্যে আদৃত হচ্ছেন, বাহবা পাচ্ছেন!
আমাদের দেশে কর্ম পছন্দ-সংক্রান্ত সমালোচনার বিষয় কিন্তু আরও অনেক আছে। যখন প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদ ইত্যাদি বিশেষ ডিগ্রিধারীরা এসে কাস্টম অফিসার, পুলিশ অফিসার, অ্যাডমিন ক্যাডার ইত্যাদি পদে নিয়োগ নিচ্ছেন ও যোগদান করছেন তখন কিন্তু এত সমালোচনা শোনা যাচ্ছে না। তাদের উদ্দেশ্য কি প্রশ্নবিদ্ধ নয়? যখন শিক্ষকতার মতো সম্মানজনক কাজ তথা শিক্ষা ক্যাডার বাদ দিয়ে অনেকেই অন্য ক্যাডারে বা চেয়ারে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করছেন ও যাচ্ছেন তখন কিন্তু এত সমালোচনা হচ্ছে না। অ্যাডমিন ক্যাডারে কেউ সুযোগ পেলে তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়, তাকে নিয়ে অনেক লেখালেখি করা হয়, তাকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার জন্য অনেক কিছুই করা হয়! তার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা হয় না! অথচ শিক্ষার্থীদের ক্যাডারের যোগ্য করে তোলার জন্য যারা নিয়োজিত থাকেন, বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি করেন, উত্তরপত্র মূল্যায়ন করেন, সেই শিক্ষা ক্যাডারে কেউ সুযোগ পেলে তাকে কিন্তু সংবর্ধনা দেওয়া হয় না! বিসিএস পরীক্ষার ফরম পূরণের সময় প্রায় সব প্রার্থীর সর্বশেষ পছন্দ থাকে শিক্ষা ক্যাডার! সর্বশেষ সুযোগ কাজে লাগিয়েও অন্য পেশায় চলে যেতে চান, চলে যান শিক্ষক। এসব কি দুঃখজনক নয়? সর্বাধিক যোগ্যরা শিক্ষক হবেন, অন্য পেশা ছেড়ে শিক্ষকতায় আসবেন, শিক্ষকরা সর্বাধিক সচ্ছল ও সম্মানিত হবেন, তবেই তো শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে জাতি। অথচ এ জন্য আমরা কিন্তু তেমন কিছুই করছি না! যখন উচ্চশিক্ষিতরা অনেক চেষ্টা-তদবির করে অবৈধ আয়ে ভরপুর বিভিন্ন বিভাগের ছোট ছোট পদ হাত করছেন ও যোগদান করছেন তখন কিন্তু আমরা তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে খুব বেশি সমালোচনা করছি না। বরং প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে গেলে, পরিশ্রম করে বৈধ উপার্জন করতে গেলে, সৎভাবে সাধারণ জীবনযাপন করতে গেলে, আমরা অনেকেই বলছি- সে লেখাপড়া করে কী করেছে? একটা সরকারি চাকরি ম্যানেজ করতে পারে নাই! আবার সরকারি চাকরি সৎভাবে করে, সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে, দেশকে বা মানুষকে সেবা দিয়ে সাধারণ জীবনযাপন করে, কেউ অবসরে এলে আমরাই কেউ কেউ বলছি- সে সারাজীবন সরকারি চাকরি করে কিছুই করতে পারল না! অথচ সব চাকরির ক্ষেত্র যদি সম্পূর্ণ দুর্নীতিমুক্ত হতো, সব চাকরির বৈধ সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে যদি ন্যায্যতা নিশ্চিত হতো, পদ-পদবি-পরিচিতি নির্বিশেষে সব অপরাধীর যথাযথ শাস্তি যদি নিশ্চিত হতো, সর্বক্ষেত্রে সবার ন্যায্য অধিকার ও প্রাপ্য মর্যাদা যদি নিশ্চিত থাকত, তাহলে নিশ্চয়ই আলোচিত পরিস্থিতির চিত্রটি অন্যরকম হতো।
দুর্নীতিবাজদের মোটা অঙ্কের অনুদান নিয়ে অনেক মসজিদ-মাদ্রাসায় কমিটির নেতা-কর্মী বানানো হচ্ছে! সেসব দুর্নীতিবাজদের তোয়াজ করে বেড়াচ্ছেন কতিপয় হুজুর ও তাদের অনুসারীরা! অধিক চতুর দুর্নীতিবাজরা সুদ খেয়ে, ঘুষ খেয়ে, চাঁদাবাজি করে, দখলদারি করে এসে স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসা বানিয়ে সেখানকার নেতা বনে যাচ্ছেন। এসব করে অবৈধ ও কালো টাকা ধর্মীয়ভাবে সাদা হয় ও অবৈধ উপার্জনের পাপ মাফ হয় বলে আমার জানা নেই! পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, টাকা হলে সবই হয়! যার টাকা নেই তার কিছুই নেই! এই অশুভ পরিস্থিতি কিন্তু অনেক মানুষের দুর্নীতির আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে!
