প্রবন্ধ- 'কান ধরে উঠ-বস ও পরিচালনা কমিটির রাহু' -ভোরের কাগজ- ২১ মে ২০১৬

প্রবন্ধ- 'কান ধরে উঠ-বস ও পরিচালনা কমিটির রাহু' -ভোরের কাগজ- ২১ মে ২০১৬
IMG_20180425_152628_1ভোরের কাগজ, ২১ মে ২০১৬, শনিবার » মুক্তচিন্তা  পত্রিকার লিংক
কান ধরে উঠ-বস ও পরিচালনা কমিটির রাহু
মো. রহমত উল্লাহ্‌
আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন কোনো অপরাধ করলে কোনো কোনো শিক্ষক আমাদের কান ধরে উঠবস করাতেন। এখন আর সেই দিন নেই। এখন শিক্ষার্থীকে কোনোরূপ শারীরিক ও মানসিক শাস্তি প্রদান আইনত দণ্ডনীয়। তাই নারায়ণগঞ্জের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত যদি কোনো শিক্ষার্থীকে শাস্তি দিয়ে থাকেন তো বিদ্যমান আইনানুযায়ী তার বিচার হবে। তিনি যদি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে কিছু বলে থাকেন তো সেটিরও বিচার হবে আইনানুযায়ী। কিন্তু এসব অভিযোগ তুলে তাকে যা করা হলো তা মেনে নেয়া যায় না কোনোভাবেই।
এ বিষয়ে দৈনিক শিক্ষা ডট কম পত্রিকায় ১৯ মে ২০১৬ তারিখে প্রকাশিত সংবাদটির আংশিক ছিল এমন। [নারায়ণগঞ্জের শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত বলেন : সেদিন সেলিম ওসমান তার দুই গালে দুটি করে চারটি চড় মারেন। এরপর বলেন, ‘শালা কান ধর’। … শিক্ষক বলেন, পুরো ব্যাপারটিই ছিল সাজানো। মসজিদের মাইকে উত্তেজনা ছড়ানো হচ্ছিল। সভার কথা শুনে তিনি স্কুলে যান। কিন্তু গিয়ে দেখেন পরিস্থিতি ভিন্ন। তিনি বলেন, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে স্থানীয় কয়েকজন আমাকে পেটায়। বিকেলে সেলিম ওসমান ঘটনাস্থলে আসেন। আমার শরীর তখন একেবারেই দুর্বল। যে ঘরে আমাকে আটকে রাখা হয়েছিল, সংসদ সদস্য সেখানে ঢুকে কোনো কথা না বলে দুটি করে চারটি চড় মারেন। লজ্জায় তখন আমার মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছিল। এরপর আমাকে ঘর থেকে বের করে লোকজনের সামনে এনে সংসদ সদস্য বলেন, ‘শালা কান ধর। ১০ বার উঠ-বস কর।’ জীবন বাঁচাতে তা করতে বাধ্য হই। কেন এ রকম ঘটনা ঘটল, জানতে চাইলে শিক্ষক বলেন, আমি স্কুলটি দাঁড় করিয়েছি। কিছু লোকজন চাচ্ছিলেন আমি যেন স্কুলে না থাকতে পারি। তারাই ষড়যন্ত্র করেন। ইসলাম ধর্ম নিয়ে কোনো কট‚ক্তি করেছিলেন কি না, জানতে চাইলে শিক্ষক বলেন, আমি কোনো কট‚ক্তি করিনি। পুরোটাই সাজানো। স্কুল থেকে বের করতেই এসব ষড়যন্ত্র হয়েছে। শিক্ষককে সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান ‘তার ছেঁড়া’ বলেছেন।]
