পত্রিকার লিংক
শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও কোচিং-বাণিজ্য
মো. রহমত উল্লাহ্
খোলা কাগজ, ২২ জুন ২০২১
আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে যতটুকু অগ্রগতি তথা অনুকূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে ও হচ্ছে তা মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন ও আছেন শিক্ষক সমাজ। অন্যথায় এই সফলতাটুকু অর্জন সম্ভব ছিল না মোটেও। আর এই শিক্ষকদের প্রায় ৯৭ ভাগ হচ্ছেন বেসরকারি। তাদের প্রাপ্ত বেতন-ভাতায় সংসার চলে না, এটি এখন সবাই জানেন ও বোঝেন। শিক্ষকদের বাধ্য হয়েই বিকল্প উপার্জনের রাস্তা খুঁজতে হচ্ছে সংসারের ন্যূনতম ব্যয় মেটানোর জন্য। তাই তারা যোগ্যতানুসারে বেছে নিয়েছেন অতিরিক্ত কাজ করে সামান্য আয়ের পথ। কেউ কেউ প্রাইভেট পড়ানো, নোট-গাইড লেখা, বিভিন্ন ব্যবসা, ঠিকাদারি, রাজনীতি ইত্যাদি করছেন। আবার কেউ বাবার/স্বামীর ধন খাচ্ছেন। সেসব খাতের আয়ের ওপর যেহেতু তাদের জীবনধারণ অনেকাংশে নির্ভর করছে; সেহেতু তারা ঐ কাজকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। ঐ কাজেই বেশি সময়, শ্রম ও মেধা খাটাচ্ছেন। ফলে শিক্ষকতায় তাদের মনোযোগ না থাকা বা কম থাকাই স্বাভাবিক। শিক্ষার্থীরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়াই বাস্তব। এই বাস্তবতায় প্রাইভেট না পড়ে বা কোচিং না করে শিক্ষার্থীরা পারবে কীভাবে? তবে এ কথা স্বীকার করতে হবে, যারা শিক্ষকতার পাশাপাশি অন্যান্য কাজ করছেন বা করতে বাধ্য হচ্ছেন; তাদের চেয়ে যারা প্রাইভেট পড়াচ্ছেন বা কোচিং করাচ্ছেন তারা তো ব্যক্তিগতভাবে হলেও শিক্ষকতাই করছেন। নিজের পাঠদানের বিষয়টি নিয়মিত চর্চা করছেন কমবেশি। অন্যরা তো তা-ও করছেন না। এই প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করতে পারেনি এবং শিক্ষকদের কাম্য বেতন-ভাতা নিশ্চিত করতে পারেনি বলেই হয়তো যুগ যুগ ধরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাইভেট-কোচিং বন্ধের ব্যাপারে নমনীয় নীতি অনুসরণ ও নির্ধারণ করতে বাধ্য হয়েছে বার বার।
সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর মহোদয়ের আমলে প্রাইভেট-কোচিং বন্ধের জন্য গত ২০ জুন ২০১২ তারিখে যে নমনীয় নীতিমালা জারি করা হয়েছিল সেই নীতিমালাকেই বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীর মহোদয়ের আমলে আইনি ভিত্তি দেওয়ার জন্য গত ০৮ ফেব্রু়ারি ২০১৯ তারিখে গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বিভিন্ন উপ-ধরাসহ মোট ১৪টি ধারা সংযুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে:
১/ক. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: সরকারি ও বেসরকারি সকল ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহকে বুঝাবে।
১/গ. শিক্ষক: সরকারি ও বেসরকারি সকল ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সকল শিক্ষককে বুঝাবে।
১/ঘ. শিক্ষার্থী: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে অধ্যয়নরত সকল ছাত্র-ছাত্রীকে বোঝাবে।
১/চ. কোচিং: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম চলাকালীন শিক্ষকের নির্ধারিত ক্লাসের বাইরে বা এর পূর্বে অথবা পরে শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে/বাহিরে কোন স্থানে পাঠদান করাকে কোচিং বোঝাবে।
১/ছ. কোচিং বাণিজ্য: উপানুচ্ছেদ চ অনুযায়ী বিভিন্ন জাতীয়/ দৈনিক/ স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি, পোস্টার, ফেস্টুন, লিফলেট, ব্যানার, দেয়াল লিখন অথবা অন্যকোন প্রচারমাধ্যমে মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে শিক্ষার্থী ভর্তির মাধ্যমে কোচিং কার্যক্রম পরিচালনা করাকে বুঝাবে।
১/জ. প্রাইভেট টিউশনি: প্রাইভেট টিউশনি বলতে শিক্ষকের নিজগৃহে কিংবা শিক্ষার্থীর গৃহে পাঠদানকে বুঝাবে।
২. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান কার্যক্রম চলাকালীন শ্রেণি সময়ের মধ্যে কোন শিক্ষক কোচিং করতে পারবেন না।