বেশির ভাগ ভোটারের মানসিকতা এমন হয়েছে যে, টাকা না দিলে, খাবার না দিলে, সুযোগ-সুবিধা না দিলে, ভোট দিবে না; প্রার্থী যতই সৎ ও যোগ্য হোক! অবৈধ সুযোগ-সুবিধা না দিলে সঙ্গে বা পাশে থাকবে না কর্মী, দায়িত্ব পালন করবে না কর্মচারী। রোদ-বৃষ্টি-ঈদ-পূজা ইত্যাদি উসিলা পেলেই জিনিসের দাম বাড়িয়ে দিবে ব্যবসায়ীরা, ভাড়া বাড়িয়ে দিবে রিকশাওয়ালা ও গাড়িওয়ালা! সুযোগ পেলেই সামান্য পানি মিশিয়ে দিবে দুধে। অর্থাৎ যার যতটুকু সুযোগ বা ক্ষমতা আছে, সে ততটুকুই দুর্নীতি করতে উদগ্রীব! এতে মনে হচ্ছে মনস্তাত্ত্বিকভাবে আমরা অনেকেই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছি! মনস্তাত্ত্বিকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের চিন্তা-চেতনা সর্বত্রই দুর্নীতির পক্ষে যুক্তি খুঁজে! তাদের কেউ এক টাকার দুর্নীতিবাজ, কেউ লাখ টাকার দুর্নীতিবাজ, কেউ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতিবাজ। নীতিকথা আজ মূল্যহীন, নীতিবানরা আজ অবহেলিত, বিজ্ঞরা মূর্খের অধীন, সততা মানেই দরিদ্রতা। সবকিছুই যেন গ্রাস করেছে দুর্নীতির দুষ্টচক্র! দুর্নীতি করা, দুর্নীতিকে সমর্থন করা, দুর্নীতিবাজকে সম্মানিত করা, যখন সামাজিকভাবে স্বাভাবিক হয়ে যায় তখন সমাজের মানুষের মানসিকতা কতটা অস্বাভাবিক হয়ে গেছে, তা কিঞ্চিৎ অনুমান করা যায়! এমন অস্বাভাবিক মানসিকতার ধারকই আদনান ফেরদৌস ও অন্যরা। এমন অস্বাভাবিক দুর্নীতিপরায়ণ মানসিকতা একদিনে কিংবা এক যুগে তৈরি হয় না, আমাদেরও হয়নি। এটি কত যে ভয়াবহ, তা আমরা অনেকেই অনুমান করতে পারছি না এখনো। মনে পচন ধরে গেলে মানুষের আর অবশিষ্ট থাকে না কিছুই!