গত কদিন সবাই জানতাম, কেবল কান ধরে উঠবস করানো হয়েছে। এই সংবাদ থেকে জানা গেল শিক্ষককে চারটি চড় মারা হয়েছে। এর পরে হয়তো আরো কিছু জানা যাবে। তা সে মানা যাক বা না যাক। বারবার বলা হচ্ছে, শিক্ষক ইসলাম ধর্ম নিয়ে কট‚ক্তি করেছেন। তাই তাকে শায়েস্তা করার জন্য মাইকিং করে লোক জড় করা হয়েছে, সকালে একবার মারধর করা হয়েছে, সারাদিন আটক রাখা হয়েছে, বিকালে একহালি চড় মারা হয়েছে, জনতার সামনে কান ধরে উঠবস করানো হয়েছে, পুলিশে দেয়া হয়েছে এবং পরে বহিষ্কারও করা হয়েছে। যে অপরাধের কথা বলে একজন শিক্ষককে এত শাস্তি দেয়া হলো সেই অপরাধের বিস্তারিত কিন্তু জানা যায়নি এখনো। অর্থাৎ একজন হিন্দুলোক মুসলমানদের ধর্ম নিয়ে কী কী কটু কথা বলেছেন, তা আর কেউ বলছেন না একবাও। এমনকি সংসদ সদস্য নিজেও আর উচ্চারণ করেননি সেই মারাত্মক কটু কথাটি! কেবল বলাবলি হচ্ছে তিনি কটু কথা বলেছেন। প্রতিটি হিন্দু ও মুসলমানেরই জানার অধিকার আছে, কী কথা বলেছিলেন তিনি। কী কথা বললে এমন পরিণতি পোহাতে হয়, তা জানা থাকলে হয়তো আর কেউ এ কথা বলবেন না। যেই কটু বাক্যের কারণে সারা দেশ আজ উত্তাল, সে বাক্যটি সত্য হলে এখনো অপ্রকাশিত থাকার কথা নয়। সত্য গোপন থাকে না। এতেই প্রতীয়মান হয় না যে, শ্যামল কান্তি ভক্তের কথাই সঠিক। তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। তাকে প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে সরিয়ে কমিটির অধিক পছন্দের, অধিক লাভজনক, অধিক আজ্ঞাবহ অন্য কাউকে বসানোর জন্য এসব করা হয়েছে। এক সময় তার এই স্কুলটি ছোট ছিল, বেড়ার ঘর ছিল, ডুবা জায়গা ছিল। তখন তিনি খাটতেন খেয়ে না খেয়ে, তখন তিনি ভালো ছিলেন। এখন স্কুলটি বড় হয়েছে, স্কুলের অবস্থা ভালো হয়েছে। তাই বড়দের চোখ পড়েছে এটির ওপর। এখন সেই প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত মন্দ হয়েছেন, তার ছেঁড়া হয়েছেন, ইসলামবিরোধী হয়েছেন। মার খেয়েছেন, কান ধরে উঠবস করেছেন, বরখাস্ত হয়েছেন। আন্দোলনের মুখে আবার পুনর্বহাল হয়েছেন। সব চেয়ে বড় ব্যাপার হলো, হিন্দু শিক্ষক মুসলমান সংসদ সদস্যের শালা হয়েছেন। আজকের এই আন্দোলন থেমে গেলে, এই শালার খবর নিতে হয়তো আর যাবেন না কেউ। তখন থাকবেন কেবল এই সংসদ সদস্য ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। আবার নতুন কমিটি হবে। সরকারের আজগবি বিধান অনুসারে এই সংসদ সদস্যের বাছাই করা লোকই হবেন সেই কমিটির সভাপতি এবং সদস্যরা। তখন তারা আবার সুদে আসলে আদায় করবেন আজকের এই লোকসান। হয়তো চাকরি হারাবেন, বাড়ি ছাড়া হবেন বা এলাকা ছাড়া হবেন অথবা দেশ ছাড়া হবেন এই শ্যামল কান্তি ভক্ত ও তার পরিবার-পরিজন।
কমিটি নামক এই রাহুর কবলে আজ কেবল শ্যামল কান্তি ভক্তই নন; অধিকাংশ বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার প্রধান এবং শিক্ষকরা। তিনি হচ্ছেন এখনকার সময়ের একটি আলোচিত উদাহরণ মাত্র। এমন হাজারো অঘটন ঘটে নিত্যদিন, যা প্রকাশ করার সাহস ও সুযোগ থাকে না শিক্ষকদের। কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত কমিটির অশিক্ষিত, কুশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত লোকদের মন মতো কাজকর্ম না করলে, প্রতিদিনই প্রতিষ্ঠান প্রধান ও শিক্ষকদের চাকরি খান দুই তিন বেলা। তবে আমাদের প্রতিষ্ঠানের কমিটি তেমন নয়। তাই আমি আবারো বলছি, সব কমিটির সব লোকই যে মন্দ তা নয়। তবে ভালোর সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য।