২/ক. আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সময়ের পূর্বে বা পরে শুধুমাত্র অভিভাবকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠান প্রধান অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন।
২/খ. এক্ষেত্রে প্রতি বিষয়ে মেট্রোপলিটন শহরে মাসিক সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা, জেলা শহরে ২০০ টাকা এবং উপজেলা বা স্থানীয় পর্যায়ে ১৫০ টাকা রশিদ এর মাধ্যমে অতিরিক্ত সময় ক্লাস পরিচালনার জন্য আগ্রহী শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে গ্রহণ করা যাবে; যা সর্বোচ্চ ১,২০০ টাকার অধিক হবে না। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান প্রধান স্ববিবেচনায় এই হার কমাতে/মওকুফ করতে পারবেন। একটি বিষয়ে মাসে সর্বনিম্ন বারোটি ক্লাস অনুষ্ঠিত হতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে প্রতি ক্লাসে সর্বোচ্চ ৪০ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করতে পারবে।
২/গ. এই নীতিমালার আওতায় সংগৃহীত ফি প্রতিষ্ঠান প্রধানের নিয়ন্ত্রণে একটি আলাদা তহবিলে জমা থাকবে। প্রতিষ্ঠানের পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং সহায়ক কর্মচারীদের ব্যয় বাবদ ১০% অর্থ রেখে অবশিষ্ট অর্থ অতিরিক্ত ক্লাসের কাজে নিয়োজিত শিক্ষকদের মধ্যে বন্টন করা হবে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, অতিরিক্ত সময় ক্লাস পরিচালনার অন্যান্য খরচ উল্লিখিত অর্থের বাইরে ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট থেকে আদায় করা যাবে না। এছাড়া কোনক্রমেই উক্ত খাতের অর্থ অন্য কোন খাতে ব্যয় করা যাবে না।
৩. কোন শিক্ষক তার নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে পারবেন না। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানের পূর্ব অনুমতি সাপেক্ষে দৈনিক বা প্রতিদিন অন্য যে কোন প্রতিষ্ঠানের সীমিত সংখ্যক (১০ জনের বেশি নয়) শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানকে লিখিতভাবে ছাত্র-ছাত্রীর তালিকা (রোল, শ্রেণি উল্লেখসহ) জানাতে হবে।
৪. কোন শিক্ষক বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গড়ে ওঠা কোন কোচিং সেন্টারে নিজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত হতে পারবেন না বা নিজে কোন কোচিং সেন্টারের মালিক হতে পারবেন না বা কোচিং সেন্টার গড়ে তুলতে পারবেন না।
৫. কোন শিক্ষক কোন শিক্ষার্থীকে কোচিংয়ে উৎসাহিত বা উদ্বুদ্ধ বা বাধ্য করতে পারবেন না। এমনকি কোন শিক্ষক/শিক্ষার্থীর নাম ব্যবহার করে বিজ্ঞাপন/প্রচারণা চালাতে পারবেন না।
৬. কোন শিক্ষক কোন শিক্ষার্থীকে কোচিংয়ে আসার জন্য তার নিজ নামে বা কোচিং সেন্টারের নামে কোনরকম প্রচারণা চালাতে পারবেন না।
৭. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি কোচিং বাণিজ্য রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
৮. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে কোচিং বাণিজ্য বন্ধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান প্রয়োজনীয় প্রচারণা ও অভিভাবকদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন।
৯. কোচিং সেন্টারের নামে বাসা ভাড়া নিয়ে কোচিং বাণিজ্য পরিচালনা করা যাবে না।
১০. কোচিং বাণিজ্য বন্ধে প্রণীত নীতিমালায় বর্ণিত পদক্ষেপ কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় অর্থ সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বহন করবে।
১১. কোচিং বাণিজ্য বন্ধে প্রণীত এই নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য ৮/৯ সদস্যের একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করা হবে। যার প্রধান থাকবেন ক্ষেত্রমতে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার বা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বা উপজেলা নির্বাহি অফিসার।
