বেসরকারি শিক্ষক হওয়ার পূর্বে কতিপয় বিবেচ্য বিষয়, দৈনিক বাংলা

বেসরকারি শিক্ষক হওয়ার পূর্বে কতিপয় বিবেচ্য বিষয়, দৈনিক বাংলা

 

পত্রিকার লিংক

বেসরকারি শিক্ষক হওয়ার পূর্বে কতিপয় বিবেচ্য বিষয়

মো. রহমত উল্লাহ
প্রকাশিত : ২৭ মে, ২০২৪ ১৪:১৫

আমাদের দেশে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে যারা এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হতে আগ্রহী তাদের উচিত বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য জেনে বুঝে বাস্তবতার আলোকে এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা। কেননা অতি আবেগ-তাড়িত হয়ে বা অন্য চাকরি না পেয়ে অথবা ভিন্ন কোনো কারণে সবকিছু না জেনে, না বুঝে বেসরকারি শিক্ষক হয়ে নিজের কর্মের ওপর সন্তুষ্ট থাকতে না পারলে ব্যক্তিগত সফলতা অর্জন এবং দেশ ও জাতির কল্যাণসাধন মোটেই সম্ভব নয়। সফল শিক্ষক ব্যতীত যোগ্য ও দক্ষ নাগরিককর্মী তৈরি হয় না। একজন স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ও আত্মনিবেদিত সুযোগ্য সফল শিক্ষক সারাজীবনে তৈরি করেন অগণিত সফল মানুষ। বিপরীতক্রমে একজন অনাগ্রহী ও অসন্তুষ্ট শিক্ষক নিজের জান্তে বা অজান্তে সারাজীবনে তৈরি করেন অগণিত অযোগ্য নাগরিক। উত্তম শিক্ষকতার জন্য সন্তুষ্টচিত্তে আত্মমনোযোগী হওয়া অত্যাবশ্যক। তাই বলছি, ভালোভাবে সবকিছু জেনে বুঝে ভেবেচিন্তেই হওয়া উচিত শিক্ষক, বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষক। এ জন্য প্রার্থীদের সুবিধার্থে সংক্ষিপ্তভাবে নিচে উপস্থাপন করছি কিছু বিবেচ্য বিষয়।

মনে রাখতে হবে, ভিন্ন ভিন্ন ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডি দ্বারা পরিচালিত প্রতিটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পৃথক, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি পদ সম্পূর্ণ পৃথক, চাকরির আবেদনের চয়েজ লিস্টের প্রতিটি চয়েজ পৃথক। পদ শূন্য থাকলে নিজের যোগ্যতা ও ইচ্ছা অনুসারে বাড়ির পাশে, দূরে বা বহুদূরে, শহরে কিংবা গ্রামে অবস্থিত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায়, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবেদন করা যাবে। এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে সরাসরি বদলি হওয়ার কোনো সুযোগ বিদ্যমান নেই। কেন নেই সে ব্যাখ্যা অনেক বিস্তৃত ও অনেক বিতর্কিত। প্রতিষ্ঠান বদলের ন্যূনতম সুযোগটুকুও এখন আর নেই! সেটি পুনরায় আদৌ তৈরি হবে কি না, হলেও কতদিনে হবে তা অনিশ্চিত। বদলির কিংবা প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ যখনই হোক, যে নীতিমালা তৈরি করা হবে সে নীতিমালায় কে কতটুকু সুযোগ পাবে তাও অজানা।

কেউ কোনো দিন সুযোগ পেলেও তাকে অন্য একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই যেতে হবে এবং সেটির ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডির অধীনস্থ হয়েই চাকরি করতে হবে।