এমন একসময় ছিল, যখন কমিটির লোকজন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করত, নিজেরা জমি দিত, টাকা দিত, শিক্ষকদের বেতন দিত, ঘর তৈরি করে দিত, শিক্ষাসামগ্রী দিত, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সহায়তা দিত। তারপর এমন একসময় গেছে, যখন কমিটির লোকেরা নিজেদের অযোগ্য সন্তানদের বা টাকা খেয়ে অন্যের অযোগ্য সন্তানদের অথবা দলীয় ক্যাডারদের শিক্ষক বানাতো। সেই অযোগ্যদের কারণেই আজ যোগ্য শিক্ষকের বড় অভাব এই দেশে। যা খোদ শিক্ষামন্ত্রীও স্বীকার করেছেন কিছুদিন আগে। কমিটির নিকট থেকে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা অতিসম্প্রতি কেড়ে নিয়ে রাষ্ট্রই স্বীকার করে নিয়েছে যে, কমিটি শিক্ষক নিয়োগে চরম অনিয়ম করত। আর এখন কমিটি অলিখিত অঘোষিতভাবে শুরু করেছে প্রতিষ্ঠান প্রধান নিয়োগের বা বদলের অনিয়ম। শ্যামল কান্তি ভক্ত সেই মিশনেরই শিকার হয়েছেন হয়তো। কমিটির লোকদের এখন আর কাজ কী?
বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের সরকার শতভাগ বেতন দেয়। সাধ্যমতো ভাতা দেয়। প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো তৈরি করে দেয়। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়। বিনামূল্যে বই দেয়। শিক্ষাসামগ্রী দেয়। আর শিক্ষার মান যাচাই করার জন্য, শিক্ষকদের কাজ তদারক করার জন্য প্রতি থানায়/উপজেলায় রয়েছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার, সহকারী অফিসার ও পরিদর্শক। এ ছাড়াও প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কার্যবিবরণী অনলাইনের মাধ্যমে জমা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে। ডায়নামিক ওয়েব এপ্লিকেশনের মাধ্যমে নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ও একাডেমিক কাজের সচ্ছতা। ভর্তি হচ্ছে অনলাইনে, ভর্তি ফি নির্ধারণ করছে সরকার, টিউশন ফি নির্ধারণ করছে সরকার। শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছে সরকার। তাহলে এখন আর কেন প্রয়োজন পরিচালনা কমিটি নামক এই রাহু? কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত নিজেদের মালিক আর শিক্ষকদের তাদের কেনা গোলাম ভেবে অহেতুক দাবড়ানো ছাড়া তাদের আর ভালো কাজ কী এখন? তারা অনেকেই মনে করেন প্রতিষ্ঠানের টাকা মানেই তাদের টাকা। তারা প্রতিষ্ঠানের পুকুরের মাছ নেয়, খামারের ফসল নেয়, গাছের ফল নেয়, দোকানের ভাড়া নেয়, জমির দখল নেয়, গাছপালা নেয়, ফ্যান-লাইট নেয়, ইটা-বালি-সিমেন্ট নেয়, ঠিকাদারি নেয়, সাপ্লাই কাজ নেয়, শিক্ষকদের ডিউটির টাকার ভাগ নেয়, টিএ-ডিএ নেয়, মিটিং করার দিন সম্মানীর নামে টাকা