১২. কোচিং বাণিজ্য বন্ধে প্রণীত নীতিমালার প্রয়োগ এবং এ ধরনের কাজকে নিরুৎসাহিত করার জন্য সরকার সচেতনতা বৃদ্ধি সহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
১৩/ক. এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত কোন শিক্ষক কোচিং বাণিজ্যে জড়িত থাকলে তার এমপিও স্থগিত, বাতিল, বেতন-ভাতাদি স্থগিত, বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি স্থগিত, এক ধাপ অবনমিতকরণ, সাময়িক বরখাস্ত, চূড়ান্ত বরখাস্ত ইত্যাদি শাস্তিমুলক ব্যবস্থা কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করবেন।
১৩/খ. এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিও বিহীন কোন শিক্ষক কোচিং বাণিজ্যে জড়িত থাকলে তার প্রতিষ্ঠান প্রদত্ত বেতন-ভাতাদি স্থগিত, বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি স্থগিত, বেতন এক ধাপ অবনমিতকরণ, সাময়িক বরখাস্ত, চূড়ান্ত বরখাস্ত ইত্যাদি শাস্তি মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
১৩/গ. এমপিও বিহীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোন শিক্ষক কোচিং বাণিজ্যে জড়িত থাকলে তার প্রতিষ্ঠান প্রদত্ত বেতন-ভাতাদি স্থগিত, বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি স্থগিত, বেতন একধাপ অবনমিত করণ, সাময়িক বরখাস্ত, চূড়ান্ত বরখাস্ত ইত্যাদি শাস্তি মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
১৩/ঘ. কোচিং বাণিজ্যের সাথে জড়িত শিক্ষক এর বিরুদ্ধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে সরকার পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়াসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান পাঠদানের অনুমতি, স্বীকৃতি অধিভুক্তি বাতিল করতে পারবে।
১৩/ঙ. সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোন শিক্ষক কোচিং বাণিজ্যে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ১৯৮৫ এর অধীনে অসদাচরণ হিসেবে গণ্য করে শাস্তি মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ইত্যাদি…।
এখনো বলবত আছে সেই নীতিমালা। কিন্তু তা কখনোই কার্যকর হয়নি শতভাগ। অধিকাংশ অভিভাবক মনে করেন এই নীতিমালার মাধ্যমে প্রকারান্তরে কোচিং বাণিজ্যকেই বৈধতা দেওয়া হয়েছে।
উল্লিখিত নীতিমালার ব্যাপক প্রতিফলন পুনরায় লক্ষ্য করা যাচ্ছে প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন ২০২০ এ। এতে বলা হয়েছে, "কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট-টিউশনের মাধ্যমে পাঠদান করতে পারবেন না। কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে অর্থের বিনিময়ে ইলেকট্রনিক বা অনলাইন পদ্ধতিতেও প্রাইভেট টিউশন বা কোচিংয়ের মাধ্যমে পাঠদান করতে পারবেন না। করলে তা অসদাচরণ বলে গণ্য ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে। তবে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের শনাক্ত করে সংশ্লিষ্ট অভিভাবকদের লিখিত সম্মতি সাপেক্ষে স্কুল সময়ের পরে বা আগে সরকার কর্তৃক প্রণীত বিধি বা নীতিমালা অথবা জারিকৃত পরিপত্র বা নির্বাহী আদেশ অনুসরণপূর্বক অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করতে পারবেন। তাছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট টিউশনের মাধ্যমে পাঠদানের উদ্দেশ্যে কোচিং সেন্টার পরিচালনা করা বা কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করা এ আইনের অধীন নিষিদ্ধ হইবে না। এক্ষেত্রে দুটি শর্ত আরোপ করা হয়েছে। এক. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলাকালীন সময় সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত কোচিং সেন্টার পরিচালনা করা যাইবে না। করা হলে উক্ত কোচিং সেন্টারের ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করা যাবে। দুই. কোচিং সেন্টারে কোনো শিক্ষক তার নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থীকে পাঠদান করতে পারবেন না। করলে তা অসদাচরণ হিসেবে শাস্তিযোগ্য হবে। ইত্যাদি..."