মোট শূন্যপদের বিপরীতে মোট প্রার্থীর সংখ্যা যাই থাকুক না কেন ভালো, সচ্ছল ও সুবিধাজনক প্রতিষ্ঠানে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংখ্যা বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। নিবন্ধন পরীক্ষায় বেশি নম্বর প্রাপ্ত হয়ে থাকলেও ভালো প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পেতে চাইলে একাধিক প্রতিষ্ঠানে আবেদন করার প্রয়োজন হবে। যাদের নিবন্ধন পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর তুলনামূলক কম তাদের আরও বেশিসংখ্যক প্রতিষ্ঠানে আবেদন করার প্রয়োজন হবে। সেক্ষেত্রে নিজের বাড়ির আশপাশে অবস্থিত একাধিক প্রতিষ্ঠানে এবং অনেক দূরদূরান্তে অবস্থিত একাধিক প্রতিষ্ঠানে আবেদন করার তাগিদ অনুভব করতে পারেন।

যে প্রতিষ্ঠানেই আবেদন করুন না কেন; ধরে নিতে হবে ওই প্রতিষ্ঠানেই আপনার চাকরি হবে এবং আপনি অবশ্যই সেখানে চাকরি করতে যাবেন। তাই একজন প্রার্থীর নিম্নলিখিত বিষয়গুলো ভালোভাবে বিবেচনায় রেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চয়েজ করে সিলেকশন করা বা আবেদন করা উচিত।

১। নিবন্ধন পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর বেশি বা মেরিট পজিশন আগে না থাকলে বেশি ভালো বা সুবিধাজনক প্রতিষ্ঠানে সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকবে। সেক্ষেত্রে অধিক সংখ্যক আবেদন করার প্রয়োজন হতে পারে।

২। নিজের এলাকায় ও কম দূরে অবস্থিত যাতায়াত সুবিধা-সংবলিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে পছন্দের ক্ষেত্রে যথাসম্ভব অগ্রাধিকার দেওয়া। বিশেষ করে যাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সমস্যা আছে এবং যারা মহিলা প্রার্থী তাদের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিজের বাড়িতে থেকে কম বেতন পেলেও টিকে থাকা যায় এবং অন্যান্য সুবিধা পাওয়া যায়।

৩। প্রতিষ্ঠানের সুনাম, অবস্থা, অবস্থান, কর্মপরিবেশ, শিক্ষার্থীর সংখ্যা, আর্থিক সচ্ছলতা ও শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি সন্তোষজনক কি না তা জেনে নেওয়া। শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম থাকলে প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ-সুবিধার পরিমাণও সাধারণত কম থাকে। এমনকি বৈধভাবে প্রাইভেট পড়ানোর সুযোগও কম থাকে।

৪। আবেদনের জন্য প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত পদটি এমপিওভুক্ত শূন্যপদ কি না, এ পদের বিপরীতে কাম্য শিক্ষার্থী আছে কি না, কোনো মামলা-মোকদ্দমা আছে কি না, এমপিওভুক্ত হবে কি না, হলে কতদিন লাগতে পারে তা নিশ্চিত হওয়া।

৫। কোনো কারণে নন-এমপিও পদে আবেদন করতে চাইলে তা জেনে বুঝেই করা। প্রতিষ্ঠানের সচ্ছলতা নিশ্চিত হওয়া এবং প্রতিষ্ঠান থেকে সব সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় কি না, তা নিশ্চিত হওয়া। কারণ সরকারি আদেশ থাকার পরও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান থেকেই নন-এমপিও শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সমপরিমাণ আর্থিক সুবিধা প্রদান করা হয় না!