নেয়, নিজেদের কাজে প্রতিষ্ঠানের গাড়ি নেয়, প্রতিষ্ঠানে আয়া-পিয়ন বাসায় নেয়, ফেল/বখাটে শিক্ষার্থীর পক্ষ নেয়, নিজের পছন্দের শিক্ষকদের ইংরেজি/অঙ্ক ক্লাস দেয়, ক্লাসে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সামনেই শিক্ষকের ভুল ধরার নামে বকাবকি করে, নিজেদের সন্তানদের বিনা টাকায় প্রতিষ্ঠানে এমনকি প্রাইভেটেও পড়াতে বাধ্য করে। আরো কত কী যে করে তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি/সদস্য হওয়া এখন আর সেবামূলক কাজ নয়; বিভিন্নমুখী লাভজক কাজ। তাই তা হওয়ার জন্য সবাই মরিয়া। এমপিরা-মন্ত্রীরা এই পদ/পদের ক্ষমতা ছাড়তে চান না। তারা নিজেরা বা তাদের কর্মী-সমর্থকদের দখলে রাখতে চান কমিটির সব পদ। আবার ডিসি-ইউএনওরাও হতে চান সকল প্রতিষ্ঠানের সভাপতি। শিক্ষকরা প্রতিষ্ঠান থেকে যে সামান্য ভাতাদি পান তা যেন কমিটির লোকদের দয়ার দান। শিক্ষামন্ত্রী নিজে শিক্ষকদের স্যার বলেন কিন্তু কমিটির লোকেরা শিক্ষকদের স্যার বলতে চান না; বরং তারা চান যে শিক্ষকরা ও প্রধানরা জনসম্মুখে তাদের স্যার স্যার করুক। হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকুক। তাদের কথায় কান ধরে উঠবস করুক এবং তাই হয় অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে। তারা ভুলে থাকেন যে শিক্ষকরা তাদের চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষিত। এমনকি যে শিক্ষার্থীর বাবা-মা কমিটির সদস্য হন সেই শিক্ষার্থীও খবরদারি করেন শিক্ষকগণের ওপর। শুধু তাই নয়, কমিটির সভাপতি/সদস্যের দলের, বয়সের, বাড়িঘরের সবাই খবরদারি করেন শিক্ষকদের ওপর এবং তা মানতে বাধ্যও হন শিক্ষকরা। না হলে চোখ মুখ বন্ধ করে মেনে নিতে হয় এই শ্যামল কান্তির মতো পরিণতি। আমি আবারো বলছি, সব কমিটির সব লোকই যে মন্দ তা নয়। তবে ভালোর সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য।
এহেন পরিস্থিতিতে প্রচলিত কমিটির মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার বিধান বাতিল করে শিক্ষক ও প্রধানদের নির্বিঘ্নে শিক্ষকতা করার ও প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করার পরিবেশ নিশ্চিত করা এখন সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। তা না হলে এদেশের শিক্ষকদের প্রতিনিয়তই শুনতে হবে- ‘শালা কান ধর। ১০ বার উঠ-বস কর।’
মো. রহমতউল্লাহ্ : লেখক ও শিক্ষক।

http://www.bhorerkagoj.net/print-edition/2016/05/21/89518.php

জন্মনিবন্ধন সনদ, শিক্ষাসনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্রে নামের ভুল প্রসঙ্গ

জন্মনিবন্ধন সনদ, শিক্ষাসনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্রে নামের ভুল প্রসঙ্গ
ভোরের কাগজ > ১৫ মে ২০১৬, রবিবার
আজকের পত্রিকা » মুক্তচিন্তা
জন্মনিবন্ধন সনদ, শিক্ষা সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্রে নামের ভুল প্রসঙ্গ