এসব নীতিমালা ও আইনের ফলে যে অবস্থা তৈরি হতে পারে তা হচ্ছে, অতীতে কেবল কঠিন বিষয়ে কোচিং হতো ভবিষ্যতে হবে সব বিষয়ে। অতীতে কেবল পরীক্ষার্থীদের কোচিং হতো ভবিষ্যতে হবে সকল শ্রেণির কোচিং। কারণ বিশেষ কিছু শ্রেণির ও বিষয়ের শিক্ষক কোচিং ফি পাবেন আর অন্যরা পাবেন না তা তো হবে না! তাই ক্লাসের না পড়িয়ে বা কম পড়িয়ে এবং পরীক্ষায় ফেল করিয়ে বা কম নম্বর দিয়ে শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ে সম্মতি দিতে বাধ্য করতে পারেন অতি সহজ বিষয়ের জটিল স্যারেরাও। ভবিষ্যতে হয়ত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনায় কোচিং করতে বাধ্য হবে সকল শ্রেণির সকল বিষয়ের শিক্ষার্থীরা! মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী তো বলেই দিয়েছেন, 'কোচিংয়ের পুরোটাই তো খারাপ নয়, কোচিংয়ের দরকার নেই তাও নয়, কোচিংয়ের দরকার হতে পারে।' সুতরাং যা করলে শিক্ষার্থীদের নির্ধারিত ক্লাসের বাইরে বা এর পূর্বে অথবা পরে অতিরিক্ত ক্লাস তথা কোচিং দরকার হয় শিক্ষকগণ তাই করতে পারেন। কেননা, প্রাপ্ত বেতন-ভাতায় শিক্ষকগণের ন্যূনতম জীবনধারণ কোনভাবেই সম্ভব নয় বিধায় বাড়তি টাকার প্রয়োজন সকল শ্রেণির সকল বিষয়ের শিক্ষকেরই। ক্ষুধার জ্বালায় মানুষ ভুলে যায় আইনের ভয়ে! এক্ষেত্রে পূর্ণ জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা খুবই কঠিন। কেননা, শিক্ষকের কাজ ইট ভাঙার কাজের মতো গুনে দেখা সম্ভব নয় যে, তিনি কতটা করেছেন, আর কতটা করেননি। শিক্ষক যদি প্রস্তুতি নিয়ে শ্রেণিকক্ষে যেয়ে সন্তুষ্টচিত্তে বিবেকের তাড়নায় স্বপ্রণোদিত হয়ে স্বেচ্ছায় নিজেকে উজাড় করে না দেন তো শিক্ষার্থীরা সঠিক শিক্ষা নিতে পারে না, পারবে না এটাই বাস্তবতা।
অপরদিকে নিজের বাসায় বসে বা শিক্ষার্থীর বাসায় গিয়ে কোন শিক্ষক কখন কতজন কোন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াচ্ছেন তা মনিটর করা আমাদের জন্য দুরূহ কাজ। আমরা তো এখনও আমাদের নিত্যদিনের ওপেন ও প্যাকেট খাবারগুলোই ভেজাল এবং ফরমালিনমুক্ত করতে পারছি না। প্রকাশ্যে সদর রাস্তায় চলা মিটারবিহীন অটোরিকশা ও ট্যাক্সিক্যাব বন্ধ করতে পারছি না। সরকারি ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ করতে চেষ্টাও করছি না। অথচ কোথায় কোন গ্রামেগঞ্জে, শহরে কোন ঘরে বসে বা অন্যের ঘরে গিয়ে কবে কখন সকাল-বিকেল রাতে কোন প্রতিষ্ঠানের কতজন শিক্ষার্থীকে কোন প্রতিষ্ঠানের কোন শিক্ষক প্রাইভেট-কোচিং দিচ্ছেন বা দিবেন তা খুঁজে বের করে শাস্তি দেবেন আর প্রাইভেট-কোচিং বন্ধ হবে এমনটি অবাস্তব নয় কি?