৬। দূরবর্তী কোনো প্রতিষ্ঠানে আবেদন করতে হলে সেই প্রতিষ্ঠান ও এলাকা সম্পর্কে ভালোভাবে জেনেশুনে দেখে নেওয়া। তদুপরি সেখানে যাতায়াত সুবিধা কেমন, থাকা-খাওয়ার সুবিধা আছে কি না, নিরাপত্তাব্যবস্থা কেমন, ছুটিতে বা প্রয়োজনে নিজের আপনজনের কাছে যাওয়া-আসা করা যাবে কি না, যেসব অসুবিধা আছে সেগুলো সহজে মেনে নেওয়া যাবে কি না, তাও বিবেচনা করা। প্রার্থী মহিলা হলে এসব বিষয় অধিক গুরুত্ব দিয়ে দেখা।

৭। গ্রামে কিংবা শহরে যেখানে বসবাস করতে আপনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন সেখানকার প্রতিষ্ঠানকে অগ্রাধিকার দেওয়া। শহরে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানে আবেদন করার ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, শহরেও সচ্ছল এবং অসচ্ছল উভয় ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। শহরের কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে বেতন-ভাতা কিছুটা বেশি থাকলেও জীবনযাপনের ব্যয় অনেক বেশি।

৮। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি ও ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কোনো ধরনের প্রতিষ্ঠানে বা সহকর্মীদের সঙ্গে কর্ম করে আপনি অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন তা ভেবে নেওয়া।

৯। যে পদে আবেদন করবেন সেই পদের মর্যাদা কতটুকু, সরকারি বেতন স্কেল কী, বর্তমান মূল বেতন কত, অন্যান্য ভাতাদি পরিমাণ কত, মাসিক কর্তনের পরিমাণ কত, বিভিন্ন বোনাসের পরিমাণ কত, বার্ষিক ইনক্রিমেন্টের পরিমাণ কত, পদোন্নতির সুযোগ আছে কি না, অবসরের সময় কী পরিমাণ আর্থিক সুবিধা পাওয়া যেতে পারে এবং অন্যান্য পেশার তুলনায় সুযোগ-সুবিধা কতটুকু কম-বেশি ইত্যাদি জেনে নেওয়া।

১০। একাধিক স্তরবিশিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত পদে যোগদান করলে কোন কোন স্তরে ক্লাস নিতে হবে, তা জেনে নেওয়া এবং সেই স্তরে ক্লাস নেওয়ার জন্য নিজের ইচ্ছা ও যোগ্যতা আছে কি না বা থাকবে কি না তা ভেবে নেওয়া।

১১। আধুনিক শিক্ষকতায় কাজের ধরন-পরিধি কেমন, লেখাপড়ায় লেগে থাকতে ভালো লাগে কি না, শিক্ষকের দায়িত্ব-কর্তব্য কতটুকু ও কর্মকালে ছুটি ভোগের বিধান কেমন, অন্যান্য পেশার তুলনায় সুযোগ-সুবিধা কতটুকু কম-বেশি, নিজের যোগ্যতা ও মন-মানসিকতার সঙ্গে এই পেশা খাপ খায় কি না ইত্যাদি বুঝে নেওয়া।

১২। প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের ক্ষেত্রে (পুনরায় সুযোগ দেওয়া হলে) কাঙ্ক্ষিত প্রতিষ্ঠানের অবস্থা ও অবস্থান বর্তমান প্রতিষ্ঠানের অবস্থা ও অবস্থানের তুলনায় অধিক ভালো কি না এবং সেখানে গেলে পরিবর্তনের উদ্দেশ্য পূর্ণ হবে কি না, তা জেনে বুঝে নেওয়া।

উল্লিখিত বিষয়গুলোর সঙ্গে নিজের বিশেষ বিষয়গুলো সার্বিক বিবেচনায় যথাযথ ও মনোপুত হলেই পছন্দ তালিকা তৈরি করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক পদে আবেদন করা উচিত; যেন নিয়োগ পেলে যোগদান করার ব্যাপারে কোনোরূপ অনিহা না থাকে। কেননা নিয়োগ পেয়ে কেউ যোগদান না করলে একদিকে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা শিক্ষক প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয় এবং অন্যদিকে একজন প্রার্থী নিয়োগ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন! যেখানে চাকরি হলে আপনি যাবেন না সেখানে অহেতুক আবেদন করে অন্য প্রার্থীকে বঞ্চিত করা ও পদটি শূন্য রেখে শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত করা মোটেও উচিত নয়। তাই সংশ্লিষ্ট নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান, থানা/উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস, এলাকার মানুষ ও অন্যান্য সোর্স থেকে কাঙ্ক্ষিত তথ্য সংগ্রহ করে সবদিক বিবেচনা করে এমন পদে বা প্রতিষ্ঠানে আবেদন করা উচিত যেখানে নিয়োগ পেলে যোগদান ও কর্ম সম্পাদনে নিজের আগ্রহ থাকবে।