cropped-DSC00115-1.jpg
মো. রহমত উল্লাহ্‌
জন্মনিবন্ধনের সময় শিশুর নিজের নাম, পিতার নাম ও মাতার নাম লিখতে হয়। নিবন্ধন সনদে লিখিত এই তিনটি নামই শিশুর পারিবারিক পরিচিতির বাহন। পরবর্তীতে এই নামেই তৈরি হয় তার জীবনের সব সনদ। তাই এই তিনটি নাম ও নামের বানান সঠিক হওয়া অত্যন্ত জরুরি। কেননা এই নিবন্ধন সনদ অনুসারেই শিশুদের নিজের নাম, পিতার নাম ও মাতার নাম লেখা হয় তার স্কুলের খাতায়। এই নামেই তৈরি হয় তার পিইসি পরীক্ষা পাসের সনদসহ জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি, স্নাতক, স্নাতকোত্তর এমনকি ডক্টরেট ডিগ্রির সনদ। জন্মনিবন্ধন সনদে কারো নামে কোনো রকম ভুল থাকলে সে ভুল থেকে যেতে পারে তার সব সনদে।
আমাদের দেশে বর্তমানে জন্মনিবন্ধন সনদে যে ধরনের ভুল বেশি পরিলক্ষিত হয়ে থাকে তা হচ্ছে প্রচলিত ভুল। যেমন- প্রায় সব শিশুর, শিশুর পিতার ও মাতার নামের আগেই ‘মোহাম্মদ’কে ‘মোঃ/মো:’ বা ‘মোহাঃ/মো:’, ‘মুহাম্মদ’কে ‘মুঃ’ বা ‘মুহাঃ’, ‘মোসাম্মৎ’কে ‘মোসাঃ’ ইত্যাদি লেখা হয়। এভাবে বিসর্গ (ঃ)/ কোলন (:) দিয়ে শব্দ সংক্ষেপ সঠিক নয়। বিসর্গ যতিচিহ্ন নয়, বর্ণ। বিসর্গের (ঃ) আছে উচ্চারণ ধ্বনি। আছে সঠিক ব্যবহারের নিয়মকানুন। অথচ আমরা অনেকেই না জেনে, না বুঝে এই বিসর্গ (ঃ) ধ্বনিকে ব্যবহার করছি যতিচিহ্ন হিসেবে। শব্দ সংক্ষেপ করার জন্য ব্যবহার করতে হবে যতিচিহ্ন। কোলন (:) যতিচিহ্ন। তবে এটি সংক্ষিপ্তকরণ চিহ্ন নয়। একমাত্র দাঁড়ি (।) ব্যতীত সব যতিচিহ্নই আমরা পেয়েছি / নিয়েছি ইংরেজি ভাষা থেকে। তাই ব্যবহারও হচ্ছে ইংরেজি ভাষার রীতি অনুসারেই। সে মতে শব্দ সংক্ষেপ করার জন্য ব্যবহৃত হবে ডট (.)। বাংলায় আমরা এর নাম দিয়েছি একবিন্দু (.) বা শব্দ সংক্ষেপণ চিহ্ন। তাই উল্লিখিত শব্দগুলো সংক্ষেপে লিখতে চাইলে ‘মোহাম্মদ’কে ‘মো.’ বা ‘মোহা.’, ‘মুহাম্মদ’কে ‘মু.’ বা ‘মুহা.’, ‘মোসাম্মৎ’কে ‘মোসা.’ এভাবে লিখতে হবে। তবে এভাবে সংক্ষিপ্ত না লিখে প্রতিটি নামের অন্তর্গত সব শব্দের পূর্ণ রূপ লেখাই উত্তম।
এছাড়াও অধিকাংশ শিশুর জন্ম সনদে তার পিতার ও মাতার নামের আগে/পরে হাজি, আলহাজ, ডক্টর, ডাক্তার, মাওলানা, মৌলভি, পণ্ডিত, এডভোকেট, অধ্যক্ষ/অধ্যক্ষা, আধ্যাপক/অধ্যাপিকা, বিএ, এমএ, বিএসসি, এমএসসি ইত্যাদি লেখা হয়। যা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডে ঢাকা-এর বিদ্যালয় পরিদর্শক কর্তৃক গত ১৪ জানুয়ারি ২০১৬ তারিখে স্বাক্ষরিত আদেশ অনুসারে শিক্ষার্থীর শিক্ষা সনদে লেখা নিষেধ।