যদি কোচিং ভালো হয়, বাণিজ্য ভালো হয়, তো ক্লাসরুমের পড়া আর কতটুকু ভালো থাকে? শিক্ষকগণ যদি নীতিমালা বা আইন মেনেই ক্লাসরুটিনের আগে ও পরে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনায় অতিরিক্ত টাকার বিনিময়ে কোচিং করাতে পারেন এবং আরও অতিরিক্ত টাকার বিনিময়ে কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিতে পারেন বা বাসায় প্রাইভেট পড়াতে পারেন তো এসব করে অর্থ উপার্জন করবেন না কেন? সমাজের আর সকলের মত শিক্ষকদেরও তো অর্থের প্রয়োজন আছে। সুতরাং ভোরে বাসায় প্রাইভেট পড়াবেন। সকালে প্রতিষ্ঠানে এসে প্রথমে কোচিং করাবেন। পরে ক্লান্ত হয়ে মাথা গরম করে দু'একটি দায়সারা রুটিনক্লাস করাবেন। দুপুরে বাসায় যেয়ে খেয়েদেয়ে রেস্ট নিয়ে ফ্রেশ হয়ে বিকালে আবার কোচিং সেন্টারে বা বাসায় পড়াবেন। হয়তো ক্লাসে এমন ভাবে পড়াবেন যেন শিক্ষার্থীরা প্রাতিষ্ঠানিক কোচিংয়ে আসতে বাধ্য হয়! আবার প্রাতিষ্ঠানিক কোচিংয়েও হয়তো এমন ভাবেই পড়াবেন যেন শিক্ষার্থীরা কোচিং সেন্টারে বা বাসায় যেতে বাধ্য হয়! শুধু স্কুল-কলেজেই নয়; এই অবস্থা চলতে পারে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, মাদ্রাসাতে এবং কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও। সেক্ষেত্রে প্রায় সকল অভিভাবককেই গুনতে হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত ভর্তি ও বেতন-ফিস, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনায় আয়োজিত কোচিং ফিস এবং কোচিং সেন্টারে বা বাসায় প্রাইভেট পড়ার ফিস! তদুপরি পরিশোধ করতে হবে শিক্ষা সামগ্রীর বিস্তর ব্যয়। ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করবে শিক্ষা বাণিজ্য! ধোপা বাড়ির কাপড়ে পরিণত হবে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের জীবন!
আসলে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা সঠিকভাবে পড়াচ্ছেন কি না, তদারকি করা প্রয়োজন সেটি। তা না করে শিক্ষকরা সরকারি নিয়ম মেনে প্রাইভেট-কোচিং দিচ্ছেন কি না। এ যেন ‘চোখের অপারেশন পায়ে’। একটু গভীরভাবে তাকালে দেখা যাবে অনেক মন্ত্রী, এমপি, আমলা, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতির ছেলেমেয়ে বা নাতি-নাতনিকে প্রাইভেট পড়ানোর জন্য হয়তো বাসায়ই নিয়োগ দেওয়া আছে একাধিক টিচার। বিশেষ করে নামকরা টিচারের বাসা ও কোচিং-সেন্টারের আশেপাশের রাস্তায় যেসব দামি দামি গাড়ির ভিড় লেগে থাকে সেগুলোর অধিকাংশই সমাজ ও রাষ্ট্রের বিশেষ ব্যক্তিদের ছেলেমেয়ে বা নাতি-নাতনিদের। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, যাদের দিয়ে এই প্রাইভেট-কোচিং বাণিজ্য বন্ধের তদারকি করানো হবে তাদের কারও সন্তানই যে প্রাইভেট পড়েনি, পড়ছে না এবং পড়বে না, তা নিশ্চিত করবে কে?
বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষকরা প্রাইভেট-কোচিং করানো বন্ধ করতে বাধ্য হলেও শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট-কোচিং না করে পারবে না। কারণ শ্রেণিকক্ষে পর্যাপ্ত শিক্ষা থেকে তারা বঞ্চিত। আর এ বিষয়টি যেন আমরা অনেকটা মেনেই নিয়েছি যে, ক্লাসরুমে পড়া হয় না, হবে না! এমন ব্যর্থ ভাবনাই আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ধ্বংসের অন্যতম কারণ। ফলে অশিক্ষকের কাছ থেকে প্রাইভেট-কোচিং নিতে বাধ্য হবে শিক্ষার্থীরা। অশিক্ষকদের তো আর শাস্তি নেই। সে হবে আরও বেশি ক্ষতির কারণ। কিন্তু এভাবে তো আর চলতে পারে না। শিক্ষার্থীরা নিজের প্রতিষ্ঠানে মোটা অঙ্কের টাকায় ভর্তি হবে, বেতন-ফি পরিশোধ করবে, আবার নিজের প্রতিষ্ঠানেই অতিরিক্ত টাকা দিয়ে কোচিং ক্লাস করে রিকভার করতে বাধ্য হবে নির্ধারিত ক্লাসের ঘাটতি পড়া! তদুপরি ক্লাসের বাইরে গিয়েও পড়তে হবে প্রাইভেট, করতে হবে কোচিং! অথচ সব শিক্ষার্থীকে সব বিষয়ে পরিপূর্ণ পাঠদান করাই তো শিক্ষকদের চাকরি। কিন্তু শিক্ষকরা এ কাজ সঠিকভাবে সম্পাদন করছেন কি না তা তদারক করা জরুরি। একজন শিক্ষক দৈনিক কত ঘণ্টা প্রতিষ্ঠানে থাকবেন, কত ঘণ্টা থাকছেন তার কি কোনো হিসাব নেওয়া হয়?