হাজার বছর ধরেই এদেশের শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা অত্যন্ত কম ছিল। তখনকার শিক্ষকদের প্রায় সবাই স্বেচ্ছায় স্বপ্রণোদিত হয়ে, আত্মনিবেদিত হয়ে শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন। তাদের কাছে শিক্ষকতা প্রায় শতভাগ ব্রত ছিল। তখনকার জীবনযাপনের প্রেক্ষাপটে শিক্ষকতার মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্য মুখ্য ছিল না। তবে বর্তমান বাস্তবতায় শিক্ষকদের ন্যূনতম জীবন ধারণের প্রয়োজনেই শিক্ষকতার মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের বিষয়টি অনেকাংশে মুখ্য হয়ে উঠেছে। তথাপি আমাদের দেশের শিক্ষকদের বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা অন্যান্য দেশের তুলনায় খুবই নগণ্য! বর্তমানে এমপিও-এর মাধ্যমে সরকার মাধ্যমিক স্তরের একজন প্রশিক্ষণবিহীন সহকারী শিক্ষককে মূল বেতন দিয়ে থাকে মাত্র ১২ হাজার ৫০০ টাকা! উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ের একজন প্রভাষককে প্রাথমিক মূল বেতন দেওয়া হয় ২২ হাজার টাকা। এ ছাড়া সব স্তরের শিক্ষকদের বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট অনধিক ৫ শতাংশ, বাড়ি ভাড়া ভাতা ১ হাজার টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা, উৎসব ভাতা ২৫ শতাংশ, বাংলা নববর্ষ ভাতা ২০ শতাংশ দেওয়া হয়ে থাকে। অন্যদিকে এই মূল বেতন থেকে অবসর + কল্যাণ তহবিলের জন্য ১০ শতাংশ টাকা জমা রাখা হয়। নিয়মিত ২৫ বা ততোধিক বৎসর চাকরি করে অবসরে গেলে কল্যাণ + অবসর তহবিল থেকে সর্বশেষ মূল বেতনের প্রায় ১০০ গুণ টাকা পাওয়ার বিধান বিদ্যমান। উল্লিখিত সরকারি সুবিধার অতিরিক্ত কোনো সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব সচ্ছলতা ও বিধি-বিধানের ওপর নির্ভরশীল। প্রতিষ্ঠান সচ্ছল হলে আরও কিছু সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। কিন্তু প্রতিষ্ঠান অসচ্ছল হলে সরকারি টাকার বাইরে উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই পাওয়া যায় না! এই ডিজিটাল যুগে নিজেকে তৈরি করতে জানলে এর চেয়ে অধিক উপার্জনের বহুমুখী সুযোগ দেশে-বিদেশে অবারিত। বেসরকারি শিক্ষকদের বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা কতদিনে কতটুকু বৃদ্ধি পাবে তা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। কতকালে কতটি প্রতিষ্ঠান সরকারি হবে তা আরও বেশি অনিশ্চিত। আমার দীর্ঘ অতীত অভিজ্ঞতা তাই বলে বারবার।