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরাধীন থানা/উপজেলা শিক্ষা অফিসের আদেশ মোতাবেক শিশুর জন্মনিবন্ধন সনদে যেভাবে তার নাম, তার পিতা ও তার মাতার নাম লেখা থাকে সেভাবেই তাদের পিইসি পরীক্ষার জন্য নাম রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। ফলে জন্মনিবন্ধনে কারো নাম ভুল থাকলে সে ভুল থেকে যায় শিশুর পিইসি পাসের সনদে। আবার সেই শিক্ষার্থীর জেএসসি পরীক্ষার জন্য নাম রেজিস্ট্রেশন করার সময় দেখা যায় কোনো নামের আগে ‘হাজি/মাওলানা, ডঃ/ড:/ড., মোঃ/মো:’ এবং পরে ‘বিএ/এমএ,’ ইত্যাদি লিখতে গেলে ভুল ধরা হয় অন-লাইন সিস্টেমে। বিপাকে পড়তে হয় তখন। কেননা, কোনো নামের আগে ‘মোহাম্মদ/মোসাম্মৎ’ সংক্ষেপে লিখতে গেলে ‘মো./মোসা.’ লেখার নিয়ম মানতে হয় এবং নামের আগে/পরে ‘হাজি, আলহাজ, ডক্টর, ডাক্তার, মাওলানা, মৌলভি, পণ্ডিত, এডভোকেট, অধ্যক্ষ/অধ্যক্ষা, আধ্যাপক/অধ্যাপিকা, বিএ, এমএ, বিএসসি, এমএসসি’ ইত্যাদি লেখা যায় না। শিক্ষা বোর্ডের নিয়ম মানতে গেলে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর জন্মনিবন্ধন সনদ ও পিইসি পরীক্ষা পাসের সনদ সংশোধন প্রয়োজন হয়। প্রথমত, অভিভাবকরা এ দু’টি সনদ সংশোধন করতে চান না। তারা বুঝতে চান না যে, ‘মৃত/হাজি/ডাক্তার/পণ্ডিত’, ‘স্মর্গীয়/শ্রী/শ্রী শ্রী/শ্রী যুক্ত’ ইত্যাদি তাদের নামের অংশ নয়। তিনি নিজে জন্মগ্রহণের পর পর যে নাম রাখা হয়েছিল সেটিই তার নাম। তখন তিন ‘মৃত/হাজি/ডাক্তার/পণ্ডিত’, ‘স্মর্গীয়/শ্রী/শ্রী শ্রী/শ্রী যুক্ত’ ইত্যাদি ছিলেন না। সুতরাং এসব তার নামের অংশ হতে পারে না।
বাস্তবতা হচ্ছে, জন্মনিবন্ধন সনদ প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে অত্যন্ত অজ্ঞ ও চরম উদাসীন। এই কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ অফিস, ওয়ার্ড কাউন্সিল অফিস, পৌরসভা অফিস ও সিটি কর্পোরেশন অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের এই বিষয়ে আরো দক্ষ ও মনোযোগী হওয়া অত্যাবশ্যক। তাদের দপ্তরে একাজে সংশ্লিষ্ট কম্পিউটারের সফটওয়ার এমনভাবে তৈরি করা/আপডেট করা জরুরি যাতে কারো নাম-ঠিকানা লেখার সময় এ ধরনের ভুল (বাই-ডিফল্ট) ইনপুট দেয়ার কোনো সুযোগ না থাকে। এছাড়া কোনো শিক্ষক, ডাক্তার, অফিসার ও জনপ্রতিনিধি যখন কারো জন্মনিবন্ধনের আবেদন ফরম ও জাতীয় পরিচয়পত্র প্রণয়নের আবেদন ফরম সত্যায়ন করেন; তখন তাদেরও আরো জেনে, বুঝে, সতর্ক হয়ে এই কাজটি করা উচিত। যাতে আলোচিত ভুলগুলো না থাকে। অপরদিকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে এমন একটি আদেশ জারি করা জরুরি যাতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এবং থানা/উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসাররা কোনো শিক্ষার্থীর নাম রেজিস্ট্রেশনের সময় আলোচিত ভুলগুলো (যদি কারো জন্মনিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্রে থেকে থাকে) অবশ্যই সংশোধন করে দিতে বাধ্য হন। এ কাজে সংশ্লিষ্ট সবাই জেনে, বুঝে, সচেতন ও দায়িত্ববান হয়ে সমন্বিত পদক্ষেপ নিয়ে কাজ করলে সহজেই বেরিয়ে আসা সম্ভব উল্লিখিত ভুলের বেড়াজাল থেকে এবং তা এখনই করা অত্যন্ত জরুরি।
মো. রহমত উল্লাহ্ : অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।