আমি জানি, আমার এ কথাগুলো পছন্দ হবে না অনেকেরই। এমনও অনেক শিক্ষক আছেন যারা এক শহরে/গ্রামে বসবাস করে বা অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত থেকে চাকরি করছেন গিয়ে অনেক দূরের অন্য শহরের/গ্রামের সরকারি/বেসরকারি স্কুল/কলেজে/মাদ্রাসায়। সিনিয়র হলে সপ্তাহে যাচ্ছেন ৩-৪ দিন। চল্লিশ মিনিটের ক্লাস নিচ্ছেন দিনে দু'য়েকটি মাত্র। বাস্তবে ক্লাসে/ প্রতিষ্ঠানের ক্লাসে তাদের মাসিক কর্মঘণ্টা ৩২-৪০ ঘণ্টার বেশি নয়। শুধু উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণি আছে এমন কলেজের একজন শিক্ষক যদি প্রতিদিন চল্লিশ মিনিটের দুটি করে ক্লাস সপ্তাহে ছয় দিনই নেন তবুও তার প্রতিষ্ঠানের ক্লাসে মাসিক কর্মঘণ্টা হবে সর্বোচ্চ ৪৮ ঘণ্টা। এর বাইরে হয়তো কিছু প্রস্তুতি নেওয়া, পরীক্ষা নেওয়া আর খাতা দেখা। দৌড়ে এসে ক্লাস আবার ক্লাস শেষ হলেই দৌড়। এক কাজ থেকে এসে আবার ছুটছেন বা ছুটতে বাধ্য হচ্ছেন অন্য কাজে। এই লেখা বা পত্রপত্রিকা পড়ার সময় এবং ধৈর্যও নেই অনেকেরই। গবেষণা তো অনেক দূরের কথা। শিক্ষকগণ এমন সার্ভিস দিলে শিক্ষার্থীরা যাবে কোথায়? কমবেশি একাদশ শ্রেণির ১২০ এবং দ্বাদশ শ্রেণির ১২০ জনসহ মোট ২৪০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজনমাত্র ইংরেজি শিক্ষক যথেষ্ট কি না তা-ও ভেবে দেখা প্রয়োজন। দীর্ঘদিনের এই দুরবস্থা থেকে শিক্ষার উত্তরণ ঘটাতে চাইলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদেরও বাড়াতে হবে শিক্ষকদের প্রকৃত আর্থিক সুবিধা এবং সেই সঙ্গে বাড়াতে হবে তাদের বাস্তবিক কর্মঘণ্টা। আর সেটি আন্তরিক ভাবে মেনে নিতে হবে শিক্ষকদের। উন্নত বিশ্বের শিক্ষকগণ তাদের শিক্ষার্থীদের নির্ধারিত ক্লাসেই দিয়ে থাকেন পরিপূর্ণ শিক্ষা। স্কুলের বাইরে গিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়তে হয় না ক্লাসের পড়া।
আমাদের মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে প্রথমত নিশ্চিত করতে হবে মানসম্মত শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দ্বিতীয়ত শিক্ষকদের পর্যাপ্ত বেতন-ভাতা প্রদানের মাধ্যমে আরো বেশি সময় প্রতিষ্ঠানে অবস্থান নিশ্চিত করে শিক্ষার্থীদের জন্য নিশ্চিত করতে হবে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা। যেন শিক্ষকদের না থাকে বেতন-ভাতার অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের ধান্দা এবং শিক্ষার্থীদের না থাকে ক্লাসরুমের বাইরে ক্লাসের বিষয় পড়ার কোনো প্রয়োজনীয়তা। তদুপরি কোচিং/ কোচিং বাণিজ্য/ প্রাইভেট টিউশনি বন্ধে নমনীয় সিদ্ধান্ত নিতে না হয় শিক্ষা প্রশাসনের। তা না হলে বন্ধ করা সম্ভব হবে না প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ধ্বংসকারী এই কোচিং/ কোচিং বাণিজ্য/ প্রাইভেট টিউশনি, নিশ্চিত করা যাবে না মানসম্মত শিক্ষা, উৎপাদন করা যাবে না বিশ্বমানের যোগ্য নাগরিক-কর্মী।
মো. রহমত উল্লাহ্: শিক্ষক, সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক।
[অধ্যক্ষ -কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা। ১৭ জুন ২০২১]
http://www.kholakagojbd.com/public-opinion/
79659