কেউ যদি ধারণা করেন, অন্যান্য চাকরির তুলনায় শিক্ষকতায় সময়, শ্রম ও মেধা কম দিতে হয় তো সেটি ভুল। শিক্ষকতায় কাজের পরিধি এখন অনেক বিস্তৃত। নিত্যনতুন বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সঠিক জ্ঞান দেওয়ার জন্য শিক্ষককে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হয় প্রতিনিয়ত। আয়ত্ত করতে হয় অত্যাধুনিক পাঠদান ও মূল্যায়ন কৌশল। আত্মনিবেদিত থাকতে হয় সর্বক্ষণ। বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদ্‌যাপনের জন্য ছুটির দিনেও আসতে হয় প্রতিষ্ঠানে। শিক্ষার্থীর কল্যাণার্থে চিন্তা-চেতনার দিক থেকে প্রকৃত শিক্ষকের কোনো ছুটি নেই। এসবই করা চাই অত্যন্ত আগ্রহ ও আনন্দের সঙ্গে। শিক্ষকতা শিক্ষকের জন্য আনন্দদায়ক না হলে শিক্ষালাভ শিক্ষার্থীদের জন্য আনন্দদায়ক হয় না, সফল হয় না। শিক্ষক হওয়ার আগে অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে এসব।

মোট কথা হচ্ছে, না জেনে না বুঝে শিক্ষকতায় এসে কেউ যদি হতাশায় ভোগেন তো তিনি নিজে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হন তেমনি শিক্ষার্থীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই সবকিছু জেনে বুঝে, মেনে নিয়ে, মনে নিয়ে, তবেই আসা উচিত শিক্ষকতায় বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকতায়। আমি বলতে চাচ্ছি, সবার শিক্ষক হওয়া উচিত নয়। যারা সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত, ভোগের চেয়ে ত্যাগে আনন্দিত, শিক্ষা অর্জনে ঐকান্তিক, শিক্ষাদানে উজ্জীবিত, মননশীল ও সৃষ্টিশীল, মহৎ চিন্তায় ও কাজে নিবেদিত, শিক্ষার্থীদের কল্যাণে নিরলস, শিক্ষার্থীদের মধ্যে অমর হতে ইচ্ছুক তাদেরই হওয়া উচিত শিক্ষক। তা না হলে এ মহৎ কাজে এসে সারাক্ষণ মন খারাপ করে, দাবি-দাওয়া করে, আন্দোলন করে, দলাদলি করে, অন্যকে দোষারোপ করে, অন্যের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করে, বিক্ষুব্ধ বা হতাশাগ্রস্ত হয়ে নিজের পেশাকে মন্দ বলে বলে মন্দ সময় পার করে; না হওয়া যায় শিক্ষক, না পাওয়া যায় আনন্দ, না পাওয়া যায় শান্তি!