আমাদের সবারই যে দুর্নীতিপরায়ণ মানসিকতা তৈরি হয়ে গেছে তা কিন্তু নয়। নিজের অস্তিত্ব জানান দেয় না, দিতে পারে না, এমন অগণিত ভালো মানুষ এখনো আমাদের সমাজের আনাচে-কানাচে বিদ্যমান। তবে সামাজিকভাবে স্বেচ্ছায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার মতো সক্রিয় মানুষের সংখ্যা লক্ষণীয়ভাবে কমে গেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা, তেমনটি করতে গেলে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব। কেউ ন্যায়ের পক্ষে ও অন্যায়ের বিপক্ষে সামান্য এগিয়ে এলেই আঘাত করা হয়, ফেলে দেওয়া হয়! এর বিচার চাইতে গেলেও বিপদ হয়! আমরা স্বীকার করি বা না করি বাস্তবতা হচ্ছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভালোরা ঐক্যহীন, শক্তিহীন ও দুর্বল আর মন্দরা ঐক্যবদ্ধ, শক্তিধর ও সবল! এমতাবস্থায় আমাদের নতুন প্রজন্মের ভালোরা, যোগ্যরা ও দক্ষরা বাধ্য হয়েই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে দেশ থেকে, পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে। এতে মাঠ খালি পেয়ে খুশি হয়ে তবল বাজাচ্ছে অযোগ্য আর দুষ্টুরা! আমাদের অনেকেই বিশ্বসেরা হচ্ছে বিদেশে গিয়ে অনুকূল পরিবেশ পেয়ে। অথচ তারা দেশে থাকলে দেশটাই বিশ্বসেরা হতে পারত তাদের দ্বারা। যারা বিদেশ যেতে পারছে না বা চাচ্ছে না; অথচ সৎভাবে পরিশ্রম করে সচ্ছল জীবনযাপন করতে চাচ্ছে, তারা চাকরি নিচ্ছে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে। একটু লক্ষ করলেই দেখা যায়, ব্যাংক ও আইটি সেক্টরসহ বিভিন্ন প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে আমাদের অনেক যোগ্য সন্তান। দুর্নীতিকে ঘৃণা করার মতো, দুর্নীতিমুক্ত থাকার মতো, সৎ জীবনযাপন করার মতো, পরিশ্রম করে অধিক অর্থ উপার্জন করার মতো, দেশ-জাতিকে ভালোবাসার মতো অনেক মানুষ এখনো অবশিষ্ট আছে এবং আরও অনেক মানুষ তৈরি হচ্ছে। এটি অবশ্যই আমাদের শুদ্ধ সমাজ ফিরে পাওয়ার সম্ভাব্য আশার বিষয়। তাই যেকোনো মূল্যে ওদের জন্য নিশ্চিত করতে হবে অনুকূল পরিবেশ। শক্তিশালী ও বাস্তবমুখী করতে হবে শুদ্ধতার সংগ্রাম। পরাস্ত করতে হবে দুর্নীতির দুষ্টচক্র। যার জন্য প্রয়োজন আইনের শাসন ও নৈতিক শিক্ষা। নৈতিক শিক্ষার পাশাপাশি অপরাধের শাস্তি নিশ্চিতকরণ ব্যতীত কোনো দেশের মানুষই দুর্নীতিমুক্ত হয়নি, হবে না। মহান সৃষ্টিকর্তাও তাই মানুষের জন্য উপদেশ দেওয়ার পাশাপাশি শাস্তির বিধান দিয়েছেন। যেখানে শাসন থাকে না, শাস্তির ভয় থাকে না, বিবেকের দংশন থাকে না সেখানেই মানুষ অবাধ্য হয় বেশি। এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক বিষয়। ক্যান্টনমেন্টের ভিতর ঢুকলেই সব ট্রাফিক আইন মেনে চলে সব ড্রাইভার। যে দেশে নৈতিক শিক্ষা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা যত বেশি সে দেশে দুর্নীতি তত কম। সে সব দেশের কৌশল আমাদের জন্য হতে পারে অনুসরণীয়। একটি দেশ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হতে যেমন দীর্ঘ সময় লাগে তেমনি দুর্নীতি থেকে উত্তরণের জন্য আরও বেশি সময় প্রয়োজন হয় এবং সেটি ধরে রাখার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। দেশ ও জাতির অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই শুদ্ধতার সে সংগ্রাম আরও শুদ্ধ করা, সুসংগঠিত করা ও শক্তিশালী করা অত্যাবশ্যক।
লেখক: সাহিত্যিক, শিক্ষক ও কলামিস্ট
https://www.dainikbangla.com.bd/opinion/45638/1718984851