লেখক: অধ্যক্ষ, শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক

যে করেই হোক বন্ধ করতে হবে সনদ জালিয়াতি

যে করেই হোক বন্ধ করতে হবে সনদ জালিয়াতি

পত্রিকার লিংক 


যে করেই হোক বন্ধ করতে হবে সনদ জালিয়াতি 

মো. রহমত উল্লাহ্

দৈনিক বাংলা, o৩ মে ২০২৪

>সম্প্রতি কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের কম্পিউটার সেলের সিস্টেম এনালিস্ট এ কে এম শামসুজ্জামান সনদ জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছে। সনদ জালিয়াতির ব্যাপারে তার স্বীকারোক্তি ও জবানবন্দীর পরিপ্রেক্ষিতে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সদ্যসাবেক চেয়ারম্যান আলী আকবর খান এর স্ত্রী সেহেলা পারভীনকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রয়োজনে আলী আকবর খানকেও গ্রেফতার করা হতে পারে। সেহেলা পারভীন সিস্টেম অ্যানালিস্ট এর সঙ্গে অবৈধ অর্থ লেনদেনের কথা স্বীকার করেছে। জানা গেছে আসামি একে এম শামসুজ্জামান বিপুলসংখ্যক জাল সার্টিফিকেট তৈরি করে দেশব্যাপী বিভিন্ন সার্টিফিকেট প্রত্যাশীদের কাছে বিক্রি করে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইটে আপলোড করেছে। অর্থাৎ সার্টিফিকেট জালিয়াতির কাজটি এমনভাবেই করা হয়েছে যে বোর্ডের ওয়েবসাইটে যাচাই করেও জাল সনদ চিহ্নিত করার কোন উপায় নেই! এমতাবস্থায় কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সকল সনদ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক নয় কি? যারা কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে প্রকৃতপক্ষে শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে বৈধ সনদের অধিকারী হয়েছেন তারাও এখন লজ্জিত, অপমানিত ও বিক্ষুব্ধ। বৈধ সনদের অধিকারীরাই অপরাধীদের বিরুদ্ধে সর্বাধিক সোচ্চার হওয়া উচিত এবং এটি তাদের নৈতিক দায়িত্ব। 


যোগ্যতার সনদ জালিয়াতি বাস্তবে একটিমাত্র অপরাধ নয়; অনেক অনেক অপরাধের সূত্রপাত। জাল সনদ প্রদানকারী ও গ্রহণকারী উভয়ই অপরাধী। জাল সনদ গ্রহণকারী জাল সনদ ব্যবহার করে সারা জীবনে যাই করুক সবই অপরাধ। সে নিজেকে এ সনদ অর্জনকারী বলা অপরাধ, এই সনদ কোথাও দাখিল করা অপরাধ, এ সনদ দ্বারা চাকরির আবেদন করা অপরাধ, এ সনদ দ্বারা একজন যোগ্য লোককে বঞ্চিত করা অপরাধ, এ সনদ দ্বারা চাকরি করা অপরাধ, এ সনদে প্রাপ্ত কর্মের/ চাকরির আয় অবৈধ, এ আয় দ্বারা জীবনযাপন অপরাধ, এ আয় খেয়ে ইবাদত নিষ্ফল, এ সনদের যোগ্যতা ও কর্ম দেখিয়ে বৈবাহিক সম্পর্ক করা অপরাধ! এমন আরো অনেক অনেক অপরাধের অংশীদার কিন্তু সেই অবৈধ সনদ প্রদানকারীও। একজন অবৈধ সনদ প্রদানকারী কিন্তু বহু জনকে বহু অবৈধ কাজের সুযোগ সৃষ্টিকারী! সে হাজারো অপরাধের সূত্রপাত ঘটায়! সে অনেক মানুষের সারা জীবনের জন্য নৈতিক স্খলন ঘটায়! কেননা তার দেওয়া অবৈধ সনদ দ্বারা কেউ কোন কাজে নিয়োজিত হলে আজীবন ওই অপকর্মেই থেকে যায়। ভুয়া সনদ প্রদানকারী বহু অপরাধের হুতা, সর্বাধিক শাস্তিযোগ্য অপরাধী! 


বিভিন্ন সময় দফায় দফায় হাজার হাজার জাল সনদধারী শিক্ষকের খোঁজ পাওয়া গেছে! এটি আমাদের শিক্ষক সমাজের জন্য, দেশের জন্য, জাতির জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক, লজ্জাজনক ও কলঙ্কজনক! সম্পূর্ণ অযোগ্য, জাল সনদধারী, চরম অনৈতিক হাজারো দুষ্ট লোক যে দেশে শিক্ষক হতে পারে, শিক্ষকতায় নিয়োজিত থাকতে পারে, সে দেশের শিক্ষার মান কেমন হবে তা তো যে কেউ অনুমান করতে পারবেন। এমন দুষ্ট লোকদের কাছে শিক্ষার্থীরা কেমন শিক্ষা লাভ করবে তা তো অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ! ভুয়া/ জাল/ অবৈধ সনদধারী কেউ যাতে শিক্ষাক্ষেত্রে থাকতে না পারে এবং শিক্ষকতায় আসতে না পারে সেজন্য সর্তকতা অবলম্বন করা ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। তদুপরি কোন অজুহাতে যাতে অযোগ্যরা আবারো শিক্ষক হতে না পারে সে ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখা আবশ্যক এবং শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে অধিক যোগ্য ও আদর্শ মানুষদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করা দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে অত্যন্ত প্রয়োজন। তড়িঘড়ি করে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করার চেয়ে বিলম্ব করে অধিক যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করা দীর্ঘমেয়াদে অধিক কল্যাণকর। তাই কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন এক বছর মেয়াদী এ্যাডভান্স সার্টিফিকেট ইন ফাইন আর্টস (চারু-কারুকলা) এবং কম্পিউটার টেকনোলজি (ICT) কোর্সের সনদ তড়িঘড়ি নিয়ে যারা সহজেই বেসরকারি শিক্ষক হবার ব্যাপক সুযোগ পাচ্ছেন তাদের এ সনদ ও যোগ্যতা নিয়ে পরে যেন কোন প্রশ্ন দেখা দিতে না পারে সে ব্যাপারে এখনই সতর্ক ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সম্প্রতি এ দুটি বিষয়ে অতি সংক্ষিপ্ত সময়ে বিপুলসংখ্যক সনদ অর্জনকারীদের সনদের সত্যতা, কোর্স সম্পন্ন করানো প্রতিষ্ঠান গুলোর বৈধতা ও উপযুক্ততা এবং অনুমোদন প্রদানের যথার্থতা, প্রশিক্ষণ প্রদানকারী প্রশিক্ষকদের প্রকৃত যোগ্যতা ও পর্যাপ্ততা, প্রশিক্ষণার্থী ভর্তির তারিখ থেকে কোর্স সমাপ্তির বাস্তব ডিউরেশন (অর্থাৎ ১২ মাসের কোর্সের ৮-৯ মাস কিংবা তারও বেশি সময় চলে যাওয়ার পর শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে কিনা!), প্রকৃতপক্ষে যথাযথ প্রশিক্ষণ গ্রহণের সত্যতা, প্রশিক্ষণে সফলতা অর্জনের সত্যতা ইত্যাদি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে বিশেষ কমিটি গঠন করে পিছন থেকে যাচাই-বাছাই করা আবশ্যক।


শুধুমাত্র শিক্ষকতায়ই নয় অন্যান্য চাকরিতেও অবৈধ সনদধারী থাকার সম্ভাবনা আছে। বিশেষ করে যে সকল কর্মে/ চাকরিতে অষ্টম শ্রেণি পাশের সনদ দিয়ে নিয়োজিত হওয়া যায় সে সকল ক্ষেত্রে সর্বাধিক ভুয়া সনদধারী পাওয়ার সম্ভাবনা বিদ্যমান। শুধুমাত্র নাম দস্তখত করতে জানেন, আর কিছুই লিখতে পড়তে পারেন না, এমন অনেকেই অষ্টম শ্রেণি পাস সনদ দিয়ে বিভিন্ন সেক্টরে নিয়োজিত ছিলেন, আছেন। জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা বাতিল হওয়ায় আবারও তেমনটি ঘটবে বলে পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। অপরদিকে টেকনিক্যাল ট্রেনিং ও প্র্যাকটিক্যাল এডুকেশন রিলেটেড সার্টিফিকেট দিয়ে যে সকল কর্মে নিয়োজিত হওয়া যায় সে সকল ক্ষেত্রেও ভুয়া সনদধারী থাকার সম্ভাবনা বেশি। এমন অনেক চাকরিজীবী আছেন যারা তাদের সনদে লিখিত যোগ্যতা ও দক্ষতা ন্যূনতম প্রমাণে সক্ষম নন। লোভে বা চাপে এমন অনেক ভুয়া বা অবৈধ সনদ দিয়ে থাকেন বা দিতে বাধ্য হন অনেক প্রতিষ্ঠান প্রধান। এ সকল বাস্তবতায় জাল বা অবৈধ কিংবা ভুয়া বা আংশিক ভুয়া সনদ কিন্তু অনেক রকম হতে পারে। এক. কোন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়নি, নির্ধারিত কোর্স সম্পন্ন করেনি, পরীক্ষায় বা কাজে অংশগ্রহণ করেনি এমন কাউকে কোন পরীক্ষা পাশের বা কাজের দক্ষতা লাভের সনদ তৈরি করে দেওয়া। দুই. প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছে কিন্তু কোর্স সম্পন্ন করেনি ও পরীক্ষায় বা কাজে অংশগ্রহণ করেনি এমন কাউকে কোন পরীক্ষা পাশের বা কাজের দক্ষতা লাভের সনদ দেওয়া। তিন. প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছে কিন্তু নির্ধারিত কোর্স সম্পন্ন করেনি ও পরীক্ষায় বা কাজে অংশগ্রহণ করে কৃতকার্য হয়নি এমন কাউকে সনদ দেওয়া। চার. প্রতিষ্ঠানে বিলম্বে ভর্তি হয়েছে বিধায় বা অন্য কোন কারণে নির্ধারিত কোর্স সম্পন্ন করেনি বা করতে পারেনি তাকে অনৈতিকভাবে পাস দেখিয়ে/করিয়ে সনদ দেওয়া। পাঁচ. পরীক্ষায় বা মূল্যায়নে নকল করার অবাধ/উন্মুক্ত সুযোগ দিয়ে পাস করিয়ে সনদ দেওয়া। ছয়. প্রকৃত প্রাপ্ত গ্রেডকে অবৈধ ভাবে আপগ্রেড করে সনদ দেওয়া। অর্থাৎ জাল বা অবৈধ সনদ কিংবা ভুয়া বা আংশিক ভুয়া সনদ যথাযথ কর্তৃপক্ষের প্রকৃত কাগজে প্রকৃত সিল-স্বাক্ষর যুক্ত হয়েও তৈরি হতে পারে, আবার সবকিছুই নকল হতে পারে। যখন সবকিছুই নকল হয় তখন শুধুমাত্র সনদ যাচাই করে সত্যতা/ অসত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। কিন্তু যখন যথাযথ কর্তৃপক্ষের আসল কাগজে আসল সিল-স্বাক্ষর যুক্ত হয়ে অবৈধ বা ভুয়া কিংবা আংশিক ভুয়া সার্টিফিকেট তৈরি হয় তখন সেটির যাচাই কাজ অনেক পিছন থেকে শুরু করতে হয়। তাই সে প্রক্রিয়াটি অনেক গভীর ও দীর্ঘ হয়। তেমন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সনদের সত্যতা যাচাই করা হয় না বললেই চলে। তাই অনেক ভুয়া বা অবৈধ সনদধারীরা আলোচনার ও ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। তারা টেকনিক্যাল এডুকেশন এবং সাধারণ শিক্ষা উভয় ধরনের বা একেক জন একেক ধরনের সনদধারী হতে পারে। বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে সার্বিকভাবে বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত রাখা অত্যাবশ্যক। তা না হলে একসময় জাল সনদের জালে আটকে যেতে পারে আমাদের অনেক ক্ষেত্র। যে করেই হোক ভুয়া শিক্ষকের শিক্ষকতা ও ভুয়া চিকিৎসকের চিকিৎসা থেকে মুক্ত হওয়াসহ ভুয়া বা অবৈধ সনদধারীমুক্ত করতে হবে আমাদের দেশের প্রতিটি ব্যক্তি, প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ও সবকটি ক্ষেত্র।<


লেখক: অধ্যক্ষ, শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট 


https://epaper.dainikbangla.com.bd/home/displaypage/news_2024-05-03_5_15_b